প্রচ্ছদ / খিলাফত/ইসলামী রাষ্ট্রনীতি / দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদঃ কী বলে ইসলাম?

দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদঃ কী বলে ইসলাম?

প্রশ্ন

From: আবুবকর মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ
বিষয়ঃ শরীয়তের আলোকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ

প্রশ্নঃ
আসসালামু আলাইকুম। জনাব, আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই। আমি আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে কয়েকদিন আগে শুনেছি যে, ইসলাম ধর্মে নাকি দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি হারাম করা হয়েছে। বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর। এবিষয়ে কুরআন ও হাদিস থেকে উত্তর দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো। ধন্যবাদ।

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

এখানে প্রসঙ্গ দু’টি। একটি হলো দেশপ্রেম। আরেকটি হলো জাতীয়তাবাদ।

দু’টি বিষয়ের হুকুম ভিন্ন ভিন্ন।

দেশপ্রেম

নিজের মাতৃভূমিকে মোহাব্বত করা। ভালোবাসা এটা একটি প্রাকৃতিক বিষয়। স্রষ্টাকর্তৃক একটি স্বাভাবিক মনোবৃত্তি।

এটা হারাম নয়। বরং জায়েজ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম স্বীয় মাতৃভূমি মক্কাকে মোহাব্বত করতেন।

যখন হিজরত করে মক্কা থেকে মদীনা রওনা হোন, তখন মক্কাকে উদ্দেশ্য করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:


ما أطيبَكِ مِن بلدةٍ وأحَبَّك إليَّ، ولولا أنَّ قومي أخرَجوني منكِ ما سكَنْتُ غيرَكِ. (صحيح ابن حبان عن عبد الله بن عباس، الصفحة أو الرقم: 3709)

মক্কা! তুমি কতোইনা পবিত্র শহর। আমার প্রিয় শহর। আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা যদি আমাকে তাড়িয়ে না দিতো, তাহলে আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কোথাও থাকতাম না। [সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৩৭০৯)

মক্কা থেকে হিজরত করে যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা নিজের বাসস্থান বানালেন। তখন মদীনার বিষয়ে দুআ করতেন:

اللَّهمَّ حبِّبْ إلينا المدينةَ كما حبَّبْتَ إلينا مكَّةَ وأشَد (صحيح ابن حبان عن عائشة، الصفحة أو الرقم: 5600)

হে আল্লাহ! আমার কাছে মক্কা যতোটা প্রিয় ছিল, এর চেয়ে বেশি প্রিয় আমার কাছে মদীনাকে বানিয়ে দাও। [সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৬০০]

মদীনা নিজের দেশ বানানোর পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনি মদীনার বাহির থেকে মদীনার দিকে ফিরে আসতেন। তখন নবীজী কী করতেন? এক হাদীসে আসছে:

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا قَدِمَ مِنْ سَفَرٍ، فَأَبْصَرَ دَرَجَاتِ المَدِينَةِ، أَوْضَعَ نَاقَتَهُ، وَإِنْ كَانَتْ دَابَّةً حَرَّكَهَا. قَالَ أَبُوعَبْدِاللَّهِ: زَادَ الحَارِثُ بْنُ عُمَيْرٍ، عَنْ حُمَيْدٍ: حَرَّكَهَا مِنْ حُبِّهَا.

হুমায়দ (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি আনাস (রাঃ) কে বলতে শুনেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফর থেকে ফিরে যখন মদিনার উঁচু রাস্তাগুলো দেখতেন তখন তিনি তাঁর উটনীকে মদীনার মোহাব্বাতে দ্রুতগতিতে চালাতেন তার বাহন অন্য জানোয়ার হলে তিনি তাকে তাড়া দিতেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১৮০২, ইফাবা-১৬৮৫]

উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ বলেন:

وَفِي الْحَدِيثِ دِلَالَةٌ عَلَى فَضْلِ الْمَدِينَةِ وَعَلَى مَشْرُوعِيَّة حب الوطن والحنين إِلَيْهِ

উক্ত হাদীস মদীনার ফযীলতের সাথে সাথে স্বীয় দেশকে মোহাব্বত করা ও তার প্রতি টান অনুভব করার বৈধতার প্রমাণও বহন করে। [ফাতহুল বারী-৩/৬২১, বর্ণনা নং-১৮০২]

উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইবনে বাত্তাল রহঃ লিখেন:

قوله: (من حبها) يعنى لأنها وطنه، وفيها أهله وولده الذين هم أحب الناس إليه، وقد جبل الله النفوس على حب الأوطان والحنين إليها، وفعل ذلك عليه السلام، وفيه أكرم الأسوة، وأمر أمته سرعة الرجوع إلى أهلهم عند انقضاء أسفارهم

মদীনার মোহাব্বতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সওয়ারী দ্রুতগামী করার কারণ হলো, কেননা, এটি তাঁর দেশ। এতে তার পরিবার পরিজনগণ ছিলেন। যারা লোকদের মাঝে তাঁর কাছে সর্বাধিক প্রিয় ছিল। স্বীয় দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং আন্তরিক টান অনুভব করা আল্লাহ তাআলা স্বভাবজাত বানিয়েছেন। যেমনটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও করেছেন। যাতে আমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রয়োজনীয় সফর শেষ হবার পর স্বীয় পরিবারের কাছে দ্রুত ফিরে আসার আদেশ করেছেন। [শরহে সহীহ বুখারী লিইবনে বাত্তাল-৪/৪৫৩, বর্ণনা নং-২২৩]

সুতরাং বুঝা গেল যে, নিজের মাতৃভূমি বা স্বীয় দেশকে মোহাব্বত করা, ভালোবাসা, তার প্রতি আন্তরিক টান অনুভব করা এটা হারাম বা নাজায়েজ নয়। বরং এটি একটি বৈধ বিষয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের একটি স্বভাবজতা আচরণ। এটাকে হারাম বলার কোন সুযোগ নেই।

জাতীয়তাবাদ

স্বীয় জাতি বা গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়ের প্রতি কট্টর মনোবৃত্তি লালন করার নামই মূলত জাতীয়তাবাদ। চাই তারা ভালো হোক বা মন্দ। সঠিক হোক বা ভুল, সর্বাবস্থায় স্বীয় জাতি, গোষ্ঠি ও সম্প্রদায়ের অন্ধ অনুকরণ ও প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টাকে মূলত জাতীয়তাবাদ বলা হয়। এটাকে কট্টর গোত্রপ্রীতি বা গোষ্টিপ্রীতি বললেও যথার্থ বলা হবে।

সঠিক ও হেদায়েতের উপর থাকা জাতির প্রতি কট্টর সমর্থনতো ঠিক আছে। কিন্তু শুধুমাত্র স্বীয় জাতির হবার কারণে তার প্রতি অন্যায় সাপোর্ট করার জাতীয়তা ‘জাহিলিয়্যাত’ বা বর্বরতা বলে হাদীসে ইরশাদ হয়েছে। তবে স্বীয় জাতির সঠিক ও ন্যায্য দাবীর স্বপক্ষে অবস্থান নেয়াতে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। অন্যায্য ও অন্যায় বিষয়ে শুধু নিজ জাতি হবার কারণে জাতীয়তাবাদের স্লোগান দিয়ে একত্র হওয়া এটা জাহেলী যুগের বর্বর মানসিকতা।

তাই এহেন জাতীয়তাবাদ ইসলাম বহির্ভূত এবং হারাম।

عَنْ جُنْدَبِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ الْبَجَلِيِّ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ مَنْ قُتِلَ تَحْتَ رَايَةٍ عُمِّيَّةٍ يَدْعُو عَصَبِيَّةً أَوْ يَنْصُرُ عَصَبِيَّةً فَقِتْلَةٌ جَاهِلِيَّةٌ

জুনদব ইবনু আবদুল্লাহ বাজালী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি লক্ষ্যহীন নেতৃত্বের পতাকাতলে যুদ্ধ করে, গোত্র প্রীতির দিকে আহবান জানায় এবং গোত্রপ্রীতির কারণেই সাহায্য করে তার মৃত্যু জাহেলিয়াতের মৃত্যু। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৪৬৩৯]

عَنْ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: لَيْسَ مِنَّا مَنْ دَعَا إِلَى عَصَبِيَّةٍ، وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ قَاتَلَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ، وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ مَاتَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ

জুবায়র ইবনু মুত্ব‘ইম (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি গোত্রপ্রীতির দিকে ডাকে আমার দলভুক্ত নয়। আর ঐ ব্যক্তিও আমাদের দলভুক্ত নয় যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যুদ্ধ করে এবং সেও নয় যে জাতীয়তাবাদ বা পক্ষপাতদুষ্ট গোত্রপ্রীতির উপর মারা যায়। [সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং-৫১২১, ইফাবা-৫০৩৩]

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ خَرَجَ مِنْ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً وَمَنْ خَرَجَ عَلَى أُمَّتِي يَضْرِبُ بَرَّهَا وَفَاجِرَهَا لَا يَتَحَاشَى مِنْ مُؤْمِنِهَا وَلَا يَفِي لِذِي عَهْدِهَا فَلَيْسَ مِنِّي وَمَنْ قَاتَلَ تَحْتَ رَايَةٍ عُمِّيَّةٍ يَدْعُو إِلَى عَصَبِيَّةٍ أَوْ يَغْضَبُ لِعَصَبِيَّةٍ فَقُتِلَ فَقِتْلَةٌ جَاهِلِيَّةٌ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি নেতার আনুগত্য হতে বের হয়ে যায় এবং মুসলিমদের দল ত্যাগ করে, আর এই অবস্থায় মারা যায়, তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু। যে ব্যক্তি আমার উম্মতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হয়ে ভাল-মন্দ নির্বিচারে হত্যা করে এবং মুসলিমকেও ছাড়ে না; আর যার সাথে যে অঙ্গীকারাবদ্ধ, তার অঙ্গীকার রক্ষা করে না, তার সাথে আমার কোন সম্বন্ধ থাকবে না। আর যে ব্যক্তি পথভ্রষ্টতা এবং অজ্ঞতার পতাকাতলে যুদ্ধ করে, আর লোকদেরকে জাতীয়তাবাদের দিকে আহ্বান করে এবং তার ক্রোধ জাতীয়তাবাদের জন্যই হয়, পরে সে নিহত হয়; তার মৃত্যু জাহিলিয়াতের মৃত্যু হবে। [সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং-৪১১৫]

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।

ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com 

আরও জানুন

কুয়েতে প্যাকেটজাত গোস্ত খাওয়ার হুকুম কী?

প্রশ্ন আসসালামু আলাইকুম। আমি বর্তমানে কুয়েতে থাকি। আমার প্রশ্ন হলো এখানকার মার্কেটে যে সমস্ত প্যাকেটিং …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস