লেখক– মুনাজিরে ইসলাম মাওলানা মুহাম্মদ আমীন সফদর ওকাড়বী রহঃ
অনুবাদঃ লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচয়
প্রিয় ভাইয়েরা! পিছনের কয়েকটি লেখায় আপনারা মাসঈদী ফিরক্বার পরিচয় জানতে পেরেছেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের নাম কাফেরদের মুকাবিলায় মুসলিমীন রেখেছেন। আজ পর্যন্ত আমরা কাফেরদের বিপরীতে এ নামেই পরিচিত। আর রাসূল সাঃ বিদআতি ফিরক্বার বিপরীতে আমাদের নাম রেখেছেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত। রাসূল সাঃ এর জমানা থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত আহলে বিদআতের বিপরীতে আমাদের নাম আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতই রয়ে গেছে।
কিছু শাখাগত মাসআলায় হাদীসে বাহ্যিক বিপরীতমুখীতা থাকায় সাহাবায়ে কেরামের মাঝে মতভেদ হয়েছে। যা হাজারো মুজতাহিদ সাহাবাগণের বক্তব্যে বিদ্যমান রয়েছে। যেসব মতভেদপূর্ণ বক্তব্য কিতাবুল আসার লিইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল আসার লিইমাম মুহাম্মদ, মুয়াত্তা মালিক, মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক ইত্যাদি কিতাবে বিদ্যমান।
চার ইমামগণ যখন রাসূল সাঃ এর সুন্নতকে সংকলিত করলেন, তখন হাজারো মুজতাহিদ সাহাবাগণের মতভেদপূর্ণ বক্তব্যগুলো চার ইমামের চার মাযহাবে সন্নিবেশিত হয়ে গেছে। এসব শাখাগত মাসআলায় মালেকী, শাফেয়ী এবং হাম্বলী মাযহাবের বিপরীতে এই ইজতিহাদী মাসআলায় আমরা হানাফী নামে পরিচিত। যেমন ভারতীদের বিপরীতে আমরা বাংলাদেশী। চট্টগ্রামের বিপরীতে আমরা ঢাকাবাসী। গুলশানের বিপরীতে আমরা রামপুরাবাসী। ঠিক একই পদ্ধতিতে আমরা ইহুদী খৃষ্টানের বিপরীতে মুসলিম। খারেজী, শিয়া বিদআতিদের বিপরীতে আমরা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত। আর হাম্বলী, শাফেয়ী ও মালেকীদের বিপরীতে আমরা হানাফী।
আজ পর্যন্ত আমাদের সামনে এমন কোন মুর্খ দৃষ্টিগোচর হয়নি, যে আমাদের প্রশ্ন করেছে যে, আপনি কি ঢাকাবাসী না রামপুরাবাসী? অথবা এমন প্রশ্ন করেছে যে, তুমি কি ঢাকাবাসী না বাংলাদেশী?
তবে এমন মুর্খের পাল্লায় আমরা পড়েছি যে, যে কখনো জিজ্ঞাসা করে যে, তুমি হানাফী নাকি মুসলিম? কখনো প্রশ্ন করে যে, তুমি সুন্নি নাকি মুসলিম?
তাদের বারবার বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে মুসলিম শব্দ কাফেরদের বিপরীতে উল্লেখ করেছেন, সেখানে আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যের বিপরীত মুসলিম শব্দকে হানাফী, শাফেয়ী ও মালেকী মাযহাবের বিপরীত উল্লেখ করে ইহুদীদের মত আল্লাহর বাণী বিকৃত করার অপচেষ্টা করছে ওরা।
কাদিয়ানীরা কাফের হওয়ার ব্যাপারে পুরো উম্মতে মুসলিমা একমত। তাই তাদের সাথে সালাম কালাম দেয়া মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। কাদিয়ানীরা না কোন মুসলিমকে সালাম দেয়, না কোন মুসলিমের সালাম গ্রহণ করে।
ঠিক তেমনি মাসউদী ফিরক্বা। মাসউদ সাহেব হজ্বে গিয়ে কাবার ইমামের পিছনে নামায পড়েনি। কারণ কাবার ইমাম হাম্বলী মাযহাবী। আর মাযহাবের অনুসারী তার ভাষায় সাম্প্রদায়ক এবং অমুসলিম। এ কারণে সে কাবার ইমামের পিছনে নামায পড়েনি।
কিন্তু মজার ব্যাপার হল, সেই গায়রে মুসলিমের নেতৃত্বে হজ্ব সম্পাদন করে এসেছে। নামায আর হজ্বের মাঝে এ পার্থক্যকরণ মাসউদ সাহেব সম্ভবত ওহীয়ে শয়তানীর মাধ্যমে পেয়েছেন। নতুবা ওহীয়ে রহমানীতেতো নামায আর হজ্বের মাঝে কোন পার্থক্য বিদ্যমান নয়। আশা করি সাম্প্রদায়িক মাসউদ সাহেব এ বিষয়টি পরিস্কার করবেন।
সালাতুল মুসলিমীন
মাসউদী ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা ১৩৯৫ হিজরীতে স্বীয় ফিরক্বা প্রতিষ্ঠা করেন। তার জন্য তখন প্রয়োজন ছিল, তার বানানো ফিরক্বার জন্য একটি আলাদা নামাযও উপহার দেয়া। সে হিসেবে ১৩৯৮ হিজরীতে মাসউদ সাহেব “সালাতুল মুসলিমীন” নামে একটি বই রচনা করেন। এ বইয়ের শতভাগই নেয়া হয়েছে গায়রে মুসলিমের কিতাব থেকে। এ কিতাবের তানা হল নাসীরুদ্দীন আলবানীর কিতাব “সুফাতু সালাতিন নাবী” আর বানা হল শাওকানী যায়দী এবং ইবনে হাজার শাফেয়ী মুকাল্লিদ থেকে নেয়া হয়েছে।
এ তিন ব্যক্তিই মাসউদ সাহেবের মতে সাম্প্রদায়িক এবং গায়রে মুসলিম।
কোন ইহুদী আজ পর্যন্ত তার ইবাদতের কিতাব গায়রে ইহুদীর কিতাব থেকে সংকলিত করেনি। কোন শিখ আজ পর্যন্ত তার ধর্মের ইবাদতের পদ্ধতি কোন হিন্দুর বই থেকে নিয়েছে এর কোন নজীর নেই। কিন্তু মাসউস সাহেবের আত্মমর্যাদাবোধ নজীরবিহীন। যিনি যখন আল্লাহর সামনে দন্ডয়মান হন, তখন মাথা থেকে নিয়ে পা পর্যন্ত গায়রে মুসলিম হয়ে যান। সেই সাথে তার ফিরক্বা অনুসারীরাও গায়রে মুসলিম পদ্ধতিতে নামায আদায় করে থাকে। কেননা, এ কিতাবের একেকটি মাসআলা ঐসব লোকদের কিতাব থেকে চুরি করা হয়েছে, যাদের মাসঈদী ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা সম্প্রদায়িক এবং গায়রে মুসলিম বলে থাকে। বিশেষ করে “আলজামাআতুল কাদীমা” পুস্তিকা লিখে আলবানী সাহেবের পুরোপুরি বিরোধিতা প্রকাশ করেছে।
মুতাওয়াতির নামায
রাসূল সাঃ তেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত মানুষ আদায় করে আসছে। দুনিয়াতে এমন কোন দিন অতিক্রান্ত হয়নি, যেদিন পৃথিবীর কোথাও নামায আদায় করা হয়নি। মাসউদ সাহেব নিজেও এটাকে অস্বিকার করতে পারবেন না। মাসউদ সাহেবের পিতৃপুরুষ কতিপয় গায়রে মুকাল্লিদরা রুকুর পরও সীনার উপর হাত বেঁধে থাকে। হাত লটকিয়ে রাখে না।
মাসউদ সাহেব রুকুর পর হাত যারা বেঁধে থাকে তাদের একটি নীতিনির্ধারণী প্রশ্ন করে থাকেন। তিনি বলেন-
“রুকুর পর সীনার উপর হাত যারা বেঁধে থাকে, তারা বলে থাকেন যে, রাসূল সাঃ রুকুর পর হাত বাঁধতেন। আচ্ছা, ঠিক আছে! আমরা মেনে নিলাম। একথা পরিস্কার যে, যদি রাসূল সাঃ হাত বেঁধে থাকেন, তাহলে সাহাবাগণ রাঃ ও হাত বেঁধেছেন। তারপর তাবেয়ীগণও হাত বেঁধেছেন। আর এভাবে সিলসিলা চলতেছিল।
কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হল, ঐ সময়টা বলুন, যখন এসে লোকেরা একেবারে হাত বাঁধা ছেড়ে দিয়েছেন। আর কোন ব্যক্তিই এর বিরোধিতা করেননি। …. আমরা যে সময়কারের প্রশ্ন করলাম, এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, এর কোন প্রমাণ হাত যারা বাঁধেন, তাদের কাছে নেই। আর এটিই নিশ্চিত কথা যে, পরস্পর মুজাকারা করলেও এ প্রশ্নে কোন উত্তর পাওয়া যাবে না। সুতরাং একথাই সঠিক যে, রুকুর পর হাত কখনো বাঁধাই হয়নি। সব সময়ই হাত ছেড়ে রাখা হতো। এ আমলই রাসূল সাঃ এর জমানা থেকে যুগ যুগ ধরে নিরবচ্ছিন্ন আমলী সূত্র পরম্পরায় চলে এসেছে। বর্তমানে সেই মুতাওয়াতির আমলের উপরই আমাদের আমল। যে কাজ রাসূল সাঃ থেকে আমল হিসেবে মুতাওয়াতির সূত্রে চলে আসছে, তার উপর পূর্বসূরীর তাকলীদ কোন আলেমের শান নয়। …….যদি কোন আমল মুতাওয়াতির সূত্রে চলে আসে, রাসূল সাঃ এর জমানায় বা সাহাবাগণের জমানায় এ আমল বন্ধ হওয়ার কোন প্রমাণ বিদ্যমান না থাকে, তাহলে উক্ত আমল হুজ্জত হবে। {সালাতুল মুসলিমীন-৫০৯-৫১২, ঈষৎ সংক্ষেপিত}
সম্মানিত পাঠকেরা! যে কুরআন মানুষ প্রতিদিন তিলাওয়াত করে থাকে, যেমনিভাবে উক্ত কুরআন তিলাওয়াত হিসেবে মুতাওয়াতির, এমনিভাবে যে নামায মুসলিমরা পড়ে থাকে, সে নামাযও তেমনিভাবে আমল হিসেবে মুতাওয়াতির।
মাসঈদী ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা সাহেব সেই আমলী মুতাওয়াতির নামাযকে প্রতিপক্ষ বানিয়েছেন। অথচ সুযোগমত তিনি নিজেই সেই আমলী মুতাওয়াতিরকে গলার মালা বানিয়ে নেন। যেমনটি উপরের বক্তব্যে দেখতে পেলেন।
মজার ঘটনা
একদিন পাঁচ জন মাসঈদী ফিরক্বা অনুসারী আমার কাছে এল। এসে বলতে লাগল, তুমি দ্বীন বিচ্যুত, আর আমরা শুধু কুরআনও হাদীসের উপর আমল করে থাকি।
আমি বললাম, আপনারা এর উপর পাক্কা থাকতে পারবেনতো? নিজের সব কথাকে কুরআনও হাদীসের দ্বারা প্রমাণিত করতে পারবেনতো?
– অবশ্যই। যদি এমন কোন কথা আসে, যার প্রমাণ আমরা কুরআন বা হাদীস থেকে না দিতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের দাবিতে মিথ্যবাদী সাব্যস্ত হবো।
– আপনাদের দাবি হল, আপনারা কেবল কুরআন ও হাদীস মেনে থাকেন। তো আমার প্রশ্ন হল, আপনারা উভয়টি কি একই পদ্ধতিতে মানেন? না ভিন্নতা আছে?
– একই পদ্ধতি।
– যেমনিভাবে প্রতিটি হাদীসের সনদ খুঁজে থাকেন, তারপর রাবীদের অবস্থা তালাশ করেন, তারপর কোন হাদীসকে সহীহ, কোন হাদীসকে জঈফ বলে থাকেন, তেমনি কুরআনে পাকের প্রতিটি আয়াতেরও কি সনদ তালাশ করেন? প্রতিটি রাবীর অবস্থা অনুসন্ধান করেন? তারপর কিছু আয়াতকে সনদহীন ও প্রমাণহীন বলে ছেড়ে দেন?
– আরে কি বলেন? কুরআনে কারীমের সাথে এমন আচরণ করলেতো পুরো কুরআনই হাত থেকে ছুটে যাবে। আমরা কুরআনে কারীমের উপর এমন জুলুম কি করে করতে পারি যে, যার কারণে কুরআনের সমস্ত আয়াত ও তার তারবীতের প্রমাণই দিতে পারবো না। এ কারণে আমরা কুরআনে কারীমের প্রতি আয়াতের সনদ অনুসন্ধান করি না। তবে প্রতিটি হাদীসের সনদ তালাশ করে থাকি। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমরা কুরআন ও হাদীস গ্রহণের মাঝে সুনিশ্চিত পার্থক্য করে থাকি।
– এ পার্থক্যকরণের উপর কোন আয়াত বা হাদীস পেশ করুন।
– এ পার্থক্য করার উপরতো কোন আয়াত বা হাদীস নেই। হ্যাঁ, আমরা এ পার্থক্য এ কারণে করি যে, যেহেতু কুরআনে কারীম তিলাওয়াত হিসেবে মুতাওয়াতির, কিন্তু হাদীস মুতাওয়াতির নয়।
– আপনিতো প্রথম প্রশ্নের জবাবের ক্ষেত্রেই মিথ্যুক প্রমাণিত হয়ে গেলেন। না আয়াত পেশ করতে পারলেন, না হাদীস। আশ্চর্যের বিষয় হল, আপনাদের বানানো ইমামকেও ছেড়ে দিলেন। আপনি এ পার্থক্য বলেছেন যে, কুরআন মুতাওয়াতির আর হাদীস মুতাওয়াতির নয়। অথচ আপনার ফিরক্বার প্রতিষ্ঠাতা লিখেছেন-
“হাদীসের হিফাযত দুই প্রকার। যথা-১-আমল হিসেবে। ২-বর্ণনা হিসেবে। যেকথা রাসূল সাঃ বলেছেন, তার উপর প্রতিটি জমানায় আমল হয়ে আসছে। যেমন হাদীসে এসেছে যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ। জোহরের চার রাকাত, মাগরিবের তিন রাকাত, প্রতিটি রাকাতে একটি রুকু, তারপর দুইটি সেজদা। বছরে দুইটি ঈদ ইত্যাদি। এ প্রকারের অসংখ্য হাদীস রয়েছে। যা প্রতিটি জমানার শিশুদেরও মুখে মুখে ছিল। যদি মুখে নাও বলে থাকে, তাহলে কমপক্ষে মনে মনে অবশ্যই ছিল। আর আমল হিসেবে সবাই করতেন। একদম তাওয়াতুরের সাথে এর উপর আমল হতেছিল। সেই সাথে তাওয়াতুরের সাথে তা স্থানান্তরিত হয়ে আসছে। এসব হাদীসের অকাট্য সহীহ। আর এসবের তাওয়াতুর কুরআনে কারীমের তাওয়াতুরের চেয়েও বেশি প্রশস্ত। কুরআনে কারীমের আয়াত কতিপয় আলেম এবং হাফেজদের হিফাযতে রয়েছে। কিন্তু এসব হাদীসসমূহ প্রতিটি আলেম-গায়রে আলিম এবং পুরুষ-নারী, বড় ছোটের আমলে চলে আসছে।” {তাফহীমুল ইসলাম-৫৭}
মাসঈদী ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা আমলী তাওয়াতুরকে সনদের তাওয়াতুর বরং কুরআনী তাওয়াতুরেরও উপরে মর্যাদা দিয়েছে।
আলহামদুলিল্লাহ! আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত এর নামায ঐ তাওয়াতুর দ্বারাই প্রমাণিত। আর এ মুতাওয়াতির সূত্রে পৌঁছা নামাযের বিরোধিতা করা হয়েছে মাসঈদী ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতার লিখিত “সালাতুল মুসলিমীন” দ্বারা। যে কিতাবে উম্মতের মুতাওয়াতির নামাযকে ভুল সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ কিতাবের অবস্থা এমনি, যেমন কোন অর্বাচিন মুতাওয়াতির কুরআনে কারীমের খেলাফ শাজ ও মাতরূক কিরাতকে কিতাবে একত্রিত করে নাম দিয়ে দিল “কুরআনুল মুসলিমীন”। যা সুনিশ্চিতভাবে অপূর্ণাঙ্গ এবং পরিত্যাজ্য।
ঠিক তেমনি এই “সালাতুল মুসলিমীন” কিতাবটি একেবারেই অপূর্ণাঙ্গ। না এতে পূর্ণাঙ্গ নামাযের মাসআলা আছে। না পূর্ণাঙ্গ ধারাবাহিকতা। সেই সাথে মুতাওয়াতিরের বিপরীত শাজ বর্ণনায় ভরা। কোন মুসলিম যেমন মুতাওয়াতির কুরআনকে রেখে কোন শাজ এবং অপূর্ণাঙ্গ কুরআনকে গ্রহণ করবে না। তেমনি কোন মুসলিম এ শাজ অপূর্ণাঙ্গ নামাযকে কবুল করবে না।
দ্বিতীয় প্রশ্ন
তারপর আমি ঐ মাসউদী অনুসারীদের জিজ্ঞাসা করলাম, “কুরআন ও হাদীসের সংজ্ঞা কি?”
আমার কথা শুনে ওরা ক্ষেপে গেল, বলতে লাগল-“কে জানে না কুরআন ও হাদীসের সংজ্ঞা কি? এটাতো সবাই জানে”।
– যদি সবাই জানে, তাহলে বলতে সমস্যা কোথায়? কোন গোনাহতো নেই? যদি গোনাহ না থাকে, আর না বলার কারণে যদি লোকেরা আপনাদের অজ্ঞ বলে ধারণা করে, তাই বলে দেয়াই কি উত্তম নয়? তখন একজন বলতে লাগল-
– কুরআন ঐ কিতাব! যা রাসূল সাঃ এর উপর নাজিল হয়েছে। যা মাসহাফ তথা পুস্তকে লিপিবদ্ধ। সেই সাথে কোন সন্দেহ ছাড়া মুতাওয়াতির সূত্রে নকল হয়ে আসছে। আর হাদীস বলা হয়, রাসূল সাঃ এর কওল তথা কথা ফেল তথা কর্ম এবং তাকরীর তথা মৌন সমর্থনকে বলা হয়।
– আচ্ছা! এ দুই সংজ্ঞা কোন আয়াত বা হাদীসের অনুবাদ? একটু রেফারেন্স দিন।
– এ সংজ্ঞা আল্লাহ ও রাসূল সাঃ থেকে বর্ণিত নয়। এটি ঊসূল তথা মূলনীতিবীদ উলামায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত।
– তাহলেতো আপনি আবারো স্বীয় দাবিতে মিথ্যুক প্রমানিত হয়ে গেলেন। আপনি বলেছেন, আপনি নাকি শুধু কুরআনও হাদীস মানেন, অথচ কুরআন ও হাদীসের সংজ্ঞা কুরআন ও হাদীস থেকে দেখাতে পারলেন না। আচ্ছা, এবার ঊসুলের কিতাবের একটু রেফারেন্স দিন, কে লিকেছে এসব? কোন জমানায় লিখেছে? আর কোন ফিরক্বার লোক এসব লিখেছেন? তাদের রায়কে আপনারা শরীয়ত বিকৃতি সাব্যস্ত করবেন কি না?
একথার জবাবে লোকটি কোন রেফারেন্স দিতে পারেনি।
তৃতীয় প্রশ্ন
আপনারা এক হাদীসকে সহীহ আরেক হাদীসকে জঈফ বলে থাকেন, তো আপনারা প্রতিটি হাদীসের ক্ষেত্রে এ ফায়সালা কি আল্লাহ ও রাসূল সাঃ থেকে নকল করেন না উম্মতী থেকে নকল করেন? কেননা, আপনাদের কাছেতো আল্লাহ ও রাসূল সাঃ ছাড়া কারো কথা শরয়ী দলীল নয়।
লোকটি বলতে লাগল- “দুনিয়াব্যাপী কোন হাদীসের সহীহ বা জঈফ হওয়ার বিষয় আল্লাহ বা রাসূল সাঃ থেকে বর্ণিত নয়। আমরা এ ব্যাপারে শুধুমাত্র আমাদের দল প্রতিষ্ঠাতার উপর নির্ভর করি। আর আমাদের দল প্রতিষ্ঠাতা এক্ষেত্রে ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর মুকাল্লিদ হাফেজ ইবনে হাজার রহঃ, শাওকানী যায়দী এবং আলবানী গায়রে মুকাল্লিদ ফিরক্বাবাজ গায়রে মুসলিমদের উপর নির্ভর করে থাকেন।
তারা নিজেদের রায় অনুপাতে সহীহ ও জঈফের সংজ্ঞা বানিয়েছেন। যা কুরআন ও হাদীসে একেবারেই বিদ্যমান নেই। আমাদের ইমাম মুফতারিজুত তাআত [যাকে অনুসরণ করা আবশ্যক] জনাব, মাসউদ সাহেব লিখেছেন-
“এ হাদীসে কোন জঈফ হাদীস আনা হয়নি। যদি কোন ব্যক্তি এ কিতাবের কোন হাদীস জঈফ হওয়া ধরিয়ে দেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ পরবর্তী প্রকাশে তা আর উল্লেখ করা হবে না।” {সালাতুল মুসলিমীন-২৪}
আমি বললাম-“এর দ্বারা বুঝা গেল যে, হাদীস গ্রহণ ও রদ করার মানদন্ড উম্মতীর রায়। দ্বিতীয় এই বুঝা গেল যে, হাতির দাঁত দেখানোর জন্য এক, আর খাওয়ার জন্য আরেক।
আমি ২৩ই মুহাররম ১৪১১ হিজরী তারিখে ৭ পৃষ্ঠার একটি লেখা ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা মাসঈদ সাহেবের কাছে প্রেরণ করলাম। যাতে জঈফ হাদীস ও খিয়ানত ও ধোঁকাবাজীর বিষয়ে উল্লেখ করে দেই। কিন্তু তিনি আজ পর্যন্ত তা ঠিক করেননি।”
চতুর্থ প্রশ্ন
চার ইমাম এবং মুহাদ্দিসীন এবং ফুক্বাহায়ে কেরাম শরীয়তের আহকাম বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। অজু, নামায ইত্যাদির কতটি ফরজ, যার কোন একটি না করার দ্বারা অজু ও নামায নষ্ট হয়ে যায়, কিছু কাজ বা বলার দ্বারা সেজদায়ে সাহু ওয়াজিব হয়, কিছু কাজ রাসূল সাঃ ফরজ ও ওয়াজিব হওয়া ছাড়াই সর্বদা করেছেন যাকে সুন্নত বলা হয়। সেই সাথে যাকে পছন্দ করেছেন কিন্তু সর্বদা করেননি, তাকে বলা হয় মুস্তাহাব।
কিন্তু ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা মাসঈদ সাহেব পুরো উম্মতের খেলাফ লিখে দিয়েছেন- “যে তরীকায় রাসূল সাঃ নামায আদায় করেছেন, সেই তরীকা ফরজ। সেই তরীকার মঝে ফরজ ওয়াজিব, ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাবের সংজ্ঞা বানোয়াট।” {সালাতুল মুসলিমীন-৪৭}
এখন প্রশ্ন হল, ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা সাহেবতো এখানে এসবকে বানোয়াট সাব্যস্ত করে ফেলেছেন, কিন্তু ১৫৭ পৃষ্ঠায় নামাযের রাকাত সংখ্যার শিরোনাম দিয়ে তিনি ঠিকই ফরজ, সুন্নত, মুস্তাহাবের এ বানোয়াট সংজ্ঞাকে মেনে নিয়েছেন।
এবার বলুনতো, মুহাদ্দিসীনদের পরিভাষা হাদীস সহীহ, জঈফ, মাওজু, মুরসাল, মুদাল্লাস, মুযতারিব, মারূফ, মুনকার ইত্যাদির সংজ্ঞা যা আপনাদের ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা স্বীকার করেন, তা কি কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত না বানানো?
জবাবে তারা পাঁচজনই স্বীকার করে যে, আসল কথা হল, “কুরআনও হাদীসই মানি” আমরা আমাদের এ দাবি কখনোই প্রমাণিত করতে পারবো না।
রাসূল সাঃ এর সাথে বিদ্রোহ
ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা অধিকাংশ মাসআলায়ও হাদীস উপস্থাপন করতে পারেননি, যার উপর উম্মতের আমল চলে আসছে। শুধু মতভেদপূর্ণ মাসআলায় জোর চেষ্টা প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও মতভেদপূর্ণ মাসআলায় এক হাদীস গ্রহণ আরেক হাদীস বর্জনের ক্ষেত্রেও কোন শরয়ী দলীল অনুসরণ করেননি।
এটা কিছুতেই হতে পারে না যে, যে হাদীস সে লিখেছে, তা আল্লাহ ও রাসূল সাঃ লিখতে বলেছেন, আর যেটাকে ছেড়ে দিয়েছে তা আল্লাহ ও রাসূল সাঃ ছেড়ে দিতে বলেছেন। এসব মতভেদপূর্ণ হাদীসের ক্ষেত্রে খোদ রাসূল সাঃ যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেটিকেও সে ভেঙ্গে দেয়।
১ম মানদন্ড
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ , عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ: «سَيَأْتِيكُمْ عَنِّي أَحَادِيثُ مُخْتَلِفَةٌ , فَمَا جَاءَكُمْ مُوَافِقًا لِكِتَابِ اللَّهِ تَعَالَى وَلِسُنَّتِي فَهُوَ مِنِّي , وَمَا جَاءَكُمْ مُخَالِفًا لِكِتَابِ اللَّهِ تَعَالَى وَلِسُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي»
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, লোকেরা আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে মতভেদপূর্ণ হাদীস বর্ণনা করবে, সেসবের মাঝে যা কুরআন ও আমার সুন্নতের মুয়াফিক হবে সেটি আমার পক্ষ থেকে বলে সাব্যস্ত হবে। আর যা কিতাবুল্লাহ ও আমার সুন্নতের খেলাফ হবে, তা আমার পক্ষ থেকে নয়। {আলকিফায়াহ, খতীব বাগদাদীকৃত-৪৩০, সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং-৪৪৭৩}
কিন্তু মাসঈদী ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা খুঁজে খুঁজে তার কিতাবে এমন সব হাদীসকে একত্র করেছেন, যা মুতাওয়াতির কুরআন ও সুন্নতের বিপরীত। অর্থাৎ আমলী তাওয়াতুরের বিপরীত। অথচ রাসূল সাঃ এসব করতে নিষেধ করেছেন।
২য় মানদন্ড
أَبَا هُرَيْرَةَ، يَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يَكُونُ فِي آخِرِ الزَّمَانِ دَجَّالُونَ كَذَّابُونَ، يَأْتُونَكُمْ مِنَ الْأَحَادِيثِ بِمَا لَمْ تَسْمَعُوا أَنْتُمْ، وَلَا آبَاؤُكُمْ، فَإِيَّاكُمْ وَإِيَّاهُمْ، لَا يُضِلُّونَكُمْ، وَلَا يَفْتِنُونَكُمْ
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, আমার উম্মতে শেষ জমানায় এমন মিথ্যুক ও দাজ্জাল প্রকৃতির ব্যক্তি হবে, যারা তোমাদের কাছে কিছু হাদীস নিয়ে আসবে, হাদীসগুলো এমন হবে যে, যা তোমাদের বাপ-দাদারা কখনো শুনেনি। [তথা বাপ-দাদার আমলী তাওয়াতুরের বিপরীত হবে] ঐ সকল দাজ্জাল ও মিথ্যুকদের থেকে বেঁচে থেকো। তাদের নিজেদের কাছে ভিরতে দিবে না। এমন যেন না হয়, তারা তোমাদের মাঝে বিভ্রান্তি ও ফিতনা ছড়িয়ে দেয়। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৮৫৯৬, সহীহ মুসলিম-১০, হাদীস নং-৭, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৬৭৬৬}
মাসঈদী ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা একজাটাই করেছে। খুঁজে খুঁজে এমন সব হাদীস হাদীস লিখেছে, যা জমহুরের আমলী তাওয়াতুরের খেলাফ। সেই সাথে উম্মতে মুসলিমাকে মুতাওয়াতির সুন্নত থেকে হটিয়ে গোমরাহীতে ফেলে দিয়েছে। ঘরে ঘরে ফিতনা পৌঁছে দিয়ে কাফেরদের হাসির পাত্র বানিয়ে দিয়েছে।
৩য় মানদন্ড
মতভেদের কথা উল্লেখ করার পর রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, তোমরা আমার এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে আঁকড়ে ধর। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৭১৪২, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-৯৬, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৪৩, তিরমিজী, হাদীস নং-২৬৭৬}
মাসঈদী ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা পরিপূর্ণ প্রচেষ্টা আর মেহনত করে এমন সব হাদীসকে খুঁজে খুঁজে বের করেছে যার উপর খুলাফায়ে রাশেদীনের ধারাবাহিক আমল কিয়ামত পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারবে না।
মোটকথা, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতকে ভুল প্রমাণ করার জন্য আমলী তাওয়াতুরের সাথে সাথে রাসূল সাঃ এর বাতানো উসূলেরও বিরুদ্ধাচারণ করেছে। সেই সাথে খুলাফায়ে রাশেদীনগনের সুন্নতকে পশ্চাতে নিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। এসব করেও এ দাবি করছে যে, দুনিয়ার সকলের সংশোধন তার হাতে!
ইলমের দৈন্যতা
আমল হিসেবে মুতাওয়াতির নামাযের বিরুদ্ধে এ কিতাবে সবচে’ বেশি মুর্খতা রফয়ে ইয়াদাইনের মাসআলায় প্রদর্শন করেছে। কিন্তু আফসোস হল, এর সঠিক হুকুমটা পর্যন্ত বলতে পারেনি। স্বীয় কিতাব “খুলাসা তালাশে হক” এর মাঝে ১৯৬২ হিজরীতে রফয়ে ইয়াদাইনকে ফরজ লিখেছে। [পৃষ্ঠা-৭৯}
অথচ পুরো কিতাবে এটিকে সুন্নত সাব্যস্ত করার জন্য জোর কসরত করে গেছে। কিন্তু কোন হাদীসের মাঝে এটিকে না ফরজ লেখা দেখাতে পেরেছে না সুন্নত। যদি কোন হাদীসে ফরজ বা সুন্নত শব্দ দেখাতে পারে, তাহলে আমরা সে হাদীসের প্রতিটি শব্দের বিনিময়ে এক হাজার টাকা করে পুরুস্কার দেব।
মিথ্যা! শুধুই মিথ্যা!
মাসঈদী ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা তার বইয়ের ৪৫৩ নং পৃষ্ঠায় লিখেছে “যে সকল সাহাবাগণ রাঃ থেকে রফয়ে ইয়াদাইন সম্পর্কে একাধিক আমল সম্বলিত হাদীস বর্ণিত। তাদের মাঝে রয়েছেন-
১-হযরত উসমান রাঃ ২- হযরত তালহা রাঃ। ৩- হযরত যুবায়ের রাঃ। ৪- হযরত সাদ রাঃ। ৫- হযরত আব্দুর রহমান বিন আউফ রাঃ। ৬- হযরত আবু উবায়দা রাঃ। ৭- হযরত জায়েদ বিন সাবেত রাঃ। ৮- হযরত উবাই বিন কাব রাঃ। ৯-ইবনে মাসঈদ রাঃ। ১০- হযরত যিয়াদ বিন হারেস রাঃ প্রমূখ।
কিন্তু মাসঈদী ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা কিয়ামত পর্যন্ত একথা প্রমাণ করতে পারবে না যে, এ দশজন সাহাবী কোন সহীহ সনদে রাসূল সাঃ থেকে মতভিন্নতাপূর্ণ রফয়ে ইয়াদাইনের হাদীস বর্ণনা করেছেন।
শুধু তাই নয়, একথাও প্রমাণিত করতে পারবে না যে, এ দশজন সাহাবী রফয়ে ইয়াদাইন বিষয়ে একেক সময় একেক আমল প্রমাণিত।
এক শ্বাসে দশজন সাহাবীর উপর মিথ্যাচারতো দাজ্জালও করতে ভয় পাবে। অথচ সনদহীন কথাকে খোদ ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা নিজেই জাল আর বানোয়াট বলে মন্তব্য করে থাকে। [দেখুন- ৪৮৬-৪৮৭]
যদি মাসউদ সাহেব কিংবা মাসঈদী ফিরক্বা অনুসারী কেউ এই ১০জন সাহাবী থেকে ভিন্ন সময় ভিন্ন আমল রফয়ে ইয়াদাইন বিষয়ে দেখাতে পারে সহীহ সনদে, তাহলে প্রতিটি হাদীস হিসেবে দশ হাজার টাকা পুরুস্কার দেয়া হবে।
আছে কি কোন বীর পুরুষ? আসুন! হাদীস নিয়ে আসুন!
দশ নাকি সতের?
মাসঈদী ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা তার বইয়ের ৩৯৩ নং পৃষ্ঠায় আবু উমাঈদ সাঈদীর হাদীসের মাঝে একটি মজলিসের কথা উল্লেখ করেছেন। লিখেছে “এ মজলিসে দশজন সাহাবী ছিলেন।” রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করেছেন আবু দাউদ আর তিরমিজীর।
কিন্তু ৪৫৩ পৃষ্ঠায় একই মজলিসের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আবূ হুমাইদ রাঃ ছাড়াও ১৭জন সাহাবীর নাম উল্লেখ করেছেন। আর উদ্ধৃতি দিয়েছেন গায়রে মুকাল্লিদ ওয়াহিদুজ্জামান সাহেবের কিতাব “তাসহীলুল কারী” এর।
মাসঈদ সাহেব কিংবা মাসঈদী ফিরক্বার অনুসারী কেউ কি এ ১৭জন সাহাবীর নাম উক্ত মজলিসে উপস্থিত থাকার কথা সহীহ সনদে প্রমাণিত করতে পারবেন?
কল্পিত সেমিনার
মাসঈদ সাহেব হযরত আবূ হুমাইদ রাঃ থেকে যে মজলিসের কথা উল্লেখ করেছেন, তার বর্ণনাকারী হলেন, হযরত মুহাম্মদ বিন উমর বিন আতা। যার জন্ম হল ৪০ হিজরীতে। তাহলে এ মজলিস ৫০ হিজরীতে হয়তো অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু অংশগ্রহণকারীদের মাঝে হযরত জায়েদ রাঃ এর নামও নেয়া হয়েছে। যিনি ৪৮ হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন। হযরত আবূ মাসউদ রাঃ ৩৮হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন। হযরত সালমান ফার্সি রাঃ ৩৪ হিজরীতে। হযরত আম্মার বিন ইয়াসির রাঃ ৩৮ হিজরীতে, হযরত আবূ কাতাদা রাঃ ৩৮ বা ৫৪ হিজরীতে। হযরত মুহাম্মদ বিন মাসলামা রাঃ ৪১ হিজরীতে, হযরত ইমাম হাসান ৪৯ হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন।
ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতার কারিশমা এটি যে, ৫০ হিজরীতে অনুষ্ঠিত মিটিংয়ে দশ বছর আগে ইন্তেকাল হওয়া ব্যক্তিদের রফয়ে ইয়াদাইন প্রমাণ করার জন্য কবর থেকে এনে একত্র করে দিয়েছে। বাহ! চমৎকার!
অথচ সাহাবায়ে কেরামের সময়কাল ছিল ১১০ বা ১২০ হিজরী পর্যন্ত। কিন্তু ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতার উর্বর গবেষণা অনুপাতে রফয়ে ইয়াদাইনের অধিকাংশ বর্ণনাকারী ৫০ হিজরীর আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন।
মাসঈদ সাহেবের খুব কষ্ট করে তাঁদের উপস্থিত করার কষ্ট করতে হয়েছে।
এর দ্বারা বুঝা গেল যে, মাসঈদ সাহেবের কুরআন ও হাদীসতো দূরে থাক ইতিহাস সম্পর্কেও সামান্য জ্ঞান নেই। {দেখুন-৪৮৮}
বিবিধ
৩১০ নং পৃষ্ঠায় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাঃ এর যে হাদীস উল্লেখ করেছে, সেটির সনদের প্রথম রাবী হলেন, ইমাম বায়হাকী রহঃ। যিনি ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর মুকাল্লিদ। সেই সাথে তিনি নবীগণ কবরে জীবিত আক্বিদায় বিশ্বাসী। দ্বিতীয় রাবী হলেন, হাকীম গালী। যে হল শিয়া। তৃতীয় রাবী হলেন আরেম। তার মুখস্ত শক্তি একদমই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
৩১১ নং পৃষ্ঠায় হযরত উমর রাঃ এর একটি বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। সেটির সনদে বায়হাকী মুকাল্লিদ ছাড়াও সুলাইমান বিন কায়সান, আব্দুল্লাহ বিন কাসেম এবং হুসাইন বিন আলী নামী তিন রাবী গায়রে মারূফ।
৩১২ নং পৃষ্ঠায় হযরত আলী রাঃ এর হাদীস উপস্থাপন করা হয়েছে। যার সনদের রাবী আব্দুর রহমান বিন আবী যিয়াদের মুখস্ত শক্তি বাগদাদে আসার পর খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আর এ হাদীসটি সুলাইমান বিন দাউদ বাগদাদী তার কাছ থেকেই নকল করেছেন। তাই এ হাদীসটি সহীহ নয়।
৩১২ নং পৃষ্ঠায় হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ থেকে হাদীস বর্ণনা করা হয়েছে। যেটি মারফূ হওয়াই সন্দেহযুক্ত।
৩১৩ নং পৃষ্ঠায় হযরত মালিক বিন হুয়াইরিস রাঃ এর হাদীস নকল করা হয়েছে। যার ভিত্তি আবূ কালাবা নাসেবী এবং নসর বিন আসেম খারেজীর উপর। সেই সাথে এর দ্বারা নাসায়ীতে সেজদার অবস্থায় রফয়ে ইয়াদাইন করাও প্রমাণিত। কিন্তু ফিরক্বা প্রতিষ্ঠাতা একথা প্রকাশ করেনি। গোপন করেছে।
৩১৩ নং পৃষ্ঠায় হযরত ওয়াইল বিন হুজুর রাঃ এর হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। যার সনদে মুহাম্মদ বিন জাহাদাহ শিয়া। সেই সাথে আবূ দাউদে তার থেকে সেজদার অবস্থায় রফয়ে ইয়াদাইন করার প্রমাণ বিদ্যমান।
৪৫৪ পৃষ্ঠায় এ দাবি করা হয়েছে যে, রফয়ে ইয়াদাইনতো সকল সাহাবাই করতেন। দলীল হিসেবে আবু দাউদের হযরত ওয়াইল বিন হুজুর রাঃ এর হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ আবু দাউদে হযরত ওয়াইল বিন হুজুরের দ্বিতীয়বার আগমনের সময়ে শুধুমাত্র তাকবীরে তাহরীমার রফয়ে ইয়াদাইনের কথা এসেছে। কিন্তু মাসঈদ সাহেব এর দ্বারা রুকুতে যাওয়ার রফয়ে ইয়াদাইন প্রমাণ করতে চেষ্টা করছেন।
৩৩৮ নং পৃষ্ঠায় কিরাত খালফাল ইমাম তথা ইমামের পিছনে কিরাত পড়ার আলোচনায় হযরত আব্দুল্লা বিন ওমর রাঃ ও আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ এর একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। যাতে বলা হয়েছে যে, ইমামের চুপ থাকার সময় মুক্তাদীরা কিরাত পড়ে নিবে। এর সনদের প্রথম রাবী হলেন ইমাম বায়হাকী। যিনি ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর মুকাল্লিদ। দ্বিতীয় রাবী হলেন আবূ আব্দুল্লাহ হাফেজ হল রাফেজী খবীশ। তৃতীয় রাবী আবূস সালাত হারয়ী রাফেজী খবীশ। চতুর্থ রাবী আবু মুয়াবিয়া মুরজিয়া।
এরা সবাই মাসঈদ সাহেবের নিকটও ফিরক্বাবাজ এবং মুশরিক। তাছাড়া মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আবূ তাইয়্যিব শায়ীরী এবং আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন আব্দুল আজীজ কাজী জুরজানী রহঃ এ দুইজনকে গ্রহণযোগ্য বলেননি। আর শুয়াঈব এবং মুহাম্মদ উভয় রাবী মুদাল্লিস।
এই হল তার বর্ণিত দলীলের সনদের হালাত। যেটাকে মাসঈদ সাহেব সহীহ বলে প্রচার করছেন।
ভাল বলে দেয় যেটিকে ইচ্ছে, এই হল তাদের কারিশমা।
চোখ বন্ধ করে কত কর্ম করে মনে করে কেউ দেখে না।
মোদ্দাকথা, এ সালাতুল মুসলিমীন কিতাব যা সে তার ধারণা অনুপাতে গায়র মুসলিমের কিতাব থেকে সংকলিত করেছে। অগ্রহণযোগ্য হওয়ার সাথে সাথে নামাযের মাসায়েল এবং নামাযের ধারাবাহিকতা বর্ণনার ক্ষেত্রে নেহায়াতই অসম্পূর্ণ গ্রন্থ।
অধিকাংশই দুর্বল বর্ণনার উপর নির্ভর করা হয়েছে। যা মুতাওয়াতির আমলের খেলাফ হওয়ার দরূন কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। হাদীস নির্বাচন এবং তার সহীহ ও জঈফ হওয়ার ক্ষেত্রে শরয়ী দলীলের দিকে দৃষ্টি দেয়া হয়নি।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে মুতাওয়াতির কুরআনের মত মুতাওয়াতির নামাযের উপর আমল করার তৌফিক দান করুন। সেই সাথে বিভেদ সৃষ্টিকারী দলের প্রোপাগান্ডা থেকে হিফাযত করুন। আমীন।