প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / মাযহাবের ইমামগণের কাছে সব হাদীস ছিল না তাই তারা বলে গেছেন “হাদীস সহীহ হলেই সেটি আমার মাযহাব”?

মাযহাবের ইমামগণের কাছে সব হাদীস ছিল না তাই তারা বলে গেছেন “হাদীস সহীহ হলেই সেটি আমার মাযহাব”?

প্রশ্ন

আসসালামু আলাইকুম ।

মুফতি সাহেব , অনেকে বলে যে চার মাজহাবের ইমামগণই ঠিক কিন্তু তাদের সময়ে অনেক হাদিস তাদের সামনে ছিল না ।পরে সহিহ হাদিস পাওয়া গেছে ।আর যেহেতু ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) বলেছেন,কোনো সহিহ হাদিস পেলে সেটাই আমার মাজহাব ।কাজেই হানাফি মাজহাব মানতে গেলে এখন মাজহাব না মেনে সহিহ হাদিস মানতে হবে ।

আমার প্রশ্ন হল এ ধরনের কথা ঠিক কিনা ।আশা করি অতি শীঘ্রই জবাব দেবেন।

মাহবুবুর রাহমান

ঢাকা,বাংলাদেশ।

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

সেই হাদীসই বিশুদ্ধ হবে, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সূত্রবদ্ধ। উপরোক্ত মুখরোচক অথব বাস্তবতা বিরোধী বক্তব্যটির অসাড়তা বুঝতে হলে দু’টি প্রশ্নের জবাব জানতে হবে। যথা-

দ্বিতীয় শতাব্দীতে যে হাদীস পাওয়া যায়নি, সে হাদীস তৃতীয় শতাব্দীতে এসে কোত্থেকে আবিস্কৃত হল?

আরো সহজ ভাষায় বললে, চার ইমামগণ আগের মানুষ। তাদের সময় যদি হাদীস না থাকে, অথচ তারা ইলমের শহরগুলোতে ঘুরে বেড়িয়েছেন হাদীস ও দ্বীন শিখতে। যদি তাদের সময় হাদীস না থাকে, তাহলে পরবর্তী সময়ে এসে সেই হাদীস কোত্থেকে আবিস্কৃত হল? একটু জানাবেন কি?

চার মাযহাবের ইমামগণ হাদীস পাননি, তাই তারা হাদীস বিরোধী বক্তব্য প্রদান করেছেন” আপনার উপরোক্ত কথাটি তথন সত্য বলে ধরে নেয়া যাবে, যখন আপনি এমন একটি হাদীস দেখাতে পারবেন, যেখানে ইমামগণ মাসআলা বলেছেন, অথচ তাদের স্বপক্ষে কোন হাদীস নেই। কিন্তু তাদের মতের উল্টো হাদীস আছে।

এমন একটি মাসআলা কি দেখাতে পারবেন?

বরং সর্বোচ্চ এতটুকু দেখাতে পারবেন যে, তারা যে হাদীসের উপর ভিত্তি করে মাসআলা বলেছেন, সেই হাদীসটি তাদের পরবর্তী কোন ব্যক্তির কারণে হয়তো মুতাকাল্লাম ফী হল, কিন্তু তাদের মতের স্বপক্ষে কুরআন বা হাদীসের কোন বক্তব্য নেই অথচ বিপরীত পক্ষে হাদীস বা কুরআন আছে এমন একটি মাসআলা দেখাতে পারবেন কি?

উপরোক্ত দু’টি প্রশ্নের জবাব যিনি প্রশ্নোক্ত দাবিটি করে থাকেন, তার কাছে জিজ্ঞাসা করুন। যে উত্তর দিবে, সেটার মাধ্যমেই আপনি বুঝে যাবেন উপরোক্ত অভিযোগটি কতটা বাস্তবতা বিবর্জিত এবং অন্তসারশূণ্য।

যেহেতু মাযহাবের চারজন ইমামই আগে জন্ম নিয়েছেন। বাস করেছেন কুফা, মক্কা, মদীনায়।

তারও  বহু পরে এসেছেন কুতুবে সিত্তার সংকলকগণ। আর হাদীসগুলো বিশুদ্ধ হতে হলে পূর্ব থেকেই সূত্র থাকতে হয়, তাই মাযহাবের ইমামদের সময় হাদীস ছিল না, কিন্তু পরে এসে পাওয়া গেল, বলা মূল হাদীসের বিশুদ্ধতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।

দ্বিতীয়তঃ মাযহাবের ইমামগণ হাদীস পাননি, কথাটি তখনি বলা যেতো যখন তাদের বলা মন্তব্যের স্বপক্ষে কোন হাদীস বা কুরআনের আয়াত না থাকতো, আর বিপরীত মতের স্বপক্ষে কুরআন বা হাদীস থাকতো।

যদি এমন কোন মাসআলা দেখাতে পারেন, তাহলেই কেবল উপরোক্ত উদ্ভট দাবিটির সত্যতা প্রমাণিত হবে। নতুবা এটি কেবলি মুখরোচক বক্তব্য বলে প্রতিয়মান হবে।

সহীহ হাদীস হলেই সেটি আমার মাযহাব?

উপরোক্ত বক্তব্যের ক্ষেত্রে আমাদের কয়েকটি কথা। যথা-

উক্ত কথাটি ইমামগণ বলেছেন, মর্মে ইমামগণ পর্যন্ত কোন বিশুদ্ধ সনদ কি কোন লা-মাযহাবী দেখাতে পারবে?

আর বিশুদ্ধ সনদ ছাড়া কথা কি তারা গ্রহণ করে? তাহলে এ কথা নিয়ে কেন এত লাফালাফি?

উক্ত কথাটিকে লা-মাযহাবী বন্ধুগন যেভাবে ব্যবহার করেন, সেই অর্থে কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি উক্ত আহমকী কথা বলতেই পারেন না। কারণ হাদীস বিশুদ্ধ হলেই সেটি কারণ পথ বা মাযহাব হয়ে যেতে পারে না।

তাহলে মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।

যেমন বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামায পড়ার হাদীস সহীহ।

নিকাহে মুতার হাদীস সহীহ।

মদ খাওয়ার বৈধতার হাদীস সহীহ।

সহীহ বলেই কি তা কারো মাযহাব হয়ে যাবে? নাকি এর পূর্বাপর, এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য হাদীসও সামনে রাখতে হবে? অন্যান্য হাদীস সামনে না রাখলেতো ব্যক্তি হাদীস সহীহ হলেই মাযহাব দাবি করে মুতা করতে শুরু করবে, বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে নামায পড়তে শুরু করবে, মদ খেতে শুরু করবে। কারণ এসবই সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

কি বুঝা গেল?

হাদীস সহীহ হলেই মাযহাব হয়ে যাবার দাবি করা আসলে আহমকী দাবি। এটি কিছুতেই হতে পারে না। হাদীস সহীহ হলেই সেটি মাযহাব পা চলার পথ হয় না। আমলযোগ্য হয় না। দেখতে হবে এ সংক্রান্ত আরো হাদীস আছে কি না? উপরোক্ত হাদীস সহীহ হলেও এর বিধানটি রহিত হয়ে গেছে কি না? এর উপর পরবর্তীরা আমল ছেড়ে দিয়েছেন কি না? এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আসছে কি না?

এসবই দেখতে হবে। শুধু মুখরোচক স্লোগান “হাদীস সহীহ হলেই সেটি আমার মাযহাব” বলা গোমরাহী ছাড়া আর কিছু নয়।

আরো মজার বিষয় হল, যদি আমরা মেনেও নেই যে, ইমামগণ উক্ত কথাটি বলেছেন, তাহলে বুঝা যায়, ইমামগণ সহীহ হাদীসকেই নিজেদের আমলের ভিত্তি সাব্যস্ত করেছেন। তাহলে সেই সব ইমামগণ যেসব হাদীসের উপর ভিত্তি করে মাসআলা বললেন। নিশ্চিতভাবেই সেই হাদীসটি তাদের কাছে সহীহ। এ কারণেই সেই হাদীসের ভিত্তিতে তারা মাসআলা বলছেন। কারণ তাদের মতে সহীহ হাদীস হলেই সেটি তাদের মাযহাব হয়।

তো এখন ইমামগণ যে হাদীসের উপর ভিত্তিতে মাসআলা বলেছেন এবং আমল করেছেন, উক্ত হাদীসকে পরবর্তী কারো কথায় জঈফ বলার অধিকার লা-মাযহাবীদের কে দিল?

হাদীসটি ইমামদের কাছে জঈফ মনে হলেতো তারা এর উপর আমলই করতেন না। কারণ সহীহ হাদীস তাদের মাযহাব।

উদাহরণতঃ

আমীন আস্তে বলার হাদীস, রফয়ে ইয়াদাইন ছেড়ে দেবার হাদীস, ইমামের পিছনে মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা না পড়ার হাদীস ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর কাছে সহীহ ছিল বলেই তিনি এ সংক্রান্ত হাদীসের উপর ফাতওয়া প্রদান করেছেন। এ বিষয়ে মত দিয়েছেন।

কারণ সহীহ হাদীস হলেইতো তার মাযহাব। যা বুঝায়, এ সংক্রান্ত হাদীস তার কাছে দুর্বল হলে তিনি আমীন আস্তে, রফয়ে ইয়াদাইন ছেড়ে দেয়া এবং ইমামের পিছনে মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা ছেড়ে দেবার ফাতওয়া প্রদান করতেন না। যেহেতু তার কাছে এ বিষয়ক হাদীস সহীহ মনে হয়েছে তাই তিনি এর উপর আমল করেছেন।

এখন যে সমস্ত লা-মাযহাবীরা বলে বেড়ায়, ইমাম আবু হানীফা রহঃ বলেছেন, হাদীস সহীহ হলে সেটি তার মাযহাব। সেই সমস্ত লা-মাযহাবীরা কোন মুখে ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর আমলকৃত আস্তে আমীন, রফয়ে ইয়াদাইন ছেড়ে দেয়া এবং ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা না পড়ার হাদীসকে পরবর্তী কোন মুহাদ্দিসের বক্তব্য অনুপাতে জঈফ বলেন?

এটা কি স্ববিরোধীতা নয়? একদিকে বলছেন ইমাম সাহেব জঈফ হাদীস মানেন না। সহীহ হাদীসের উপর মাযহাব বানিয়েছেন। আবার বলেন, তিনি যে হাদীসের ভিত্তিতে মাসআলা বলেছেন সেটি জঈফ। এটি কোন ধরণের ধোঁকাবাজী। এরকম ডাবল ষ্ট্যান্ডার্ড মানসিকতা কেন প্রদর্শন করছে লা-মাযহাবীরা?

উপরোক্ত আলোচনা ঠান্ডা মাথায়, বিবেক খাঁটিয়ে পড়লে আশা করি লা-মাযহাবী বন্ধুদের এ সংক্রান্ত ধোঁকাবাজী ও প্রতারণা পরিস্কার হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

এ বিষয়ে আরো দু’টি লেখা পড়ে নিতে পারেনঃ

ইমাম আবূ হানীফা রহঃ কি হাফীজুল হাদীস ছিলেন না?

“হাদীস সহীহ হলেই তা আমার মাযহাব” ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর উক্ত কথার মানে কী?

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

মুহাদ্দিস-জামিয়া উবাদা ইবনুল জাররাহ, ভাটারা ঢাকা।

ইমেইল[email protected]

0Shares

আরও জানুন

বিয়ের আগে ‘ব্রেক আপ বা তালাক’ বললে কি বিয়ের পর তালাক হয়?

প্রশ্ন   নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, কাতার প্রবাসী একটি মেয়ের সাথে দীর্ঘদিন হারাম রিলেশন ছিল এখন …