প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / নামাযে কোথায় ও কিভাবে হাত বাঁধা সুন্নত?

নামাযে কোথায় ও কিভাবে হাত বাঁধা সুন্নত?

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। আদম আলাইহিস সালাম থেকে নিয়ে ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত কোন নবীকে আল্লাহ তাআ’লা পূর্ণাঙ্গ দ্বীন ও শরীয়ত প্রদান করেননি। কারণ, তারা সাময়িক নবী ছিলেন। নিজ সম্প্রদায়ের নবী ছিলেন। মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের নবুয়তের দায়িত্ব শেষ হয়ে যেতো। এরপর নতুন নবী আসতেন। তিনি এসে নতুন শরীয়ত ও বিধান নিয়ে আসতেন।

এভাবে আদম থেকে ঈসা পর্যন্ত ইসলামের ছিল শৈশবকাল। শৈশবকালের বানানো জামা কালে কালে বছরান্তে পরিবর্তন করতে হয়। ৫ বছর বয়সে বানানো জামা ছয় সাত বছরে আর গায়ে লাগানো যায় না। তেমনি আগের নবীদের একজন গত হলে নতুন আসতেন। নতুন নবী আসলে আর পূর্বের নবীর শরীয়তের বিধান চলতো না। নতুন নবীর শরীয়ত হতো কার্যকরী।

এরপর সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে দ্বীনে শরীয়তের যৌবনকাল চলে এসেছে। ইসলাম পেয়েছে তার পূর্ণতা। যৌবনকালের বানানো জামা যেমন মৃত্যু পর্যন্ত আর ছোট বড় হয় না। বরং এক মাপের জামা মৃত্যু পর্যন্ত কাজে লাগে। ঠিক তেমনি ইসলাম পূর্ণতা পাওয়ার পর কিয়ামত পর্যন্ত আর নতুন শরীয়তের প্রয়োজন নেই। মুহাম্মদী এক শরীয়তই কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।

যেহেতু ইসলাম পূর্ণাঙ্গ। তাই এর বিধিবিধানও পূর্ণাঙ্গ। এর প্রতিটি বিধানও পূর্ণাঙ্গ। সেই হিসেবে ইসলামের একটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হল নামায। যা অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ। যার প্রতিটি আমলই পূর্ণাঙ্গ। যেহেতু নামায পূর্ণাঙ্গ তাই এর দলীলও হতে হবে পূর্ণাঙ্গ।

আমরা বক্ষ্যমান প্রবন্ধে নামাযের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল তাকবীরে তাহরীমার পর হাত কোথায় এবং কিভাবে বাঁধবো এ বিষয়ে দালিলীক আলোচনা করবো।

নামাযে হাত বাঁধা পূর্ণাঙ্গ বুঝতে হলে, আমাদের দু’টি মাসআলা জানা আবশ্যক। যথা- নামাযে হাতটা কিভাবে বাঁধবো? দ্বিতীয় হল নামাযে হাতটা কিভাবে বাঁধবো?

নামাযে হাত কিভাবে বাঁধবো?

সহজ উত্তর হল, ডান হাতের পাঞ্জা বাম হাতের কব্জির উপর রাখবে।

নামাযে হাতটা কোথায় রাখবে?

ডান হাতের পাঞ্জা বাম হাতের কব্জির উপর রাখার পর তা ছেড়ে দিলে যেখানে যাবে সেটাই প্রতিটি পুরুষ মুসল্লির নামাযে হাত বাঁধার স্থান। আর পরিস্কার শব্দে বললে বলতে হবে, নাভির নিচে হাতটা রাখবে। কারণ, উপরোক্ত পদ্ধতিতে হাত বেধে ছেড়ে দিলে হাতটা নাভির নিচেই চলে যায়।

তাহলে হাত বাঁধা সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ মাসআলা দাঁড়ালঃ নামাযে ডান হাতের পাঞ্জা বাম হাতের কব্জির উপর রেখে নাভির নিচে রাখাই হল পুরুষের জন্য সুন্নত।

প্রথমে আমরা পূর্ণাঙ্গ মাসআলা জানলাম। এবার আমরা উক্ত পূর্ণ মাসআলার পূর্ণাঙ্গ দলীল দেখবোঃ

লা-মাযহাবী আলেমদের কর্তৃক সম্পাদিত এবং তাদের নিজস্ব প্রকাশনী ‘তাওহীদ পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত সহীহ বুখারীর ১ম খণ্ডের ৫৭৯ নং পৃষ্ঠায় এসেছেঃ
ووضع على رضى الله تعالى عنه كفه على رسغه الأيسر
‘আলী রাজিআল্লাহু আনহু (সলাতে) সাধারণত তাঁর ডান হাতের পাঞ্জা বাম হাতের কব্জির উপর রাখতেন। [সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স-১/৫৭৯]

তাহলে আমরা লা-মাযহাবী আলেমদের প্রকাশিত বুখারীর অনুবাদ গ্রন্থ থেকে আমরা নামাযে হাত কিভাবে রাখবো? তা পেয়ে গেলাম।

এবার বাকি রইল হাতটা কোথায় রাখবো? এ মাসআলার দলীল।
ইমাম বুখারী রহঃ এর উস্তাজ ইমাম আবু বকর ইবনে আবী শাইবা রহঃ এর পৃথিবী বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা। যা আরব বিশ্বের প্রসিদ্ধ আলেম শায়েখ আওয়ামা দামাত বারাকাতুহু একাধিক হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপিকে সামনে রেখে মিশর থেকে প্রকাশ করেছেন।

উক্ত কিতাবে বর্ণিত একটি হাদীস লক্ষ্য করিঃ

حدثنا وكيع، عن موسى بن عمير، عن علقمة بن وائل بن حجر، عن ابيه قال: رأيت النبى صلى الله عليه وسلم وضع يمينه على شماله فى الصلاة تحت السرة

হযরত ওয়ায়েল বিন হুজুর রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে নাভির নীচে রাখতে দেখেছি। [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-৩/৩২০-৩২২, হাদীস নং-৩৯৫৯]

এর সনদ সহীহ।

হাফেজ কাসিম ইবনে কুতলূবুগা রহঃ, তিরমিযী শরীফের ভাষ্যকার আবুত্ তায়্যিব সিন্ধী রহঃ ও আল্লামা আবেদ সিন্ধী রহঃ প্রমুখ হাদীসটিকে মজবুত ও শক্তিশালী বলেছেন।

এর সনদ এরূপ: ইবনে আবী শায়বা রহঃ বর্ণনা করেছেন ওয়াকী’ থেকে, তিনি মূসা ইবনে উমায়ের থেকে, তিনি আলকামার সূত্রে হযরত ওয়াইল রাঃ থেকে। এই সনদে কোন দুর্বল রাবী নেই।

এ হাদীসটি সম্পর্কে কেউ কেউ শুধু এতটুকু আপত্তি উত্থাপন করেছেন যে, মুসান্নাফের কোন কোন পা-ুলিপিতে এটি বিদ্যমান নেই। কিন্তু এ আপত্তি হাদীসের অনেক কিতাবের ক্ষেত্রেই চলে। তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ, সহীহ ইবনে হিব্বান প্রভৃতি কিতাব দেখুন, এক পা-ুলিপিতে এমন কিছু হাদীস পাওয়া যায়, যা অন্য পাণ্ডুলিপিতে নেই। তিরমিযী শরীফের মুবারকপুরী, আহমাদ শাকের ও শুআয়ব আরনাউতের তিন কপিতেই এ তারতম্য দেখা যায়। সুতরাং এটা কোন আপত্তি হতে পারে না। যারা নিজের চোখে হাদীসটি মুসান্নাফে দেখেছেন তাদের কথাই গ্রহণযোগ্য হবে।

তাহলে আমরা পরিস্কারভাবে আমরা নামাযে কিভাবে হাত রাখবো? এবং কোথায় হাতটা রাখবো? বিস্তারিতভাবে পূর্ণাঙ্গ আমলটাই পূর্ণাঙ্গ এবং বিশুদ্ধ দলীলসহ জানতে পারলাম।

আরো অনেক দলীল আছে, কিন্তু প্রবন্ধের কলেবর বড় হয়ে যাবে বলে আমরা আর দলীল উপস্থাপন করলাম না। বরং

সংক্ষেপেই আমাদের আমলের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ এবং পূর্ণাঙ্গ বিশুদ্ধ দলীল পেশ করে শেষ করলাম।

লা-মাযহাবীদের হাত বাঁধার কী হাল?

এবার আমরা লা-মাযহাবীদের নামাযে হাত বিষয়ে জেনে নেই।

যদি আপনি কোন লা-মাযহাবীকে জিজ্ঞাসা করেন যে, নামাযে হাতটা কোথায় বাঁধবো?

সে সাথে সাথে জবাব দিয়ে বলবেঃ বুকের উপর।

এবার জিজ্ঞাসা করুনঃ কিভাবে বাঁধবো?

বাধ্য হয়ে সে বলবেঃ জানি না। যেভাবে ইচ্ছে বাঁধেন।

এর মানে লা-মাযহাবীরা নামাযে হাতটা কোথায় বাঁধবে তা জানে। কিন্তু কিভাবে বাঁধবে তা জানে না। এজন্য তাদের হাত বাঁধার স্টাইল একেক ধরণের। কেউ কেউ ডান হাত দিয়ে কব্জি চেপে ধরে বুকের উপর রাখে। কেউ ডান হাতকে বাম বাঁজুর উপর রেখে বুকের উপর রাখে। কেউবা ডান হাতের কব্জি দিয়ে বাম হাতের কনুই ধরে বুকের উপর রাখে। কেউবা আবার ডান হাত দিয়ে বাম হাতের কনুইয়ের উপর দিয়ে ধরে বুকের রাখে।

মোদ্দাকথা, তাদের হাত বাঁধার তরীকা ভিন্ন ভিন্ন। সবার হাত বাঁধার তরীকা এক নয়। কারণ হল, তারা হাতটা রাখার বিষয়ে জানে। কিন্তু কিভাবে রাখবে তা জানে না।

আর আমরা আগেই বলেছি, ইসলাম পূর্ণাঙ্গ। তাই এর যাবতীয় মাসআলা পূর্ণাঙ্গ হবে। কিন্তু লা-মাযহাবী বন্ধুদের কাছে নামাযের

হাত বাঁধার মাসআলাই পূর্ণাঙ্গ জানা নেই। অথচ পুরো শরীয়তের মাসায়েল পূর্ণাঙ্গভাবে কুরআন ও হাদীসের বাহ্যিক শব্দ দিয়ে জানানোর মিথ্যা দাবী করে বেড়ায়।

যাইহোক, তাহলে আমরা একটি মূল বিষয় বুঝে গেলাম। সেটি হল, লা-মাযহাবী বন্ধুদের নামাযের হাত বাঁধার স্থান সম্পর্কে জানে। কিন্তু হাত বাঁধার পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুই জানে না। বা দলীল দিয়ে প্রমাণ করতে পারে না।

তাহলে পরিস্কার বুঝা গেল যে, তারা এ মাসআলা পরিপূর্ণ জানেই না।

দ্বিতীয়তঃ এবার যদি আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করেন যে, তোমরা যে, বুকের উপর হাত বাঁধো এ মাসআলা কোথায় পেয়েছো?
সাথে সাথে বলে দিবে বুখারীতে আছে। লা-মাযহাবীদের প্রতিটি আলেম যারাই সালাত সংক্রান্ত বই লিখেছে, তারা সবাই বুকের উপর হাত বাঁধার দলীল হিসেবে প্রথমত বুখারীর একটি হাদীসই উপস্থাপন করেছে।

এবার আমরা বুকের উপর হাত বাঁধার দলীল হিসেবে উপস্থাপিত দলীলটি তাদেরই প্রকাশিত বুখারী শরীফের বাংলা অনুবাদ থেকে দেখে নেই। তাহলেই পরিস্কার হবে যে, তারা এ মাসআলায় জাতিকে কি পরিমাণ ধোঁকা ও প্রতারণায় ফেলে রেখেছে।
তাওহীদ পাবলিকেশন্সের বুখারী অনুবাদের অনুবাদটি দেখে নিন, যা লা-মাযহাবীরা নামাযে বুকের উপর হাত বাঁধার দলীল হিসেবে পেশ করেঃ

عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ كَانَ النَّاسُ يُؤْمَرُونَ أَنْ يَضَعَ الرَّجُلُ الْيَدَ الْيُمْنَى عَلَى ذِرَاعِهِ الْيُسْرَى فِي الصَّلاَةِ

সাহল ইবনু সা‘দ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকদের নির্দেশ দেয়া হত যে, সালাতে প্রত্যেক ডান হাত বাম হাতের উপর রাখবে। [তাওহীদ পাবলিকেশন্স প্রকাশিত সহীহ বুখারী-১/৩৫৭, হাদীস নং-৭৪০] এখানে আরবী ও অনুবাদটি লক্ষ্য করুন। আরবী ‘ইয়াদুন’ শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে ‘হাত’। আবার আরবী ‘জিরা’ শব্দটিরও অনুবাদ করা হয়েছে হাত।

অথচ এটা এক ধরণের ধোঁকা। কারণ, আরবী ‘ইয়াদুন’ বলতে হাতের আঙ্গুলের মাথা থেকে বগল পর্যন্ত পুরোটাকে বুঝায়। আর আরবী ‘যিরা’ শব্দ দ্বারা শুধুমাত্র হাতের আঙ্গুলের মাথা থেকে হাতের কনুই পর্যন্ত বুঝায়।

তাহলে ইয়াদুন এবং যিরা শব্দের একই অনুবাদ করা অবশ্যই ঠিক নয়। যা তাদের একটি প্রতারণা।

দ্বিতীয়ত ‘যিরা’ শব্দের ব্যাখ্যা তারা নিজেরাই করেছে এক গজ বিশিষ্ট হাত বলে। [প্রাগুক্ত] এর মানে তাদের কাছেও ‘যিরা’ বলতে পুরো হাত নয়, বরং আঙ্গুল থেকে কনুই পর্যন্ত অংশকে বুঝায়।

আচ্ছা, আমরা তাদের বুকে হাত বাঁধার দলীলটা দেখলাম। তাদেরই অনুদিত বুখারী থেকে।
বিজ্ঞ পাঠকের কাছে এবার আমার জিজ্ঞাসাঃ উক্ত হাদীসের কোন স্থানে বুকের উপর হাত বাঁধার কথা এসেছে?

হাদীসে আসলো যে, ডান হাতকে বাম যিরার উপর রাখতে হবে। এর মানে বুকের উপর রাখতে হবে এটা কী ধরণের যুক্তি?
এর নাম হাদীসের উপর আমল নাকি হাদীসের সাথে ফাজলামো করা? বুকের উপর কথার আবিস্কার তারা কোত্থেকে করলেন?
যেহেতু উক্ত হাদীস দিয়ে বুকের উপর হাত বাঁধা প্রমাণ করা যায় না, তাই তাদের চতুর শায়েখ মুযাফফর বিন মুহসিন একটি আজীব কিয়াস করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ

‘মূলত: পুরো বাম হাতের উপরে ডান হাত রাখলে বুকের উপরই চলে যায়।’। [জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর ছালাত-২২০]

আমরা আগেই জেনেছি যে, হাদীসের শব্দ হল, যিরা। আর যিরা মানে হল আঙ্গুল থেকে কনুই। আর ইয়াদুন মানে হাত। যার দ্বারা উদ্দেশ্য হল, আঙ্গুল থেকে বগল পর্যন্ত।

এবার আমরা একটু মুযাফফর সাহেবের অদ্ভূত কিয়াসের উপর আমল করে দেখি। তার বক্তব্য অনুপাতে ডান হাতকে পূর্ণাঙ্গ বাম যিরার উপর রাখলে হাতটা বুকের উপরই চলে যায়।

বিজ্ঞ পাঠকগণের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ। আপনারা একটু চেষ্টা করে দেখুনতো। ডান হাতটা বাম পূর্ণ যিরার উপর রাখুন। দেখুনতো হাতটা কি বুকের উপর আসে নাকি পেটের উপর আসে? অবশ্যই পেটের উপর আসবে।
তাহলে মুযাফফর সাহেবের কিয়াস মেনে পূর্ণ বাম যিরার উপর হাত রাখলেওতো হাতটা বুকের যায় না। বরং পেটের উপর যায়। এর মানে এ হাদীস হাত বাঁধার দলীল মানতে হলে, এটা কিছুতেই বুকের উপর হাত বাঁধার দলীল থাকে না, বরং ভূরির উপর হাত বাঁধার দলীল হয়।

এখানে মুযাফফর সাহেব পরিস্কার একটি মিথ্যার আশ্রয় নিলেন।

দ্বিতীয়ত তিনি একটি প্রতারণা করেছেন। সেটি হল, হাদীসে ডান হাতকে বাম যিরার উপর রাখার কথা এসেছে। আর তিনি এ হাদীসের উপর আমল করতে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ বাম যিরার উপর হাত রাখার পরামর্শ দিলেন। প্রশ্ন হল, হাদীস এক হওয়া সত্বেও পূর্ণ ডান হাত রাখার কথা কেন বলেননি? তাহলে বাম যিরা পূর্ণাঙ্গ, কিন্তু ডান হাত অর্ধেক এ দ্বিমুখী আচরণ কোত্থেকে আবিস্কার করলেন জনাব মুযাফফর?

যাইহোক, আমাদের কাছে পরিস্কার যে, বুকের উপর হাত বাঁধার কোন হাদীস বুখারীতে নেই। যারা বুখারীতে বুকের উপর হাত বাঁধার হাদীস আছে মর্মে দাবী করেন, তারা পরিস্কার মিথ্যুক ছাড়া আর কিছু নয়।

এছাড়া বুকের উপর হাত বাঁধা সংক্রান্ত যত হাদীস আছে, তার সব ক’টিকে লা-মাযহাবী বন্ধুরাই জঈফ বলে মন্তব্য করেন। শুধু একটি হাদীস ছাড়া। সেটি হল, সহীহ ইবনে খুযাইমার হাদীসটি।

যে হাদীসের মাঝে একজন রাবী আছেন মুআম্মাল বিন ইসমাইল নামে। যাকে ইমাম বুখারী রহঃ ‘মুনকারুর হাদীস’ বলে মন্তব্য করেছেন। [তাহযীবুল কামাল ফী আসমায়ির রিজাল, রাবী নং-৬৩১৯, আলমুগনী ফিজ জুআফা, রাবী নং-৬৫৪৭, তারীখুল ইসলাম, রাবী নং-৩৮০, সিয়ারু আলামিন নুবালা, রাবী নং-১৫৪৬, মিযানুল ইতিদাল, রাবী নং-৮৯৪৯, তাহযীবুত তাহযীব, রাবী নং-৬৮, লিসানুল মিযান, বর্ণনা নং-৪৯৮৭}

ইমাম বুখারী রহঃ যাকে মুনকারুল হাদীস বলেন, তার ব্যাপারে ইমাম বুখারী বলেন,

ونقل ابن القطان أن البخاري قال: كل من قلت فيه منكر الحديث فلا تحل الرواية عنه

আমি যার ব্যাপারে মুনকারুল হাদীস বলি, তার থেকে বর্ণনা করা জায়েজ নয়। [মীযানুল ই’তিদাল-১/৫৪, লিসানুল মীযান-১/১০২]

সুতরাং বুঝা গেল, লা-মাযহাবীদের জন্য এ হাদীস পেশ করা লজ্জাজনক ছাড়া আর কী’বা হতে পারে?

সহীহ হাদীস অনুসারী দাবীদারদের সহীহ প্রতারণা!

আমরা ইতোপূর্বে লা-মাযহাবী বন্ধুদের বুকের উপর হাত বাঁধা সংক্রান্ত সবচে’ শক্তিশালী ও প্রধান দলীলটা দেখে আসলাম। যা তাদের ধোঁকাবাজী ও প্রতারণার মুখোশ খুলে দেয়।

কিন্তু এবার আমি আপনাদের দেখাতে চাই, এরা হাদীস অনুসরণের নামে কত বড় মিথ্যাবাদী এবং প্রতারক। তা ভাবতেও আমাদের অবাক লাগে।

তাওহীদ পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত বাংলা বুখারী। যা সতের জন লা-মাযহাবী শায়েখ মিলে অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন। চার জন লা-মাযহাবী শায়েখ যে অনুবাদের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন। ইতোমধ্যে ১০/১২ বার যার নতুন সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে। সেই বুখারীর টিকায় তারা কী লিখেছে তা একটু পড়ে নিনঃ

‘সংশয় নিরসনের লক্ষে এ সম্পর্কে খানিকটা বিশদ আলোচনা উদ্ধৃত করা হলো- ওয়াইল বিন হুজ্র (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, আমি নাবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সলাত আদায় করেছি। (আমি দেখেছি) নাবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর রাখলেন। (বুখারী ১০২ পৃষ্ঠা। সহীহ ইবনু খুযায়মাহ ২০ পৃষ্ঠা। মুসলিম ১৭৩ পৃষ্ঠা। আবূ দাঊদ ১ম খ-, ১১০, ১২১, ১২৮ পৃষ্ঠা। তিরমিযী ৫৯ পৃষ্ঠা। নাসাঈ ১৪১ পৃষ্ঠা। ইবনু মাজাহ ৫৮, ৫৯ পৃষ্ঠা, মেশকাত ৭৫ পৃষ্ঠা। মুয়াত্তা মালিক ১৭৪ পৃষ্ঠা। মুয়াত্তা মুহাম্মাদ ১৬০ পৃষ্ঠা। যাদুল মায়াদ ১২৯ পৃষ্ঠা। হিদায়া দিরায়াহ ১০১ পৃষ্ঠা। কিমিয়ায়ে সাআদাত ১ম খ-, ১৮৯ পৃষ্ঠা। বুখারী আযীযুল হক ১ম খ-, হাদীস নং ৪৩৫। বুখারী আধুনিক প্রকাশনী ১ম খ-, হাদীস নং ৬৯৬। বুখারী ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২য় খ-, হাদীস নং ৭০২; মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২য় খ-, হাদীস নং ৮৫১। আবূদাঊদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১ম খন্ড, হাদীস নং ৭৫৯, তিরমিযী ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১ম খন্ড হাদীস নং ২৫২, মেশকাত নূর মোহাম্মদ আযমী ২য় খন্ড ও মাদ্রাসা পাঠ্য ২য় খন্ড, হাদীস নং ৭৪১, ৭৪২। বুলুগুল মারাম বাংলা ৮২ পৃষ্ঠা)

এখানে লক্ষ্য করুন, তাওহীদ পাবলিকেশন্সের বুখারী শরীফের টিকায় সতের জন লা-মাযহাবী শায়েখ মিলে কী লিখল? প্রথমে ওয়েল বিন হুজুর রাঃ থেকে বর্ণিত একটি হাদীস লিখল। যাতে আসছে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর রাখলেন।

এরপর উক্ত বর্ণনাটির রেফারেন্স উল্লেখ করল, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিজী এবং ইবনে মাজাহের। অর্থাৎ ছয়টি প্রসিদ্ধ হাদীসের কিতাবের রেফারেন্ন পেশ করল। সেই সাথে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং আল্লামা আজীজুল হক রহঃ ও আধুনিক প্রকাশনীর বাংলা অনুদিত হাদীসগ্রন্থগুলোর খন্ড ও পৃষ্ঠা নাম্বারের রেফারেন্স পর্যন্ত পেশ করল।

এমন রেফারেন্স দেখে যে কেউ বুঝবেন যে, তারা নিশ্চিতভাবে জেনে বুঝেই তা উপস্থাপন করেছেন। আর হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞ যেকোন ব্যক্তি বিশ্বাস করবেন যে, উক্ত হাদীসটি আসলেই উপরোক্ত ছয় কিতাবে আছে।

সেই হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই হানাফী উলামাগণের উপর বিদ্বেষ আসবে যে, প্রসিদ্ধ ছয়টি কিতাবে নবীজী থেকে বুকের উপর হাত বাঁধার হাদীস থাকার পরও হানাফীরা কেন তার উপর আমল করে না?

কিন্তু আফসোস! এবং আফসোস! সেই সাথে আমরা স্তম্ভিত। বাকরূদ্ধ। এমন জালিয়াত মানুষ হয় কিভাবে? কিভাবে নিজেকে সহীহ হাদীসের অনুসারী দাবী করে মানুষ এভাবে প্রতারণা করতে পারে?

আস্তাগফিরুল্লাহ। আস্তাগফিরুল্লাহ। ছয় ছয়টি কিতাবের খন্ড ও পৃষ্ঠা নাম্বার দিয়ে বুকের উপর হাত বাঁধার ওয়াইল বিন হুজুর থেকে বর্ণিত যে হাদীসের রেফারেন্স দেয়া হল, উক্ত হাদীসের কোন অস্তিত্ব উপরোক্ত ছয় কিতাবের কোথাও নেই।

পাঠকদের বিশ্বাস না হলে আপনারা নিজেরাই তাদের রেফারেন্স বাংলা বুখারী, মুসলিম থেকে যাচাই করে দেখতে পারেন। কিয়ামত পর্যন্ত কোন লা-মাযহাবী আলেম উক্ত ছয় কিতাব থেকে উক্ত হাদীসটি দেখাতে পারবে না।

তাহলে এমন প্রতারণা কেন? কেন এই জালিয়াতী? হাদীসের নামে, দ্বীনের নামে এমন ধোঁকাবাজী! ইন্নালিল্লাহ। এমন অসংখ্য ধোঁকা ও প্রতারণামূলক রেফারেন্স এবং উদ্ধৃতিতে পূর্ণ এসব লা-মাযহাবী আলেমদের লিখিত বই এবং বক্তৃতা। তাই তাদের লিখিত বইয়ের বিশাল বিশাল রেফারেন্স দেখে ভড়কে যাওয়া যাবে না। আল্লাহ এসব প্রতারকদের থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের ঈমান ও আমলকে হিফাযত করুন।

নারীরা কোথায় হাত বাঁধবে?

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমরা পরিস্কার ভাষায় বলি যে, আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য দলীল হল ৪টি। যথা- কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস।

এ ৪টি দলীলের মাধ্যমেই ইসলামী শরীয়ত পূর্ণতা পেয়েছে। এর কোন একটি মাধ্যমে কোন আমল প্রমাণিত হলেই তা আমাদের কাছে দলীলসমৃদ্ধ হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে যায়।

নারীরা নামাযে কোথায় হাত বাঁধবে? এ বিষয়ে আমাদের পরিস্কার বক্তব্য হল, কুরআনে এ সংক্রান্ত কোন আয়াত নেই।
কুরআনে না পেয়ে আমরা চলে গেলাম হাদীসের দিকে। আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলি যে, হাদীসের ভান্ডারের মাঝে কোন হাদীসে নারীরা কোন স্থানে হাত বেঁধে নামায আদায় করবেন তা আলাদাভাবে বর্ণিত হয়নি।

তাই আমরা বাধ্য হয়ে শরীয়তের ৩য় দলীল ইজমার দিকে চলে যাই। আমরা এ বিষয়ে ইজমা খুঁজে পাই।
হযরত আব্দুল হাই লক্ষ্ণৌবী রহঃ লিখেছেনঃ

اما فى حق النساء فاتفقوا على ان السنة لهن وضع اليدين على الصدر، (السعاية-২/১৫৬)

আর মহিলাদের ক্ষেত্রে সকলেই ঐক্যমত্ব যে, তাদের ক্ষেত্রে সুন্নত হল তাদের উভয় হাতকে বুকের উপর রাখবে। {আসসিয়ায়াহ-২/১৫৬}

সুতরাং বুঝা গেল, নারীদের বুকের হাত বাঁধার মাসআলাটি ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। আর ইজমা আমাদের কাছে দলীল।
আর বর্তমানে যত দল নামায পড়েন, যেমন, হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী, আহলে হাদীস, শিয়া। তাদের মাঝের প্রতিটি দলের মুসলিম নারীরাই বুকের উপর হাত বেঁধে থাকেন। যা বর্তমানের আমলী ইজমা হিসেবেও স্পষ্ট।

উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা দ্বারা আশা করি একথা পরিস্কার যে, পুরুষের জন্য নামাযে ডান হাতের পাঞ্জা বাম হাতের কব্জির উপর রেখে নাভির নিচে বাঁধা সুন্নাহ সম্মত আমল। যা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আর পুরুষদের বুকের উপর হাত বাঁধা সংক্রান্ত কোন সহীহ হাদীসই নেই। সেই সাথে একথাও প্রতিভাত হয়েছে যে, সহীহ হাদীস না থাকায় লা-মাযহাবীরা বুখারীর হাদীস নিয়ে চরম মিথ্যাচার ও ধোঁকাবাজীতে লিপ্ত।

আল্লাহ তাআলা আমাদের বুঝার তৌফিক দান করুন। আমীন।

আরও জানুন

মসজিদে নির্দিষ্ট জামাতের পূর্বে জামাতবদ্ধ হয়ে নামাজ আদায় করা যাবে কী?

প্রশ্নঃ আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ! মুহতারাম মুফতী সাহেব! আমি যে মহল্লায় থাকি সে মহল্লার জামে মসজিদ …

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস