প্রশ্ন
লা-মাযহাবী আলেম তাউসীফুর রহমান বলেন যে, ফাযায়েলে জিকির অধ্যায়ে বর্ণিত একটি ঘটনার প্রমাণ করে যে, দেওবন্দীগণ তাদের বুযুর্গদের ক্ষেত্রে ইলমে গায়েবের আকিদা রাখে।
এ বিষয়ে আপনাদের মতামত জানতে চাচ্ছি।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
আমরা প্রথমে ঘটনাটির মূল ইবারত পড়ার আগে প্রথমে ফাযায়েলে আমালের ফাযায়েলে জিকিরে বর্ণিত কয়েকটি হাদীস দেখে নেইঃ
أَبِي هُرَيْرَةَ وَأَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ أَنَّهُمَا شَهِدَا عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ: «لَا يَقْعُدُ قَوْمٌ يَذْكُرُونَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ إِلَّا حَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ، وَنَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السَّكِينَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ
আবূ হুরায়রা রাঃ ও হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাঃ একথার স্বাক্ষ্যি প্রদান করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কোন জাতি যখন আল্লাহর জিকির করতে বসে, তখন ফেরেশতারা তাদের ঘিরে ফেলেন, রহমাত তাদের ঢেকে ফেলে। তাদের উপর সকীনা নাজীল হয়, এবং আল্লাহ তাআলা তাদের কথা ফেরেশতাদের মজলিসে আলোচনা করেন। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৭০০, ফাযায়েলে আমাল-৩৪৫, ফাযায়েলে জিকির-৩৯, হাদীস নং-৮]
عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ قَالَ: «قَالَ رَسُولُ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -: ” لَيَبْعَثَنَّ اللَّهُ أَقْوَامًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِي وُجُوهِهِمُ النُّورُ، عَلَى مَنَابِرِ اللُّؤْلُؤِ، يَغْبِطُهُمُ النَّاسُ، لَيْسُوا بِأَنْبِيَاءَ وَلَا شُهَدَاءَ “.
قَالَ: فَجَثَا أَعْرَابِيٌّ عَلَى رُكْبَتَيْهِ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، حَلِّهِمْ لَنَا نَعْرِفْهُمْ.
قَالَ: هُمُ الْمُتَحَابُّونَ فِي اللَّهِ، مِنْ قَبَائِلَ شَتَّى، وَبِلَادٍ شَتَّى، يَجْتَمِعُونَ عَلَى ذِكْرِ اللَّهِ يَذْكُرُونَهُ
হযরত আবূ দারদা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা কিছু লোককে হাশরের ময়দানে এভাবে উঠাবেন যে, তাদের চেহারায় নূর চমকাতে থাকবে। তারা মোতির মিম্বরে বসা থাকবে, অন্য লোকেরা তাদের ঈর্ষা করতে থাকবে। তারা নবী বা শহীদ নন। এক গ্রাম্য ব্যক্তি এগিয়ে গেলেন। বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের অবস্থা বলুন, যাতে করে তাদের আমরা চিনতে পারি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, তারা ঐ সকল লোক, যারা বিভিন্ন এলাকা হতে এবং বিভিন্ন খান্দান হতে এক জায়গায় একত্রিত হয়ে আল্লাহর জিকিরে মশগুল হয়। [মাযমাউজ যাওয়ায়েদ, হাদীস নং-১৬৭৭০, ফাযায়েলে আমাল-৩৬০-৩৬১, ফাযায়েলে জিকির-৫৪-৫৫, হাদীস নং-১২] উক্ত হাদীসটি নকল করার পর আল্লামা হায়ছামী রহঃ বলেন, বর্ণনাটির সনদ হাসান পর্যায়ের।
হযরত কা’ব রহঃ বলেন,
أَنَّ كَعْبًا، قَالَ: إِنَّ الْمَلَائِكَةَ يَنْظُرُونَ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الَّذِينَ يُصَلُّونَ بِاللَّيْلِ فِي بُيُوتِهِمْ كَمَا تَنْظُرُونَ أَنْتُمْ إِلَى نُجُومِ السَّمَاءِ
নিশ্চয় ফেরেশতারা আসমান থেকে রাতে আপনা ঘরে নামাযরত ব্যক্তিদের দিকে এমনভাবে দেখেন, যেমন তোমরা আসমানের দিকে তাকিয়ে তারকা দেখো। [হিলয়াতুল আওলিয়া-৬/৪৩, মাজমূউ রাসায়েল লিইবনে রজব আলহাম্বলী-৫১]
ব্যাখ্যাঃ
এসব হাদীস একথাই প্রমাণিত করছে যে, আল্লাহর জিকিরের নূর রয়েছে। আর এতে সকীনা নাজিল হয়।
বুখারী শরীফে এসেছেঃ
عَنِ البَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ، قَالَ: كَانَ رَجُلٌ يَقْرَأُ سُورَةَ الكَهْفِ، وَإِلَى جَانِبِهِ حِصَانٌ مَرْبُوطٌ بِشَطَنَيْنِ، فَتَغَشَّتْهُ سَحَابَةٌ، فَجَعَلَتْ تَدْنُو وَتَدْنُو وَجَعَلَ فَرَسُهُ يَنْفِرُ، فَلَمَّا أَصْبَحَ أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَذَكَرَ ذَلِكَ لَهُ فَقَالَ: «تِلْكَ السَّكِينَةُ تَنَزَّلَتْ بِالقُرْآنِ
হযরত বারা বিন আযেব রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করছিলেন। তার পাশেই এক ঘোড়া রশি দিয়ে বাঁধা ছিল। তখন এক টুকরো মেঘ এসে তার উপর ছায়া দান করল। মেঘখন্ড ক্রমেই নিচের দিকে নেমে আসতে লাগল। আর তার ঘোড়া ভয়ে লাফালাফি শুরু করে দিল। যখন সকালে ঘটনাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বর্ণনা করা হল, তখন তিনি বললেন, এটি ছিল সাকীনা, যা কুরআন তিলাওয়াতের বরকতে নাজীল হয়েছিল। [বুখারী, হাদীস নং-৫০১১]
এসব হাদীসের মাধ্যমে পরিস্কার জানা গেল যে, আল্লাহর জিকিরে সকীনা নাজীল হয়, আর তার জিকিরে নূর বিদ্যমান।
আর এ নূর আল্লাহ তাআলা ইচ্ছে করলে কাউকে দেখিয়ে দিতে পারেন। এটি সম্পূর্ণই মহান আল্লাহর মর্জি।
এবার আমরা ফাযায়েলে আমালের অভিযুক্ত পূর্ণ ইবারত দেখে নেইঃ
শায়খ আব্দুল আজীজ দাব্বাগ রহঃ কাছাকাছি যুগের একজন উম্মী বুযুর্গ ছিলেন। কিন্তু কুরআনের আয়াত, হাদীসে কুদসী, হাদীসে নববী, জাল হাদীস এইসবগুলিকে তিনি ভিন্ন ভিন্ন করিয়া বলিয়া দিতে পারিতেন। তিনি বলিতেন যে, বর্ণনাকারীর জবান হইতে যখন শব্দ বাহির হয়, তখন ঐ শব্দসমূহকে নূরের দ্বারা বুঝিতে পারিঃ ইহা কাহার কালাম?
কেননা, আল্লাহর কালাম এবং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কালামের নূর আলাদা। অন্যদের কালামে এ দুইপ্রকারের নূর থাকে না। [উর্দু ফাযায়েলে আমাল-৪২৭, বাংলা ফাযায়েলে আমাল, ফাযায়েলে জিকির-৩৬৩, দারুল কিতাব প্রকাশনী]
খেয়াল করুন!
শায়েখ জাকারিয়া রহঃ আল্লাহর জিকির সম্পর্কিত হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন। উদ্ধৃত করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস দ্বারা একথা প্রমাণিত যে, আল্লাহর জিকিরের নূর রয়েছে। জিকির করলে সকীনা নাজিল হয়। আর এ সকীনা ও নূর আল্লাহ তাআলা কাউকে কাউকে দিব্য দৃষ্টিতে দেখাতেও পারেন।
হাদীসগুলো বর্ণনা করার পর, শায়েখ জাকারিয়া রহঃ উপরোক্ত ঘটনা নকল করেছেন। যা তারতীব আকারে কেউ পড়লে তার মনে কোন প্রশ্নই জাগরিত হবে না।
কিন্তু লা-লামাযহাবীরা সাধারণ লোকদের ধোঁকা দেবার জন্য অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করে সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করে যায়।
দেখুন লা-মাযহাবী বন্ধুদের মান্যবর ব্যক্তিত্ব আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহঃ তার শায়েখ ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর বিষয়ে কী নকল করেছেন?
وَلَمَّا طُلِبَ إِلَى الدِّيَارِ الْمِصْرِيَّةِ، وَأُرِيدَ قَتْلُهُ – بَعْدَمَا أُنْضِجَتْ لَهُ الْقُدُورُ، وَقُلِّبَتْ لَهُ الْأُمُورُ – اجْتَمَعَ أَصْحَابُهُ لِوَدَاعِهِ. وَقَالُوا: قَدْ تَوَاتَرَتِ الْكُتُبُ بِأَنَّ الْقَوْمَ عَامِلُونَ عَلَى قَتْلِكَ. فَقَالَ: وَاللَّهِ لَا يَصِلُونَ إِلَى ذَلِكَ أَبَدًا. قَالُوا: أَفَتُحْبَسُ؟ قَالَ: نَعَمْ، وَيَطُولُ حَبْسِي. ثُمَّ أَخْرُجُ وَأَتَكَلَّمُ بِالسُّنَّةِ عَلَى رُءُوسِ النَّاسِ. سَمِعْتُهُ يَقُولُ ذَلِكَ.
যখন ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর ব্যাপারে পরিবেশ উত্তপ্ত করে তোলা হয়। আর তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে মিশর তলব করা হয়। তখন তার সাথীরা তাকে বিদায় জানাতে উপস্থিত হয়। বলতে থাকে, ধারাবাহিক পত্র আসছে যে, তারা আপনাকে হত্যা করে ফেলবে। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! তারা আমাকে কিছুতেই হত্যা করতে পারবে না। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলঃ তাহলে কি আপনাকে বন্দি করা হবে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, আর আমি দীর্ঘ সময় বন্দি থাকবো। তারপর মুক্ত হবো এবং লোকদের সামনে সুন্নাহের বাণী প্রচার করবো। [ইবনুল কায়্যিম রহঃ বলেন] আমি এসব কথা তাকে বলতে নিজে শুনেছি। [মাদারিজুস সালেকীন লিইবনুল কায়্যিম-২/৪৫৮]
স্ক্রীণ শর্ট
ইতিহাস স্বাক্ষ্য, ইবনে তাইমিয়া রহঃ যা বলেছিলেন হুবহু তা’ই হয়েছিল। তাকে গ্রেফতার করে বন্দী করা হয়। তারপর অনেকদিন পর তাকে মুক্ত করে দেয়া হয়।
এখন তাউসীফুর রহমানসহ সমস্ত লা-মাযহাবীদের কাছে আমাদের প্রশ্ন হল, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ যে, বললেন “আল্লাহর কসম! তারা আমাকে কিছুতেই হত্যা করতে পারবে না।” এরপর যা বললেন।
কতটা মজবুতির সাথে। আল্লাহর কসম করে বললেন। এখন প্রশ্ন হল এটি কি ইলমে গায়েব নয়?
ফাযায়েলে আমলে এমন টাইপের ঘটনা আনলে যদি ইলমে গায়েব হয়ে যায়। আর উলামায়ে দেওবন্দ আল্লাহর সাথে শরীককারী সাব্যস্ত হয়ে যায় [নাউজুবিল্লাহ] তাহলে একই ধরণের কথা ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ আনলে তার ক্ষেত্রে লা-মাযহাবী বন্ধুদের ফাতওয়া বন্ধ কেন? কেন শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর বিরুদ্ধে ফাতওয়া প্রদান বন্ধ?
এসব কী প্রমাণ করে? আসলে এসব ঘটনার উপর অভিযোগ নয়। মূল বিদ্বেষ হল হক্কানী জামাত উলামায়ে দেওবন্দের উপর বিদ্বেষ। যে বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে এসব উদ্ভট ফাতওয়া উলামায়ে হক উলামায়ে দেওবন্দের উপর আরোপ করা হচ্ছে।
আল্লাহ তাআলা লা-মাযহাবী ফিতনাবাজদের প্রতারণা থেকে উম্মতে মুসলিমাকে হিফাযত করুন।
অপবাদের কবলে ফাযায়েলে আমাল [পর্ব-১] [স্বপ্নে নবীজী সাঃ এর আগমণ ও তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়ন কি শিরক?
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– কাসিমুল উলুম আলইসলামিয়া, আমীনবাজার ঢাকা।
মুহাদ্দিস– মাদরাসা উবাদা ইবনুল জাররাহ, ভাটারা ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]