প্রচ্ছদ / জিহাদ ও কিতাল / মাওলানা জসীমুদ্দীন রহমানী সম্পর্কে দু’টি প্রশ্নের জবাব

মাওলানা জসীমুদ্দীন রহমানী সম্পর্কে দু’টি প্রশ্নের জবাব

প্রশ্ন

মুফতি জসিমউদ্দীন রাহমানি সম্পর্কে আপনাদের ধারণা কি??? তার মাযহাব বিরোধী ও জিহাদী লেকচার কি ঠিক আছে নাকি ভুল??? একটু বিস্তারিত জানালে উপকৃত হতাম।।।খুবই,চিন্তিত বিষয়গুলি নিয়ে।

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

আপনার প্রশ্ন মূলত দু’টি। যথা-

জসীমুদ্দীন রহমানী সাহেবের মাযহাব বিরোধী বক্তব্যগুলো কি ঠিক আছে?

জসীমুদ্দীন রহমানী সাহেবের জিহাদ বিষয়ক লেকচারগুলো কি ঠিক আছে?

১ম প্রশ্নের জবাব

মাযহাব হল, কুরআন ও সুন্নাহে বর্ণিত মাসায়েলের সংকলিত রূপ।আরেক শব্দে বললে বলতে হয়, মাযহাব অর্থ হল পথ। তাই’ কুরআন ও হাদীসে নিহিত-লুকায়িত মাসায়েল পর্যন্ত গমনের পথ হল মাযহাব।

যেমন গোসলের ফরজ কয়টি? অজুর ফরজ কয়টি? অজু ভঙ্গের কারণ কয়টি? নামায ভঙ্গের কারণ কয়টি? ইত্যাদি সংখ্যাসহ পরিস্কার শব্দে কুরআন ও হাদীসে আসেনি। কিন্তু মূল বিষয় বিদ্যমান। তো মাযহাবের ইমামগণ উক্ত বিষয়গুলোকে কুরআন ও হাদীস মন্থন করে আলাদা আলাদাভাবে উল্লেখ করে দিয়ে উম্মতের উপর ইহসান করে গেছেন।

তা’ই আমরা মাযহাবের ইমামদের জন্য দুআ করি, এবং ইবাদত করি আল্লাহর জন্য।

যেহেতু কুরআন ও হাদীসে লুকায়িত মাসায়েলের সমন্বিত রূপের নাম হল মাযহাব। তা’ই মাযহাবের বিরোধীতা মানেই হল কুরআন ও হাদীসেরই বিরোধীতা।

সুতরাং মাযহাব বিরোধীতা কোন মুসলমানই মেনে নিতে পারে না। আর মাযহাব বিরোধীতা ঠিক হবারতো প্রশ্নই উঠে না।

সিহাহ সিত্তাসহ হাদীসের প্রায় সকল সংকলকগণই কোন না কোন মাযহাবের অনুসারী ছিলেন।

১। ইমাম বুখারী রহঃ শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী।

সুত্রঃ আহলে হাদীস আলেম নবাব ছিদ্দিক হাসান খান লিখিত আবজাদুল উলুম পৃষ্ঠা নং ৮১০, আলহিত্তা পৃষ্ঠা নং ২৮৩।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহঃ লিখিত আল-ইনসাফ পৃষ্ঠা নং ৬৭।

আল্লামা তাজ উদ্দীন সুবকী রহঃ লিখিত ত্ববকাতুশ শাফেয়ী পৃষ্ঠা নং ২/২।

২। ইমাম মুসলিম রহঃ শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী।

সুত্রঃ ছিদ্দিক হাঃ খান লিখিত আল-হিত্তা পৃষ্ঠা নং ২২৮।

৩। ইমাম তিরমিজী নিজে মুজ্তাহিদ ছিলেন। তবে হানাফী ও হাম্বলী মাজহাবের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন।

সুত্রঃ শা ওয়ালিউল্লাহ রহঃ লিখিত আল-ইনসাফ পৃষ্ঠা নং ৭৯।

৪। ইমাম নাসাঈ শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী ছিলেন।

সুত্রঃ নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান লিখিত আল-হিত্তা পৃষ্ঠা নং ২৯৩।

৫। ইমাম আবুদাউদ রহঃ শাফেয়ী।

সুত্রঃ আল-হিত্তা পৃষ্ঠা নং ২২৮।

আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহঃ ইবনে তাইমিয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে ফয়জুল বারী ১/৫৮ তে ইমাম আবুদাউদ রহঃ কে হাম্বলী বলে উল্লেখ করেছেন।

৬। ইমাম ইবনে মাজাহ শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী।

সুত্রঃ ফয়জুল বারী ১/৫৮।

এ গেল ছিহাহ ছিত্তার ইমামগণের মাজহাব।

অন্যান্য ইমামগণের মাজহাব নবাব ছিদ্দীক হাসান খান সাহেবের আল-হিত্তা থেকে।

╚►৭। মিশকাত শরিফ প্রণেতা শাফেয়ী, পৃঃ ১৩৫

╚►৮। ইমাম খাত্তাবী রহঃ শাফেয়ী, পৃঃ ১৩৫

╚►৯। ইমাম নববী রহঃ শাফেয়ী, পৃঃ ১৩৫

╚►১০। ইমাম বাগভী রহঃ শাফেয়ী, পৃঃ ১৩৮

╚►১১। ইমাম ত্বহাবী হাম্বলী, পৃঃ১৩৫

╚►১২। বড় পীর আঃ কাদের জিলানী রহঃ হাম্বলী, পৃঃ ৩০০

╚►১৩। ইমাম ইবনে তাইমিয়া হাম্বলী, পৃঃ ১৬৮

╚►১৪। ইবনে কায়্যিম রহঃ হাম্বলী, পৃঃ ১৬৮

╚►১৫। ইমাম ইবনে আব্দিল বার রহঃ মালেকী, পৃঃ ১৩৫

╚►১৬। ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ হানাফী, পৃঃ ১৬০

╚►১৭। শাহ ওয়ালিউল্লাহ  দেহলবী রহঃ হানাফী, পৃঃ ১৬০-১৬৩

╚►১৮। ইমাম ইবনে বাত্তাল রহঃ মালেকী, পৃঃ ২১৩

╚►১৯। ইমাম হালাবী রহঃ হানাফী পৃঃ ২১৩

╚►২০। ইমাম শামসুদ্দীন আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুদদায়েম রহঃ শাফেয়ী, পৃঃ ২১৫

╚►২১। ইমাম বদরুদ্দীন আঈনী রহঃ হানাফী, পৃঃ ২১৬

╚►২২। ইমাম যারকানী রহঃ শাফেয়ী, পৃঃ ২১৭

╚►২৩। ইমাম ক্বাজী মুহিব্বুদ্দীন হাম্বলী, পৃঃ ২১৮

╚►২৪। ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী, পৃঃ ২১৯

╚►২৫। ইমাম বুলকিনী শাফেয়ী, পৃঃ ২১৯

╚►২৬। ইমাম মার্যুকী মালেকী পৃঃ ২২০

╚►২৭। ইমাম জালালুদ্দীন বকরী শাফেয়ী, পৃঃ২২০

╚►২৮। ইমাম কাস্তাল্লানী শাফেয়ী, পৃঃ ২২২

╚►২৯। ইমাম ইবনে আরাবী মালেকী, পৃঃ ২২৪

এমন কি তাদের মডেল আব্দুল ওয়াহ্হাব নজদীকে ও হাম্বলী বলে উল্লেখ করেছেন নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান তার আল-হিত্তাতু ফিস সিহাহিস সিত্তাহ‘র ১৬৭ পৃষ্ঠায়।

ইমাম তাহাবী রহঃ ছিলেন হানাফী রহঃ এর অনুসারী। যা তার সংকলিত তাহাবী শরীফ পড়লেই যে কেউ বুঝতে পারবে।

তাহলে মাযহাবকে বাতিল বলা, মাযহাবের বিরুদ্ধে বলাতো সমস্ত মুহাদ্দিস, আলেম উলামা ও ফুক্বাহায়ে কেরামকেই বাতিল বলে দেয়া। আমরা কি সিহাহ সিত্তার সংকলকসহ সমস্ত মুহাদ্দিস ও ফুক্বাহায়ে কেরাম ও আলেম উলামাদের হক বলবো নাকি জসীমুদ্দীন রহমানী সাহেবকে হক বলবো?

বিচারের ভার আপনার উপরই ন্যস্ত করা হল।

২য় প্রশ্নের জবাব

জিহাদ ইসলামের ফরজ একটি বিধান।কুরআনে কারীমের অসংখ্য আয়াতে জিহাদের ফাযায়েল ও জিহাদের প্রতি উদ্ভুদ্ধকরণমূলক নির্দেশনা এসেছে। সেই সাথে জিহাদ ছেড়ে দেবার পরিণাম ধ্বংস বলেও অনেক আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

হাদীসের মাঝেও রয়েছে এ বিষয়ে প্রচুর উৎসাহ প্রদান ও সতর্কবার্তা। তা’ই জিহাদকে অস্বিকার করার কোন জো নেই। জিহাদ অস্বিকারকারী নামায রোযা ইত্যাদি অস্বিকারকারীর মতই সমান কাফির। এতে কোন সন্দেহ নেই। সেই সাথে জিহাদের ভুল ব্যখ্যা করাও কুফরীর শামিল।

এক হাদীসে এসেছে রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ، وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ، مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِفَاقٍ»

হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মারা গেল, কিন্তু সে জিহাদে যায়নি, কিংবা জিহাদে যাওয়ার ইচ্ছেও অন্তরে পোষণ করেনি, সে এক প্রকার মুনাফিকী [অবস্থায়] মৃত্যুবরণ করল। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৫৮]

এ হাদীস প্রমাণ করে, জিহাদে যাবার সংকল্প থাকা প্রকৃত মুমিন হবার জন্যও শর্ত। তাই ইসলামে জিহাদের গুরুত্ব, ফযীলত, জিহাদের যৌক্তিকতা, জিহাদে যাবার পদ্ধতি, কাদের সাথে জিহাদ করতে হবে? কখন জিহাদ করতে হবে, এসব বিষয় কুরআন ও হাদীসের আলোকে সাধারণ মুসলমানদের সামনে উপস্থাপন করাও একটি ইবাদত।

উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব হল, জিহাদ বিষয়ে মানুষ সজাগ সচেতন করা। জিহাদের হাকীকত মানুষকে বুঝানো। এটি উলামায়ে কেরামের গুরু দায়িত্ব।

মাওলানা  জসীমুদ্দীন রাহমানী সাহেব দালিলিকভাবে জিহাদের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার পদক্ষেপ নিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দিচ্ছিলেন।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, তিনি এক সময় জিহাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হন। নিজের মন মত জিহাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে নিজেই একটি ফিতনায় পরিণত হন। সেই সাথে বিজ্ঞ ও মুখলিস উলামায়ে কেরামের বিরোধীতা, হাজার বছর ধরে দ্বীন ও ইসলামের উপর আমলের সহজ ও সুসন্বিত পদ্ধতি মাযহাবের বিরোধীতা শুরু করে দেন। শুরু করে দেন মুখলিস দ্বীনের দাঈ উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে বিষোদগার।

এসব করে আমাদের পর্যবেক্ষণ অনুপাতে মাওলানা জসীমুদ্দীন রহমানী সাহেব অবশেষে হক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন বলেই আমরা মনে করি। আমরা জসীমুদ্দীন রহমানী সাহেবের জিহাদ প্রয়োগের তার স্বীয় উদ্ভাবিত নীতিকে ভ্রষ্ট পদ্ধতি বলেই বিশ্বাস করি।

বাকি আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সামনে হককে হক হিসেবে প্রকাশিত করে দিন, যেন তা মানতে পারি। এবং বাতিলকে বাতিল হিসেবে প্রতিভাত করে দিন, যেন তা থেকে বিরত থাকতে পারি। আমীন।

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল- ahlehaqmedia2014@gmail.com

আরও জানুন

মোবাইলে নাপাকী লাগলে তা পবিত্র করার পদ্ধতি কী?

প্রশ্ন: ছোট বাচ্চা  মোবাইল এ পেশাব করে দিয়েছে,  এখন ঐ মোবাইল পবিত্র কিভাবে  করতে হবে?? বাটন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস