প্রচ্ছদ / তালাক/ডিভোর্স/হুরমত / তালাকের ক্ষেত্রে ‘ডিভোর্স দিলাম’ শব্দটি কি ‘ছরীহ’ নাকি ‘কেনায়ী’?

তালাকের ক্ষেত্রে ‘ডিভোর্স দিলাম’ শব্দটি কি ‘ছরীহ’ নাকি ‘কেনায়ী’?

প্রশ্ন

স্বামীর বয়ান:

ঘটনাটা ২০১৭ সালের। ইসলামী মাসলা মাসায়েল সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারনা ছিল না। শুধু এতটুকু আমার ধারণা ছিল (লোকমুখে শোনা কথা) একসাথে তিন তালাক দিলে সেটা এক তালাক হয় এবং তালাকে বাইয়েনা না বলা পর্যন্ত তালাক পতিত হয় না। আমার স্ত্রীর সাথে আমার ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি তাকে বলি যে, আমি তোমাকে ঠান্ডা মাথায় ডিভোর্স দিলাম, ডিভোর্স দিলাম, ডিভোর্স দিলাম। এই শব্দগুলো আমি বলেছিলাম আমার উপরোক্ত ধারণা থেকে এবং তাকে ভয় বা সতর্ক করার উদ্দেশ্যে (যেহেতু আমার ধারণা ছিল যে, একসাথে তিনবার বললে একবার হয়)। এখন হুজুরের নিকট আমার জিজ্ঞাসা: এতে কি আমার স্ত্রীর ওপর এক তালাক পতিত হবে নাকি তিন তালাক পতিত হবে?

স্ত্রীর বয়ান:

আমার স্বামীর প্রতি আমার সব সময় ভালোবাসা ছিল।

কিন্তু কিছু বিষয়ে সে আমার হক আদায় করেনি। আমার সাথে মাঝে মাঝে খারাপ আচরণ করেছে। তাই হঠাৎ করে আমার পরিবর্তন হয়ে যায়। তখন আমি ডিসিশন নেই যে, তাকে আমি ডিভোর্স দিবো। আমি যখন ডিভোর্স দেই তখন আমার চিন্তা ছিল আমি আর কখনোই ফিরবো না। কিন্তু যেহেতু তাকে সব সময় ভালোবাসতাম সে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং আমার পরিবারের বোঝানোর ফলে আমার মন পরিবর্তন হয়। ডিভোর্স কার্যকর হওয়ার আগেই আমি আমার ডিভোর্স উঠিয়ে নেই।

ডিভোর্স পেপারে যা লেখা ছিল আমি হুবহু তা এখানে লিখে দিলাম:

আমি ধীরে স্থিরভঅবে চিন্তা করিয়া দেখিলাম যে, তাহার সহিত আমার দাম্পত্য জীবন কোনদিনই সুখের হইবে না। আমার নিরাপত্তা ও সুখ শান্তির জন্যই তাহার সহিত আমার বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করা অতি আবশ্যক। আমি মুসলিম আইনের বিধান মোতাবেক নিজ নফসের উপর তালাক তাওফিজ নিয়া বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছি। অদ্য হইতে সে আমার স্বামী নয়, আমিও তাহার স্ত্রী নহে। স্বামী হিসাবে কেউ কারো উপর কোন দাবি দাওয়া উ্তথাপন করিতে পারিবো না। উল্লেখ্য যে, কাজী অফিসের মাধ্যমে তালাক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।

কাবিননামার ১৮ নং কলামের (১৮ নাম্বার কলামে ছিল, দাম্পত্য ধর্ম পালন না করিয়ে বা বনিবনা না হলে আমি তালাক দিতে পারবো) স্বামীর দেওয়া তাফউজের ক্ষমতা বলে আমি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে সুস্থ্য মস্তিস্কে অন্যের বিনা প্ররোচনায় নিজেই নিজ নফসের উপর তালাকে তপউইজ গ্রহণ করে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করলাম।

১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইনের ৮নং অর্ডিন্যান্সের ৭ ধারার এক উপধারা মতে করা হল।

ডিভোর্স পেপারে কোথাও কোন তালাকের সংখ্যা উল্লেখ করা ছিল না।

বিনীত

নাম উহ্য রাখা হলো।

সিরাজগঞ্জ, (ঢাকা)

বাংলাদেশ।

পশ্চিম বাংলা ভারতের আল্লামা রুহুল আমীন স্মৃতি জামিয়ার পক্ষ থেকে উত্তর:

“স্বামীর বর্ণনা অনুযায়ী স্বামী তাহার স্ত্রীর উপর তিনবার “ডিভোর্স” শব্দ ব্যবহার করিয়াছে। ‘ডিভোর্স শব্দটি তালাকের জন্য (صريح) শব্দ নহে। বরং ‘ডিভোর্স’ শব্দটি কেনায়া তথা তালাকের প্রতি ইঙ্গিতসূচক একটি শব্দ।…………… এরূপ শব্দ কেহ স্ত্রীর উপর ব্যবহার করিলে তাহার হুকুম এইরুপ হয় যে, এক তালাকের নিয়তে বলিলে এক তালাকে বায়েন আর তিন তালাকের নিয়তে বলিলে তিন তালাকে বায়েন হয়।

আর কোন নিয়ত নেই অথচ স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া কিম্বা রাগ-দ্বেষের পরিস্থিতিতে ঐরুপ শব্দ ব্যবহার করিলে তাহাতেও ‘এক তালাকে বায়েন’ পতিত হয়’।

উল্লেখ্য বর্ণিত বিষয়ে স্বামী স্ত্রীর ভিতরে ঝগড়ার মাধ্যমে ডিভোর্স শব্দ তিনবার ব্যবহার করিয়াছে। প্রথমবার বলাতেই এক তালাকে বায়েন পতিত হইয়াছে। বাকী দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার বলা অনর্থক হইয়াছে।………………………………।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

স্বামীর বিবরণ অনুপাতে স্ত্রীর উপর তিন তালাকে মুগাল্লাজা পতিত হয়ে স্ত্রী স্বামীর জন্য হারাম হয়ে গেছে।

‘ডিভোর্স’ শব্দটি আরবী তালাক শব্দেরই অনুবাদ। এটা صريح তথা তালাকের ক্ষেত্রে পরিস্কার শব্দ। যারা এটা পরিস্কার শব্দ নয় বলেন, তাদের বক্তব্যটি সঠিক নয়।

কারণ, ছরীহ তালাক ঐ শব্দকে বলা হয়, যে শব্দটি শুধুমাত্র তালাকের জন্যই ব্যবহার করা হয়। আর ‘ডিভোর্স’ শব্দটি যদিও ইংরেজী শব্দ। কিন্তু তা আমাদের বাংলাদেশে কেবল তালাকের জন্যই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অন্য কিছুর জন্য ব্যবহার করা হয় না। সুতরাং এটি صريح তথা পরিস্কার তালাকের শব্দ। এটাকে কেনায়ী তালাকের শব্দ বলার কোন সুযোগই নেই।

ছরীহ তালাকের ক্ষেত্রে তালাকের নিয়ত প্রয়োজন হয় না, এমনিতেই তালাক পতিত হয়ে যায়। সেই হিসেবে তিন তালাকই পতিত হয়ে গেছে।

পশ্চিম বাংলা ভারতের উক্ত জামিয়ার ফতোয়া সম্পূর্ণ ভুল। এর উপর আমল করার কোন সুযোগ নেই।

 

وقد مر أن الصريح مالم يستعمل إلا فى الطلاق من أى لغة كانت (رد المحتار، زكريا-4/530، كرتاشى-3/299)

صريحة مالم يستعمل إلا فيه، ولو بالفارسية، فمالا يستعمل فيها إلا فى الطلاق، فهو صريح يقع بلا نية (رد المحتار، زكريا-4/457، كرتاشى-3/247)

وقد مر أن الصريح ما غلب فى العرف استعماله فى الطلاق بحيث لا يستعمل عرفا إلا فيه من أى لغة كانت، وهذا فى عرف زماننا كذلك، فوجب اعتباره صريحا (رد المحتار، زكريا-4/464، كرتاشى-3/252)

أما الصريح: فهو اللفظ الذى لا يستعمل إلا فى حل قيد النكاح (بدائع الصنائع، زكريا-3/161)

وصريح الطلاق ما استعمل اللفظ له ولا يستعمل فى غيره (الفتاوى التاتارخانية-4/400، رقم-6522)

فإن ما غلب استعماله فى معنى بحيث يتبادر حقيقة أو مجازا صريح (فتح القدير، بيروت-4/3، البحر الرائق، زكريا-3/437، كرتاشى-3/251)

إذا قال الرجل لامرأته: بهشتم ترا أز زنى فاعلم بأن هذه اللفظة استعملها أهل خرسان، وأهل العراق فى الطلاق، وأنها صريحة عند أبى يوسف حتى لو كان الوقع بها رجعيا ويقع بدون النية (الفتاوى الهندية-1/379، جديد-1/447)

إذا قال الرجل لامرأته: بهشتم ترا أز زنى فاعلم أن هذه اللفظة استعملها أهل خرسان وأهل العراق فى الطلاق، وأنه صريحة عند أبى يوسف، كان الواقع بها رجعيا، ويقع بدون النية، وفى الخلاصة: وبه أخذ الفقيه أو الليث، وفى التفريد: وعليه الفتوى (الفتاوى التاتارخانية-4/463، رقم-6678)

سرحتك وهو “رها كردم” لأنه صار صريحا فى العرف على ما صرح به نجم الزاهدى الخورزمى فى شرح القدورى (رد المحتار، زكريا-4/530، كرتاشى-3/299)

 

যেহেতু তিন তালাক পতিত হবার কারণে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। তাই ইদ্দত শেষে যদি অন্যত্র বিয়ে হয়। সেখানে স্বাভাবিক ঘর সংসার করতে থাকে। কোন কারণে দ্বিতীয় স্বামী মারা যায়, বা তালাক দেয়, তাহলে ইদ্দত শেষে আবার প্রথম স্বামী বিয়ে করতে পারবে। এছাড়া উক্ত স্ত্রীর সাথে ঘরসংসার করার কোন পদ্ধতি নেই।

 

فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِن بَعْدُ حَتَّىٰ تَنكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ ۗ فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَن يَتَرَاجَعَا إِن ظَنَّا أَن يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ ۗ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ سورة [البعرة٢:٢٣٠ [وقال الليث عن نافع كان ابن عمر إذا سئل عمن طلق ثلاثا قال لو طلقت مرة أو مرتين فأن النبي صلى الله عليه و سلم أمرني بهذا فإن طلقتها ثلاثا حرمت حتى تنكح زوجا غيرك (صحيح البخارى-2/792، 2/803)

عن مجاهد قال كنت عند ابن عباس فجاء رجل فقال إنه طلق امرأته ثلاثا. قال فسكت حتى ظننت أنه رادها إليه ثم قال ينطلق أحدكم فيركب الحموقة ثم يقول يا ابن عباس يا ابن عباس وإن الله قال (وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا) وإنك لم تتق الله فلم أجد لك مخرجا عصيت ربك وبانت منك امرأتك (سنن أبى داود-1/299، رقم-2199، سنن الكبرى للبيهقى، رقم-14720، سنن دار قطنى، رقم-143)

عن عائشة رضى الله عنها قاتل: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: اذا طلق الرجل امرأته ثلاثا لم تحل له حتى تنكح زوجا غيره، ويذوق كل واحد منهما عسليلة صاحبه (سنن الدار قطنى، كتاب الطلاق، دار الكتب العلمية-4\21، رقم-3932)

وإن كان الطلاق ثلاثا فى الحرة، وثنتين فى الأمة لم تحل له حتى تنكح زوجا غيره نكاحا صحيحا ويدخل بها، ثم يطلقها، أو يموت عنها (الفتاوى الهندية-1\478، جديد-1\535)

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।

ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com 

আরও জানুন

গুগল দেখে নামাজের সময় নির্ধারণ করা যাবে কী? ইচ্ছেকৃত নামাজ দেরিতে পড়া বড় গুনাহ?

প্রশ্ন: ১- Google গুগল থেকে নামাজের সময় সূচির জানা ও তার উপর আমল করা কতটা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস