প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / ওয়াসওয়াসাঃ চার মাযহাবের দ্বারা উম্মত চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে?

ওয়াসওয়াসাঃ চার মাযহাবের দ্বারা উম্মত চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে?

প্রশ্ন

শ্রদ্ধেয় মুফতী সাহেব!

আমাদের এলাকায় কিছু আহলে হাদীস ভাই আছেন। তারা এলাকায় খুবই ফিতনা সৃষ্টি করছে। আলহামদুলিল্লাহ আপনাদের সাইটের ভিডিও এবং লেখাগুলো আমাদের খুবই কাজে আসছে। অনেক ভাই এ বিষয়ে সচেতন হয়েছে। সেই সাথে বেশ কিছু ভাই তাদের ফিতনা থেকে তওবা করেছে। কিন্তু এখনো অনেক ভাই আসছে না। আমাদের অনেক গালাগাল ও বিষোদগার করে থাকে।

তাদের কিছু কথা আমাদের মনে অনেক দ্বিধাদন্দের সৃষ্টি করে। এর মাঝে একটি কথা হল, তারা বলে-

“চার মাযহাবের দ্বারা তিন চার ভাগ হয়ে গেছে। আর দ্বীনকে এভাবে ভাগ করা জায়েজ নেই”।

তাদের এ প্রশ্নের জবাবে আমরা কিছু বলতে পারি না। এ বিষয়ে কি জবাব দেয়া যায়? দয়া করে জানালে ভাল হতো।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

আসলে এটি লা-মাযহাবীদের পক্ষ থেকে একটি ওয়াসওয়াসা। তারা এর মাধ্যমে সাধারণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে থাকেন। অথচ এর কোন বাস্তবতা নেই।

চার মাযহাবের দ্বারা দ্বীনে শরীয়তের মাঝে কোন বিভক্তি আসেনি। বিভক্তি এসেছে মূলত লা-মাযহাবী ফিরক্বার কারণে।

এ সকল ফিতনাবাজ লা-মাযহাবীরা “বিভক্তি” এর মানেই জানে না। বিভক্তি মানে হল এক দল অন্য দলের সম্পূর্ণ বিপরীত হওয়া। অথচ চার মাযহাবের মাঝে মৌলিক কোন বৈপরীত্বই নেই। সকল মাযহাবের অনুসারীরাই বলে থাকেন, অপর মাযহাবও সঠিক। অপর মাযহাবও হকের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রতিটি মাযহাবই সুন্নাতে রাসূলের উপর প্রতিষ্ঠিত।

যেখানে চার মাযহাবের অনুসারীরাই অপর মাযহাবকে সুন্নাহ সম্মত এবং সঠিক বলে স্বীকৃতি প্রদান করছে। কিন্তু এলাকায় যাদের মাধ্যমে দ্বীন পৌছেছে এবং যে পদ্ধতিতে ইসলাম আসার পর থেকে সুন্নাহ সম্মত আমল জারি আছে তারা সেটির উপর আমল করছে সেই সাথে অপর এলাকায় প্রচলিত সুন্নাহ সম্মত আমলকে সঠিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করছে, সেখানে বিভক্তি আসল কোত্থেকে?

বিভক্তি আসতো তখন, যখন এক মাযহাবের অনুসারীরা অপর মাযহাবের অনুসারীদের বাতিল বলতো। অপর মাযহাবের অনুসারীদের ভুল ভ্রান্ত বলে ঘোষণা দিত। তাহলে মাযহাবের দ্বারা দ্বীনের মাঝে বিভক্তি এসেছে বলে যেতো। কিন্তু কোন মাযহাবের অনুসারীগণতো একথা বলেন না। তাহলে এ কল্পিত বিভক্তি লা-মাযহাবী ভাইয়েরা কোত্থেকে আবিস্কার করলেন?

আবারো বলছি! চার মাযহাবের দ্বারা দ্বীনের মাঝে বিভক্তি এসেছে তখনি বলা যেতো, যদি এক মাযহাবের অনুসারীরা অপর মাযহাবকে বাতিল ও ভ্রান্ত বলে সাব্যস্ত করতো। কিন্তু এমনটি কেউ বলেন না। বরং প্রতিটি মাযহাবের অনুসারীরাই অপর মাযহাবের অনুসারীদের সঠিক ও হক বলে স্বীকার করছে। সেখানে বিভক্তি বলার প্রশ্নই আসে না। বিভক্তি এসেছে বলা মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়।

হ্যাঁ। লা-মাযহাবী ফিরক্বার কারণে উম্মতের মাঝে প্রচন্ড বিবাদ ও বিভক্তি এসেছে। রানী ভিক্টোরিয়ার মাধ্যমে সৃজিত এ ফিরক্বার মাধ্যমে উম্মতের মাঝে বিবাদ বিভক্তি ছড়িয়ে পড়ছে। পুরো দ্বীনটাই সন্দিহান হয়ে পড়ছে তাদের অনভিজ্ঞ ও অর্বাচিন গবেষণার কারণে।

কয়েকটি উদাহরণ নিচে উদ্ধৃত করা হল-

কিরাত পড়া প্রসঙ্গে

শায়েখ আলবানীর মতে জোরে কিরাত পড়া নামাযে তথা জেহরী নামাযে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়ার বিধান রহিত হয়ে গেছে। [সিফাতু সালাতিন্নাবী সাঃ-৮৩}

কিন্তু আহলে হাদীস আন্দোলনের সভাপতি আসাদুল্লাহ গালিব সাহেব বলেন জোরে আস্তে উভয় কিরাতের নামাযে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া ফরজ। না পড়লে নামায হবে না। {ছালাতুর রাসূল সাঃ-৮৮}

সহীহ হাদীসের নামে নামায বিষয়ে এমন বিভক্তি কেন?

বিসমিল্লাহ প্রসঙ্গে

লা-মাযহাবী আসাদুল্লাহ গালিব সাহেব বলেন-বিসমিল্লাহ সূরা ফাতিহার অংশ হবার পক্ষে কোন ছহীহ দলীল নেই। {ছালাতুর রাসূল-৮৬}

অপরদিকে আরেক লা-মাযহাবী আইনুল বারী সাহেব লিখেছেন- সূরা ফাতিহা কুরআনের অংশ। {আইনী তুহফা সলাতে মুস্তাফা-১০৫}

বিসমিল্লাহ জোরে পড়া

আসাদুল্লাহ গালিব সাহেবের মতে এর কোন ভিত্তি নেই। [ছালাতুর রাসূল-৮৬}

কিন্তু শায়েখ আকরামুজ্জামান সম্পাদিত গ্রন্থে এসেছে- জোরে আস্তে উভয়ভাবে বিসমিল্লাহ পড়া ছহীহ সনদে বর্ণিত। {শায়েখ আকরামুজ্জামান সম্পাদিত ছালাত আদায়ের পদ্ধতি-২৮}

-রুকু

ক) রুকু পেলে রাকাআত পাওয়া যায়। {আকরামুজ্জামান সম্পাদিত ছালাত আদায় পদ্ধতি-৩৩}

খ) রুকু পেলে উক্ত রাকাত পায়নি। {গালিব সাহেবের ছালাতুর রাসূল-৯৬}

-সালাম

ক)ডান দিকে ফিরে ওয়াবারাকাতুহু বলতে হবে {আকরামুজ্জামান সম্পাদিত ছালাত আদায় পদ্ধতি-৬২}

খ) উভয় দিকেই ওয়াবারাকাতুহু বলতে হবে। {ইবনে ফজলের সহীহ নামায ও দুআ শিক্ষা-১০৩}

-জনাযায় ফাতিহা

ক) আসাদুল্লাহ গালিব বলে পড়া ওয়াজিব। {ছালাতুর রাসূল-২১৩}

খ)আলবানী বলেছেন সুন্নত। {সিফাতু সালাতিন্নবী-১১১}

৭-নামায পরিত্যাগকারীর বিধান

নাসীরুদ্দীন আলবানী সাহেব লিখেছেন-নামায ফরজ বিশ্বাস করার পর অলসতাবশতঃ নামায ছেড়ে দিলে তাকে কাফির বলা যাবে না। {সলাত পরিত্যাগকারীর হুকুম, অনুবাদ মুহাম্মদ আল আমীন বিন ইউসুফ, পরিবেশনায় তাওহীদ পাবলিকেশন্স]

কিন্তু লা-মাযহাবী খলীলুর রহমান বিন ফজলুর রহমান সাহেব আলাদা পুস্তিকা লিখেছেন সলাত পরিত্যাগকারীকে কাফির ফাতওয়া দিয়ে। দেখুন-জামাআতে সালাত ত্যাগকারীর পরিণতি, আত তাওহীদ প্রকাশনী]

৮-ঈদের তাকবীর

ড. সাইফুল্লাহ সাহেব বলেন –ছয় তাকবীরে ঈদের সালাত পড়া সুন্নাহ সম্মত।

কিন্তু মুযাফফর এবং আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ সাহেব বলেন ছয় তাকবীরের কোন প্রমাণ নেই। [ইউটিউবে আপলোডকৃত ভিডিও]

৯-তারাবীহ নামায

ড. সাইফুল্লাহ সাহেব বলেন, তারাবীহ নামায বিশ রাকাত পড়া যায়। কোন সমস্যা নেই।

কিন্তু মুযাফফর ও আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ বলেন, আট রাকাতের বেশি তারাবীহ নামায পড়া যাবে না। এর কোন প্রমাণ নেই।

[ইউটিউবে আপলোডকৃত ভিডিও]

১০-সৌদীর সাথে মিলিয়ে ঈদ

মুরাদ বিন আমজাদ ও আবু সুমাইয়া মতিউর রহমান বলেন সারা পৃথিবীতে একই সময়ে ঈদ করতে হবে। যারা সৌদীতে ঈদের দিন রোযা রেখেছে তারা হারাম কাজ করেছে, পক্ষান্তরে আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল বলেছেন একই দিনে ঈদকারীরা কাদিয়ানীদের বংশধর। [ইউটিউবে আপলোডকৃত ভিডিও]

এইতো মাত্র দশটি মতভেদ দিলাম। এরকম অসংখ্য মতভেদ রয়েছে আমাদের এ ছোট্ট দেশের সংখ্যালঘু এ লা-মাযহাবী ফিরক্বার মাঝে। যারা সহীহ হাদীসের নামে একতার আড়ালে ঘরে ঘরে বিভক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। একদল আরেক দলের মাসআলাকে গলত বলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

অথচ এ উপমহাদেশে ইসলাম আসার পর থেকে নিয়ে এক মাযহাবের অনুসারী আরেক মাযহাবের অনুসারীকে ভ্রান্ত বলে ফাতওয়া প্রদান করেছে এর কোন নজীর কেউ দেখাতে পারবে না। মাযহাবের অনুসারীদের মাঝে মাযহাব বিষয়ে কোন বিরোধই দেখা যায়নি এ উপমহাদেশে। তাহলে চার মাযহাবের দ্বারা বিভক্তি এসেছে একথার বাস্তবতা রইল কোথায়?

বরং বাস্তব কথা হল, লা-মাযহাবী ফিরক্বার মাধ্যমে এ উপমহাদেশে বিবাদ ও বিভক্তির বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে। আল্লাহ তাআলা এ ভ্রান্ত ফিরক্বার ওয়াসওয়া ও ধোঁকা থেকে উম্মতে মুসলিমাকে হিফাযত করুন। আমীন।

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল- [email protected]

[email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …

No comments

  1. আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুক । আমিন

Leave a Reply to Rezaul Karim Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *