প্রশ্ন
ফিক্বহে হানাফীর কিতাব আদদুররুল মুখতারে ইমামতীর অধিক হক্বদারের আলোচনা করতে গিয়ে লিখা হয়েছে যে, যদি ইমামতীর প্রারম্ভিক শর্ত যদি উপস্থিত সবার মাঝে সমান সমান হয়, তাহলে এমন ব্যক্তিকে ইমাম বানাবে যার স্ত্রী সুন্দরী। এ গুণেও যদি সমান সমান হয়, তাহলে ইমাম ঐ ব্যক্তি হবে, যার মাথা বড় এবং অঙ্গ ছোট হয়। তারপর অঙ্গের ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, অঙ্গ মানে হল লিঙ্গ। {দুররে মুখতার মাআ রদ্দুল মুহতার-১/৫৫৮, তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ}
সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, হানাফীদের নিকট ইমামতীর অধিক উপযোক্ত ঐ ব্যক্তি হবে, যার স্ত্রী সুন্দরী হবে, আর মাথা হবে বড় আর লিঙ্গ হবে ছোট।
এ কেমন অদ্ভুত বিধান ফিক্বহে হানাফীর?
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ এর ইবারত এবং আদদুররুর মুখতারের ইবারত প্রায় কাছাকাছি। তাই শুধু আদ দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতারের উপর আরোপিত প্রশ্নটির উত্তর দিলেই মারাকিল ফালাহের উপর উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর হয়ে যাবে।
আসলে কী আছে আদদুররুল মুখতার ও তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ রদ্দুল মুহতারে?
আদ দুররুল মুখতার প্রণেতা ইমামতীর অধিক হক্বদার কে হবে? এর আলোচনা করতে গিয়ে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করেছেন যে,
১- যে ব্যক্তি নামাযের মাসআলার ব্যাপারে অধিক জানে উক্ত ব্যক্তি ইমামতীর অধিক যোগ্য হবে।
যদি উপস্থিত সবাই নামাযের মাসআলায় সমান জ্ঞানী হয়, তাহলে-
২- উপস্থিতদের মাঝে যার কিরাত সুন্দর হয়, সে ইমাম হবে।
যদি এতেও সবাই বরাবর হয়, তাহলে-
৩- ঐ ব্যক্তি ইমাম হবে, যে অধিক বুজুর্গ তথা সন্দেহযুক্ত বস্তু থেকে বেশি পরিমান বেঁচে থাকে।
যদি এতেও সবাই সমান সমান হয়, তাহলে-
৪- যে ব্যক্তি সবার চেয়ে বয়সে বড় হবে বা ইসলাম আগে গ্রহণ করেছে সে হবে ইমাম।
যদি এ গুণেও উপস্থিত সবাই সমান হয়, তাহলে-
৫- যার চরিত্র উত্তম।
যদিও এতেও সবাই বরাবর হয়, তাহলে-
৬- যে ব্যক্তি অধিক পরিমাণ তাহাজ্জুদ পড়ে উক্ত ব্যক্তি হবে ইমাম।
যদি এ গুণেও সবাই সমান গুণান্বিত হয়, তাহলে-
৭- বংশের দিক থেকে যে ব্যক্তি উত্তম হবে সে ইমাম হবে।
যদি এতেও সবাই বরাবর হয়, তাহলে-
৮- যে ব্যক্তি অধিক অভিজাত হবে সে ইমাম হবে।
যদি এতেও সবাই বরাবর হয়, তাহলে-
৯- যার কণ্ঠ অধিক সুন্দর হবে সে ইমাম হওয়ার অধিক হকদার হবে।
যদি উল্লেখিত সকল গুণে সবাই সমান সমান হয় তাহলে-a
ثُمَّ الْأَحْسَنُ زَوْجَةً ثُمَّ الْأَكْثَرُ مَالًا ، ثُمَّ الْأَكْثَرُ جَاهًا ( ثُمَّ الْأَنْظَفُ ثَوْبًا ) ثُمَّ الْأَكْبَرُ رَأْسًا وَالْأَصْغَرُ عُضْوً
[ইমামতীর হক্বদার হওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক সকল গুণ উপস্থিত সবার মাঝে সমান হলে] (১০) তারপর প্রাধান্য পাবে ঐ ব্যক্তি যার স্ত্রী সুন্দরী। (১১) তারপর যার সম্পদ বেশি। (১২) তারপর যার ক্ষমতা বেশি। (১৩) তারপর যার কাপড় অধিক পরিচ্ছন্ন। তারপর যার মাথা বড় আর অঙ্গ ছোট। {আদদুররুল মুখতার মাআ রদ্দুল মুহতার-২/২৯৫-২৯৬}রদ্দুল মুহতারে উক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে
( قَوْلُهُ ثُمَّ الْأَحْسَنُ زَوْجَةً ) لِأَنَّهُ غَالِبًا يَكُونُ أَحَبَّ لَهَا وَأَعَفَّ لِعَدَمِ تَعَلُّقِهِ بِغَيْرِهَا .
وَهَذَا مِمَّا يُعْلَمُ بَيْنَ الْأَصْحَابِ أَوْ الْأَرْحَامِ أَوْ الْجِيرَانِ ، إذْ لَيْسَ الْمُرَادَ أَنْ يَذْكُرَ كُلٌّ مِنْهُمْ أَوْصَافَ زَوْجَتِهِ حَتَّى يَعْلَمَ مَنْ هُوَ أَحْسَنُ زَوْجَةً
“তারপর প্রাধান্য পাবে ঐ ব্যক্তি যার স্ত্রী সুন্দরী”
কারণ এক্ষেত্রে স্ত্রীর প্রতি তার ভালবাসা থাকবে অধিক বেশি, ফলে অন্য মহিলাদের সাথে সম্পর্ক করা থেকে সে থাকবে অধিক নিরাপদ।
আর এ বিষয়টি [কার স্ত্রী সুন্দরী] জানা যাবে সাথী সঙ্গী কিংবা প্রতিবেশি বা নিকত্মীয়গণ থেকে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য এটা নয় যে, উপস্থিত সবাই স্বীয় স্ত্রীর গুণাবলী বলতে শুরু করে দিবে, যাতে কার স্ত্রী সুন্দরী তা জানা যায়।
( قَوْلُهُ ثُمَّ الْأَكْثَرُ مَالًا ) إذْ بِكَثْرَتِهِ مَعَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ الْأَوْصَافِ يَحْصُلُ لَهُ الْقَنَاعَةُ وَالْعِفَّةُ فَيَرْغَبُ النَّاسُ فِيهِ أَكْثَرَ
“তারপর যার সম্পদ বেশি”
যেহেতু পূর্বোল্লিখিত গুণসহ অধিক সম্পদশালীও হয়, তাহলে তার মাঝে অল্পে তুষ্টতা এবং আখলাকের পরিচ্ছন্নতা বেশি থাকা স্বাভাবিক। আর এমন ব্যক্তির প্রতি [স্বাভাবিকভাবে] মানুষের আগ্রহ থাকে বেশি।
( قَوْلُهُ ثُمَّ الْأَكْبَرُ رَأْسًا إلَخْ ) لِأَنَّهُ يَدُلُّ عَلَى كِبَرِ الْعَقْلِ يَعْنِي مَعَ مُنَاسَبَةِ الْأَعْضَاءِ لَهُ ، وَإِلَّا فَلَوْ فَحُشَ الرَّأْسُ كِبَرًا وَالْأَعْضَاءُ صِغَرًا كَانَ دَلَالَةً عَلَى اخْتِلَالِ تَرْكِيبِ مِزَاجِهِ الْمُسْتَلْزِمِ لِعَدَمِ اعْتِدَالِ عَقْلِهِ ا هـ ح .
وَفِي حَاشِيَةِ أَبِي السُّعُودِ ؛ وَقَدْ نُقِلَ عَنْ بَعْضِهِمْ فِي هَذَا الْمَقَامِ مَا لَا يَلِيقُ أَنْ يُذْكَرَ فَضْلًا عَنْ أَنْ يُكْتَبَ ا هـ وَكَأَنَّهُ يُشِيرُ إلَى مَا قِيلَ أَنَّ الْمُرَادَ بِالْعُضْوِ الذَّكَرُ
“তারপর যার মাথা বড় আর অঙ্গ ছোট”
কেননা, এটা প্রমাণবাহী যে, লোকটির আকল বেশি। অর্থাৎ বাকি অঙ্গ সামাঞ্জস্যশীল হওয়ার সাথে সাথে। নতুবা যদি মাথা অস্বাভাবিক বড় হয়, আর বাকি অঙ্গসমূহ ছোট হয়, তাহলে এটা লোকটির শারিরিক গঠণের সমস্যার প্রমাণ বহন করে, যা তার বুদ্ধির ভারসম্যতার কমতিকে আবশ্যক করে থাকে।
আর আবু সঊদের টিকায় আছে। তাতে কতিপয় লোক থেকে এমন একটি বিষয় বর্ণনা করেছে তা উল্লেখ করাই সমীচিন নয় লেখাতো দূরে থাক।
সেখানে লিখা আছে যে, তারা মনে হয় ইঙ্গিত করেছেন এদিকে যে, এখানে অঙ্গ দ্বারা উদ্দেশ্য হল লিঙ্গ।
পাঠকদের কাছে জিজ্ঞাসা!
উপরে উল্লেখ করা হয়েছে আদ দুররুল মুখতার তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ রদ্দুল মুহতারের আসল ইবারত ও তার অনুবাদ। যাদের মাথায় আল্লাহ পাক সামান্যতম ঘিলু দিয়েছেন, তারা কি বলতে পারবেন যে, উক্ত কিতাব দুটিতে দোষের মত কী বলা হয়েছে?
লিঙ্গ ছোট হওয়া ইমামতীর অধিক হকদার হওয়ার দলীল একথা কে বলেছেন? আদদুররুল মুখতার প্রণেতা আল্লামা হাসকাফী রহঃ? না রদ্দুল মুখতার প্রণেতা আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহঃ?
এ দু’জনের কেউইতো একথা বলেন নি। বরং রদ্দুল মুহতার প্রণেতা আল্লামা শামী রহঃ আবু সউদের টিকায় যে, অঙ্গ দ্বারা উদ্দেশ্য অস্পষ্টভাবে লিঙ্গ নেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ আছে, সেটার ভুল হওয়া ও অনুচিত হওয়া স্পষ্ট শব্দে বলেছেন। তিনি যেটা উদ্দেশ্য নেয়াকে ভুল বলে আখ্যায়িত করেছেন, সেটা তার নিজের বক্তব্য হয় কী করে? এরকম মিথ্যাচার করার নাম দ্বীন প্রচার? কুরআন আর সহীহ হাদীসের উপর আমল?
এতটুকু আকল যাদের নেই, তারা আবার কুরআন আর সহীহ হাদীস কী ঘোড়ার ডিমটা বুঝবে?
অঙ্গ মানে কি?
আদদুররুল মুখতারে বলা হয়েছে,যার অঙ্গ ছোট হবে। অঙ্গ কাকে বলে? আমরা জানি শরীরে ৩৬০টি অঙ্গ আছে। আমাদের বুঝে আসে না কথিত আহলে হাদীস নামধারীরা কেন ৩৫৯টি অঙ্গ বাদ দিয়ে কিতাবে বর্ণিত অঙ্গ শব্দের অর্থ বিশেষ অঙ্গ লিঙ্গ নিচ্ছেন।
যদি অঙ্গ দ্বারা লিঙ্গ উদ্দেশ্য নেয়াও হয়, তবু এর দ্বারা কোন দোষের কাজ হবে না। কারণ তখন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, বেগানা মহিলা থেকে নিজের লজ্জাস্থানকে হিফাযত করে রাখা। তথা জিনা ও ব্যভিচার করা, অন্য মহিলাদের দিকে তাকিয়ে থেকে মজা নেয়া থেকে নিজের লজ্জাস্থানকে ছোট করে রাখে যে সে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে উত্তর চরিত্রের অধিকারী। সে ব্যক্তির মাঝে উপরোল্লিখিত গুণ থাকার সাথে সাথে যদি এ গুণটিও অধিক থাকে, তাহলে সেই ইমামতীর অধিক হকদার এটাতো প্রশংসার দাবিদার। সমালোচনার কি হল?
সমালোচনাকারীগণ নিজের হাঁড়ির খবর নিন
গায়রে মুকাল্লিদ তথা কথিত আহলে হাদীসদের একজন বড় আলেম মৌলবী ওয়াহিদুজ্জান সাহেব নুজুলুল আবরারের ৯৬ পৃষ্ঠায় ইমামতীর অধিক হকদারের আলোচনা করতে গিয়ে লিখেন-
তারপর যার স্ত্রী অধিক সুন্দরী। তারপর অধিক সম্পদশালী ব্যক্তি, তারপর অধিক মর্যাদাবান, তারপর অধিক পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধানকারী ইমামতীর অধিক হকদার। তারপর যার মাথা বড় ও পা ছোট হয় সে ইমামতীর অধিক হকদার। {নুজুলুল আবরার-৯৬}
নুজুলুল আবরারে ছোট পা স্পষ্ট শব্দে বলা হয়েছে, আর আদদুররুল মুখতারে পা না বলে আরেকটু আমভাবে অঙ্গ বলা হয়েছে। নুজুলুল আবরারের পা, আর আদদুররুল মুখতারের অঙ্গ একই জিনিস। কিন্তু আফসোসের বিষয় হল গায়রে মুকাল্লিদ ভাইয়েরা অঙ্গ বলতে বুঝেন শুধু বিশেষ অঙ্গটিকেই।
আল্লাহ তাআলা ফিক্বহ অস্বিকারকারী মিথ্যুকদের প্রোপাগান্ডা থেকে জাতিকে হিফাযত করুন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
ইমেইল- ahlehaqmedia2014@gmail.com