লেখক– মুনাজিরে ইসলাম মাওলানা মুহাম্মদ আমীন সফদর ওকাড়বী রহঃ
অনুবাদঃ লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
একজন গায়রে মুকাল্লিদের সাথে কথোপকথন
কয়েক মাস আগে এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ হল। সে তার পরিচয় দিতে গিয়ে বলে-“আমি আহলে হাদীস! আর শুনেছি আপনি নাকি আহলে হাদীসদের খুব বিরোধী?”
আমি তাকে বললাম-“আমিতো বর্তমান সময়ের আহলে কুরআনেরও শক্ত বিরোধী”।
– ঠিক আছে। আহলে কুরআনের আমি নিজেওতো খুব বিরোধী। আচ্ছা, হাদীস কোন খারাপ বিষয় নাকি যে, আপনি এর বিরোধীতা করেন?
– কুরআন কি কোন খারাপ বিষয় নাকি যে, আপনি এর বিরোধীতা করেন।
– আহলে হাদীসতো সে দিন থেকেই, যেদিন থেকে হাদীস এসেছে।
– আহলে কুরআনও একথাই বলে যে, যেদিন থেকে কুরআন, সেদিন থেকেই আহলে কুরআন। তারা এটাও বলে যে, কুরআন প্রাচীন তথা কাদীম তাই আহলে কুরআন ও কাদীম আহলে হাদীসের তুলনায়।
– আরে ওরাতো ইংরেজদের আসার পর সৃষ্টি হয়েছে।
– “একথার দলিল কি”? তড়িৎ আমি তাকে বললাম।
– “আরে এটাতে দ্বিপ্রহরের সূর্যের মতই স্পষ্ট যে, ইংরেজরা আসার আগে আহলে কুরআনের না আছে কোন তরজমায়ে কুরআন, না কুরআনের কোন টিকা টিপ্পনী, না তাফসীর, না সারা পৃথিবীতে কোন আহলে কুরআন মসজিদ ছিল”।খুবই সাবলীল ভঙ্গিমায় বলল লোকটি।
আমি বললাম- এ দলিল দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয়ে যায় যে, বর্তমান বিদ্যমান ফিরক্বায়ে আহলে হাদীসও ইংরেজ সৃষ্ট। কেননা, ইংরেজদের আমলের পূর্বে না আহলে হাদীসের কোন কুরআনের অনুবাদ আছে, না হাদীসের অনুবাদ, না কোন তাফসীর, না টিকা টিপ্পনী, না সারা পৃথিবীতে ছিল কোন আহলে হাদীস মসজিদ।
পক্ষান্তরে ইংরেজদের আমলের পূর্বেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পক্ষ থেকে লিখেন কুরআনের ফার্সি অনুবাদ শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ, শাহ আব্দুল কাদীর মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ লিখেন কুরানের উর্দু অনুবাদ। শাহ রফীউদ্দীন মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ ও লিখেন উর্দু অনুবাদ। এসব অনুবাদ ইংরেজদেও আসার আগে থেকেই সর্বসাধরণের কাছে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ।
মেশকাতের উর্দু অনুবাদ মাজাহেরে হক, ফার্সী অনুবাদ ইশাআতুল লামআত, আরবী ব্যাখ্যগ্রন্থ আল লামআতুত তানক্বীহ বিদ্যমান আছে। আজো ইংরেজদের আগমণের পূর্বেও কুরআনের অনুবাদ, হাদীসের অনুবাদ দেখাতে পারবো।
তাছাড়া লাহোরের শাহি মসজিদ, চিনুটের শাহি মসজিদ, দ্বীপালপুরের শাহি মসজিদ, দিল্লির শাহি মসজিদ, আগ্রার শাহি মসজিদ, ঠাঠার শাহি মসজিদ সুনিশ্চিতভাবে ইংরেজদের আগমনের পূর্বের মসজিদ।
আর স্বীকৃত ঐতিহাসিক সত্য হল- এ সকল মসজিদ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত হানাফীদের। নামধারী আহলে হাদীসদের কোন মসজিদ, কোন মাদরাসা, কোন কবরস্থান ও বিদ্যমান ছিল না ইংরেজদের আগমনের আগে।
সে বলতে লাগল-“সিহাহ সিত্তা আমাদের কিতাব। কারণ এসব হাদীসের কিতাব। আর আমরা আহলে হাদীস। তাই এসব আমাদের কিতাব।
আমি বললাম- আপনারা কুরআনকে কেন মানে না?
-আমরা মানিতো।
-তাহলে আপনার দলিল অনুযায়ীতো আহলে কুরআনদের হল কুরআনে কারীম। আপনাদের নয়।
-আরে ওরাতো ধোঁকা দেয়। শুধুমাত্র আহলে কুরআন নাম রেখে কিভাবে কুরআনের উপর ছিনতাইকারীর মত দখল নেয়া যায়?
-তাহলে আপনারা কেন আহলে হাদীস নাম রেখে হাদীসের উপর ছিনতাইকারীর মত দখল নিতে চান?
-সকল মুহাদ্দিসীনরা শুধু কুরআন ও হাদীসকে মানতেন, কিয়াসকে তারা শয়তানের কাজ ও তাক্বলীদকে শিরক মনে করতেন।
-আপনার কথাটি সম্পূর্ণই মিথ্যাচার। আপনার এ বক্তব্যটির রেফারেন্স দিন। প্রথমে একটি কথা বুঝে নিন। সেটা হল-তাক্বলদিরে সম্পর্ক ইজতিহাদী মাসায়েলের সাথে। ইজতিহাদী মাসায়েলে যে ব্যক্তি নিজেই ইজতিহাদের ক্ষমতা রাখেন, তাকে মুজতাহিদ, আর যিনি ইজতিহাদ করতে জানে না, আর ইজতিহাদী মাসায়েলের মাঝে যে মাসআলা মুজতাহিদ কুরআন ও হাদীসের আলোকে উদ্ভাবন করেছেন তার উপর আমল করে তাকে বলা হয় মুকাল্লিদ। আর যে ব্যক্তি ইজতিহাদের যোগ্যতাও রাখে না, আবার মুজতাহিদের তাক্বলীদও করে না, তাকে বলা হয় গায়রে মুকাল্লিদ।
আমরা এ ঐতিহাসিক সত্যকে মানি যে, হাদীসের কিতাবে সংকলকগণ অনেকে ছিলেন মুজতাহিদ, যা আপনাদের বিশ্বাস অনুযায়ী শয়তান করে। আর অনেকে ছিলেন মুকাল্লিদ, যারা আপনাদের বিশ্বাস অনুযায়ী মুশরিক ছিল। নাউজুবিল্লাহ।
হযারাত মুহাদ্দিসীনে কেরামের ব্যাপাওে ঐতিহাসিকগণ যেসব কিতাব লিখেছেন সেসবের নামই এরকম টাইপের যে,-
# তাবাক্বাতে হানাফিয়্যাহ, # তাবাক্বাতে মালেকিয়্যাহ, # তাবাক্বাতে শাফিয়িয়্যাহ, # তাবাক্বাতে হানাবেলা।
পক্ষান্তরে তাবাক্বাতে গায়রে মুকাল্লিদীন নামে কোন কিতাব কোন গ্রহণযোগ্য মুহাদ্দিস বা ঐতিহাসিক লিখেছেন বলে পাওয়া যায় না। আপনি কোন কিতাব থেকে সিহাহ সিত্তার সংকলকের ব্যাপারে একথা প্রমাণিত করে দেখাতে পারবেন না যে, তাদের মাঝে ইজতিাহদের যোগ্যতাও ছিল না, আবার তারা কারো তাক্বলীদও করেন নি, বরং তারা ছিলেন গায়রে মুকাল্লিদ।
হযরত আক্বদাস মাওলানা খায়র মুহাম্মদ সাহেব জালান্ধরী রহঃ খাইরুল উসুল গ্রন্থে লিখেছেন- ইমাম বুখারী মুজতাহিদ ছিলেন। {নাফেউল কাবীর, কাশফুল মাহবুব}।অথবা তিনি শাফেয়ী ছিলেন। [দ্রষ্টব্য-তাবাক্বাতে শাফেয়ীয়্যাহ-৩/২, আল হিত্তাহ-১২১}
ইমাম মুসলিম রহঃ শাফেয়ী ছিলেন। {আল ইয়াফেউল জিনা-৪৯}
ইমাম আবু দাউদ রহঃ হাম্বলী ছিলেন। {আল হিত্তাহ-১২৫} অথবা শাফেয়ী ছিলেন। {তাবাক্বাতে শাফেয়িয়্যাহ-৬/৪৮}
ইমাম নাসায়ী রহঃ শাফেয়ী ছিলেন। [আল হিত্তাহ-১২৭}
ইমাম তিরমিযী ও ইমাম ইবনে মাজাহ রহঃ শাফেয়ী ছিলেন। {আরফুশ শাজী, খাইরুল উসুল-৯}
লোকটি বলল-“আমরা এসব কিতাব মানি না, আমরা শুধু কুরআন ও হাদীস মানি।
আমি বললাম- “আচ্ছা! মজার ব্যাপারতো! তাহলে বিসমিল্লাহ বলে আপনি কুরআন ও হাদীসে দেখিয়ে দিন যে, সিহাহ সিত্তার সংকলকগণ না ইজতিহাদের যোগ্যতা রাখতেন, না তাক্বলীদ করতেন, বরং ইজতিহাদকে ইবলীসের কাজ, আর তাক্বলীদকে শিরক বলেন, এ কারনে তারা গায়রে মুকাল্লিদ”।
আমি আরো বললাম-“কুরআন ও হাদীস দ্বারা এটাওতো প্রমাণিত হয় না যে, তারা দুনিয়াতে জন্ম নিয়েছিলেন কি না? তারা মুসলমান ছিলেন নাকি না?”
সে বলল- “ঐতিহাসিকগণ ও মুহাদ্দিসীনরা তাদের মুকাল্লিদদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন দলিল ছাড়াই। তাদের স্বীকারোক্তি দেখান। যাতে তারা বলেছেন যে, তারা মুকাল্লিদ।
আমি বললাম- “কোন বিষয়ের সত্যতা যেমন স্বীকারোক্তির দ্বারা প্রমানিত হয়, তেমনি সাক্ষ্যর দ্বারাও প্রমাণিত হয়। এটা মুহাদ্দিসীন ও ঐতিহাসিকদের ধারাবাহিক নিরবচ্ছিন্ন সাক্ষ্যর দ্বারা প্রমাণিত বিষয়। যখন তাদের উল্লেখ সে বিষয়ে অভিজ্ঞরা তাবাক্বাতে মুকাল্লিদীনদের মাঝে করেছেন। আর অন্য মুহাদ্দিসীন ও ঐতিহাসিকগণ এটাকে অস্বিকার করেন নি, তাহলে এটি সর্বসম্মত সাক্ষ্য হয়ে গেছে।
কুরআন ও হাদীসে কি এ মূলনীতি নেই যে, সাক্ষ্যর দ্বারাও প্রমাণ সাব্যস্ত হয়?
লোকটি বলল- সাক্ষ্যর দ্বারাতো প্রমাণ হয়, কিন্তু আমার মন মানছে না। আপনি তাদের স্বীকারোক্তি দেখান।
আমি বললাম- “আপনার মন কি একথাটি মানছে যে, সিহাহ সিত্তার সংকলক মুসলমান ছিলেন?
-অবশ্যই।
-তাদের স্বীকারোক্তি বা সাক্ষ্য পাওয়া গেছে নাকি যে, তারা মুসলমান?
-স্বীকারোক্তিতো পাওয়া যায়নি, কিন্তু সুনিশ্চিত নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিক সাক্ষ্যতো আছে।
-আপনার মন একথা মানছে যে, সিহাহ সিত্তার সংকলক আলেম ছিলেন। তারা মুহাদ্দিস ছিলেন। নামাযী ছিলেন। হাজী ছিলেন। রোযাদার ছিলেন?
-অবশ্যই। অবশ্যই।
-তাদের কোন স্বীকারোক্তি আছে যে, তারা আলেম? তারা নামাযী? তারা হাজী? তারা রোযাদার? নাকি সাক্ষ্য দ্বারা একথা জানতে পেরেছেন?
আপনার মন বড়ই আশ্চর্য ধরণের! তাদের বিদ্যমানতা তাদের আলেম হওয়া, হাজী হওয়া, নামাযী হওয়া, রোযাদার হওয়া, মুহাদ্দিস হওয়া সবই ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দ্বারাতো মেনে নিচ্ছে মন। কিন্তু তাদের মুকাল্লিদ হওয়ার উপর ঐতিহাসিক সাক্ষ্য মন মেনে নিচ্ছেনা। বড়ই আশ্চর্য ব্যাপার!
যদি ঐতিহাসিক সাক্ষ্যকে অস্বিকার করার ইচ্ছে হয়, তাহলে তাদের ঈমান, তাদের ইসলামও অস্বিকার করুন। কেননা, এসব ঐতিহাসিক সাক্ষ্য মন মেনে নেওয়ার যোগ্য নয়।
কিন্তু যদি তাদের মুমীন, মুসলমান, হাজী, রোযাদার, নামাযী, মুহাদ্দিস হওয়া ঐতিহাসিক সাক্ষ্যর ভিত্তিতে মেনেই নেন, তাহলে মুকাল্লিদ হওয়াও মেনে নিন।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম-“আপনি সাহাবীদের মানেন?”
-হ্যাঁ।
-সেই সাহাবীকেই কেবল মানেন, যিনি নিজে স্বীকার করে বলেছেন যে, তিনি সাহাবী? নাকি যার সাহাবী হওয়া স্বীয় স্বীকারোক্তি দ্বারা নয়,বরং ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত তাকেও সাহাবী মানেন?
-সবাইকেই মানি। আপনি কেবল সেই রাবীকেই দুর্বল বলেন, যে রাবী স্বীকার করে বলেছে যে, সে দুর্বল, সে মিথ্যুক, সে দাজ্জাল, সে সত্যবাদী নয়, সে অপরিচিত ইত্যাদি?
-ঐতিহাসিক সাক্ষ্য ছাড়া এখানে কোন পথই নেই।
-যে মূলনীতিকে আপনি সর্বস্থানে মানেন, সেই মূলনীতির ভিত্তিতেইতো সিহাহ সিত্তার সংকলক মুকাল্লিদ ও মুজতাহিদ হওয়া প্রমাণিত। তাদের গায়ওে মুকাল্লিদ হওয়ার উপর না আপনি তাদের কোন স্বীকারোক্তি পেশ করতে পারবেন, না কোথাও তারা একথা বলেছেন যে, তারা মুকাল্লিদ ও নন, আবার মুজতাহিদও নন, বরং তারা গায়রে মুকাল্লিদ। না আপনি কোন ঐতিহাসিক সাক্ষ্য পেশ করতে পারবেন তাদের গায়রে মুকাল্লিদ হওয়ার উপর।
-আমি যদি ইংরেজদের আগমণের পূর্বের কিতাব দেখাতে পারি যাতে আহলে হাদীস নাম আছে, তাহলেতো আপনি মেনে নিবেন যে, আহলে হাদীস দল শুরু থেকেই চলে আসছে?
-আমি যদি আপনাকে হাদীসে আহলে কুরআন শব্দ দেখিয়ে দেই যাতে রাসূল সাঃ বলেছেন “হে আহলে কুরআন! বিতর পড়!” {সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১১৬৯} এবং রাসূল সাঃ আরো ইরশাদ করেছেন যে, “আহলে কুরআনই আহলূল্লাহ!” {সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-২১৫}, তাহলে কি আপনি মেনে নিবেন যে, এ হাদীস অস্বিকারকারী যারা নিজেদের আহলে কুরআন বলে দাবী করে, তারা রাসূল সাঃ এর জমানা থেকেই ছিল?
-না, না,কিছুতেই না।
-আমি যদি কুরআন ও হাদীস মুসলিমীন ও জামাআতে মুসলিমীন শব্দ দেখিয়ে দেই, তাহলে কি আপনি মেনে নিবেন যে, মাসঈদী ফিরক্বা যারা আহলে হাদীসদেরও অমুসলিম বলে, তারা রাসূল সাঃ এর জমানা থেকেই চলে আসছে?
-না, না, কিছুতেই না।
-যদি কুরআনে কারীমে রবূহ শব্দ দেখাতি পারি, তাহলে কি মেনে নিবেন যে, কাদিয়ানীদের রবূহ হযরত ঈসা আঃ এর সময়কালে বানানো?
-অবশ্যই না।
-যদি কুরআন ও হাদীসে আহমাদ শব্দ দেখাতে পারি, তাহলে কি আপনি মেনে নিবেন যে, কাদিয়ানী যারা নিজেদের আহমাদী দাবি করে, তারা রাসূল সাঃ এর জমানা থেকেই বিদ্যমান?
-অবশ্যই না। তবে আপনার জানা উচিত যে, হাদীসের শব্দ কুরআনে ২৮ স্থানে এসেছে।
-তো কী হয়েছে? কুরআন শব্দ ৬৮ স্থানে এসেছে। আর কিতাব শব্দ ২৪২ স্থানে, আহলে কিতাব শব্দ ২৮ স্থানে, আহলুল ইঞ্জিল ১ স্থানে, আহলে মদীনা এক স্থানে, আহলে মাদায়েন ৩ স্থানে এসেছে। অথচ আহলে হাদীস এক স্তানেও আসেনি।
-কিতাবে যে আহলে হাদীসের কথা আছে, এর দ্বারা কারা উদ্দেশ্য?
-হাদীস ও কিতাবের মাঝে যে আহলে কুরআন শব্দ আছে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য কারা?
-হুফফাজুল কুরআন তথা কুরআনের হাফেজরা উদ্দেশ্য। মুনকিরীনে হাদীস তথা হাদীস অস্বিকারকারীরা নয়।
-কুরআন ও হাদীসেতো “আহলে হাদীস”শব্দ আসেনি। আমভাবে কিতাবের মাঝে যে আহলে হাদীস বা আসহাবুল হাদীস শব্দ আসে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল- মুহাদ্দিসীনে কেরাম ও হুফফাজে হাদীসগণ। এর দ্বারা মুনকিরীনে ফিক্বহ তথা ফিক্বহ অস্বিকারকারী গায়রে মুকাল্লিদ উদ্দেশ্য নয়।
-খতীব বাগদাদী পূর্ণ একটি কিতাবই লিখেছেন। যার নাম হল-“শরফু আহলিল হাদীস”।
-এটাতো হাদীস ও মুহাদ্দিসীনদের ফযীলতের উপর লেখা। যেমন প্রায় প্রতিটি হাদীসের কিতাবেই কুরআনের ফযীলতের অধ্যায়, হুফফাজুল কুরআনের ফযীলতের উপর অধ্যায় থাকে। সে সকল হাদীসের সাথে আহলে কুরআন মুনকিরীনে হাদীসের কী সম্পর্ক? তেমনি মুহাদ্দিসীনদে ফযীলততো যথার্থ। কিন্তু এর সাথে গায়রে মুকাল্লিদদের কী সম্পর্ক?
-আরে আমরাতো হাদীস মানি। এ কারণে আহলে হাদীস।
-হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলীরাও হাদীস মানে। আর হাদীসের সব কিতাব তারাই একত্রিত করেছেন। কোন গায়রে মুকাল্লিদ হাদীসের কোন মূলনীতি পর্যন্ত সনদ সহকারে আজ পর্যন্ত বর্ণনা করেনি।
বরং সারা দুনিয়াতে একটি কিতাবও এমন নেই যে, যে কিতাবের সনদের বর্ণনাকারীদের গায়রে মুকাল্লিদ হওয়া তাদের স্বীকারোক্তি অথবা ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত।
তারপরও আশ্চর্য ব্যাপার হল! হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলীদের আহলে হাদীস মানা হয় না। অথচ যাদের হাদীসে সংকলনে নেই কোন ভূমিকা, নেই হাদীস যাচাই বাছাইয়ে, নেই হাদীস প্রচার-প্রসারেও তাদের বলা হচ্ছে “আহলে হাদীস”!?
-আমরা ফিক্বহ, রায় ও কিয়াসকে মান্যকারীদের শয়তান মনে করি, তাই আমরা আহলে হাদীস।
-রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন যে, “একজন ফক্বীহ শয়তানের উপর এক হাজার আবেদের চেয়ে বেশি কষ্টকর। {সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-২২২}, এ হাদীস দ্বারাতো একথা বুঝা যায় যে, ফক্বীহ শয়তান হয় না, বরং ফক্বীহ এর বিরোধীরা হয় শয়তান। আপনিও একটি হাদীস দেখান, যাতে বলা হয়েছে যে, ফিক্বহ অস্বিকারকারীর নাম আহলে হাদীস।
-হানাফী, শাফেয়ীরা কুরআন হাদীসের পর ইজমা ও কিয়াসকেও মানে, তাই তারা কখনোই আহলে হাদীস নয়, বরং আহলে রায় বা যুক্তিপূজারী। আমরা শুধুমাত্র আল্লাহ ও তার রাসূল সাঃ এর কথা মানি, কোন উম্মতীর কথা মানাকে শিরক মনে করি, তাই আমরা আহলে হাদীস।
-আপনি সত্য আহলে হাদীস না ধোঁকাবাজ?
-মানে কি?
-আপনি যদি প্রতিটি প্রশ্নের জবাব শুধু কুরআন ও হাদীস থেকে দেন, তাহলে আপনি সত্য আহলে হাদীস। আর যদি আপনিও কোন উম্মতীর কথা উদ্ধৃত করেন, তাহলে আপনি ধোঁকাবাজ আহলে হাদীস।
-আমি সত্য আহলে হাদীস। সকল প্রশ্নের জবাব শুধু কুরআন ও হাদীস থেকেই দেব।
-হাদীসের সংজ্ঞাটা একটু বর্ণনা করুন।
-রাসূল সাঃ এর কওল তথা বক্তব্য, ফেল তথা কর্ম ও তাক্বরীর তথা নীরব সম্মতিকে হাদীস বলে।
-এ সংজ্ঞাটি কোন কুরআনের আয়াতে আছে?
-اذا اسر النبى الى بعض ازواجه حديثا
-রাসূল সাঃ কি কওল, ফেল ও তাক্বরীর তিনটি লুকিয়েছিলেন?
-না।
-এ সংজ্ঞাটি কোন হাদীসে আছে?
-না, নেই। এ সংজ্ঞাতো কোন উম্মতী বানিয়েছেন।
-এ কারণেইতো আমি আপনাকে বলেছিলাম যে, আপনি মিথ্যা আহলে হাদীস। নাম হাদীসের নেন। আর বক্তব্য উম্মতীর মানেন। আবার উম্মতীর কথাও পূর্ণ মানেন না। আসলে আপনারা না নবীকে মানেন, না কোন উম্মতীকে। বরং নিজের নফসকে মানেন তথা মনের পূজা করে থাকেন।
-হাদীসের সংজ্ঞায় আমি কি ভুল করেছি?
-মুহাদ্দিসুল আসর, মাওলানা খায়ের মুহাম্মদ সাহেব জালন্ধরী রহঃ বলেছেন-
হযরত রাসূল সাঃ এবং সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণের কওল, ফেল ও তাক্বরীরকে বলা হয় হাদীস। আবার কখনো কখনো এটাকে “খবর”ও বলা হয়। {খাইরুল উসূল-৩}
লোকটি বলল-আমি এ সংজ্ঞা এই প্রথম শুনলাম। এ সংজ্ঞা অনুযায়ীতো সবাই আহলে হাদীস হয়ে যাবে। এ সংজ্ঞা কি হযরতের আগে আর কেউ করেছেন নাকি?
-মিশকাতের ভূমিকায় নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান সাহেব ও আল হিত্তাহ ফি জিকরীস সিহাহ সিত্তাহ এর ৫৬ নং পৃষ্ঠায় জমহুর ওলামা থেকে এটাই নকল করেছেন। কিন্তু এ সকল সর্বশেষে উম্মতীইতো হবেন। তাদের বক্তব্য না কুরআন, না হাদীস। তো?
-কোন আহলে হাদীস কি এ সংজ্ঞা লিখেছেন?
-আপনাদের নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান সাহেবের আহলে হাদীস হওয়ার মাঝে কোন সন্দেহ আছে নাকি? শুধু তাই নয়, দারুল হাদীস মদীনা মনোয়ারা উস্তাদ শায়েখ সাইফুর রহমান স্বীয় কিতাব “আস সাহলুল মুসাহহাল ফি মুসতালাহিল হাদীস”নামক গ্রন্থেও ১০ নং পৃষ্ঠায় এ সংজ্ঞাই করেছেন। আর মুহাদ্দিসীনে কেরামও হাদীসের এ তিন প্রকার করেছেন। তথা ১-মারফু, ২- মাওকুফ। ৩- মাকতু’।
কুরআন ও হাদীস
তারপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম-“আপনাদের যে দাবি যে, আপনারা কেবল কুরআন ও হাদীস মানেন”এ দাবি পালন করতে গিয়ে উভয়ের পদ্ধতি কি একই না ভিন্ন ভিন্ন?
সে বলল-“মানে কি?”
আমি বললাম-“আপনারা কুরআনের কোন আয়াতের সনদ অনুসন্ধান করেন না, অথচ হাদীসের ক্ষেত্রে সনদ তালাশ করেন, এ পার্থক্য কি কুরআনে কারীমে বর্ণিত? নাকি হাদীসে আছে?
লোকটি ঘাবড়ে গিয়ে বলতে লাগল-“এ পার্থক্য না কুরআনে আছে, না হাদীসে আছে। এটাতো উসুলবীদ ওলামায়ে কেরাম বলেছেন। আর তারা সবাই উম্মতী।
আমিবললাম-তাহলে আপনাদের আহলে হাদীস হওয়ার দাবিটি আবারো মিথ্যা প্রমাণিত হল।
হাদীসের প্রকারভেদ
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম-“যেভাবে আপনারা কুরআনে পাকের সকল আয়াতকে সহীহ ও মুতাওয়াতির মানেন, তেমনি সকল হাদীসকেও কি এমন পর্যায়ের সহীহ ও মুতাওয়াতির মানেন? ইা কিছুকে সহীহ আর কিছুকে দুর্বল মানেন?”
সে বলল-“হাদীসেরতো অনেক প্রকার আছে। যেমন মুতাওয়াতির, মাশহুর, আজীজ, গরীব, মারফু, মওকুফ, মাকতু, সহীহ লি জাতিহী, সহীহ লি গায়রিহী, হাসান লি জাতিহী, হাসান লি গায়রিহী, জয়ীফ, মওজু, মাতরুক, শাজ, মাহফুজ, মুনকার, মারুফ, মুআল্লাল, মুযতারাব, মাকলুব, মুসাহহাফ, মুদরাজ, মুত্তাসিল, মুসনাদ, মুনকাতি, মুআল্লাক, মুফাসসাল, মুরসাল, মুদাল্লাস, মুআন আন, মুসালসাল ইত্যাদি।
– এ সকল প্রকার কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন?
– না, বলেন নি।
– হাদীসে রাসূল সাঃ বলেছেন?
– না।
– আপনারা কোন হাদীসকে সহীহ, কোন হাদীসকে জয়ীফ, কোন হাদীসকে মওজু ইত্যাদি বলে থাকেন। এসব বলতে আপনাদের আল্লাহ তাআলা বলেছেন? না রাসূল সাঃ?
– এসব আল্লাহ ও রাসূল সাঃ বলেন নি, এসবতো উম্মতীদের গবেষণা।
– তাহলেতো আপনারা আহলে হাদীস না। বরং আপনাদের বক্তব্য অনুপাতেই আপনার মুশরিক।
এবার লোকটি বহুত পেরেশান হয়ে যায়। বলতে লাগল- “আপনি আমাকে দু’মাসের সময় দিন। গবেষণা ও তথ্য-তালাশ করে আবার আসবো”।
আমি বললাম-“আপনার ইচ্ছে”।
দ্বিতীয়বার আগমণ
আনুমানিক ৪ মাস পর লোকটি আবার আসল। এসে বলতে লাগল-“আপনি বলেছেন কোন হাদীসে আহলে হাদীস শব্দ নেই। আমি সে হাদীস খুঁজে নিয়ে এসেছি”।
আমি বললাম-“আপনার মনে হয় আমার কথা মনে নেই। আমি আপনার কাছে এমন হাদীস চেয়েছিলাম, যাতে রাসূল সাঃ ফিক্বহ অস্বিকারকারীকে আহলে হাদীস বলেছেন”।
সে বলল-“এটা হাকীম মুহাম্মদ সাদেক শিয়ালকুটির কিতাব ‘সাবিলুর রাসূল’কিতাবে আছে। হাদীসটি হল-
عن انس رض قال قال رسول الله ﷺ اذا كان يوم القيامة جاء اصحاب الحديث ما بين يدى الله ومعهم المحابر، فيقول الله انتم اصحاب الحديث كنتم تصلون على النبى صلى الله عليه وسلم ادخلوا الجنة-
অর্থাৎ হযরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-কিয়ামতের দিন মুহাদ্দিসীনরা আল্লাহ তাআলার সামনে উপস্থিত হবেন স্বীয় দোয়াতসহ। আল্লাহ তাআলা বলবেন-‘তোমরা মুহাদ্দিস ছিলে। আর রাসূল সাঃ এর উপর দরূদ পড়তে। যাও! জান্নাতে প্রবেশ কর”’। (মুহাদ্দিসে খতীব বাগদাদী সংকলিত জাওয়াহেরুল উসুল, তারীখে বাগদাদ”।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম- “এ হাদীস কি সহীহ? এর সহীহ হওয়া আল্লাহ বা রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণিত করে দাও, তাহলে আমি আপনাকে আহলে হাদীস মেনে নিব। আর যদি প্রমাণ করতে না পারেন, তাহলে কোন উম্মতীর দ্বারা প্রমাণিত করুন, তারপর ঘোষণা দিয়ে দেন যে, আপনি মিথ্যা আহলে হাদীস ছিলেন, আর এখন ওমুক ব্যক্তির মুকাল্লিদ হয়ে গেছেন”।
– খতীব বাগদাদী এটাকে সহীহ বলেছেন। আর আমিও এ মুহাদ্দিসের তাক্বলীদ করে এটাকে সহীহ বলি।
– রেফারেন্স দিন যে, খতীব বাগদাদী এটাকে সহীহ বলেছেন।
– রেফারেন্সতো আমার জানা নেই। আমিতো শুধু হাকীম মুহাম্মদ সাদেক সাহেবের উপর নির্ভর করেছি।
– খতীব বাগদাদীতো এ হাদীসের ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন যে, هذا حديث موضوعঅর্থাৎ এ হাদীস বানোয়াট ও মনগড়া। {তারীখে বাগদাদ-৩/১৪০}। একথা জানেনতো যে, আল্লাহর নবীর উপর মিথ্যারোপ করা স্বীয় ঠিকানা জাহান্নামে বানানো?
লোকটি খুব ধ্যান দিয়ে রেফারেন্সটি পড়ল। চিন্তিত হয়ে গেলে সাথে সাথে।
আমি বললাম-“আল্লামা সুবকী শাফেয়ী রহঃ ও এ হাদীসের ব্যাপারে বলেছেন যে, এর বর্ণনাকারী “মুহাম্মদ বিন ইউসুফ”।যাকে খতীব বাগদাদী “কাজ্জাব”তথা মারাত্মক মিথ্যুক বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর আমাদের উস্তাদ ইমাম জাহাবী রহঃ বলেছেন যে, লোকটি জাল হাদীস বানাতো। লোকটি তাবরানী রহঃ এর দিকে একটি মিথ্যা হাদীসের নিসবত করেছিল। আমার মনে হচ্ছে এটা সেই হাদীসই”।{তাবাক্বাতে শাফিয়িয়্যাহ-১/৯৩}
আশ্চর্য ব্যাপার হল-আপনি চার মাস ধওে যে জাল হাদীস অনুসন্ধান করেছেন?! সেটা দ্বারাও একথা প্রমাণিত হয় না যে, সে মুহাদ্দিসীনরা ফিক্বহের অস্বিকারকারী ছিলেন।
সুতরাং একথা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, ফিক্বহ অস্বিকারকারী আহলে হাদীস কোন জাল হাদীস দিয়েও প্রমাণিত হয় না। এটাকেই ‘দ্বীন দুনিয়া সবই গেল’বলে। রাসূল সাঃ এর উপর মিথ্যা বলে দ্বীন ধ্বংস করা হল, আর দুনিয়াতে রইল অপমান”।
আমি তাকে আরো বললাম-“আফসোস! আপনারা মক্কা-মদীনার নাম নেন, অথচ কিতাব শিয়ালকোটের পেশ করছেন। যার লেখক কোন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি নয়। আরে তিনিতো তার কিতাব সাবিলুর রাসূল গ্রন্থেও ২৪৬ নাম্বার পৃষ্ঠায় এক হাদীস নকল করেছেন। যাতে রয়েছে যে, ‘উত্তম আমল হল-নামায প্রথম ওয়াক্তে পড়া’।
একথার উপর বুখারীর রেফারেন্স দিল। অথচ বুখারীতে শুধু এতটুকু লেখা যে, ‘উত্তম আমল হল- নামায সময়মত পড়া’।
হাকীম সাদেক সাহেব স্বীয় মতবাদ প্রমাণ করার জন্য ‘প্রথম’শব্দ নিজ থেকে বাড়িয়ে দিল। অথচ বুখারীতে ‘প্রথম’শব্দটির কোন নিশানাও নেই”।
লোকটি বলল-“এটা কি করে সম্ভব?”
আমি বললাম-“আপনি বুখারী থেকে দেখিয়ে দিন”।
দ্বিতীয় হাদীস
লোকটি বলল- “আচ্ছা ঠিক আছে। সাদেক শিয়ালকুটি সাহেব এ জাল হাদীস লিখেছেন। কিন্তু তিনি ৩২০ নং পৃষ্ঠায় আরেকটি হাদীস লিখেছেন। সেটা হল- রাসূল সাঃ দুআতে বললেন যে, হে আল্লাহ! তুমি আমার খলীফাদের উপর রহম কর! সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন-হুজুর! আপনার খলীফাগণ কারা? তিনি বললেন-যারা আমার পর আসবে। আর আমার হাদীস বর্ণনা করবে। আর অন্যদের শিখাবে। [শরফু আসহাবুল হাদীস]”।
আমি বললাম-“আল্লামা যায়লায়ী রহঃ নসবুর রায়াহ এর ১ নং খন্ডের ৩৪৮ নাম্বার পৃষ্ঠায়, আর আল্লামা জাহাবী রহঃ মিযানুল ই’তিদালের ১ নং খন্ডের ১২৭ নাম্বার পৃষ্ঠায় এ হাদীস সম্পর্কে বলেন যে, هذا باطلতথা এ হাদীস জাল।
এ হাদীসের বর্ণনাকারীর ব্যাপারে ইমাম দারা কুতনী রহঃ বলেন-কাজ্জাব তথা চূড়ান্ত মিথ্যুক। {মিযানুল ই’তিদাল-১/১২৬}
সাদেক সাহেব কি আপনাদের জন্য জাল হাদীস একত্রিত করে নাম সাবিলুর রাসূল রেখে দিলেন?”
লোকটি এবার আরো বেশি পেরেশান হয়ে যায়। আমি তাকে বললাম-“এ হাদীসেরও কোথাও একথা নেই যে, তারা ফিক্বহের অস্বিকারকারী”।
তৃতীয় হাদীস
লোকটি বলল- রাসূল সাঃ কে জিজ্ঞেস করা হল- আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত কারা? তিনি বললেন- ما انا عليه اليوم واصحابى। {মুহাল্লাল ও নাহলের রেফারেন্সে সাবিলুর রাসূল-১৪০}
আমি বললাম- “এখানেতো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের কথা। আর মুহাল্লাল ও নহলে এর কোন সনদ উল্লেখ নেই। ইবনুল যাওজী এটাকে মওজুআতে উল্লেখ করে এটাকে মনগড়া সাব্যস্ত করেছেন”।
লোকটি বলল-“সাদেক সাহেব কি সব জাল হাদীসই একত্র করে গেলেন নাকি?
সাহাবীদের বক্তব্য
লোকটি বলল- হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাঃ স্বীয় ছাত্রদের বলেছেন যে, فانكم خلوفنا واهل الحديث بعدناতথা ‘তোমরা আমার খলীফা। আর আমাদের পর হুফফাজ হবে’।
আমি বললাম-“এর সনদের রাবী আবু হারূন আল ঈদী সম্পর্কে লিখা আছে যে, اكذب من فرعونতথা সে ফেরাউনের চেয়েও বেশি মিথ্যুক। {মিযানুল ই’তিদাল-৩/১৭৪}।যাইহোক, এটাতে একথা কোথায় যে, তিনি ফিক্বহের অস্বিকারকারী ছিলেন? বরঞ্চ তিরমিযীতো একথা লিখা আছে যে, তিনি ফিক্বহের ছাত্র ছিলেন।
সুতরাং বুঝা গেল যে, আল্লাহ তাআলা বা রাসূল সাঃ তো দূরে থাক, কোন সাহাবী থেকেও একথা প্রমাণিত হয় না যে, ফিক্বহের অস্বিকারকারীর নাম আহলে হাদীস”।
একটি স্বপ্ন
লোকটি বলতে লাগল- জনাব হাকেম সাদেক সাহেব বলেছেন যে, হযরত আবু বকর বিন আবু দাউদ সিজিস্তানী মুহাদ্দিস রহঃ বলেছেন যে, তিনি সিজিস্তানে হযরত আবু হুরায়রা রাঃ এর হাদীস সংকলন করছিলেন। সে সময় একদা স্বপ্নে হযরত আবু হুরায়রা রাঃ এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। আমি তাকে বললাম- আমি আপনাকে অনেক ভালবাসি। তিনি বললেন-আমি দুনিয়াতে আহলে হাদীস ছিলাম। {সাবিলুর রাসূল-৩১৪}
আমি তাকে বললাম-“এ স্বপ্নের ব্যাপারে খোদ সাদেক সাহেবই লিখেছেন যে, ‘আমি এ স্বপ্নটিকে কেবল সহায়ক হিসেবে বর্ণনা করলাম। দলিল হিসেবে নয়’।
এবার দেখুন! এ স্বপ্নটি কার?
স্বপ্ন কার?
স্বপ্নটি ছিল ইমাম আবু দাউদ রহঃ এর ছেলের। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তার মুখস্ত শক্তি ছিল প্রখর। হাদীস খুবই মুখস্ত ছিল। কিন্তু এর সাথে সাথে তিনি অনেক বড় মিথ্যুকও ছিলেন। খোদ তার পিতা আবু দাউদ রহঃ এবং মুহাদ্দিস ইবরাহীম আসবায়ী রহঃ তাকে কাজ্জাব তথা চূড়ান্ত মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। {মিযানুল ই’তিদাল-২/৪২৩}
আর শায়েখ কাওসারী রহঃ বলেন- هو ناصبى مجسم خبيث তথা সে নাসেবী ছিল, মুজাসসামা ফিরক্বার অনুসারী, সেই সাথে ছিল খবীশ। {তাম্বীহুল খতীব-৬৮}
স্বপ্ন মূলত কী ছিল?
এ স্বপ্নটি আল ইসাবা গ্রন্থেও ৪ নং খন্ডের ২০৪ নাম্বার পৃষ্ঠায়, আর তারীখের গ্রন্থে ৯/৪৬৭, ও তাযকিরাতুল হুফফাজের ১/৪৯ এ বর্ণিত এ স্বপ্নটির আরবী পাঠ এই-
انا اول اصحاب الحديث كان فى الدنياএ বাক্যের অনুবাদ গায়রে মুকাল্লিদরা তাযকীরাতুল হুফফাজে এই করেছে যে, “আমিই দুনিয়াতে প্রথম ব্যক্তি, যে এত বড় ভান্ডার সংরক্ষণ করেছে”।
দেখুন! সাদেক শিয়ালকুটি সাহেবের যখন দরকার হয়, তখন “আওয়াল তথা প্রথম”শব্দ নিজ থেকে বাড়িয়ে দেন, অথচ এখানে “আওয়াল”শব্দ বিদ্যমান থাকা সত্বেও যখন নিজের মাকসাদের বিপরীত মনে হল, তখন সেটাকে উধাও করে দিলেন।
তারপরও উদ্দেশ্য হাসীল হয়নি। হাদীস সংকলনকারীদের মুহাদ্দিস বা সাহেবে হাদীস অথবা আহলে হাদীস বলা জায়েজ আছে। কিন্তু আবু হুরায়রা রাঃ কি এটা বলেছেন নাকি যে, তিনিই ফিক্বহের প্রথম অস্বিকারকারী, তাই তার নাম আহলে হাদীস?
আরে ভাই! এসব লোকেরা নিজেদের আহলে হাদীস পরিচয় দিয়ে এ কেমন খেলা শুরু করে দিল?
শেষ কথা
অবশেষে লোকটি বলতে লাগল- উম্মতীকে মানা ছাড়া কোন গত্যান্তর নেই। এজন্যই আমরা আহলে হাদীসরাও চার দলিল মানি।
আমি বললাম- আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না। আপনি আমার ছয়টি প্রশ্নের জবাব লিখিতভাবে দিন। আর এর মাঝে আপনাদের নেতৃস্থানীয় ১০ জন ব্যক্তির দস্তখতসহ ছাপিয়ে দিন। তাহলে আমি আপনার কথা বিশ্বাস করব।
১ নং প্রশ্ন-
আপনি কোন দলিলের ভিত্তিতে ইজমা, কিয়াস ও ফিক্বহকে হুজ্জত তথা দলিল মানতে শুরু করেছেন? সে সকল দলিলসমূহ বিস্তারিত লিখে দিন।
২ নং প্রশ্ন
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলীগণ ধারাবাহিকভাবে এ ৪ দলিলকে মানেন। কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস। আপনারা তাদের আহলে হাদীস বলেন না, বরং আহলে রায় তথা যুক্তিপূজারী ও আহলে কিয়াস বলে থাকেন। এখন আপনারাও এ ঘোষণা দিয়ে দেন যে, আপনারাও পরিপূর্ণ আহলে রায়, এবং আহলে কিয়াস। আর এতদিন পর্যন্ত যে নিজেদের আহলে হাদীস বলতেন তা ছিল মিথ্যাচার।
৩ নং প্রশ্ন-
এ ঘোষাণাও দিয়ে দেন যে, যেখানে হানাফীরা ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর কিয়াসকে মানে, সেখানে আমরা ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর বিপরীতে আমরা নিজেরাই কিয়াস করি। অথবা নিজেদের মসজিদের ইমামের কিয়াসকে মানি।
আজ পর্যন্ত এ মিথ্যা বলতে ছিলাম যে, “যেখানে হানাফীরা ইমাম আবু হানীফার ইজতিহাদকে মানে, সেখানে আমরা হাদীসে রাসূল মানি”
এ মুহুর্তে সে মিথ্যাচার থেকে সাচ্চা দিলে তওবা করছি।
৪ নং প্রশ্ন
আপনারা যখন কোন কিয়াস করেন, তখন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মত আপনাদের কোন উসূলে ফিক্বহ তথা তথা ফিক্বহের মূলনীতি আছে? না কাদিয়ানীদের মত মূলনীতিহীন কিয়াস করেন?
আমরা যেহেতু উসূলধারী তথা মূলনীতি নির্ভর। তাই আমাদের রয়েছে-
# উসুলুশ শাশী [৩২৫ হিজরী]।# উসুলে কারখী [৩৪০ হিজরী]।# আল ফুসূল ফিল উসূল লি আবু বকর রাজী [৩৭০ হিজরী]।
# উসুলে বাযদয়ী [৪৮২ হিজরী]।# উসূলে সারাখসী [৪৮৩ হিজরী। # হুসামী [৬৪২]।# আল মুগনী ফিল উসূল [৬৯১]।# আল মানার [৭১০ হিজরী]।# আত তানক্বীহ [৭৪৭ হিজরী]।# তাহরীরুল উসূল [৮৬১ হিজরী]।# মুসাল্লামুস সুবুত [১১১৯ হিজরী] এর মত গ্রহণযোগ্য কিতাবাদী। আপনারাও নিজেদের উসুলের কিতাবের নাম সালসহ উল্লেখ করুন।
৫ নং প্রশ্ন
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী এবং হাম্বলীগণের কিতাব সংরক্ষিত ও সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত। কাদিয়ানীদের নিজস্ব কোন কিতাব নেই। তারা ফিক্বহী মাসায়ের এদিক সেদিক থেকে চুরী করে সংগ্রহ করে। আপনাদের ফিক্বহের সনদযুক্ত কিতাব কোনটি কোনটি? যা আপনাদের মাদরাসায় সিলেবাসভূক্ত? সনসহ সেসবের তালিকা অথবা এ স্বীকারোক্তি প্রকাশ করুন যে, আপনাদের অভ্যাসও এদিক সেদিকের মাসায়েল চুরি করা।
৬ নং প্রশ্ন
আপনি আপনাদের ১০টি সর্বসম্মত মত, এবং ১০টি কিয়াসী মাসায়েল লিখে দিন। যা আহলে সুন্নাতের কিতাব থেকে চুরি করা হয়নি।
লোকটি বলতে লাগল- “আরে ভাই! আমিতো এক মুসিবত থেকে বাঁচার জন্য ৪ দলিলের নাম নিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার এ ৬ প্রশ্ন আমাকে আরেক মুসিবতে ফেলে দিল!”