প্রশ্ন
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু
বিতর সালাত তো তিন রাকাত।আর হানাফী মাযহাব মতেও এটা তিন রাকাত।কিন্তু আহলে হাদিসরা বলতেছে যে বিতর ১ রাকাত ও আছে আর তারা এই হাদিস গুলা দেয়।
১) নবী(স:) রাতের তাহাজ্জুদের নামায দুই দুই রাকাত করে আদায় করতেন এবং ১ রাকাত বিতর পড়তেন। [বুখারী -৯৩৬]
২) আবদুল্লাহ ইবনে উমর(রা:) থেকে বর্ণিত, রাতের নামায দু’ দু’ রাকাত করে। আর যখন তুমি নামায শেষ করতে চাইবে, তখন ১ রাকাত বিতর পড়বে। এতে তোমার আদায়কৃত নামাযে বিতরের নামাযও হয়ে যাবে। [বুখারী-৯৩৪]
৩) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাবা ইবনে সু’আইর(রা) থেকে বর্ণিত (নবী উনার মাথায় হাত বুলায়ে দিয়েছিলেন), ‘তিনি সাদ বিন আবিওয়াক্কাসকে বিতরের নামায ১ রাকাত পড়তে দেখেছেন’। [বুখারী-৬৯১০,৯৩২,৯৩৫]
৪) হযরত আয়েশা থেকে বর্নিত, ‘রাসুলুল্লাহ রাতে ১১ রাকাত নামায পড়তেন। তার মধ্যে ১ রাকাত বিতর পড়তেন। নামায শেষ করে তিনি ডান পাশে ফিরে শুতেন। অত:পর ভোরে আজান হলে, তিনি উঠে,সংক্ষিপ্ত ২ রাকাত (ফজরের সুন্নাত) নামায পড়তেন’। [মুসলিম- ১৫৯৪, ১৫৯৫, ১৬০৪, ১৬২৫,১৬২৬, ১৬২৭, ১৬২৮, ১৬৩৪-১৬৪০]
৫) হযরত ইবনে উমর বলেন, ‘নবী বলেছেন, রাতের নামায(নফল) পড়বে ২ রাকাত করে। আর বিতরের নামায হলো ১ রাকাত। [নাসা্য়ী- ১৬৯৪, ১৬৬৮-১৬৭৫,১৬৯০-৯৩,১৬৯৫-৯৭]
এখন তাদের কি বলবো?কিছু বুঝতে পারছি না।
এগুলো কি সহিহ?
আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন।উত্তর টা তাড়াতাড়ি দিবেন শায়েখ।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
বিতর নামায মূলত তিন রাকাত। দুই রাকাত পড়ে বৈঠক করতে হবে। তারপর উঠে আরো এক রাকাত মিলিয়ে বিতর বা বেজোড় করতে হবে। এভাবে পড়াটাই বিশুদ্ধ বিতর নামায।
এক মিলানো ছাড়া যেহেতু বিতর বা বেজোড় হয় না। তাই হাদীসসমূহে এক রাকাতকে বিতর বলা হয়েছে। কারণ, এক রাকাতের মাধ্যমে বিতর বা বেজোড় পূর্ণতা পায়।
শুধু বিতর নামায পড়া উত্তম নয়। বরং আগে নফল নামায পড়া উত্তম। একাধিক হাদীসের মাঝে দুই দুই রাকাত করে নফল পড়ে, অবশেষে দুই রাকাতের সাথে এক রাকাত মিলিয়ে বিতর পূর্ণ করতে বলা হয়েছে। এসব বর্ণনা এক রাকাত বিতরের দলীল নয়। বরং তিন রাকাত বিতরেরই দলীল।
তিন রাকাত বিতর ও প্রশ্নে উল্লেখিত এক রাকাতকে বিতর বলা বর্ণনাগুলোর মাঝে মূলত কোনো বিরোধ নেই এবং তা বিতরের বিভিন্ন পদ্ধতিও নির্দেশ করে না। এগুলি নিছক বর্ণনার পার্থক্য।
এসব বর্ণনা দ্বারা দু’টি কথা বুঝে আসে। তা হলো:
এক
প্রতি দুই রাকাতের পর বসা।
দুই
দুই রাকাতের সাথে অতিরিক্ত এক রাকাত মিলিয়ে নামাযকে বিতর (বেজোড়) বানানো।
প্রথম কথাটি বলা হয়েছে বিতরের আগের তাহাজ্জুদ সম্পর্কে।
আর দ্বিতীয় কথাটি বলা হয়েছে বিতর সম্পর্কে।
অতএব বিতর শুধু এক রাকাত পড়তেন তা উদ্দেশ্য নয়;বরং উদ্দেশ্য হল,নবম ও দশম রাকাতের সাথে আরো এক রাকাত মিলিয়ে বিতর (বেজোড়) করতেন। তথা দুই রাকাত পড়ে বৈঠক করে তার সাথে তৃতীয় রাকাত মিলিয়ে নামাযটিকে বিতর বা বেজোড় বানানো।
বিতর-নামায এক রাকাত হওয়ার ধারণা কারো চিন্তায় পূর্ব থেকে বদ্ধমূল না থাকলে বর্ণনার পূর্বাপর থেকে এই ব্যাখ্যা খুব সহজেই বুঝে আসার কথা। এ ব্যাখ্যার সপক্ষে দুটি শক্তিশালী আলামত রয়েছে :
আলামত নং-১
হযরত আয়েশা রা. থেকে মুতাওয়াতির রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাকাত বিতর পড়তেন। এবং স্বয়ং আয়েশা রা.-এর ফতোয়াও বর্ণিত হয়েছে যে, বিতর শুধু তিন রাকাত পড়া উচিত নয়; এর পূর্বে দুই রাকাত বা চার রাকাত (নামায) অবশ্যই পড়া উচিত।
মোটকথা, যখন উম্মুল মু’মিনীন থেকে অন্যান্য রাবীর সহীহ রেওয়ায়েতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিন রাকাত বিতর পড়ার কথা আছে তখন উরওয়া রাহ.-এর রেওয়ায়েত থেকে শুধু শব্দগত পার্থক্যের কারণে বিপরীত অর্থ গ্রহণ করা উচিত নয়।
দ্বিতীয় আলামত এই যে, বিতর সম্পর্কে স্বয়ং উরওয়া রাহ.-এর ফতোয়া হল, الوتر ثلاث لا يفصل بينهن بسلام ‘বিতর তিন রাকাত এবং তা মাঝে সালাম ফিরিয়ে আলাদা করা হবে না।’
অতএব তাঁর বর্ণনায়-‘এক রাকাত দ্বারা বিতর করতেন’-এর অর্থ যদি এই হত যে,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরে এক রাকাত পড়তেন তাহলে উরওয়া কখনো তিন রাকাত বিতরের ফতোয়া দিতেন না।
অতএব উরওয়া রাহ.-এর বর্ণনার সঠিক ব্যাখ্যা তা-ই যা উম্মুল মু’মিনীন থেকে অন্যান্য রাবীর রেওয়ায়েত এবং স্বয়ং উরওয়া রাহ.-এর ফতোয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
আলামত নং-২
যে বর্ণনায় আছে,‘পাঁচ রাকাত দ্বারা বিতর করতেন এবং শুধু শেষে বসতেন।’-এর অর্থ এই নয় যে, এই পাঁচ রাকাতের মাঝে কোনো ধরনের বৈঠকই করতেন না এবং সালামও ফেরাতেন না।
কারণ স্বয়ং উরওয়া রাহ.-এর পূর্ববর্তী বর্ণনায় বলা হয়েছে, প্রতি দু’ রাকাতের মাঝে সালাম ফেরাতেন। একই বর্ণনাকারীর একই সনদে বর্ণিত হাদীসকে ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ বলে দাবি করা যুক্তিযুক্ত নয়।
এই বর্ণনার সঠিক অর্থ, যা উম্মুল মু’মিনীন রা.-এর বিবরণ এবং স্বয়ং উরওয়া রাহ.-এর ফতোয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ,এই যে,
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাতের নামায সর্বমোট তেরো রাকাত হত। এর মধ্যে ছয় রাকাতে তো কিছু সময় বিরতি দিতেন কিন্তু শেষ পাঁচ রাকাত বিরতি ছাড়া আদায় করতেন।
প্রথমে দুই রাকাত নফল এরপর তিন রাকাত বিতর। এই পাঁচ রাকাতের মাঝে বিরতি হত না; বরং পাঁচ রাকাত শেষ হওয়ার পর বিরতি দিতেন।
সারকথা এই যে,এই রেওয়ায়েতে বিতর-পূর্ব দুই রাকাতে সালাম না ফেরানো এবং বিতরের দ্বিতীয় রাকাতে না বসার কথা বলা হয়নি।
বরং দু রাকাত নফল ও তিন রাকাত বিতরের মাঝে বিরতি না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কথাটা এভাবেও বলা যায় যে,এই বর্ণনায় নামাযের বৈঠক সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি, বলা হয়েছে সালামের পর বিরতি সম্পর্কে।
অন্য একটি হাদীস থেকে এ ধরনের একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি:
‘আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যোহর-আছর এবং মাগরিব-ইশা একত্রে পড়ার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন,
صليت مع النبي صلى الله عليه وسلم ثمانيا جميعا وسبعا جميعا
‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আট রাকাত একসাথে এবং সাত রাকাত একসাথে আদায় করেছি।’ (সহীহ মুসলিম ১/২৪৬)
বলাবাহুল্য,এর অর্থ কখনো এই নয় যে, যোহর-আসরের আট রাকাত এবং মাগরিব-ইশার সাত রাকাত এক সালাম ও এক বৈঠকে আদায় করেছেন।
বরং উদ্দেশ্য হল, সাধারণ অবস্থায় যোহর ও আসরের মাঝে এবং মাগরিব ও ইশার মাঝে যে বিরতি হয়ে থাকে তা দেননি। যোহর শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আসর এবং মাগরিব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইশার নামায আদায় করেছেন।
একই কথা বিতরের উপরোক্ত বর্ণনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
পাঁচ রাকাতের শুধু শেষ রাকাতে বসতেন বলে নামায শেষের বিরতি বোঝানো হয়েছে,সালাম বা নামাযের বেঠক বোঝানো হয়নি।
উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. থেকে আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান,‘আমরা বিনতে আবদুর রহমান,আবদুল্লাহ ইবনে আবী কায়স এবং আবদুল আযীয ইবনে জুরাইজও বিতরের হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনায় তিন রাকাত বিতরের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
তদ্রূপ আসওয়াদ ইবনে কায়স,মাসরূক ইবনুল আজদা’ ও ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার রাহ.ও বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনায় তিন রাকাতের কথা স্পষ্টভাবে না থাকলেও অন্য বর্ণনার সাথে মিলিয়ে পাঠ করলে তিন রাকাতই প্রতীয়মান হয়।
মোটকথা,উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা.,যিনি সকল আহলে ইলমের মতে,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিতর সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত,তাঁর বিবরণ সকল রাবীর বর্ণনা থেকে একত্র করলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, বিতর তিন রাকাত।সা’দ ইবনে হিশাম ও উরওয়া ইবনুয যুবাইর রাহ.-এর দু’ একটি বর্ণনায় যে ভিন্নতা, তা-ও উপরোক্ত ব্যাখ্যার পর অবশিষ্ট থাকে না।উপরোক্ত বর্ণনাগুলিতে আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। তা এই যে,নবী সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম-এর তাহাজ্জুদের রাকাত কমবেশি হত,কিন্তু বিতরের রাকাত কমবেশি হত না।
সা’দ ইবনে হিশাম,মাসরূক ইবনুল আজদা’ ও ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার-এর বর্ণনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরের নামায ও আগের নামাযের পার্থক্য বর্ণনা করা হয়েছে। তাতে তাহাজ্জুদের রাকাত-সংখ্যায় পরিবর্তন হলেও বিতর সর্বাবস্থায় তিন রাকাত।
আবদুল্লাহ ইবনে আবী কায়স রাহ.-এর বর্ণনায় আছে,
سألت عائشة رضي الله عنها بكم كن رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بأربع وثلاث وست ثلاث وثمان وثلاث
আমি আয়েশা রা.কে জিজ্ঞাসা করেছি,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত রাকাত বিতর পড়তেন। উম্মুল মুমিনীন এর উত্তরে বলেছেন, ‘চার ও তিন, ছয় ও তিন এবং আট ও তিন’। (আবু দাউদ ১/১৯৩; তহাবী ১/১৩৯)
অর্থাৎ তাহাজ্জুদের রাকাত-সংখ্যা কখনো চার,কখনো ছয় এবং কখনো আট হত,কিন্তু বিতর সর্বাবস্থায় তিন রাকাতই পড়তেন।
যদি তাহাজ্জুদের মতো বিতরের রাকাত-সংখ্যা পরিবর্তন হত তাহলে উম্মুল মু’মিনীন রা. অবশ্যই তা বর্ণনা করতেন। কারণ আবদুল্লাহ ইবনে আবু কায়স বিতর সম্পর্কেই প্রশ্ন করেছিলেন।
সারকথা এই যে,তাহাজ্জুদের রাকাত-সংখ্যায় হ্রাস-বৃদ্ধি উল্লেখ করা সত্ত্বেও বিতরের রাকাত-সংখ্যা সর্বাবস্থায় তিন বলা প্রমাণ বহন করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা বিতর তিন রাকাত পড়তেন। এতে কোনো পরিবর্তন হত না।
ইবনে আব্বাস রা.-এর বিবরণ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এক রাতে তার খালা উম্মুল মু’মিনীন মায়মূনা রা.-এর নিকট শুধু এই উদ্দেশ্যে রাত্রীযাপন করেছিলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কিয়ামুল লাইল (রাতের নামায) প্রত্যক্ষ করবেন। তাঁর ঐ বিবরণও বিভিন্ন রাবীর মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে।
তাঁর রাত্রিযাপনের ঘটনা সম্পর্কে হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন,
والحاصل أن قصة مبيت ابن عباس رضي الله عنهما يغلب على الظن عدم تعددها فلهذا ينبغي الاعتناء بالجمع بين مختلف الروايات منها ولا شك أن الأخذ بما اتفق عليه الأكثر ولأحفظ أولى مما خالفهم فيه من هو دونهم ولا سيما إن زاد أو نقص
‘আমার ধারণা,আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাতের নামায দেখার জন্য) একবারই নবী-গৃহে রাত্রিযাপন করেছেন।
তাই এ বিষয়ে যেসব বর্ণনা পাওয়া যায় সেগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা উচিত। আর একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিবরণের যে অংশটুকুর উপর অধিক সংখ্যক রাবী ও অধিক নির্ভরযোগ্য রাবীগণ একমত তা গ্রহণ করাই উত্তম,বিশেষত বর্ণনার বিভিন্নতা যদি হয় হ্রাস-বৃদ্ধিমূলক। (ফাতহুল বারী ২/৩৮৮)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর উপরোক্ত ঘটনার বিবরণে তিন রাকাত বিতর একাধিক রাবীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। যথা:
১
ইবনে আব্বাস রা.-এর পুত্র আলী ইবনে আবদুল্লাহ-এর বর্ণনায় আছে,
ثم أوتر بثلاث
‘অতঃপর তিন রাকাত বিতর পড়লেন।’ (নাসায়ী ১/২৪৯; তহাবী ১/১৪০)
মূল হাদীসটি সহীহ মুসলিমেও রয়েছে। তবে ইমাম মুসলিম হাদীসটির পূর্ণ পাঠ উল্লেখ করেননি। [দেখুন : সহীহ মুসলিম ১/২৬১]
২
ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার-এর বর্ণনায় আছে,
كان يصلي من الليل ثمان ركعات ويوتر بثلاث ويصلي ركعتين قبل صلاة الفجر
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে আট রাকাত (তাহাজ্জুদ) এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। এরপর ফজরের নামাযের পূর্বে (আরো) দুই রাকাত পড়তেন। (নাসায়ী ১/১৯২; তহাবী পৃ. ১৪০)
গ)
কুরাইব (মাওলা ইবনে আব্বাস রা.)-এর বর্ণনায় আছে,
فصلى رسول الله صلى الله عليه وسلم ركعتين بعد العشاء ثم ركعتين ثم ركعتين ثم ركعتين ثم أوتر بثلاث
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশার পর দুই রাকাত নামায পড়লেন,এরপর আরো দুই রাকাত পড়লেন। এরপর আরো দুই রাকাত,এরপর আরো দুই রাকাত। এরপর তিন রাকাত বিতর পড়লেন। (তহাবী ১/১৪১)
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে কুরাইব রাহ.-এর বর্ণনা অন্যভাবে আছে। তা এই,
فصلى ركعتين ثم ركعتين ثم ركعتين ثم ركعتين ثم ركعتين ثم ركعتين ثم أوتر
‘এরপর দুই রাকাত পড়লেন। এরপর দুই রাকাত, এরপর দুই রাকাত, এরপর দুই রাকাত, এরপর দুই রাকাত, এরপর দুই রাকাত। এরপর বিতর করলেন। (বুখারী ১/১৩৫; মুসলিম ১/২৬০)
যেহেতু আলী ইবনে আবদুল্লাহ, ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার এবং কুরাইব রাহ.-এরও এক বর্ণনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, সে রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাকাত বিতর পড়েছেন, তাই সহীহাইনের রেওয়ায়েতে ছয় বার দুই রাকাত বলার পর ‘অতঃপর বিতর করলেন’ বলার অর্থ এই হবে যে, পূর্বের দু’ রাকাতের সাথে এক রাকাত যুক্ত করে নামাযকে বিতর করেছেন।মোটকথা, যখন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে একাধিক রাবীর রেওয়ায়েতে আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে রাতে তিন রাকাত বিতর পড়েছিলেন, উপরন্তু কুরাইব রাহ.-এরও এক বর্ণনায় তা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
তাই কুরাইব রাহ. এর যে বর্ণনায় দুই অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে তা থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করার অবকাশ নেই; বরং অন্যান্য বর্ণনার আলোকে তার অর্থ এই হবে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্বের দুই রাকাতের সাথে আরো এক রাকাত যোগ করে বিতর করেছেন।
অতএব এই বর্ণনা থেকে এক রাকাত বিতরের অর্থ গ্রহণ করা সঠিক নয়।
কুরাইব রাহ.-এর রেওয়ায়েতের মতো আরেকটি রেওয়ায়েত সহীহ মুসলিম (১/২৬২) ও সুনানে আবু দাউদে (১/১৯৩) যায়েদ ইবনে খালিদ জুহানী রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে।
তাতেও ছয় বার দুই রাকাতের পর বলা হয়েছে-‘অতঃপর বিতর করলেন।’
উপরে কুরাইব রাহ.-এর রেওয়ায়েতের যে অর্থ বলা হয়েছে এই রেওয়ায়েতের অর্থও তাই। অর্থাৎ পূর্বের দুই রাকাতের সাথে তৃতীয় রাকাত যোগ করে বিতর করেছেন।
এর একটি আলামত তহাবীর (১/১৪২-৩/২৬৩-২৬৪; নুখাবুল আফকার, ইউনুস আন ইবনে ওয়াহব আন মালিক সূত্রে) নিম্নোক্ত বর্ণনা, যাতে পাঁচ বার দুই রাকাতের পর বিতরের কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি এই দাঁড়াল যে, তহাবীর বর্ণনায় শেষ দুই রাকাতকে তৃতীয় রাকাতসহ বিতরের মধ্যে শামিল করা হয়েছে।
পক্ষান্তরে মুসলিম ও আবু দাউদের রেওয়ায়েতে বিতরের তিন রাকাতের মধ্যে দুই রাকাত ও এক রাকাতকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি শুধু উপস্থাপনার পার্থক্য। মূল বিতর সর্বাবস্থায় তিন রাকাত।
৪
‘আমরা বিনতে আবদুর রহমান উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণনা করেন,
عن عمرة عن عائشة رضي الله عنها أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يوتر بثلاث. يقرأ في الركعة الأولى بسبح اسم ربك الأعلى، وفي الثانية قل يا ايها الكافرون وفي الثالثة قل هو الله احد وقل اعوذ برب الفلق وقل اعوذ برب الناس. هذا حديث صحيح على شرط الشيخين ولم يخرجاه. وقال الذهبي رواه ثقات عنه،
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন। প্রথম রাকাতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকাতে সূরা ইখলাছ, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করতেন।’ (আলমুসতাদরাক আলাস সহীহাইন- ১/৩০৫)
হাদীসটি সহীহ।
সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন,
عن سعيد بن جبير عن ابن عباس رضي الله عنهما قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث يقرأ في الأولى سبح اسم ربك الأعلى وفي الثانية قل يا ايها الكافرون وفي الثالثة قل هو الله احد
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন, প্রথম রাকাতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকাতে সূরা ইখলাছ পড়তেন।’ (সুনানে দারেমী ১/৩১১, হাদীস : ১৫৯৭; সুনানে তিরমিযী ১/৬১; সুনানে নাসায়ী ১/২৪৯; সুনানে ইবনে মাজাহ পৃ. ৮৩; শরহু মাআনিল আছার তহাবী ১/১৪০; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ১/২৯৯; আল-মুহাল্লা, ইবনে হায্ম ২/৫১)
ইমাম নববী রহঃ ‘খুলাসা’ কিতাবে বলেন, بإسناد صحيح অর্থাৎ হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত। (নাসবুর রায়া ২/১১৯)
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ছাড়াও বিতরের তিন রাকাতে তিন সূরা পাঠের হাদীস যাঁরা বর্ণনা করেছেন তারা হলেন :
১- হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবযা রা.। (নাসায়ী ১/২৫১; তহাবী ১/১৪৩; ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৮; আবদুর রাযযাক ২/৩৩)
২- হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা.। (নাসায়ী ১/২৪৮; ইবনে আবী শায়বা ২/৩০০)
৩- হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রা.। (তিরমিযী ১/৬১; আবদুর রাযযাক ৩/৩৪; তহাবী ১/১৪২)
৪- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১)
৫- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১)
৬- হযরত নু’মান ইবনে বাশীর রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১)
৭- হযরত আবু হুরায়রা রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১)
৮- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১)
৯- হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন রান.। (তহাবী ১/১৪২; ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৮; মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৪১; কানযুল উম্মাল ১/১৯৬)
১০- আবু খাইছামা রা. তাঁর পিতা হযরত মুয়াবিয়া ইবনে খাদীজ রা. থেকে। (মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৪১)
এই বিষয়টি মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং দশ জনেরও অধিক সাহাবীর সূত্রে বর্ণিত।
সহীহ বুখারীতে সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ.-এর বর্ণনা এভাবে উল্লেখিত হয়েছে,
فصلى أربع ركعات ثم نام ثم قام فجئت فقمت عن يساره فجعلني عن يمينه فصلى خمس ركعات ثم صلى ركعتين
‘অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার রাকাত নামায পড়লেন এবং শয্যাগ্রহণ করলেন। এরপর (রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হওয়ার পর) শয্যাত্যাগ করলেন এবং নামাযে দণ্ডায়মান হলেন। আমি তাঁর বাম দিকে দাঁড়ালাম, তিনি আমাকে ডান দিকে দাঁড় করালেন। এরপর পাঁচ রাকাত নামায পড়লেন। এরপর দুই রাকাত (ফজরের সুন্নত) আদায় করলেন।’ [সহীহ বুখারী-১/৯৭]
এখানে কেউ বলবে না যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার রাকাত এক বৈঠক ও এক সালামে আদায় করেছেন। তদ্রূপ শেষের পাঁচ রাকাত সম্পর্কেও বলা হবে না যে, তা এক বৈঠক ও এক সালামে আদায় করা হয়েছে।
সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ.-এর পূর্বোক্ত বর্ণনার আলোকে এই রেওয়ায়েতের অর্থ এমনই করা হবে যে, দুই রাকাত নফল ও তিন রাকাত বিতর আলাদা আলাদা পড়েছেন।
আর পাঁচ রাকাতকে একত্রে উল্লেখ করার পিছনে রাবীর উদ্দেশ্য এই নয় যে, উক্ত পাঁচ রাকাতের মাঝে বৈঠক বা সালাম হয়নি; বরং উদ্দেশ্য হল দুই রাকাতের সালাম ফেরানোর পর বিরতি না দিয়ে তিন রাকাত বিতর আদায় করেছেন। অর্থাৎ যেভাবে প্রথম চার রাকাতে সালামের পর বিরতি দেননি তেমনি এই পাঁচ রাকাতেও। তিনি বিরতি দিয়েছেন চার রাকাত ও পাঁচ রাকাতের মাঝে।
সুনানে আবু দাউদের (১/১৯২) বর্ণনায় এই কথাটি এভাবে বলা হয়েছে যে,
ثم أوتر بخمس لم يجلس بينهن
‘‘এরপর তিনি পাঁচ রাকাত বিতর পড়লেন, মাঝে বসলেন না।’’ বিরতি ছাড়া আদায় করার কারণে এই পাঁচ রাকাতের সমষ্টিকে বিতর বলা হয়েছে।
হাদীস শরীফের মনোযোগী পাঠকদের অজানা নয় যে,বহু রেওয়ায়েতে বিতর-পূর্ব নফলকেও বিতর বলা হয়েছে।
সারকথা এই যে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনাকারী সকল রাবীর রেওয়ায়েত একত্র করা হলেও দেখা যায় যে,কয়েকটি রেওয়ায়েতে তিন রাকাতের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আর অন্যান্য বর্ণনাতেও তার অবকাশ রয়েছে।
এজন্য ঐসব রেওয়ায়েত থেকেও তিন রাকাতের অর্থই গ্রহণ করা হবে। এগুলোকে আলাদা আলাদা ঘটনা মনে করে বিতরের বিভিন্ন পদ্ধতি দ্বারা ব্যাখ্যা করা ঠিক নয়। কারণ এগুলো একটি ঘটনার বিভিন্ন উপস্থাপনা মাত্র।
বলাবাহুল্য যে,বর্ণনাগত পার্থক্যের কারণে একটি ঘটনা একাধিক ঘটনায় পরিণত হয় না। এ প্রসঙ্গে হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর মন্তব্য ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব এইসব রেওয়ায়েত দ্বারা বিতরের পদ্ধতিগত বিভিন্নতা প্রমাণ করা সমীচীন নয়। উপরন্তু হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর ফতোয়া হলো:
সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর বাচনিক উদ্ধৃত করেছেন যে, ‘বিতর হল সাত রাকাত বা পাঁচ রাকাত। তিন রাকাত তো পুচ্ছহীন (অসম্পূর্ণ)। আমি পুচ্ছহীন নামায পছন্দ করি না।’ (তহাবী ১/১৪১; আবদুর রাযযাক ২/২৩)
পরিস্কার বুঝা যায় যে, ইবনে আব্বাস রাঃ এর মতে বিতর শুধু তিন রাকাত পড়া উচিত নয়; সাথে দু’ চার রাকাত নফল নামাযও পড়া উচিত।’
এ থেকে প্রমাণ হয় যে, তাঁর নিকটেও মূল বিতর তিন রাকাত এবং এভাবে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পড়তে দেখেছেন।
সারকথা হলো, যেসব বর্ণনায় এক রাকাত বিতরের কথা বলা হয়েছে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, আগে দুই রাকাত পড়ে বৈঠক করে তারপর এক রাকাত মিলিয়ে বিতর তথা বিজোড় করা হবে।
আর তিন রাকাত বিতর এভাবেই পড়া হয়। যেহেতু এক রাকাত পড়া ছাড়া বিতর বা বেজোড় হয় না। এ কারণে এক রাকাতকে বিতর বলা হয়েছে হাদীসসমূহে। বিতর নামায শুধুমাত্র এক রাকাত এ ধারণাটি যথার্থ নয়।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহীহভাবে আমল করার তৌফিক দান করুন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী, নরসিংদী।
ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com
আল্লাহ আপনাকে পরিপূর্ণ জাজা খাইর দান করুন।