প্রচ্ছদ / কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা / ‘কারো মৃত্যুতে কেউ আলহামদুলিল্লাহ বললে মৃত ব্যক্তির জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে যায়’ এটি কি বুখারীর হাদীস?

‘কারো মৃত্যুতে কেউ আলহামদুলিল্লাহ বললে মৃত ব্যক্তির জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে যায়’ এটি কি বুখারীর হাদীস?

প্রশ্ন

প্রশ্ন : কারো মৃত্যুতে আলহামদুলিল্লাহ বলা যাবে?

বর্তমানে আমরা একটা অস্থির সময় পার করছি। এ সময় সাধারণ মানুষের ওপর কিছুটা সবল বা ক্ষমতা আছে এমন অনেকেই নির্যাতন করে চলেছে প্রতিনিয়ত। সাধারণ মানুষের পক্ষে এসবের জবাব দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে তারা বিভিন্নভাবে নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকেন। তাদের ওপর জুলুম-অত্যাচার করা কেউ মারা গেলে বা বিপদে পড়লে আলহামদুলিল্লাহ পড়েন।

ইদানীংকালে অত্যাচারী বা তাদের সমর্থক কেউ মারা গেলে তার মৃত্যুতে আলহামদুলিল্লাহ বলার প্রবণতা বেড়েছে জনসাধারণের ভেতর। এর প্রেক্ষিতে সামাজিক মাধ্যমে বুখারি শরিফের রেফারেন্সে একটি হাদিস ঘোরাফেরা করছে, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘কারো মৃত্যুকে কেউ আলহামদুলিল্লাহ বললে মৃত ব্যক্তির জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে যায়’।

আমার জানার বিষয় হলো, বুখারি শরিফে কি সত্যিই এই হাদিস বর্ণিত হয়েছে? হয়ে থাকলে হাদিসের মানসহ  জানাবেন প্লিজ।

এছাড়াও আরেকটি বিষয় জানতে চাই, তাহলো— অত্যাচারী জালিমের বিরুদ্ধে গিয়ে জনসাধারণের কিছু করার না থাকলে তাদের মৃত্যুতে আলহামদুলিল্লাহ বলার বিষয়টি ইসলামী শরীয়তে কীভাবে দেখা হয়? জনসাধারণের আক্রোশ মেটানোর নূন্যতম এই পদ্ধতিটি জায়েজ বলে বিবেচিত হবে?

– নুরুদ্দীন তাসলিম।

দক্ষিণ বনশ্রী,  ঢাকা।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

আপনি যে শব্দে বুখারীর রেফারেন্সে হাদীসের কথা বলছেন, উপরোক্ত শব্দের কোন হাদীস বুখারীতে আছে বলে আমাদের জানা নেই।

তবে সম্ভবত বুখারীতে বর্ণিত একটি হাদীসের মর্মার্থ হিসেবে উপরোক্ত কথাটি ছড়ানো হচ্ছে। সেটি হলো:

أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ يَقُولُ مَرُّوا بِجَنَازَةٍ فَأَثْنَوْا عَلَيْهَا خَيْرًا فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم وَجَبَتْ ثُمَّ مَرُّوا بِأُخْرَى فَأَثْنَوْا عَلَيْهَا شَرًّا فَقَالَ وَجَبَتْ فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ مَا وَجَبَتْ قَالَ هَذَا أَثْنَيْتُمْ عَلَيْهِ خَيْرًا فَوَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ وَهَذَا أَثْنَيْتُمْ عَلَيْهِ شَرًّا فَوَجَبَتْ لَهُ النَّارُ أَنْتُمْ شُهَدَاءُ اللهِ فِي الأَرْضِ

আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, কিছু সংখ্যক সাহাবী একটি জানাযার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাঁরা তার প্রশংসা করলেন। তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ “ওয়াজিব হয়ে গেল”। একটু পরে অপর একটি জানাযা অতিক্রম করলেন। তখন তাঁরা তার নিন্দাসূচক মন্তব্য করলেন। (এবারও) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ “ওয়াজিব হয়ে গেলে”।

তখন ‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) আরয করলেন, (হে আল্লাহর রাসূল!) “কী ওয়াজিব হয়ে গেল?” তিনি বললেনঃ “এ (প্রথম) ব্যক্তি সম্পর্কে তোমরা উত্তম মন্তব্য করলে, তাই তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেল। আর এ (দ্বিতীয়) ব্যক্তি সম্পর্কে তোমরা নিন্দাসূচক মন্তব্য করায় তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেল। তোমরা তো পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১৩৬৭]

 

যেহেতু উক্ত হাদীসে খারাপ ব্যক্তি সম্পর্কে তার নিন্দা করা হয়েছে, তাই বলা হয়েছে তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব। আর ভালো ব্যক্তি সম্পর্কে ভালো মন্তব্য করা হয়েছে তাই বলা হয়েছে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব।

এখানে মূলত বিষয়টি এমন নয় যে, প্রশংসা ও নিন্দার কারণে উক্ত ব্যক্তিদ্বয়ের জন্য জাহান্নাম ও জান্নাত ওয়াজিব হয়েছে। বরং তাদের কৃতকর্মের দ্বারাই তাদের জান্নাত ও জাহান্নাম আবশ্যক হয়েছে।

বাকি মানুষ যেহেতু বাহ্যিক আমল ও কর্ম প্রত্যক্ষ করে থাকে, তাই সেই হিসেবে তার ব্যাপারে মন্তব্য করে থাকে যে, লোকটি ভালো ছিল নাকি খারাপ ছিল।

সুতরাং এই ধারণা করা যে, কারো মৃত্যুতে সবাই মিলে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললেই তার জন্য জাহান্নাম আবশ্যক হয়ে যাবে, এটি ভুল ধারণা। বরং তার আমল হিসেবে সে জান্নাতী ও জাহান্নামী হবে।

দ্বিতীয় যে বিষয়ে প্রশ্ন করছেন সেটির উত্তর হলো: চিহ্নিত কোন জালেম ও অত্যাচারীর মৃত্যুতে খুশি হওয়া জায়েজ আছে। সেই হিসেবে আলহামদুলিল্লাহ ও বলা যাবে।

তবে কারো ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে জালিম হওয়া প্রমাণিত না হলে সন্দেহের বশে কোন মুসলমানের মৃত্যুতে খুশি প্রকাশ করা জায়েজ হবে না।

তবে জালিম ও অত্যাচারী হওয়া নিশ্চিত হলে জায়েজ আছে।

হাদীসে ইরশাদ হচ্ছে:

عَنْ أَبِي قَتَادَةَ بْنِ رِبْعِيٍّ الأَنْصَارِيِّ أَنَّهُ كَانَ يُحَدِّثُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مُرَّ عَلَيْهِ بِجِنَازَةٍ فَقَالَ مُسْتَرِيحٌ وَمُسْتَرَاحٌ مِنْهُ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ مَا الْمُسْتَرِيحُ وَالْمُسْتَرَاحُ مِنْهُ قَالَ الْعَبْدُ الْمُؤْمِنُ يَسْتَرِيحُ مِنْ نَصَبِ الدُّنْيَا وَأَذَاهَا إِلَى رَحْمَةِ اللهِ وَالْعَبْدُ الْفَاجِرُ يَسْتَرِيحُ مِنْهُ الْعِبَادُ وَالْبِلاَدُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ

আবূ কাতাদা বিন রিবয়ী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট দিয়ে একটি জানাযা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি বললেন, সে শান্তি লাভ করেছে এবং লোকেরাও তার, নিকট থেকে শান্তি পেয়েছে। তারা (সাহাবীগণ) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এর অর্থ কি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মুমিন বান্দা দুনিয়ার দুঃখ ও কষ্ট থেকে স্বস্তি লাভ করে এবং পাপী বান্দার মন্দ হতে আল্লাহর বান্দা, গাছ পালা ও জীবজন্তু স্বস্তি পায়। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৬৫১২, ইফাবা-২০৭৩]

সুতরাং উপরোক্ত হাদীস দ্বারা জালেমের মৃত্যুতে মুমিন বান্দার শান্তিলাভের কথা বলা হয়েছে। আর শান্তি ও খুশির খবরে আলহামদুলিল্লাহ বলাতে সমস্যা নেই।

قال النووي – رحمه الله – 
معنى الحديث : أن الموتى قسمان : مستريح ومستراح منه ، ونصب الدنيا : تعبها ، وأما استراحة العباد من الفاجر معناه : اندفاع أذاه عنهم ، وأذاه يكون من وجوه ، منها : ظلمه لهم ، ومنها : ارتكابه للمنكرات فإن أنكروها قاسوا مشقة من ذلك ، وربما نالهم ضرره ، وإن سكتوا عنه أثموا واستراحة الدواب منه كذلك لأنه كان يؤذيها ويضربها ويحملها ما لا تطيقه ويجيعها في بعض الأوقات وغير ذلك واستراحة البلاد والشجر : فقيل : لأنها تمنع القطر بمصيبته قاله الداودي وقال الباجي لأنه يغصبها ويمنعها حقها من الشرب وغيره( شرح مسلم –  7 / 20 ، 21) 

قال الخلاَّل – رحمه الله
قيل لأبي عبد الله – أي : الإمام أحمد بن حنبل – : الرجل يفرح بما ينزل بأصحاب ابن أبي دؤاد ، عليه في ذلك إثم ؟ قال : ومن لا يفرح بهذا؟ (السنَّة – 5 / 121 )

قال ابن كثير – رحمه الله – فيمن توفي سنة 568 هـ 
الحسن بن صافي بن بزدن التركي ، كان من أكابر أمراء بغداد المتحكمين في الدولة ، ولكنه كان رافضيّاً خبيثاً متعصباً للروافض ، وكانوا في خفارته وجاهه ، حتى أراح الله المسلمين منه في هذه السنَة في ذي الحجة منها ، ودفن بداره ، ثم نقل إلى مقابر قريش ، فلله الحمد  والمنَّة وحين مات فرح أهل السنة بموته فرحاً شديداً ، وأظهروا الشكر لله ، فلا تجد أحداً منهم إلا يحمد الله .( البداية والنهاية- 12 / 338) 

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

প্রধান মুফতী: জামিয়াতুস সুন্নাহ লালবাগ, ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ইসলামিয়া দারুল হক লালবাগ ঢাকা।

পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।

শাইখুল হাদীস: জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, সনমানিয়া, কাপাসিয়া, গাজীপুর।

ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com 

আরও জানুন

স্বপ্নে পায়ুপথে সহবাস করতে দেখার ব্যাখ্যা কী?

প্রশ্ন আস্সালামুআলাইকুম শাইখ। আমার নাম উদয় খান। আমি ঢাকা থেকে বলছি। আমি গতকাল রাতে স্বপ্নে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *