লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
জুলুমের ষ্টিমরোলার চলছিল তখন। আঁধারে ছেয়ে ছিল ধরিত্রী। শান্তির ক্ষীনালো পর্যন্ত জ্বলছি না কোথাও। নিকষ কৃষ্ণাধারে নিমজ্জিত সব। ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসতো জালিমের চাবুকের গর্জন। মজলুমের হাহাকার ধ্বনি। নিষ্পাপ চাঁদমুখী নবজাতক কন্যা-সন্তান গগনবিদায়ী আর্তনাদে জীবন্ত প্রোথিত হতো প্রায়ই। যার পায়ের নিচে জান্নাত সে মায়ের জাতি ছিল দাস-দাসির মত নিপেড়িত-নিষ্পেষিত। জুলুম, নিপিড়ণ, অনাচার আর অত্যাচারের এক অভয়রাণ্য ছিল গোটা ধরাধাম। খানিক শান্তি আর মুক্তির আশায় প্রহর গুণছিল মানবতা।
ঠিক এমনি সময়। দীগন্ত প্রসারী আলো নিয়ে। হেদায়াতের বার্তা নিয়ে। মানবসেবার অনুপম আদর্শ নিয়ে দীপ্ত পায়ে দাঁড়িয়ে গেলেন গোটা সৃষ্টিজগতের রহমাতের নবী মুহাম্মদ সাঃ। মানবসেবার বে-নজির দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন জুলুমের অঙ্গরাজ্যে। নিপিড়িতকে বুকে টেনে নেয়া। মজলুমের সহযোগিতায় বাড়িয়ে দেয়া সাহায্যের হাত। অসহায়, দরিদ্র আর নিষ্পেষিতদের কান্ডারীরূপে আবির্ভূত হলেন মানবতার নবী মুহামুদুর রাসূলুল্লাহ সাঃ।
প্রতিষ্ঠা পেল পৃথিবীর সর্বপ্রথম অরাজনৈতিক সমাজসেবামূলক সংগঠন “হিলফুল ফুজুল”।
নিপিড়িতের পাশে দাঁড়াও! দুঃখীদের জন্য এগিয়ে দাও সহযোগিতার হাত! প্রতিটি মানুষের ন্যায্য অধিকার দিয়ে দাও! দিয়ে দাও মায়ের জাতি মেয়েদের ন্যায্য অধিকার। তুলে নাও অন্যায়-জুলুমের খরগ। মোহাব্বত-ভালবাসার জান্নাতী বন্ধনে আবদ্ধ হও গোটা মানবজাতি।
এমনি সুন্দর স্লোগানে উবে যেতে থাকে আঁধারের কালিমা। আরবের সেই ছোট্ট কুটির থেকে দীপ্তিময় হওয়া সেই দিবাকার ছড়িয়ে পড়তে থাকে দিক থেকে দিগন্তে। মাত করে দেয় পৃথিবী। অবাক বিস্ময়ে পৃথিবী তাকিয়ে দেখে এক আরব যুবকের অবিস্মরণীয় বিজয়গাঁথা। দলে দলে ছুটে আসতে থাকে মানুষ মানবতার মানস পুরুষটির কাছে। হেদায়াতের আলোয় হতে থাকে আলোকিত। প্রতিটি মানুষ ফিরে পায় তাদের ন্যায্য-প্রাপ্য অধিকার। বিশ্বজয়ী সেই বিশ্বনবীর মিশন বাস্তবায়িত হয় পৃথিবীব্যাপী।
সময়টা পাল্টে গেছে এখন। খিদমাতে খালকের সেই নববী আখলাক ছেড়ে দিয়েছি আমরা। কিন্তু অব্যর্থ সেই “খিদমাতে খালক” থিউরী আঁকড়ে ধরেছে ইহুদী খৃষ্ট শক্তি। জুলুম আর নিপিড়নের প্রডিউসাররা সেজে বসেছে মানবসেবার কান্ডারী। অনাচার আর অবিচার মানসিকতাকে আড়াল করে খোলস পড়েছে মানবতার। সর্বশ্রেণীর মানুষের অধিকার হরণকারীরা ফেরী করে চলছে অধিকারের সনদ। মানবসেবার মুখরোচক বুলি। খিদমাতের মোহময় জালে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে মুসলিমদের করে চলছে ধর্মান্তর। পাল্টে দিচ্ছে ধর্মানুভূতি। জনপদের পর জনপদ হয়ে যাচ্ছে মুসলিম শূণ্য। ঝেঁকে বসছে ধর্মান্তরের ভয়াবহ আজাব।
এখনি সময় সচেতন হওয়ার। এখনি সময় জেগে উঠার। ভুলে যেতে বসা সেই “খিদমাতে খালক তথা মানবসেবা” নিয়ে আবার এগিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। আর পিছু টান নয়। আজো নিপেড়িত কোটি মানুষ। আজো মায়েরা তাদের অধিকার বঞ্চিত। মেয়েরা বঞ্চিত ন্যায্য পাওনা থেকে। যৌতুক, এসিড সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর মাদকের ছোবলে ভেঙ্গে যেতে বসেছে সামাজিক স্থিতিশীলতা। অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে চারদিক।
এমনি সময়ে রাসূল সাঃ এর সেই “খিদমাতে খালক থিউরী নিয়ে মাঠে নামার তাগিদ অনুভব হচ্ছে। শুধু তাগিত নয় তীব্র তাগিত।
শীতার্ত মানুষ খুঁজে ফিরছে আপনার দয়ার্দ্র হাত! আপনি দয়া দেখাতে পারবেনতো?
আসছে হাড় কাঁপানো শীত! বাড়বে ধনীদের বিলাসিতা এবং গরীবের দুর্ভোগ!
শীত মানে বাড়তি কাপড়। বাড়তি জামা। বাড়তি পোশাক।
শপিংমলগুলো সাজবে বাহারী শীতের পোশাকে। চোখ ধাঁধানো হৃদয়কাড়া পোশাকে সজ্জিত হবে কাপড়ের দোকান। নানাভিদ কাপড়ের পসরা নিয়ে বসবে ব্যবসায়ীরা।
মহা আনন্দে একটির স্থলে চারটি, পাঁচটি কেউবা আবার দশ বারটি করে ক্রয় করবে শীতের জামা। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে খরচ হবে অঢেল টাকা।
শীত থেকে রক্ষা পাবার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা সত্বেও অনেকের ঘরে আবারো উঠবে নতুন বাহারী কম্বল। এসব লোকদের সাজগুজ আর কেনাকাটা দেখলে মনে হবে দুর্ভোগের শীত নয় এসেছে ভোগ আর বিলাসের এক মুক্ষম সুযোগ।
কিন্তু!
একবার!
শুধুই একবার!
তাকিয়ে কি দেখেছি শীতার্ত জনপদের রাস্তার পাশে কাঁপতে থাকা শিশুটিকে?
শৈত্যপ্রবাহের আঁধারের নিচে কুঁকরে যাওয়া পরিবারের করূণ হাল?
হাড় কাঁপানো শীতে ছেড়া কাঁথা গায়ে শুয়ে থাকা অসহায় মানুষটিকে?
বয়সের ভাড়ে ন্যুব্জ অসহায় বৃদ্ধ, পৃথিবীর কাঠিন্যতা আর নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর মাসুম শিশু। কিংবা টগবগে যৌবনদীপ্ত বয়সের যুবকের দরিদ্রতার কশাঘাতে জর্জরিত খালি গা। কিংবা আমাদের কোন এক গাঁয়ের দুঃখিনী মা। অসহায় বোন। শীতের প্রকোপে অসহায় চাহনিতে তাকিয়ে আছেন। নির্লিপ্ত তাদের চোখের কোণ। হতদরিদ্র কৃষকের নিঃশব্দ হাহাকার।
আপনার মনের দয়ার্দ্র হৃদয়কে একবারও কি নাড়া দেয় না? একবারও এসব গরীবের মুখে হাসি দেখার ইচ্ছে জাগে না? একবারও দুনিয়ায় দয়া দেখিয়ে আখেরাতে দয়া পাবার আশা জাগরিত হয় না?
দেখুন না আমার নবী। দয়ার নবী। মায়ার নবী। রহমাতের নবী কি শব্দে গরীবের পাশে দাঁড়ানোর প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন। কিছু হাদীসের বাণী দেখে নেই-
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «أَيُّمَا مُسْلِمٍ كَسَا مُسْلِمًا ثَوْبًا عَلَى عُرْيٍ، كَسَاهُ اللَّهُ مِنْ خُضْرِ الْجَنَّةِ، وَأَيُّمَا مُسْلِمٍ أَطْعَمَ مُسْلِمًا عَلَى جُوعٍ، أَطْعَمَهُ اللَّهُ مِنْ ثِمَارِ الْجَنَّةِ، وَأَيُّمَا مُسْلِمٍ سَقَى مُسْلِمًا عَلَى ظَمَإٍ، سَقَاهُ اللَّهُ مِنَ الرَّحِيقِ الْمَخْتُومِ
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাঃ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যে কোন মুসলমান কোন বস্ত্রহীন মুসলমানকে কাপড় দান দান করবে, কাল কিয়ামতে আল্লাহ পাক ঐ ব্যক্তিকে বেহেশতের সবুজ কাপড় পরিধান করাবেন। আর যে কোন মুসলমান অপর মুসলমানকে অন্ন দান করবে, তাকে আল্লাহ পাক বেহেশতের ফল ভক্ষণ করাবেন। আর যে কোন মুসলমান অপর কোন তৃষিত মুসলমানকে পানি পান করাবে, আল্লাহ পাক তাকে কাল কিয়ামতে সিলমোহর করা বোতরের স্বচ্ছ পানি পান করাবেন। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-১৬৮২}
مَا مِنْ مُسْلِمٍ كَسَا مُسْلِمًا ثَوْبًا إِلاَّ كَانَ فِي حِفْظٍ مِنَ اللهِ مَا دَامَ مِنْهُ عَلَيْهِ خِرْقَةٌ.
হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সাঃ কে বলতে শুনেছি, যে কোন মুসলমান অপর কোন মুসলমানকে একটি বস্ত্র পরিধান করাবে সে আল্লাহ পাকের তত্ত্বাবধানে থাকবে, যখন পর্যন্ত ঐ কাপড়ের একটি টুকরাও তার অঙ্গে থাকবে। {সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৪৮৪}
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ، وَلَا يَصْعَدُ إِلَى اللهِ إِلَّا طَّيِّبٌ ، فَإِنَّ اللهَ يَقْبَلُهَا بِيَمِينِهِ، ثُمَّ يُرَبِّيهَا لِصَاحِبِهَا، كَمَا يُرَبِّي أَحَدُكُمْ فَلُوَّهُ، حَتَّى تَكُونَ مِثْلَ الْجَبَلِ “
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুজুরে পাক সাঃ ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি তার হালাল উপার্জন হতে একটি খেজুর পরিমাণও কিছু দান করে আর আল্লাহ পাক তা গ্রহণ করেন না হালাল উপার্জন ছাড়া। আল্লাহ পাক তা নিজ ডান হাতে গ্রহণ করেন। তারপর তা দাতার জন্য রক্ষা করেন যেভাবে তোমাদের কেউ নিজ ঘোড়ার বাচ্চাকে প্রতিপালন করে। এভাবে প্রতিপালন করার ফরে তা পাহাড় পরিমাণ হয়ে যায়। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৮৩৮১,সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১৪১০}
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ الصَّدَقَةَ لَتُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ وَتَدْفَعُ مِيتَةَ السُّوءِ.
হযরত আনাস রাঃ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,হুজুরে পাক সাঃ ইরশাদ করেন, দান খয়রাত আল্লাহ পাকের ক্রোধ প্রশমিত করে এবং অপমৃত্যু বন্ধ করে। {সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৬৬৪, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৩৩০৯}
সবার প্রতি উদাত্ব আহবান!
নামছে তীব্র শীত। প্রতিবারের মতই শীতের তীব্র ধকল যাবে গরীব আর দুঃখীদের উপর দিয়ে। আপনার একদিনের নাস্তার টাকা, একদিনের পকেট খরচ, একদিনের অতিরিক্ত সঞ্চয় কি আপনার পাশের গরীবের হাতে তুলে দেয়া যাবে না?
একজন গরীবের জামা ক্রয় দেয়ার ক্ষমতা কি আল্লাহ তাআলা আমাদের দেননি? একটি কম্বল দরিদ্র মানুষের ঘরে পৌঁছে দেবার মত সামর্থ কি আমাদের নেই?
যার যা সামর্থ আছে। তাই নিয়ে আপনার প্রতিবেশি আপনার দেশবাসী, বিশেষ করে উত্তবঙ্গের দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য আপনার অনুগ্রহের হাত বাড়িয়ে দিন। পৌঁছে দিন শীতার্ত মানুষের কাছে শীত বস্ত্র। প্রয়োজনীয় আসবাব।
আল্লাহ তাআলা আমাদের আল্লাহর মাখলুকের সেবা করে তার প্রিয়ভাজন হবার তৌফিক দান করুন। আমীন।
Thanks bro for your great post.
I will try my best…
আমাদের সবার যার যতটুকু সাধ্য আছে সাহায্য করা উচিৎ। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ তায়ালা আমাদের সাহায্য করবেন। জাজাকাল্লাহ।
salam