প্রশ্ন
আচ্ছালামুআলাইকুম ওয়াঃ
হযরত কেমন আছেন ?
আমি মোঃ আশরাফুল আলম
নওগাঁ,রাজশাহী
প্রশ্নটি অনেক লম্বা । বিস্তারিত লিখেছি । কারন হক্কুল এবাদ এর বিষয় ।
————-
কিছু দিন পূর্বে আমি একটি লক আইফোন ক্রয় করি সিলেট থেকে ।
লক খুলতে গেলে তারা আমাকে ১৫ দিনের সময় দেয় । ১৫ দিন পর তারা আমাকে মোবাইল বেক করে এবং বলে আরো ১৫ দিন সময় দিলে এই লক খুলে দেয়া যাবে ।
ঘটনা ক্রমে আমার তাবলীগে যাবার কথা হয় ৪০ দিনের জন্য । আমি সিদ্ধান্ত্য নিলাম যে, মোবাইলটি আমি বিক্রয় করে দেব ।
এখানেই ডট কমে এড দিলে একজন মহিলা আমার কাছ থেকে মোবাইল ক্রয় করে ।
সেই মহিলা ছিল খুদে প্রতিবন্ধি এবং তার বাচ্চাও ছিল । তাই সে বলেছিল যে, আমি বাচ্চা নিয়ে এখানে সেখানে যেতে পারব না । আপনি হেল্প করলে আমার উপকার হবে ।
আমি তাকে সব খুলে বলি এবং সবশেষে বলি যে, আপনি যদি খুলতে না পারেন তাহলে আমাকে যেই মোবাইল ইঞ্জিনিয়ার খুলে দিতে চেয়েছিল আমি তার থেকে আপনাকে খুলে দেয়ার চেষ্ট করব । আর ক্রয় করার পর সে দুইদিন নিজের কাছে মোবাইল রেখে দেখেছেও । ঘটনা ক্রমে আমার আর তাবলীগে যাওয়া হয় না ।
যাই হোক সে প্রায় ১মাস চেষ্ট করার পর সেও সেই মোবাইলের লক খুলতে পারেনি ।
আমার কথা বলা অনুযায়ি সে আমাকে মোবাইলটি কুরিয়ারে পাঠিয়ে দেয় ।
আমি ঐ ইঞ্জিনিয়ার এর কাছে নিয়ে গেলে সে বলে যে, এখন লক খোলার অপশন বন্ধ হয়ে গেছে । আমি ঐ মহিলাকে কল করে সেই বিষয় জানিয়ে দিই । আমি তার সহানুভতি হয়ে বলেছিলাম যে, মোবাইলটা কি বিক্রি করে দেব ? সে বলে যে, হ্যা দেন । আমি আবার এখানেই ডট কমে বিজ্ঞপ্তি দিই । পরে একজন আমাকে কল করে । আমি সাথে সাথে ঐ মহিলাকে কল করে জানিয়ে দিই যে, মোবাইলটি একজন ক্রয় করতে চাচ্ছে আমি কি দিয়ে দেব ? সে বলেছিল হ্যা দিয়ে দেন ।
আমি ঐ লোকের সাথে কথা বলার পর ঐ লোক আমাকে মিরপুর যেতে বলে । আমি ঐ লোকের কথা অনুযায়ি মিরপুর চলে যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি যে, ঐ লোক পুলিশ । তারা আমার কাছে ডকুমেন্ট চায় । আমি দিতে পারিনি । কারন মোবাইল কেনার সময় আমি ঐ লোক থেকে কোন ডকুমেন্ট নেই নাই । যাই হোক সবশেষে ঐ লোক সহ আরো তিনজন লোক একটি পিকআপ গাড়িতে উঠিয়ে গলি গলি ঘুরতে থাকে এবং আমাকে বিভিন্ন ভাবে ভয় দেখাতে থাকে । অবশেষে তারা আমার থেকে ২০ হাজার টাকা দাবি করে । আমি তাদের ১০ হাজারে মানিয়ে নিই এবং ১০ হাজার টাকা তাদের দিয়ে চলে আসি । তারা ১০ হাজার টাকা+মোবাইল রেখে দেয় ।
আমার কাছে ঐ পুলিশদের পিকাপের নাম্বার, মোবাইল নাম্বার (যা দিয়ে আমাকে কল করেছিল) আছে ।
>> এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে, এরকম পরিস্থিতে আমি ঐ মহিলার কাজ করতে গিয়ে যেহেতু আমাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে । কাজেই এখন কি ঐ ১০ হাজার জরিমানার টাকা কি মহিলার আমাকে দিতে হবে ?
>> আর আমি যেহেতু তার মোবাইল বিক্রি করার কারনে সেখানে গিয়েছি আর মোবাইল পুলিশকে দিতে হয়েছে । কাজেই তার মোবাইলের দাম সমতুল্য টাকা ঐ মহিলাকে আমার দিতে হবে ?
এই মুহূর্তে আসলে শরীয়তের হুকুম কি ? তা জানতে চাই ।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
প্রশ্নটি জটিল। তাই কিছুটা ব্যাখ্যার সাথে উত্তর দেয়া হচ্ছে।
এক নাম্বার বিষয় হল, লক আইফোন চুরীকৃত হয়ে থাকে। জেনে শুনে চুরি করা মাল ক্রয় করা বৈধ নয়।
عن أبي هريرة عن النبي صلى الله عليه و سلم أنه قال : من اشترى سرقة وهو يعلم أنها سرقة فقد اشرك في عارها واثمها ( سنن البيهقى الكبرى-كتاب البيوع، باب كراهية مبايعة من أكثر ماله من الربا أو ثمن المحرم،
অনুবাদ-আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, যে ব্যক্তি কোন চুরির বস্তু চুরির মাল জেনেও ক্রয় করে তবে সেও সেই অপরাধে এবং গোনাহে শরীক হবে। (মুসনাদে ইসহাক বিন রাহুয়া,হাদীস নং-৪১২, শুয়াবুল ঈমান লিলবায়হাকী, হাদীস নং-৫১১২,মুস্তাদরাক আলাস সাহীহাইন,হাদীস নং-২২৫৩, সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী,হাদীস নং-১০৮২৬,মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা,হাদীস নং-২২০৬০)
দ্বিতীয় বিষয় হল, পণ্যে দোষ থাকলে ক্রেতা উক্ত ত্রুটির কারণে বিক্রিত মালটি ফেরত দিয়ে দিতে পারেন।
واذا حصل الإيجاب والقبول لزم البيع، ولا خيار لواحد منهما إلا من عيب، أو عدم الرؤية (هندية، كتاب البيوع-3/8، الجوهرة النيرة-1/220) تاتارخانية-8/222)
তবে ত্রুটি সম্পর্কে জেনে বুঝেই পণ্যটি ক্রয় করলে তাহলে আর পরবর্তীতে ত্রুটির কারণে ফেরত দেয়া যায় না।
جَهْلُ الْمُشْتَرِي بِوُجُودِ الْعَيْبِ عِنْدَ الْعَقْدِ وَالْقَبْضِ فَإِنْ كَانَ عَالِمًا بِهِ عِنْدَ أَحَدِهِمَا فَلَا خِيَارَ لَهُ، وَمِنْهَا عَدَمُ اشْتِرَاطِ الْبَرَاءَةِ عَنْ الْعَيْبِ فِي الْمَبِيعِ عِنْدَنَا حَتَّى لَوْ اُشْتُرِطَ فَلَا خِيَارَ لِلْمُشْتَرِي كَذَا فِي الْبَدَائِعِ (هندية-3/67)
তৃতীয় বিষয় হল, বিক্রির জন্য নিযুক্ত ওকীল এর হাতে পণ্য হারিয়ে বা নষ্ট হয়ে গেলে মুয়াক্কিলকে জরিমানা দিতে উকীল বাধ্য নয়। কারণ এটি তার কাছে আমানত ছিল। আর আমানত দ্রব্য অনিচ্ছায় বা ওকীলের অবহেলা ব্যতীত নষ্ট হয়ে গেলে এর জরিমানা দিতে হয় না।
ولو كان الموكل دفع الدراهم إلى الوكيل فسرقت من يد الوكيل لا ضمان على الوكيل (تاتارخانية، كتاب الوكالة-12/332، رقم-17662)
চতুর্থ বিষয় হল, ওকীলের যাতায়াত ও প্রয়োজনীয় খরচ মুয়াক্কিলের বহন করা দায়িত্ব।
কিন্তু অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় খরচ মুয়াক্কিলের উপর আবশ্যক নয়।
إذَا وَكَّلَ الرَّجُلُ رَجُلًا أَنْ يَشْتَرِيَ لَهُ كُرَّ حِنْطَةٍ فَاشْتَرَاهُ لَهُ فَاسْتَأْجَرَ بَعِيرًا فَحَمَلَهُ عَلَيْهِ فَإِنْ وَكَّلَهُ أَنْ يَشْتَرِيَ لَهُ حِنْطَةً أَوْ طَعَامًا فِي نَوَاحِي الْمِصْرِ الَّذِي هُمَا فِيهِ فَالْقِيَاسُ أَنْ يَكُونَ مُتَبَرِّعًا فِي النَّقْلِ وَلَا يَرْجِعُ بِالْأَجْرِ وَفِي الِاسْتِحْسَانِ لَا يَصِيرُ ضَامِنًا وَيَرْجِعُ بِالْكِرَاءِ وَإِنْ وَكَّلَهُ أَنْ يَشْتَرِيَ لَهُ حِنْطَةً فِي قَرْيَةٍ مِنْ قُرَى الْمِصْرِ الَّذِي هُمَا فِيهِ يَصِيرُ الْوَكِيلُ مُتَبَرِّعًا وَلَا يَرْجِعُ بِالْكِرَاءِ قِيَاسًا وَاسْتِحْسَانًا (الفتاوى الهندية-3/641)
এবার উত্তরটি বুঝে নিন!
উপরোক্ত চারটি মাসআলা বুঝে থাকলে এবার আপনার প্রশ্নটির উত্তর বুঝা সহজ হবে।
প্রথমত চুরিকৃত মাল জেনেও তা ক্রয় করা আপনার উচিত হয়নি।
দ্বিতীয়ত মহিলার কাছে বিক্রির সময় যদি মোবাইল না খোলার ত্রুটির কথা মহিলাকে জানানো হয়ে থাকে, আর জেনেশুনেই ক্রয় করে থাকে তাহলে ক্রয় বিক্রয় বিশুদ্ধ হয়ে গেছে। তাই সেটি আর ফেরত দেবার অধিকার মহিলার নেই।
তবে এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় হল, মহিলা ত্রুটি তথা লক সারিয়ে দেবার শর্তে যদি ক্রয় করে থাকে, তাহলে লক সারানো সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব আপনার উপর বর্তাবে।
সেই হিসেবে লক সারাতে না পারলে মহিলার জন্য উক্ত মোবাইল ফেরত দেবার অধিকার থাকবে।
কিন্তু যদি লক সারানোর শর্তে ক্রয় না করে থাকে, তাহলে আর ফেরত দিতে পারবে না।
উপরোক্ত দুই সুরতের মাঝে যদি দ্বিতীয় সুরত তথা লক সারানোর শর্তে ক্রয় না করে থাকে, তাহলে ক্রয় বিক্রয় বিশুদ্ধ হয়ে গেছে।
এখন আবার আপনি মহিলাটির ওকীল হিসেবে যখন বিক্রি করতে গেলেন, তখন মোবাইলটি ক্রেতার হাতে হস্তান্তর করতে যাবার আসা যাওয়ার ভাড়া মহিলার জিম্মায় আবশ্যক।
সেই সাথে মোবাইলটি আপনার কাছে মহিলার আমানত থাকায় এর জরিমানা আপনার উপর আবশ্যক হবে না।
আর পুলিশী ঝামেলা যেহেতু উক্ত পন্য বিক্রয়ের সাথে সম্পৃক্ত নয়, বরং আলাদা একটি বিষয়, তাই এর দায়ভার বা জরিমানা মহিলাটির উপর বর্তাবে না।
সংক্ষেপঃ
যাতায়াত ভাড়া মহিলা থেকে নেয়া যাবে।
মোবাইলের মূল্য মহিলাকে ফেরত দেয়া লাগবে না।
পুলিশকে দেয়া ঘুষ মহিলা থেকে আদায় করা যাবে না।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]