بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
আজ থেকে প্রায় দেড়হাজার বছর আগের কথা। তখন গোটা পৃথিবী হেদায়েতের নূর থেকে বঞ্চিত ছিলো। মানবতা ও নীতিনৈতিকতা হারিয়ে গিয়েছিলো অতল গহ্বরে। ইউরোপের ওপর ছেয়ে গিয়েছিলো মধ্যযুগীয় অন্ধকার। সকল অন্যায় ও অশ্লীলতার জয়জয়কার ছিলো ইরানে। সেখানে ভদ্্রতা ও শালীনতার কবর রচিত হয়ে ছিলো। মানুষ আর পশুতে কোনো প্রভেদ ছিলো না। আর পৌরাণিক অন্ধকারের নির্মম শিকারে পরিণত ছিলো গোটা ভারতবর্ষ। সেখানে একদিকে শুধু জড়বস্তু নয়, বিভিন্ন পশু এমনকি সাপ-বিচ্ছুরও উপাসনা হতো। অন্যদিকে বিরাট সংখ্যক বনিআদম ছিলো জন্মসূত্রে অচ্ছুৎ-অস্পৃশ্য। এদের কোনো অধিকার ছিলো না। পশুজীবনই এদের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হবার পর আজকের ভারতেও এই অমানুষিকতার দুষ্ট ক্ষত চোখে পড়ে।
আরব ভূখ- পৃথিবীর মধ্যভাগে, এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার সংযোগ-কেন্দ্রে অবস্থিত। প্রাচীনকালে তাই আরব দেশকে পৃাথিবীর ‘নাভিমূল’ বলা হতো। তখন এ অঞ্চলও আসমানী হেদায়েত এবং সব ধরনের শিক্ষা ও সুনীতি থেকে বঞ্চিত ছিলো। সামাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ভ্রষ্টতার অনুপ্রবেশ ঘটে ছিলো। সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহকে ছেড়ে অসংখ্য দেবদেবী আর পাথুরে মূর্তির পদতলে মানবতার অপমান ও বলিদানের মহোৎসব চলছিলো। আল্লাহ পাকের হুকুমে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মক্কা নগরীতে আল্লাহর ইবাদতের জন্য যে ঘর নির্মাণ করে ছিলেন, সেই কাবাঘরটিও অসংখ্য প্রতিমার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে ছিলো। পুরো অঞ্চলে কোনো প্রশাসনিক কাঠামো ছিলো না। সুতরাং বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য এবং জংলিপনাই ছিলো তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা এই মাত্রায় পৌঁছে ছিলো যে, আপন শিশু সন্তানকে নিজ হাতে জীবন্ত পুতে ফেলা কোনো ব্যাপারই ছিলো না। হত্যা, লুণ্ঠন, এবং পরস্বহরণ সেখানকার নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা। বেহায়াপনা ও নির্লজ্জতার অবস্থা এত নিচে নেমে ছিলো যে, উলঙ্গ হয়ে প্রকাশ্যে কাবাঘর প্রদক্ষিণ করা কোনো লজ্জার বিষয় ছিলো না। সৎ মাকে সন্তানরা মৌরুসি সম্পত্তির মতো ভোগ করতে দ্বিধা করতো না। এমনই ছিলো তাদের আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক পরিস্থিতি।
তাদের আর্থিক অবস্থাও চরম অবনতির শিকার ছিলো। ক্ষুধা-দারিদ্্েরর কারণে বিরাট সংখ্যক মানুষ বনবাঁদাড় চষে বেড়াতো। পোকামাকড় আর গলিত প্রাণী খেয়ে হাড্ডিসার বুকে জীবনপ্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতো।
এহেন মুহূর্তে আরবের কেন্দ্্রীয় শহরে, মক্কার অতি স¤্র¢ান্ত কুরাইশ গোত্রে একটি শিশুর শুভজন্ম হলো। শিশুটি মাতৃগর্ভে থাকতেই হলো পিতৃহারা। বিধবা মা তাকে লালন-পালন করলেন। বয়স যখন ছয়, তখন মায়ের ¯েœহছায়াও উঠে গেলো। বালকটি আশ্রয় নিলো দাদার কোলে। দুটি বছর যেতে না যেতে সেই কোলও হারিয়ে গেলো। তাকে এবার বুকে তুলে নিলেন চাচা; চাচা আবু তালেব।
পিতা ছিলেন আবদুল্লাহ। মাতা আমেনা। দাদা আবদুল মোত্তালিব। আর এ মহাজাতকের নাম রাখা হলো ‘মুহাম্মদ’। নামের অর্থ¬- যিনি নিজের কৃতকর্ম ও গুণবৈশিষ্টের কারণে খুবই প্রশংসার পাত্র।
সেকালে আরবে লেখাপড়ার প্রচলন ছিলো না। ফলে তিনিও (প্রচলিত অর্থে) উম্মী (নিরক্ষর) ছিলেন। কিন্তু আত্মার পবিত্রতা এবং স্বভাবের শুদ্ধতার কারণে এমন নষ্ট পরিবেশেও তার জীবন ছিলো নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ।
যখন তিনি বুঝবান হলেন, তখন চাচার আর্থিক কষ্ট লাঘবের জন্য জীবিকা উপার্জনের চিন্তা শুরু করলেন। ব্যবসা তাদের পারিবারিক পেশা। তাই ব্যবসার প্রতিই মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু পুঁজি না থাকায় নিজস্ব কারবার গড়ে তোলা সম্ভব ছিলো না। এজন্য অন্যের কাছ থেকে পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেন। অল্পদিনেই তার সততা-স্বচ্ছতা ও আমানতদারিতার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো। সবাই তাকে ‘আলআমীন’ (আস্থার পাত্র) বলে ডাকতে লাগলো। যে-ই তার সঙ্গে লেনদেন করলো, সে-ই তাকে ফেরেশতাতূল্য অনন্য মানুষরূপে চিনতে পারলো, তাঁর ব্যবসায়িক সততায় মুগ্ধ এবং অনুরক্ত হলো।
মক্কাতে খাদিজা নামের এক ধনাঢ্য মহিলা ছিলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও নেক স্বভাবের মানুষ ছিলেন। নিজেই বড় একটি ব্যবসা পরিচালনা করতেন; পুঁজি বিনিয়োগ করতেন। তার সঙ্গেও ‘মুহাম্মদ আলআমীন’-এর কিছু ব্যবসায়িক লেনদেন হলো। খাদিজার বয়স তখন চল্লিশ। তিনি একাধিক সন্তানবতী। তবু খাদিজার তরফ থেকে ‘মুহাম্মদ আলআমীন’-এর প্রতি বিয়ের প্রস্তাব এলো এবং সে প্রস্তাব পারিবারিকভাবে গ্রীহিত হলো। তাঁদের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠলো।
বিবাহের পর তাঁর জীবিকা উপার্জনের তেমন কোনো চাপ রইলো না। তিনি ব্যক্তিগতভাবে মানবসেবা, অভাব ও বিপদগ্রস্থ মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা এবং মক্কায় শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
এভাবে কেটে যাচ্ছিলো জীবন। নিষ্কলুষ স্বভাব-চরিত্র এবং দুঃখী মানুষের সেবা ইত্যাদির কারণে তিনি সবার ভালোবাসা ও সম্মানের পাত্র ছিলেন। বরং স্বগোত্রের অঘোষিত সরদাররূপে বরিত হয়ে ছিলেন।
বয়স যখন চল্লিশ, তখন তার ভেতর অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দিলো। অন্তরে সুতীব্র জ্বলন ও দহন সৃষ্টি হলো- লোকালয় ছেড়ে এমন কোথাও চলে যেতে, যেখানে একাকী-নিভৃতে ইবাদত ও দোয়া-মুনাজাতে নিমগ্ন হতে পারবেন এবং আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভে ধন্য হবেন।
মক্কা থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত সুউচ্চ একটি পর্বত। তার একেবারে চূড়ামুখে একটি পাথুরে গুহা ছিলো। আজও আছে এবং তা ‘হেরাগুহা’ নামে প্রসিদ্ধ। কিছু খাদ্য-পানীয় সঙ্গে নিয়ে তিনি সেখানে চলে যেতেন। পুরো সপ্তাহ ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে, পাহাড়ি কন্দরে একাকী আল্লাহর ধ্যানে রাত কাটাতেন। সপ্তাহশেষে একবার ঘরে এসে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আবার চলে যেতেন। সেই নীরবতা নিঃশব্দতার মাঝে পুরো সময় ইবাদত-বন্দেগী, মানবতার মুক্তি এবং আল্লাহ তাআলার ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন।
বিরামহীনভাবে সাধনা চলতে থাকলো মাসের পর মাস। তখন তিনি আল্লাহ পাকের সত্তা ও তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে তেমন কিছু জানতেন না। ইবাদত-বন্দেগীরও বিশেষ কোনো রীতিনীতি জানা ছিলো না। কিন্তু একজন সত্যান্বেষীর মাঝে যদি আলোকময় হৃদয় থাকে; থাকে পবিত্র আত্মা এবং স্বভাব-শুভ্রতা, তাহলে তিনি সৃষ্টিকর্তার সামান্য পরিচিতিকে অবলম্বন করেই শুরু করতে পারেন প্রেমের মহাযাত্রা, নৈকট্য অর্জনের অবিশ্রান্ত সন্তরণ।
এই সময় তার ভেতর নতুন একটি অবস্থা প্রকাশ পেলো। প্রায় প্রতি রাতে তিনি কিছু না কিছু স্বপ্ন দেখতেন এবং সকাল হতেই তার সামনে বাস্তব আকারে সেটা ঘটে যেতো। কিন্তু কাউকে তিনি জানাতেন না। ওটা ছিলো ঊধর্বজগতের সঙ্গে তার আধ্যাত্মিক যোগাযোগের সূচনা। আগত দিনের পূর্বাভাষ।
হেরাগুহার এ সাধনা চললো লাগাতার ছ’মাস। এরপর একদিন ঘটলো বিস্ময়কর ঘটনা। তিনি অস্বাভাবিক অবস্থায় ঘরে ফিরলেন। আতঙ্কগ্রস্থ ব্যক্তির মতো তাঁর চেহারা বিবর্ণ। পুরো দেহ কাঁপছে। ঘরে পৌঁছামাত্র বিছানায় লুটিয়ে পড়লেন তিনি। খাদিজাকে ডেকে বললেন, ‘গরম কাপড় দাও, মোটা চাদরে আমার গা ঢেকে দাও।’
অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে বিবি খাদিজা কী হয়েছে জানতে চাইলেন। নবীজী তখন হেরাগুহায় ফেরেশতার আগমন, আল্লাহ পাকের বাণী শ্রবণ, তার তেলাওয়াত এবং আরও যা যা ঘটলো সব বললেন। আর এ-কারণে তার শরীর ও মানসের ওপর কী পরিমাণ চাপ পড়েছে তাও খুলে বললেন। বিবি খাদিজা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে প্রথমে নবীজীকে সন্ত¦না দিলেন। বললেন, কসম খোদার! আল্লাহ আপনাকে পেরেশান করবেন না। আপনার মতো সর্বোপকারী সৎমানুষকে আল্লাহ কখনো দুঃখ দিবেন না। আপনি আত্মীয়তার কদর করেন, নিজের পিঠে দুর্বলের বোঝা বহন করেন, সম্বলহীনকে নিজের উপার্জন দিয়ে সাহায্য করেন। আপনি মেহমানের সমাদর করেন, ন্যায়ের পক্ষে আগে আগে থাকেন। সুতরাং আল্লাহ আপনাকে কিছুতেই অসম্মান করবেন না। সকল বিবেচনায় যা কল্যাণকর, আল্লাহ পাক আপনার জন্য তা-ই করবেন।
বিবি খাদিজা নবীজীকে ওয়ারাকা বিন নওফলের কাছে নিয়ে গেলেন। ইনি একজন বয়োবৃদ্ধ অন্ধ মানুষ। স্বজাতির মূর্তিপূজার ধর্ম ত্যাগ করে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। পুরোনো আসমানী কিতাব তাওরাত ও ইঞ্জিলের আলেম ছিলেন। তিনি হেরাগুহার ঘটনা শুনে দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘তোমার কাছে যে ফেরেশতা এসেছেন, তিনি সেই ফেরেশতা- যিনি পূর্ববর্তী নবীগণের নিকট আল্লাহ পাকের বাণী নিয়ে আসতেন। আমার বিশ্বাস, আল্লাহ তাআলা তোমাকে নবুওতের মর্যাদা দান করেছেন। নবুওতের গুরুদায়িত্ব তোমার কাঁধে অর্পণ করেছেন। শুনে রাখো, তোমার গোত্রের লোকেরা তোমার দুশমন হয়ে যাবে; তোমাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করবে। হায়! সে সময় যদি আমি বেঁচে থাকতাম আর আমার দেহে শক্তি থাকতো, তাহলে আমি তোমাকে সঙ্গ দিতাম।’
এভাবে এ সময় থেকে নবীজীর নবুওয়াতের শুভ সূচনা হলো।
এতোকাল তো নবীজী নিতান্তই নির্ঝঞ্জাট ও নির্বিরোধ জীবনযাপন করেছেন। নীরবে ব্যক্তিগত পরিসরে মানবসেবার ব্রত পালন করে গেছেন। নির্জনতাই ছিলো তার প্রিয়। সেকালে আরবদের মাঝে কাব্যযুদ্ধের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিলো। বাগ্মিতা প্রদর্শনের বড় বড় আয়োজন হতো। এগুলোর প্রতিও নবীজীর কোনো আকর্ষণ ছিলো না। বিশেষ কোনো কল্যাণ-চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কখনো কোনো সংঘবদ্ধ আন্দোলন-কোলাহল তৈরি করেননি। স্বজাতির সীমাহীন ভ্রষ্টতা ও চরিত্রহীনতা সংশোধনের জন্যও কোনো বিপ্লবের ডাক দেননি, উল্লেখযোগ্য কোনো প্লাটফর্ম গড়ে তোলেননি। পূর্বেকার উম্মত ও নবীগণের শিক্ষণীয় ঘটনাবলীও নবীজীর মুখে কখনও শোনা যায়নি। রাজনীতি বা অর্থনীতি নিয়েও কোনো কথা কখনো বলেননি। মোটকথা, চল্লিশ বছরের দীর্ঘ সময়ে এ-সবের সঙ্গে নবীজীর কোনো সম্পর্ক ছিলো না। কেউ তার মুখে এসব বিষয়ে এমন কোনো নির্দেশনা শোনেনি, যাতে বোঝা যায়- এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে নবীজীর প্রাথমিক কোনো ধারণা আছে।
কিন্তু বয়সের একচল্লিশতম বছরে এসে হেরাগুহার ঐ ঘটনার পর কী থেকে কী হয়ে গেলো! যেনো নবীজীর দেহে ভিন্ন প্রাণের সঞ্চার হলো। একেবারে অন্য মানুষে পরিণত হলেন তিনি। নবীজীর নীরবতা ভেঙ্গে গেলো। স্বজাতিকে বলতে লাগলেন, ‘আল্লাহ তাআলা আমার ওপর তাঁর বাণী অবতীর্ণ করেছেন। আমার কাছে নবুওতের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, যেমন তিনি ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক ও ইয়াকুব এবং মুসা ও ঈসাকে এ দায়িত্ব দান করেছিলেন।’
নবীজী কওমের লোকদেরকে আরও বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমার আমার এবং সমগ্রজাহানের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। সকলের জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ তাআলা। কল্যাণ-অকল্যাণ ও ভাঙা-গড়ার মালিক একমাত্র তিনি। তিনি সকল দোষত্রুটি থেকে পবিত্র; বড়ত্ব ও মহত্বের সমস্ত গুণের আধার তিনি। সুতরাং ইবাদত-বন্দেগীর উপযুক্তও কেবল তিনি।
তাঁকে বাদ দিয়ে যে সকল দেবদেবী ও মূর্র্তির উপসনা করা হয়, যেগুলোকে মুশকিল আসানকারী বলে মনে করা হয়, সেগুলোর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। তাই প্রকৃত উপাস্য একমাত্র আল্লাহ তাআলা। তিনি ছাড়া অন্য কারো উপাসনা মহাপাপ। সুতরাং তাঁরই ইবাদত করো। তাকে ভয় করো এবং ভালোবাসো। তার সঙ্গে অন্তরের সম্পর্ক গড়ো। এ ঘোষণা তোমার আমার সকলের জন্য।’
এ বিষয়গুলো নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন জাতিকে বোঝানোর জন্য এবং সকলের হৃদয়ে গেঁথে দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। বলতেন, ‘আমরা এখন যে পৃথিবীতে বসবাস করছি, তা চিরকাল থাকবে না। মানুষ যেমন আয়ুশেষে মৃত্যুবরণ করে, তেমনি একসময় আল্লাহ তাআলার হুকুমে তাবৎ পৃথিবী লয়প্রাপ্ত হবে; সেটা হবে কেয়ামতের দিন। এরপর আল্লাহ পাকই আপন কুদরতে সকলকে দ্বিতীয়বার জীবিত করবেন এবং তখন নতুন একটি জগতের সূচনা হবে। একে বলে আখেরাতের জগত। এখানে সকলকে নিজ নিজ কৃতকর্মের পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান করা হবে। যারা দুনিয়াতে আল্লাহ পাকের হুকুম অনুযায়ী পবিত্রতা ও সততার জীবনযাপন করেছে, তাদের প্রতি আল্লাহ পাক রহম করবেন। দয়াময় আল্লাহ তাদেরকে দান করবেন অনন্ত সুখময় বেহেশতী জীবন। কিন্তু পৃথিবীতে যারা আপন ¯্রষ্টাকে স্মরণ করেনি, আল্লাহ তাআলার হুকুম আহকামের তোয়াক্কা করেনি, পরকালের পরিণাম উড়িয়ে দিয়ে অন্যায় পথে জীবন কাটিয়েছে, তারা বড় কঠিন শাস্তিতে ফেঁসে যাবে।’
এরপর নবীজী সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বান্দার ওপর আল্লাহ তাআলার কী কী হক রয়েছে, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এক বান্দার উপর অপর বান্দার কী হক, তা-ও বিস্তারিত জানিয়েছেন। নেক আমল ও সদাচারের তালিম দিয়েছেন। অন্যায়-অনাচার, অশ্লীলতা ও দুরাচার থেকে বারণ করেছেন। এগুলোর অশুভ পরিণামের সম্পর্কে উম্মতকে সর্তক করেছেন।
এমনিভাবে নবীজী মানুষের কাছে লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মেহনত-মজদুরি সম্পর্কিত আসমানী হেদায়েতসমূহ পৌঁছে দিয়েছেন। কোন পদ্বতি ঠিক, কোন পদ্বতি ভুল ও নাজায়েয, তা জানিয়ে দিয়েছেন। খাদ্য-পানীয়ের কোনটা হালাল, কোনটা হারাম- তাও বলে দিয়েছেন। নবীজী এগুলো শুধু বর্ণনা করে ক্ষান্ত হননি, বরং এর দাওয়াতকে জীবনের মিশন বানিয়ে নিয়েছেন। এ দাওয়াত ও হেদায়েতকে পৃথিবীর সকল মানবগোষ্ঠীর নিকট পৌঁছে দেয়ার চিন্তায় এমনভাবে মশগুল হয়েছেন যে, দুনিয়ার অন্যকিছু নিয়ে সামান্য ভাবারও ফুরসত তাঁর ছিলো না। দিনরাত একই চিন্তা একই ফিকির, কী করে দুনিয়ার সমস্ত মানুষের নিকট আল্লাহ পাকের কালাম পৌঁছে দেয়া যায় এবং সকল মানুষ হেদায়েতের পথে এসে যায়; জাহান্নাম থেকে বেঁচে যায়- দুনিয়াতেও শান্তি পায়, আখেরাতেও শান্তি পায়। এ জন্য তিনি রাতের আঁধারে অশ্রু ঝরাতেন; দিনের আলোতে দ্বারে দ্বারে ছুটে বেড়াতেন।
এই এক মিশনের জন্য তিনি হাজারও কষ্ট সয়েছেন। লাঞ্ছনা বরদাশত করেছেন। দীর্ঘদিন সপরিবারে সামাজিক বয়কটের কষ্ট ভোগ করেছেন। পিঠ সোজা করার মতো খাদ্যশষ্য পাননি। এতদ্বসত্ত্বেও নবীজীর দাওয়াতে কোনো ভাটা পড়েনি। বিরোধীদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে নবীজী আপন মিশন অব্যাহত রেখেছেন। যারা জুলুম-নির্যাতন করতো, তাদের হেদায়েতের জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে আরও বেশি কান্নাকাটি করেতেন। যাদের ভেতর সত্য গ্রহণের সামান্য যোগ্যতা তখনও অবশিষ্ট ছিলো, তারা এক-দুই করে নবীজীর দাওয়াত গ্রহণ করতে লাগলো এবং তারাও মক্কার দুষ্ট লোকদের জুলুমের শিকার হলো।
এভাবে কেটে গেলো দশ-বারো বছর। এরপর পরিস্থিতি যখন এতোটা সঙ্গীন হয়ে ওঠলো যে, মক্কার লোকেরা মুসলমানদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করলো এবং মক্কায় অবস্থান করে দ্বীনী দাওয়াত অব্যাহত রাখা দুষ্কর হয়ে পড়লো, তখন আল্লাহ তাআলার হুকুমে নবীজী মদিনার উদ্দেশ্যে হিজরত করলেন।
মদিনাকে কেন্দ্র করে নবীজী দাওয়াতের কাজ আরও বেগবান করলেন। আল্লাহ পাকের দয়ায় মানুষও অনেক বেশি সংখ্যায় দাওয়াত কবুল করতে লাগলো এবং অল্পদিনেই নবীজীর অনুসারী ও সঙ্গী-সাথীদের জামাতের মাধ্যমে মদিনাতে একটি বিরল রাষ্ট্র-কাঠামো দাঁড়িয়ে গেলো। এ রাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক কোনো প্রতিরক্ষা বাহিনী ছিলো না। ছিলো না কোনো দারোগা-পুলিশ, কোর্ট-কাচারি বা পদাধিকারী। কিন্তু সবই ছিলো। অর্থাৎ প্রয়োজনের সময় রাষ্ট্রের সকল সেক্টরের কাজ সেখানে আঞ্জাম পেতো। একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রের জন্য যতো পদে কাজ হওয়া দরকার, তার সবই হতো। কিন্তু বিনা পদে বিনা বেতনে । নবীজীর দাওয়াত কবুলকারীরা স্বেচ্ছাসেবকরূপে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির আশায় সকল কাজ সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করে দিতো।
এই নতুন ধারার রাষ্ট্র ও প্রশাসন গড়ে তুলেছিলেন উম্মী নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি দুনিয়াবাসীর সামনে বাস্তব আদর্শ তুলে ধরলেন- কীভাবে নিয়মতান্ত্রিক বিরাট সৈন্যবাহিনী ও প্রাচুর্যপূর্ণ রাজকোষাগার ছাড়াই রাষ্ট্র চলে এবং রাষ্ট্রের সকল উদ্দেশ্য সাধন হতে পারে অধিকতর সুচারুরূপে। যেখানে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা হয়েছে এবং তা সবদিক থেকে পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধনীতির জন্য আদর্শ নমুনা, যেখান থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। সেখানে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি হয়েছে, সন্ধিচুক্তি হয়েছে। ইনসাফপূর্ণ ট্যাক্সনীতির প্রয়োগ হয়েছে। এর সবই আধুনিক পৃথিবীর জন্য অনুসরণীয়।
মদিনায় হিজরতের পর নবীজী মাত্র দশ বছর দুনিয়াতে ছিলেন। কিন্তু এ অল্প সময়েই আরবদেশ পুরোটা নবীজীর করতলগত হয়ে গেলো। ঐ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ নবীজীর দাওয়াত ও হেদায়েত কবুল করে ধন্য হলো। কতো কতো মানুষ- যারা আল্লাহকে চিনতো না, আখেরাত এবং জান্নাত-জাহান্নাম বিশ্বাস করতো না, যাদের পুরোটা জীবন সীমাহীন অন্যায়-অনাচারে ডুবে ছিলো, সেই মানুষগুলো নবীজীর সংস্পর্শে এসে সোনার মানুষে পরিণত হলো। এমন মানুষ, যাদের নজির মানব-ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। নবীজীর শিক্ষাদীক্ষায় আলোকিত হয়ে গুটিকয়েক ব্যক্তি শুধু নয়, বিরাট একটি জাতি গড়ে উঠেছিলো। আকাশ এমন জাতি কখনও দেখেনি, পরেও আর দেখবে না।
এ মহাবিপ্লব ঘটেছে হাতেগনা দশটি বছরে। মক্কার সময়টুকু মিলিয়ে নিলে হবে বিশ-বাইশ বছর। আর তা-ও ঘটেছে এমন এক ব্যক্তির মাধ্যমে, যিনি ‘আলিফ-বা’ও জানতেন না। কোনো আল্লাহপ্রেমিক জ্ঞানতাপসের সান্নিধ্যও তিনি পাননি। জীবনের চল্লিশটি বছর, যে সময়টা ছিলো যৌবনের আবেগ-উত্থান আর ব্যক্তিত্বপ্রকাশের স্বর্ণযুগ- সে সময়টাতে যিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নীরব-নিশ্চুপ, কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামায় যিনি কখনও অংশ নেননি, কোনো গুরুত্বপূর্ণ অন্দোলন বা কাজের নেতৃত্ব দিতেও তাকে দেখা যায়নি, কবিতা বা বাগ্মিতা যাকে কখনো স্পর্শ করেনি, সেই তিনি জীবনের একচল্লিশতম বছরে এসে কী এক অনির্বাণ শিখায় জ্বলে ওঠলেন, যার ছোঁয়ায় আলোকায়নের এমন এক মহাবিপ্লব ঘটে গেলো, পৃথিবীর ইতিহাসে যার কোনো তুলনা নেই। কীভাবে হলো? তখন তো প্রচারের জন্য রেডিও-টেলিভিশন ছিলো না, ছিলো না পত্রপত্রিকা! তা-ও কী করে সম্ভব হলো?
নবীজী বলতেন, ‘আমি কিছু নই, আমি তো তোমাদের মতো এক নিরীহ কুরাইশকন্যার সন্তান। আমার কোনো লেখাপড়া নেই। আমি আল্লাহ পাকের সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে যা বলি, কেয়ামত-আখেরাত এবং জান্নাত-জাহান্নাম সম্পর্কে যা কিছু উচ্চারণ করি, জীবনের বিভিন্ন দিকের ওপর যে বিধিবিধানের কথা বলি এবং যতো উপদেশ-নসিহত তোমাদের শুনিয়ে থাকি, এর কোনো কিছুই আমার নিজের দেমাগের ফসল নয়। চিন্তা-ফিকির করে আমি এগুলো আবিষ্কার করিনি। বরং এসব আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে এসেছে। তিনি আমাকে তোমাদের হেদায়েত ও খেদমতের জন্য বেছে নিয়েছেন।’
নবীজী একটি কালাম পড়ে শোনাতেন। যা ফেরেশতার মাধ্যমে আল্লাহ পাক তার ওপর অবতীর্ণ করতেন। যার নাম ‘আল কোরআনুল কারীম’। এটি নবীজীর সমস্ত তালিম ও হেদায়েতের আধার । এই কালামের ভেতর বিস্ময়কর আকর্ষণশক্তি আছে। যদিও তা নাযিল হয়েছে আরবি ভাষায়, তবু তা বিভিন্ন দিক থেকে ব্যতিক্রম। এমনকি নবীজীর কথাবার্তা থেকেও ভিন্নরকম। শত্রুরাও এর দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারতো না। এ জন্য তারা ‘আল কোরআনকে’ যাদু বলতো। কিন্তু এই কালামের প্রথম তেলাওয়াতকারী যিনি, তিনি বলতেন- ‘এ কালাম আমার নয়, আল্লাহ তাআলার। তিনি আমার ওপর অবতীর্ণ করেছেন। এটা তার সর্বশেষ পবিত্র গ্রন্থ। এতে আমার তোমার এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়েত নিহিত আছে; আছে জীবন পরিচালনার হুকুম-আহকাম। যে কোনো সত্যান্বেষী মানুষ একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে, এটা কখনও মানবরচিত হতে পারে না।’
এই কালামে আল্লাহ পাকের তাওহীদ ও গুণাবলী সম্পর্কে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, নিঃসন্দেহে তা মারেফত তথা আল্লাহ-পরিচয়ের চূড়ান্ত কথা। কোনো মেধাবী থেকে মেধাবী মানুষের পক্ষেও আপনা-আপনি ¯্রষ্টা-পরিচয়ের ঐ বিন্দু পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব নয়। এমনিভাবে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন এবং এ ধরনের আরও জটিল জটিল বিষয় সম্পর্কে কোরআনে যে বিধান রয়েছে, কালের বিরাট পরিবর্তন সত্ত্বেও সেগুলোর কার্যকরিতা আগের মতোই বহাল। এমতাবস্থায় কল্পনাই করা যায় না, এগুলো কোনো মানুষ বিশেষত নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজস্ব চিন্তা থেকে এসেছে। মোটকথা কোরআন নিজেই দলিল, যে তা আল্লাহ পাকের কালাম। তাঁরই নাযিলকৃত হেদায়েতনামা। আর এ কোরআন আনয়নকারী যিনি, তিনি আল্লাহর সত্য নবী। আশা করি সামনের ছত্রগুলো এ বিষয়ে আপনার উত্তম সহযোগী বলে প্রমাণিত হবে।