প্রচ্ছদ / আদব ও আখলাক / দুআ ও পার্থনা

দুআ ও পার্থনা

আল্লামা মনজূর নূমানী রহঃ

এটা সর্বজনস্বীকৃত সত্য যে, এই পৃথিবীর সবকিছু আল্লাহ পাকের হুকুমে চলছে। ছোটবড় সব কিছু তার কুদরতি কব্জায় রয়েছে। সুতরাং সকল সমস্যায় তাকে ডাকা এবং সকল প্রয়োজনে তার নিকট দুআ করা একান্ত স্বভাবসিদ্ধ বিষয়। এই জন্য সকল ধর্মে প্রার্থনার বিধান রয়েছে। সবাই আপন আপন প্রয়োজনে সৃষ্টিকর্তার নিকট হাত পাতে। আর ইসলামের দুআর বিষয়টি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ পাক বলেন,

وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ
আর তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো। সূরা গাফির ৪০/৬০

অন্য আয়াতে বলেন,

قُلْ مَا يَعْبَأُ بِكُمْ رَبِّي لَوْلَا دُعَاؤُكُمْ
বলুন, তোমাদের দুআ যদি না থাকতো, তবে আমার রব তোমাদের কোনো পরওয়াই করতেন না। সূরা ফুরকান ২৫/৭৭

এক আয়াতে এসেছে,

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ
হে রাসুল! আমার বান্দা আপনাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে, আপনি বলুন, আমি নিকটেই আছি। যখন সে দুআ করে, আমি তার দুআ শুনি এবং কবুল করি। সূরা ২/১৮৬

প্রয়োজনের সময় দুআ করা এবং আল্লাহ পাকের নিকট সাহায্যে চাওয়া একটি ইবাদত, বরং দুআ হলো ইবাদতের সারনির্যাস। কেননা এর মাধ্যমে ‘আবদিয়্যত’ তথা নিজের গোলামি এবং অক্ষমতা প্রকাশ পায়। হাদীস শরীফে এসেছে,

إِنَّ الدُّعَاءَ هُوَ الْعِبَادَةُ. وفي الباب عن أنس عند الترمذي الدُّعَاءُ مُخُّ العِبَادَةِ وهو حسن في الشواهد.
দুআই ইবাদত। অন্য বর্ণনায় এসেছে, দুআ হলো ইবাদতের মগজ। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১৮৩৫২

সুবহানাল্লাহ! দুনিয়াতে প্রয়োজন পুরনের জন্য বারবার হাত পাতলে একান্ত আপনজনও বিরক্ত হয়। আর আল্লাহ পাক নাখোশ হন বান্দা তাঁর কাছে না চাইলে, তাঁর নিকট হাত না পাতলে। হাদীস শরীফে এসেছে,

مَنْ فُتِحَ لَهُ مِنْكُمْ بَابُ الدُّعَاءِ فُتِحَتْ لَهُ أَبْوَابُ الرَّحْمَةِ. أَخْرَجَهُ التِّرْمِذِيُّ بِسَنَدٍ لَيِّنٍ
যার জন্য দুআর দরোজা খুলেগেলো অর্থাৎ যে আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে আন্তরিকভাবে দুআ করার তাওফীক প্রাপ্ত হলো, তার জন্য আল্লাহ পাকের রহমতের দরোজাও খুলে গেলো। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৪৮

দুআ যেমনিভাবে প্রয়োজন পুরণের উসিলা, তেমনি সেটা উঁচু মানের ইবাদতও বটে। কেননা দুআর দ্বারা আল্লাহ পাক বড় খুশি হন এবং বান্দার জন্য রহমতের দরোজাগুলি খুলে দেন। এখন বান্দা দ্বীনী প্রয়োজনে দুআ করুক আর দুনিয়াবী প্রয়োজনে। তবে নাজায়েয বিষয়ে দুআ করা জায়েয নয়।

এখানে মনে রাখার বিষয় হলো, যে দুআ যতটা দিল থেকে করা হবে এবং যতটা অক্ষমতা ও অসহায়ত্বের সঙ্গে করা হবে, আর যত বেশি আল্লাহ পাকের কুদরত ও রহমতের উপর একীন ও বিশ্বাস নিয়ে করা হবে, সে দুআ আল্লাহ তালার দরবারে তত বেশি কবুল হবে। কিন্তু যে দুআ অন্তর থেকে হবে না, বরং মুখোমুখ প্রথাপালনের জন্য হবে, সেটা আসলে দুআই নয়। হাদীস শরীফে এসেছে,

وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ لاَ يَسْتَجِيبُ دُعَاءً مِنْ قَلْبٍ غَافِلٍ لاَهٍ.
জেনে রেখো, উদাসীনভাবে, অমনোযোগের সাথে যে দুআ করা হয়, আল্লাহ তাআলা সে দুআ কবুল করেন না। তিরমিযী, হাদীস নং ৩৪৭৯

কিছু পরামর্শ

এক.

সকল সময়ে দুআ করা যায়। তবে বিশেষ কিছু সময় দুআ কবুলের সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেমন ফরজ নামাযের পর, শেষ রাতে, ইফতারের সময়, সফররত অবস্থায়, কোনো নেক কাজ করার পর, শুক্রবার আছর থেকে মাগরিব পর্যন্ত, আযান ও একামতের মধ্যবর্তী সময়, আরাফার ময়দানে ইত্যাদি।

দুই.

আল্লাহ পাক সকলের দুআ শোনেন ও কবুল করেন। অবশ্য যারা মুক্তাকী পরহেযগার, তাদের দুআ কবুল হওয়ায় অধিক সম্ভাবনা রাখে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ওলী-বুযুর্গদের দুআই শুধু কবুল হয়, সাধারণ মানুষের দুআ কখনোই কবুল হয় না। সুতরাং গোনাহগার হলেও দুআ ছেড়ে দেওয়া উচিৎ নয়।

আল্লাহ পাক পরম করুণাময় এবং দয়ালু। তিনি গোনাহগারকে যেমন রিযিক দান করেন, তেমনি তার দুআও কবুল করেন। তাছাড়া দুআ তো ভিন্ন একটি ইবাদাতও বটে। তাই দুআ কবুল হোক আর না হোক, সওয়াবটা তো পাবো! তেমনি উদ্দেশ্য হাসিল না হলে কয়েকবার দুআ করেই হাল ছেড়ে দেয়া উচিৎ নয়।

আল্লাহ পাক তো আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অনুসারী নন। কখন কিভাবে দুআ কবুল হওয়ার মাঝে আমাদের কল্যাণ নিহিত, তিনিই তা ভালো জানেন, আমরা জানি না। সুতরাং আমাদের কাজ আমাদের করেই যাওয়া উচিৎ। হাদীস শরীফে এসেছে,

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَدْعُو، لَيْسَ بِإِثْمٍ وَلَا بِقَطِيعَةِ رَحِمٍ، إِلَّا أَعْطَاهُ إِحْدَى ثَلَاثٍ: إِمَّا أَنْ يُعَجِّلَ لَهُ دَعْوَتَهُ، وَإِمَّا أَنْ يَدَّخِرَهَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ، وَإِمَّا أَنْ يَدْفَعَ عَنْهُ مِنَ السُّوءِ مِثْلَهَا
কোনো দুআ কখনো বেকার হয় না। তবে দুআ সফল হওয়ার ছুরত বিভিন্ন হতে পারে। কখনো বান্দা যা চায়, তা তার জন্য কল্যাণকর নয় বলে আল্লাহ পাক তাকে অন্য নেয়ামত দান করেন, বা দুআর বদৌলতে গোনাহ মাফ করে দেন। আল্লাহ তাআলা দুআকে আখেরাতের পুঁজি হিসাবে রেখে দেন। কখনো বা তার উপর থেকে কোনো বালা-মুসীবত টলিয়ে দেন। আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস নং ৭১০

কিন্তু মানুষ তা বুঝতে পারে না বলে কিছু কিছু দুআ ব্যর্থ হয়েছে মনে করে। দুনিয়াতে যার অনেক দুআ কবুল হয়নি, আখেরাতে সেই দুআগুলোর বদলে যখন সে অনেক সওয়াব ও নেয়ামত দেখতে পাবে, তখন আক্ষেপ করবে, হায়! দুনিয়াতে আমার কোনো দুআই যদি কবুল না হতো এবং সবগুলির বদলা যদি এখানে এসে পেতাম, তাহলে কতই না ভালো হতো!

মোটকথা, আল্লাহ পাকের রহমত ও কুদরতের উপর ভরসা করে এবং কবুল হওয়ার বিষয়ে পূর্ণ আস্থা রেখে সকল প্রয়োজনে দুআ করা প্রত্যেক মুমিনের একান্ত কর্তব্য। আর এ-ব্যাপারেও পূর্ণ আস্বস্ত থাকা চাই যে, কোনো দুআই কখনো বেকার যায় না।

যথাসম্ভব দুআ এমন শব্দে করা উচিৎ, যার দ্বারা আল্লাহ পাকের বড়ত্ব এবং নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ পায়। কোরআন ও হাদীসে এ ধরণের বহু দুআ বর্ণিত আছে। এগুলোই সবচে সুন্দর। এমন চল্লিশটি দুআ দুই নং পরিশিষ্টে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে প্রতিদিন কিছু সময় একান্তে দুআ-মোনাজাতে কাটানোর তাওফীক দান করুন, আমীন।

0Shares

আরও জানুন

মুসলমানদের জন্য হিন্দু পরিচয় দিয়ে ইসকনের মিছিলে শরীক হওয়ার হুকুম কী?

প্রশ্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ইসকনের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মিছিলে যেসব মুসলমান শরীক হয়, নিজেদের হিন্দু পরিচয় দেয় …