লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
গান
হাসান মাহমুদ লিখেন:
গানকে হারাম, অপমানিত ও নিষিদ্ধ করেছে শারিয়াপন্থীদের (সবাই নন) কেতাব, সংগঠন, শারিয়া আইন এবং কোথাও কোথাও সরকারি আইনও। গানের কুৎসিৎ কথা, কুৎসিৎ অঙ্গভঙ্গি বা গানের অতিরিক্ত নেশায় জীবনের ক্ষতি ইত্যাদির সীমা টানেননি তাঁরা,পুরো সঙ্গীতকেই বাতিল করেছেন ঢালাওভাবে। [শারিয়া কি বলে-৩১]
উত্তর
হাসান মাহমুদ সাহেব তার পুরো বইটার মাঝে শরয়ী যতগুলো বিষয় নিয়েই কথা বলেছেন, সব ক’টিতেই তার অজ্ঞতার পরিচয় পরিস্কারভাবেই দিয়েছেন। তিনি পুরো বিষয় তলিয়ে না দেখেই ঢালাওভাবে ভাসা ভাসা জ্ঞানে নিজেকে মস্ত পণ্ডিত জাহিরের হাস্যকর চেষ্টা করেছেন।
সংগীত বিষয়েও তিনি একই বিষয়ের অবতারণা করেছেন।
আসলে শরয়ী মাসআলা আগে বুঝুন। তাহলে হাসান মাহমুদ সাহেবের জাহালাত বুঝতে পারবেন। আসলে সব ধরণের গান হারাম নয়। এখানে আমি গান শব্দটাই ব্যবহার করছি। কারণ, হাসান সাহেবরা অজ্ঞতার কারণে কিংবা ইচ্ছেকৃত গান, সংগীত সব কিছুকে এক করেই বলে থাকেন।
মূলত সব ধরণের গানকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেনি। গান মৌলিকভাবে দুই প্রকার। যথা-
১ অশ্লীল গান। যেমন নোংরা কথা সমৃদ্ধ, কিংবা হারাম মদের প্রশংসা সম্বলিত ইত্যাদি।
২ শ্লীল গান। দেশাত্ববোধক, ধর্মীয় ভাবমূলক, ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ নির্ভর ইত্যাদি।
মূলত অশ্লীল গান গাওয়া হারাম। শ্লীল গান গাওয়া ও শুনতে কোন সমস্যা নেই।
এবার দ্বিতীয় বিষয় হল, বাজনা। বাজনাসহ সকল প্রকারই গানই নিষিদ্ধ।
চাই সেটা ইসলামী গান হোক, কিংবা দেশাত্ববোধক বা কিংবা অন্য কিছু।
কুরআন ও হাদীসের মাঝে যেসব গান কবিতাকে বৈধতা দেয়া হয়েছে সেটা বাজনাবিহীন সংগীত, কবিতা। আর যেসব স্থানে নিষিদ্ধতা আসছে, সেখানে উদ্দেশ্য হল, অশ্লীল বা নিষিদ্ধ গান কিংবা বাদ্যযন্ত্রসহ গান গাওয়া।
عَنْ أَبِي مَالِكٍ الْأَشْعَرِيِّ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَيَشْرَبَنَّ نَاسٌ مِنْ أُمَّتِي الْخَمْرَ، يُسَمُّونَهَا بِغَيْرِ اسْمِهَا، يُعْزَفُ عَلَى رُءُوسِهِمْ بِالْمَعَازِفِ، وَالْمُغَنِّيَاتِ، يَخْسِفُ اللَّهُ بِهِمُ الْأَرْضَ، وَيَجْعَلُ مِنْهُمُ الْقِرَدَةَ وَالْخَنَازِيرَ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেন,আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার উপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা রমনীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে যমীনে ধ্বসিয়ে দিবেন এবং তাদের কতককে বানর ও শূকরে রূপান্তরিত করবেন।-সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস : ৪০২০;সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস : ৬৭৫৮।
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّهُ قَالَ: «الدُّفُّ حَرَامٌ، وَالْكُوبَةُ حَرَامٌ، وَالْمِزْمَارُ حَرَامٌ
হযরত আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, দফ হারাম। বাদ্যযন্ত্র হারাম। মদের পেয়ালা হারাম। বাঁশী হারাম। [সুনানে সুগরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং-৩৩৫৯, সুনানে কুরবা লিলবায়হাকী, হাদীস নং-২১০০০]
قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يُمْسَخُ قَوْمٌ مِنْ أُمَّتِي فِي آخِرِ الزَّمَانِ قِرَدَةً وَخَنَازِيرَ»، قِيلَ: يَا رَسُولَ اللهِ، وَيَشْهَدُونَ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَأَنَّكَ رَسُولُ اللهِ، وَيَصُومُونَ؟ قَالَ: «نَعَمْ»، قِيلَ: فَمَا بَالُهُمْ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: «يَتَّخِذُونَ الْمَعَازِفَ وَالْقَيْنَاتِ وَالدُّفُوفَ، وَيَشْرَبُونَ الْأَشْرِبَةَ، فَبَاتُوا عَلَى شُرْبِهِمْ وَلَهْوِهِمْ، فَأَصْبَحُوا قَدْ مُسِخُوا قِرَدَةً وَخَنَازِيرَ
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, শেষ জমানায় আমার উম্মত বানর ও শুকরে রূপান্তরিত হবে। জিজ্ঞাসা করা হল, হে আল্লাহর রাসূল! তারা সাক্ষি দিবে যে, আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোন মাবুদ নাই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল এবং রোযা রাখার পরও?
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, হ্যাঁ।
বলা হল, তাদের অপরাধ কি?
বললেন, তারা বাদ্য, গায়িকা এবং দফের বাজনা গ্রহণ করবে। মদ খাবে, রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঘুমাবে। আর সকালে দেখবে তারা বানর ও শুকরে পরিণত হয়ে গেছে। [হিলয়াতুল আওলিয়া-৩/১১৯]
সুতরাং হাসান মাহমুদ সাহেবের নিম্নোক্ত বক্তব্য তার গান সম্পর্কিত শারিয়া জ্ঞান শূণ্যের কোঠায় হওয়ার সুতীব্র প্রমাণ বহন করে। তিনি লেখেন:
বিভিন্ন বিষয়ে এক রসুলের দুই বিপরীত সুন্নত দিয়ে ইসলামি কেতাবগুলো ভর্তি।
গানেরও পক্ষে-বিপক্ষে কিছু হাদিস আছে। প্রথমে বিপক্ষের তিনটি দেখাচ্ছি ঃ
– রসুল নিষিদ্ধ করিয়াছেন মদ্যপান, জুয়া ও সারিন্দা-জাতীয় বাদ্যযন্ত্র − আবু দাউদ।
– রসুল বলিয়াছেন − আমার পরোয়ারদিগার আমাকে আদেশ করিয়াছেন সকল বাদ্যযন্ত্র ও বাঁশি উচ্ছেদ করিতে − মিশকাত ৩১৮।
-রসুল বলিয়াছেন কেয়ামতের ইঙ্গিত হিসেবে গায়িকা ও বিভিন্নরকমের বাদ্যযন্ত্রের আবির্ভাব হইবে − মিশকাত ৪৭০।
আমরা সটান বলতে পারি এগুলো মিথ্যা হাদিস কিন্তু গান-হারামকারীদের কাছে আমাদের কথার গুরুত্ব কিই বা। তাই চলুন যাঁদের কথার গুরুত্ব আছে সেই শারিয়া-নেতাদের উদ্ধৃতি থেকেই প্রমাণ করি গান হারাম তো নয়ই বরং গান হারাম বলাই হারাম। তাঁরা সহি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন কিন্তু হাদিসের নম্বরগুলো দেননি। নম্বরগুলো দিচ্ছি যাতে আপনারা মিলিয়ে নিতে পারেন ঃ বুখারী ৩৯৩১, ২য় খণ্ড ৭০, ৪র্থ খণ্ড ১৫৫, ৫ম খণ্ড ৩৩৬ ; মুসলিম ৯৮২, ও মিশকাত ৬ষ্ঠ খণ্ড। [শারিয়া কি বলে-৩২]
সুতরাং বুঝা গেল যে, বাদ্যসহ গান কিংবা অশ্লীল গানের নিষিদ্ধতা আর শ্লীল ও বাদ্যযন্ত্রহীন গানকে ঘুলিয়ে একটা জগাখিচুরী পাকিয়েছেন গান পাগলা হাসান মাহমুদ।
বাদ্যযুক্ত গান জায়েজ প্রমাণের দাবী করে তিনি তার স্বপক্ষে কোন দলীল দেখাতে না পেরে নিজের চূড়ান্ত পাগলামীর পরিচয় দিয়ে ৭টি উদ্ভট দলীল পেশ করেছেন। যার কোনটি হাদীস হবেতো দূরে থাক কতগুলো আজগুবী কথাবার্তা।
১ নং যে দলীল দিয়েছেন সেখানে তার অশ্লীল গান ও বাদ্যযন্ত্রের কোন কথাই নেই।
২ নং দলীল দিলেন বসরা ছিল সংগীতের শহর।
৩ নং দলীল দিলেন কোথাকার কোন ব্যরিস্টার লিখেছেন যে, দাউদ আলাইহিস সালাম কবি ও সংগীত বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
৪ নং দলীল দিলেন আবুল কালাম আযাদ সাহেব নাকি লিখেছেন যে, দাউদ আলাইহিস সালাম উচ্চমানের বাদ্যযন্ত্র আবিস্কার করেছেন।
৫ নং দলীল দিলেন এক ওয়েব সাইটে লেখা আছে যে, দাউদ আঃ কে গান ও সংগীত শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
৬ নং দলীল দিলেন পাকিস্তানী সিনেমা “খুদা কে লিয়ে” দেখে সহীহ দলীল খুঁজে নিতে পরামর্শ দিলেন।
৭ নং দলীল দিলেন ইমাম গাজালী রহঃ লিখছেন যে, দাউদ আঃ কে সংগীতের জ্ঞান শিক্ষা দেয়া হয়েছে। [শারিয়া কি বলে-৩২]
তার এই উদ্ভট দলীল শুনে আমরা কি তাকে পাগল ঠাউড়াবো? নাকি বদ্ধ মাতাল বলবো আসলে শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।
মূল কথা হচ্ছে দাউদ আলাইহিস সালামের কণ্ঠস্বর অনেক সুমধুর ছিল। তিনি সমধুর কণ্ঠে যবুর তিলাওয়াত করতেন। এটাকে বাদ্যযন্ত্র আর অশ্লীল গানের দলীল বলা পাগলামী আর মাতলামী ছাড়া আর কী হতে পারে?
قال النووي رحمه الله في “شرح مسلم” : ” قَوْله صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي أَبِي مُوسَى الْأَشْعَرِيّ : ( أُعْطِيَ مِزْمَارًا مِنْ مَزَامِير آلِ دَاوُدَ ) قَالَ الْعُلَمَاء : الْمُرَاد بِالْمِزْمَارِ هُنَا الصَّوْت الْحَسَن , وَأَصْل الزَّمْر الْغِنَاء , وَآلُ دَاوُدَ هُوَ دَاوُدُ نَفْسه , وَآلُ فُلَان قَدْ يُطْلَق عَلَى نَفْسه , وَكَانَ دَاوُدُ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَسَن الصَّوْت جِدًّا ” انتهى .
وقال العراقي في “طرح التثريب” (3/105) : ” والمراد بالمزمار هنا : الصوت الحسن ، وأصله الآلة التي يزمر بها ، شبّه حسن صوته وحلاوة نغمته بصوت المزمار … وقد كان إليه المنتهى في حسن الصوت بالقراءة ” انتهى .
وقال الحافظ ابن حجر في “فتح الباري” : ” وَالْمُرَاد بِالْمِزْمَارِ الصَّوْت الْحَسَن , وَأَصْله الْآلَة أُطْلِقَ اِسْمه عَلَى الصَّوْت لِلْمُشَابَهَةِ ” انتهى
অশ্লীল গানের উকীল হাসান সাহেবের আরো দু’টি পাগলামী উক্তি দেখুন:
১
সঙ্গীত কি অস্বাভাবিক হতে পারে ?
পশু-পাখি-মাছেরা পশু-পাখি-মাছ হয়েই জন্মায় কিন্তু মানুষ হয়ে উঠতে মানুষের সুকুমার বৃত্তির দরকার হয়, সঙ্গীতই সেই সুকুমার বৃত্তি। সাহিত্য, কবিতা, চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও তা সত্য। হারাম তো শূকরের মাংস, গান কবে থেকে শূকরের মাংস হল ? আর, বাড়াবাড়ি করা ? ‘গান হারাম’ বলাই তো সেই বাড়াবাড়ি !
২
গান শুনুন এবং বাচ্চাদের গান শোনান। গান করুন এবং বাচ্চাদের গান শেখান। গান যে ভালবাসে না সে মানুষ খুন করতে পারে। গানের মত বেহেশতি জিনিস যে অপদর্শনে শূকরের মাংস হয় সেটা আসলে ইসলামের ছদ্মবেশে অন্যকিছু, বিশ্ব-মুসলিমের মঙ্গলের জন্যই ওটাকে শক্তহাতে প্রতিহত করা প্রয়োজন। [শারিয়া কি বলে-৩৩]
বাহ। ভালো বুদ্ধি সুকুমারবৃত্তির জন্য গান গাওয়া দরকার। তাহলে ঘরে ঘরে ফুল ভলিয়মে মাইক্যাল জেকশন আর শাকিরা উদ্দম গান শোনালেই বাচ্চাকাচ্চা সব ভদ্র আর সুকুমারবৃত্তির অধিকারী হয়ে যাবে?
আর গান ভালোবাসলে খুনী হয় না। গান ভালো না বাসলেই ব্যক্তি খুনী হতে পারে?
বাহ ভালোই যুক্তি।
এরশাদ শিকদারের নাম শুনেনি এমন বাংলাদেশের নাগরিক পাওয়া কঠিন। যিনি খুন করে তারপর জলসা আয়োজন করে গান গাইতেন, শুনতেন। নাচতেন। প্রশ্ন হল গান পাগলা এরশাদ শিকদারের কি প্রকৃতির সুকুরবৃত্তি হাসিল করেছেন?
এসব কি প্রমাণ নাকি পাগলামী তা সকলের সামনেই যাচাইয়ের জন্য রেখে দিলাম।
চলবে ইনশাআল্লাহ