প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / সব সহীহ হাদীসই কি আমলযোগ্য?

সব সহীহ হাদীসই কি আমলযোগ্য?

প্রশ্ন

আজকাল কিছু ভাইয়েরা খুব জোরেশোরে প্রচার করে থাকেন যে, হাদীস সহীহ হলেই সেটির উপর আমল করতে হবে। এ ব্যাপারে নাকি মাযহাবের ইমামগণও নির্দেশ দিয়ে গেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

 ‘সহীহ’ একটি পারিভাষিক শব্দ। মুহাদ্দিসগণ এ শব্দটি বহু অর্থে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। তন্মধ্যে একটি হলো, যখন এটি যঈফের বিপরীত শব্দরূপে ব্যবহৃত হয়। এরও রয়েছে সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ও অনেক শর্ত। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, অনেক আলেমও এর সংজ্ঞা ও শর্তের খবর রাখেন না। অথচ সাধারণ মানুষের মুখে একথা তুলে দেওয়া হয়েছে, সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করতে হবে।

কিন্তু এই শেষোক্ত সহীহ’র কথাই যদি ধরি, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, সব সহীহ হাদীসই কি আমলযোগ্য? নাকি এর জন্য আরো কোন শর্ত রয়েছে? হ্যাঁ, শর্ত অবশ্যই রয়েছে। যেমন :

১. হাদীসের বিধানটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য খাস না হতে হবে।

২. হাদীসটি মানসুখ বা রহিত না হতে হবে। এ দুটি শর্ত সর্বজনস্বীকৃত।

৩.

হাদীসটি অনুসারে সাহাবা, তাবিঈন ও মুজতাহিদ ইমামগণের আমল থাকতে হবে। আমল না থাকা রহিত হওয়ার আলামত।

ইমাম মালেক রহ. বলেছেন,

كان محمد بن أبي بكر بن عمرو بن حزم على القضاء بالمدينة فكان إذا قضى القضاء مخالفا للحديث ورجع إلى منزله قال له أخوه عبد الله بن أبي بكر وكان رجلا صالحا أي أخي قضيت اليوم في كذا كذا بكذا وكذا؟ فيقول له محمد : نعم أي أخي، فيقول له عبد الله : فأين أنت أي أخي عن الحديث أن تقضي به؟ فيقول محمد : أيهات فأين العمل يعني ما اجتمع عليه من العمل بالمدينة والعمل المجتمع عليه عندهم أقوى من الحديث

মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর ইবনে আমর ইবনে হাযম (তাবিঈ) মদীনার কাযী বা বিচারক ছিলেন। তিনি যখন হাদীসের বিপরীত রায় দিতেন এবং ঘরে ফিরে আসতেন, তার ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর: তিনি খুব ভাল মানুষ ছিলেন: তাঁকে বলতেন, ভাইয়া! আজকে আপনি এই এই বিষয়ে এই এই রায় দিয়েছেন, তাই না? তিনি বলতেন, হ্যাঁ, ভাইয়া। আব্দুল্লাহ বলতেন, হাদীস অনুসারে রায় দিলেন না কেন ভাইয়া? মুহাম্মদ তখন বলতেন, তাহলে আমল অর্থাৎ মদীনার সর্বসম্মত আমল কোথায় যাবে? সর্বসম্মত আমল ছিল তাদের নিকট হাদীসের চেয়ে শক্তিশালী। (তাবাকাতে ইবনে সাদ, ১/২৮২)

ইমাম মালেক বলেছেন, والعمل أثبت من الأحاديث হাদীসের চেয়েও (মদীনায় চালু) আমল অধিক শক্তিশালী। (ইবনে আবু যায়দ আল কায়রাওয়ানী, আল জামে, পৃ. ১১৭)

প্রসিদ্ধ হাফেজে হাদীস আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী বলেছেন, السنة المتقدمة من سنة أهل المدينة خير من الحديث পূর্ব থেকে চলে আসা মদীনাবাসীদের আমল হাদীসের চেয়েও উত্তম। (প্রাগুক্ত)

মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আত তাব্বা ছিলেন ইমাম মালেকের শিষ্য এবং শীর্ষ হাফেজে হাদীস ও ফকীহ। ২২৪ হি. সনে তার ওফাত হয়। তিনি বলেছেন, كل حديث جاءك عن النبي صلى الله عليه وسلم لم يبلغك أن أحدا من أصحابه فعله فدعه নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যত হাদীস তোমার নিকট পৌঁছবে এবং তাঁর সাহাবীগণের কেউ তদনুযায়ী আমল করেছেন মর্মে কোন কথা তোমার নিকট পৌঁছবে না সে হাদীসগুলো ছেড়ে দাও। (আল ফাকীহ ওয়াল মুতাফাককিহ, ১/১৩২)

হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলী বলেছেন,

أما الأئمة وفقهاء أهل الحديث فإنهم يتبعون الحديث الصحيح حيث كان إذا كان معمولا به عند الصحابة ومن بعدهم أو عند طائفة منهم فأما ما اتفق على تركه فلا يجوز العمل به ، لأنهم ما تركوه إلا على علم أنه لا يعمل به

ইমামগণ ও ফকীহ মুহাদ্দিসগণ সহীহ হাদীস অনুসরণ করতেন, তা যেখানে পেতেন। তবে শর্ত ছিল হাদীসটি অনুসারে সাহাবীগণের ও পরবর্তী আলেমগণের বা তাদের কোন এক জামাতের আমল থাকবে। পক্ষান্তরে যে হাদীস অনুসারে তাদের কেউ আমল করেন নি, সে হাদীস অনুসারে আমল করা ঠিক হবে না। কেননা এ অনুযায়ী আমল করা যাবে না: একথা জানেন বলেই তারা এটি ছেড়ে দিয়েছেন। (ফাযলু ইলমিস সালাম আলাল খালাফ, পৃ. ৯)

হাফেজ আবুল কাসেম আদ দারাকী ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। ৩৭৫ হি. সনে তাঁর ওফাত হয়। তাঁর নিকট কোন মাসআলা আসলে দীর্ঘ চিন্তাভাবনার পর ফতোয়া দিতেন। অনেক সময় তার প্রদত্ত ফতোয়া ইমাম শাফেয়ী ও আবু হানীফার মাযহাবের বিপক্ষে যেত। তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেন, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস অমুকের সূত্রে অমুক বর্ণনা করেছেন। আর ঐ দুই ইমামের মত গ্রহণ করার চেয়ে হাদীসটি গ্রহণ করাই তো শ্রেয়। হাফেজ যাহাবী তার একথার উপর মন্তব্য করে লিখেছেন,

قلت هذا جيد لكن بشرط أن يكون قد قال بذلك الحديث إمام من نظراء هذين الإمامين مثل مالك أو سفيان أو الأوزاعي وبأن يكون الحديث ثابتا سالما من علة وبأن لا يكون حجة أبي حنيفة والشافعي حديثا صحيحا معارضا للآخر أما من أخذ بحديث صحيح وقد تنكبه سائر أئمة الاجتهاد فلا

অর্থাৎ আমি বলব, এটা ভাল। তবে শর্ত হলো এই দুই ইমামের মতো আরো যেসব ইমাম রয়েছেন, তাদের কেউ না কেউ অনুরূপ বলবেন। যেমন, মালেক, সুফিয়ান ও আওযায়ী। আরেকটি শর্ত হলো, হাদীসটি প্রমাণিত হতে হবে,সকল দোষত্রুটি থেকে মুক্ত থাকতে হবে। আরেকটি শর্ত হলো, আবু হানীফা ও শাফেয়ীর দলিলটি, যা উক্ত হাদীসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে, সহীহ হাদীস হবে না। কিন্তু যে ব্যক্তি এমন কোন সহীহ হাদীস গ্রহণ করল, যেটি মুজতাহিদ ইমামগণের কেউ গ্রহণ করেন নি তাহলে সেটা ঠিক হবে না। (যাহাবী, সিয়ার, ১৬/৪০৪)

হাফেজ ইবনুস সালাহও সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করার জন্য তদনুযায়ী স্বয়ংসম্পূর্ণ ইমামের আমল থাকার শর্ত আরোপ করেছেন। (দ্র. আদাবুল মুফতী ওয়াল মুসতাফতী, ১/১১৮)

ইবনুস সালাহ’র এই বক্তব্য আলবানী সাহেবও তার সিফাতুস সালাহ গ্রন্থের টীকায় উদ্ধৃত করেছেন। দেখুন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছলাত সম্পাদনের পদ্ধতি, পৃ. ৩১।

উক্ত টীকায় ইমাম সুবকির যে কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, আমার নিকট হাদীস অনুসরণ করাই উত্তম, সেটি তার ব্যক্তিগত মত। আমার নিকট: কথাটি তাই নির্দেশ করে। উল্লেখ্য, মুজতাহিদ ইমামের আমল থাকার শর্ত এজন্যই আরেপ করা হয়েছে যে, উক্ত আমল নির্দেশ করে যে, হাদীসটি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে উম্মতের ইজমা বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় নি। কারণ কোন হাদীস ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে যদি ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে ধরে নিতে হবে সেখানে ভিন্ন কোন হাদীস ছিল, যা এটির তুলনায় অগ্রগণ্য।

কেউ কেউ আবার কোন কোন ইমাম থেকে বর্ণিত, إذا صح الحديث فهو مذهبي কথাটি দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে খুবই ব্যস্ত। একথাটি ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেছেন বলে প্রমাণিত রয়েছে। ইমাম আবু হানীফা থেকে অবিচ্ছিন্ন সনদ বা সূত্রে কথাটি পাওয়া যায় নি। যদিও কোন কোন হানাফী আলেম এটি আবু হানীফার বক্তব্য বলে দাবী করেছেন। কথা যার থেকেই প্রমাণিত থাকুক, কথাটি সত্য, এটাই ইমামগণের মনের কথা ও প্রতিষ্ঠিত নীতি। কিন্তু ঘোলা পানিতে মাছ শিকারকারীদের মতলব খারাপ। তার অনেক কারণ রয়েছে। যেমন,

.

ঐ কথাটির এমন মর্মও হতে পারে, হাদীস সহীহ হলেই তার ওপর আমি আমার মত ও মাযহাবের ভিত্তি রাখি। এ হিসাবে যত মাসআলার তিনি বা তারা সমাধান দিয়েছেন, সহীহ হাদীস অনুসারেই দিয়েছেন। এ মর্ম গ্রহণ করলে মতলববাজদের মতলব পূরণ হয় না।

খ.

যারা ঐ কথাটির এই মর্ম গ্রহণ করেছেন যে, কোন সহীহ হাদীস পাওয়া গেলে সেটাই আমার মাযহাব বলে গণ্য হবে, তারাও এর সঙ্গে এমন শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, যার কারণে মতলবওয়ালাদের মতলব সিদ্ধি হয় না। যেমন, ইমাম নববী (মৃত্যু ৬৭৬ হি.) বলেছেন,
وإنما هذا فيمن له رتبة الاجتهاد في المذهب وشرطه أن يغلب على ظنه أن الشافعي رحمه الله لم يقف على هذا الحديث أو لم يعلم صحته وهذا إنما يكون بعد مطالعة كتب الشافعي كلها ونحوه من كتب أصحابه الآخذين عنه وما أشبهها ، وهذا شرط صعب قلّ من يتصف به

অর্থাৎ এ কথাটি ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যিনি তার মাযহাবে ইজতেহাদের স্তরে পৌঁছে গেছেন। তবে শর্ত হলো, শাফেয়ী রহ. হাদীসটি সম্পর্কে অবগতি লাভ করতে পারেন নি, বা তার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে তিনি জ্ঞান লাভ করতে পারেন নি, এ ব্যাপারে তার প্রায় নিশ্চিত জ্ঞান থাকতে হবে। আর এটা কেবল তখনই সম্ভব, যখন তিনি শাফেয়ীর সকল কিতাব, তার শিষ্যগণের কিতাব ও অনুরূপ আরো কিছু অধ্যয়ন করবেন। এটি একটি কঠিন শর্ত যা খুব কম ব্যক্তির মধ্যেই পাওয়া যায়। (আল মাজমু, ১/১০৪)

হাফেজ আবু আমর ইবনুস সালাহ (মৃত্যু ৬৪৩ হি.) বলেছেন,

وليس هذا بالهين ، فليس كل فقيه يسوغ له أن يستقل بالعمل بما يراه حجة من الحديث

অর্থাৎ এ কাজ অত সহজ নয়। যে কোন ফকীহ এমনটি করতে পারেন না যে, তিনি নিজে যে হাদীসকে প্রামাণ্য জ্ঞান করবেন সে অনুযায়ী স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে আমল করবেন। (আদাবুল মুফতী ওয়াল মুসতাফতী, ১/১১৮)

হাফেজ আবু শামা রহ. বলেছেন,

ولا يتأتى النهوض بهذا إلا من عالم معلوم الاجتهاد وهو الذي خاطبه الشافعي بقوله : إذا وجدتم حديث رسول الله صلى الله عليه وسلم على خلاف قولي فخذوا به ودعوا ما قلت ، وليس هذا لكل أحد الخ

এটা এমন আলেমের কাজ, যার ইজতিহাদ করার যোগ্যতা সর্বজনবিদিত। এ ধরনের আলেমকেই শাফেয়ী বলেছিলেন, ‘তোমরা যখন আমার মতের বিপরীত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস পাবে, তখন সেটি গ্রহণ করবে আর আমার মতটি ছেড়ে দেবে।’ এটা সকলের জন্য নয়। (আছারুল হাদীস আশ শরীফ, পৃ. ৭০)

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (মৃত্যু ৮৫২ হি.) বলেছেন,

إن محل العمل بهذه الوصية ما إذا عرف أن الحديث لم يطلع عليه الشافعي ، أما إذا عرف أنه اطلع عليه وردّه أو تأوله بوجه من الوجوه فلا.

এই ওসিয়তটি মেনে চলার ক্ষেত্র হলো, যখন জানা যাবে শাফেয়ী উক্ত হাদীস সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। পক্ষান্তরে যদি জানা যায়, তিনি তা জানতেন, কিন্তু গ্রহণ করেন নি কিংবা এর কোন ব্যাখ্যা পেশ করেছেন, তখন ওসিয়তটি অনুসারে চলা যাবে না। (ফাতহুল বারী, হা. ৭৩৯)

ইমাম তাকিউদ্দীন সুবকী রহ. ইমাম শাফেয়ীর উক্ত কথাটির ব্যাখ্যায় একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকাই রচনা করে ফেলেছেন। সেখানে তিনি হাফেজ ইবনুস সালাহ ও ইমাম নববীর উল্লিখিত বক্তব্য উল্লেখ করে তাদের সঙ্গে সহমত ব্যক্ত করেছেন এবং বলেছেন, هذا تبيين لصعوبة هذا المقام حتى لا يغترّ به كل أحد এই জটিল ক্ষেত্রের এটই বিশ্লেষণ, যাতে কেউ উক্ত কথার দ্বারা ধোঁকায় না পড়ে। (আছারুল হাদীস আশ শরীফ, পৃ. ৬৮)

আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহ. রদ্দুল মুহতার গ্রন্থে বলেছেন,

ولا يخفى أن ذلك لمن كان أهلا للنظر في النصوص ومعرفة محكمها من منسوخها

একথা কারো অজানা নয় যে, এটা একমাত্র সেই ব্যক্তির জন্য, যিনি কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে ও তার মধ্যে কোনটি মানসুখ (রহিত) আর কোনটি মুহকাম (রহিত নয়) সে সম্পর্কে গভীর দৃষ্টির অধিকারী। (১/৬৮)

আল্লামা ইবনে আবেদীন তার ফতোয়া দানের মূলনীতি বিষয়ক ‘শারহু উকুদি রাসমিল মুফতী’ গ্রন্থেও উপরোক্ত কথা উল্লেখ করেছেন। তবে সেখানে তিনি আরো একটি শর্ত যোগ করেছেন। তিনি বলেছেন,

وأقول أيضا : ينبغي تقييد ذلك بما إذا وافق قولا في المذهب ، إذ لم يأذنوا في الاجتهاد فيما خرج عن المذهب مما اتفق عليه أئمتنا ، لأن اجتهادهم أقوى من اجتهاده ، فالظاهر أنهم رأوا دليلا أرجح مما رآه حتى لم يعملوا به.

অর্থাৎ আমি আরো বলছি, ঐ কথাটি এই শর্তে গ্রহণ করতে হবে যে, হাদীসটি যেন হানাফী মাযহাবের কোন একটি কওল বা মতের মোয়াফেক হয়। কেননা আমাদের ইমামগণ যে বিষয়ে একমত হয়েছেন, সে বিষয়ে মাযহাবের বাইরে ইজতিহাদ করার কোন অনুমতি আলেমগণ দেন নি। কারণ তাদের ইজতিহাদ অবশ্যই ঐ ব্যক্তির ইজতিহাদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী। সুতরাং এটাই স্পষ্ট যে, তাঁরা নিশ্চয়ই এমন কোন দলিলপ্রমাণ পেয়েছেন, যা ঐ ব্যক্তির প্রাপ্ত দলিলের চেয়ে মজবুত। ফলে তারা তদনুযায়ী আমল করেছেন। (দ্র. পৃ. ১১৮)

উল্লিখিত শর্তাবলির সারসংক্ষেপ হলো :

১.

হাদীসটি ইমামগণের নিকট পৌঁছে নি: এ মর্মে নিশ্চিত জ্ঞান থাকতে হবে। এর জন্য ইমামগণের ও তাদের শিষ্যগণের রচিত গ্রন্থাবলি পরিপূর্ণ অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান করতে হবে।

২.

যে ব্যক্তি ইমামগণের মত ছেড়ে ঐ সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করবেন তাকে মুজতাহিদ পর্যায়ের আলেম হতে হবে।

৩.

হানাফী মাযহাবের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা ও তার বড় বড় শিষ্যগণের কারো মতের সঙ্গে হাদীসটি মিলতে হবে।

এসব শর্ত উপেক্ষা করে যে কেউ যদি তার নিজের বিচার-বিবেচনায় কোন সহীহ হাদীসকে কোন ইমামের মাযহাব আখ্যা দিতে যান, তাহলে ইমামগণের প্রতিষ্ঠিত ও পরীক্ষিত মাযহাব মানুষের হাতের খেলনায় পরিণত হবে। একজন একটি সহীহ হাদীস পেয়ে বলবেন, এটাই ইমামগণের মাযহাব।

আরেকজন এর বিপরীত আরেকটি সহীহ হাদীস পেয়ে বলবেন, এটাই ইমামগণের মাযহাব। একজন একটি হাদীসকে সহীহ মনে করে ইমামগণের মাযহাব আখ্যা দেবেন।

অন্যজনের দৃষ্টিতে হাদীসটি সহীহ না হওয়ায় তিনি বলবেন, না, এটা ইমামগণের মাযহাব নয়। কারণ, অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই জানেন, অনেক হাদীসের সহীহ হওয়া না হওয়া নিয়ে হাদীস শাস্ত্রের ইমামগণের মধ্যেই দ্বিমত রয়েছে। এমনিভাবে একজন বললেন, এ সহীহ হাদীসই ইমামগণের মাযহাব।

আরেকজন বলবেন, আরে এ হাদীসের বিশুদ্ধতা তো ইমামগণের জানা ছিল। তারা তো এটাকে মানসুখ বা রহিত বলে বিশ্বাস করতেন। তাই এটা তাদের মাযহাব নয়।

এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের অবস্থা হবে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।

একথাগুলো যে শুধু কল্পনাপ্রসূত ও যুক্তিনির্ভর তা নয়, অতীতে বাস্তবেই এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। তাও আবার এমন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা, যারা নিজ নিজ যুগের শীর্ষ মুহাদ্দিস ও ফকীহ ছিলেন। কয়েকটি ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো :

১.

ইবনে আবুল জারুদ: যিনি ইমাম শাফেয়ীর শিষ্য ছিলেন: ও বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও ফকীহ আবুল ওয়ালীদ নিশাপুরী দুজনই একটি সহীহ হাদীস পেয়ে দাবী করলেন, এটাই ইমাম শাফেয়ীর মাযহাব। কিন্তু হাফেজ ইবনুস সালহ ও ইমাম তাকিউদ্দীন সুবকী এসে বললেন, এই হাদীস যে সহীহ, ইমাম শাফেয়ী তা জানতেন। কিন্তু তিনি এটাকে মানসুখ বা রহিত মনে করতেন বিধায় এর উপর আমল করেন নি। সুতরাং এটা তার মাযহাব হতে পারে না। (দ্র. আদাবুল মুফতী ওয়াল মুসতাফতী, ১/১১৮; আছারুল হাদীস আশ শরীফ, পৃ. ৬৮)

২.

ইমাম আবু মুহাম্মদ আল জুআয়নী ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। ইমাম বায়হাকীর সমসাময়িক ও মুজতাহিদ পর্যায়ের ফকীহ আলেম। তিনি একটি কিতাব প্রকাশ করতে চাইলেন, যেখানে ইমাম শাফেয়ীর ঐ কথার সূত্র ধরে তাঁর জানামতে অনেক সহীহ হাদীস একত্রিত করলেন এবং দাবী করলেন, এগুলোই ইমাম শাফেয়ীর মাযহাব। কিন্তু ইমাম বায়হাকীসহ অনেকে তার দাবী খ-ন করে প্রমাণ করেছেন, তিনি যেসব হাদীসকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন, তার মধ্যে অনেকগুলোই এমন রয়েছে যা সহীহ নয়। (দ্র. যাহাবী কৃত, মানাকিবু আবী হানীফা ওয়া সাহিবাইহি’র টীকা, পৃ. ৬৩-৬৪)

৩.

আবুল হাসান কারাজী ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী বড় ফকীহ ও মুহাদ্দিস। তিনি একটি হাদীসকে সহীহ ভেবে দাবী করলেন, এটাই ইমাম শাফেয়ীর মাযহাব। ইমাম তাকিউদ্দীন সুবকীও বেশ কিছুদিন তার কথামত আমল করেছেন। পরে ইমাম সুবকীর ভুল ভাঙল। তিনি আবার পূর্বের আমলের দিকে ফিরে গেলেন এবং শেষ পর্যন্ত পূর্বের আমলের উপরই বহাল ছিলেন। (দ্র. আছারুল হাদীস, পৃ. ৬৮)

৪.

আবু শামা আল মাকদিসী ছিলেন ইমাম নববীর উস্তাদ ও শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী একজন মুজতাহিদ আলেম। তিনি বুখারী শরীফের একটি হাদীস পেয়ে দাবী করলেন, এটাই ইমাম শাফেয়ীর মাযহাব। কিন্তু ইমাম নববী ও তাকিউদ্দীন সুবকী তার দাবী নাকচ করে দিলেন। শুধু তাই নয়, ইমাম নববী ইমাম শাফেয়ীর মতের পক্ষে বুখারী শরীফেরই অন্য একটি হাদীস ও মুসলিম শরীফের একটি হাদীস পেশ করলেন। (দ্র. আছারুল হাদীস, পৃ. ৭১, ৭২)

লক্ষ করুন, এত বড় বড় বিদ্যাসাগর ও শীর্ষ মুহাদ্দিসগণ যেখানে হোঁচট খেয়েছেন, সেখানে বর্তমানের লোকদের উপর কতটুকু ভরসা রাখা যায়! পূর্ববর্তীদের জ্ঞানভাণ্ডার তো বর্তমানকালের লোকদের তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশি সমৃদ্ধ ছিল।

(দলীলসহ নামাযের মাসায়েল, মাওলানা আব্দুল মতীন দামাত বারাকাতুহুর লিখিত বই থেকে উত্তরটি গৃহিত হয়েছে)

 

উপরোক্ত আলোচনা দ্বার একথা দীবালোকের ন্যায় পরিস্কার যে, সহীহ হাদীস হলেই তা আমলযোগ্য মনে করা গোমরাহী পর্যন্ত পৌছে দিতে পারে। তাই স্লোগানটি সুন্দর ও মুখরোচক হলেও এতে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না।

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা-জামিয়া ফারুকিয়া দক্ষিণ বনশ্রী ঢাকা।

ইমেইল– [email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …