প্রশ্ন
sirajuddin sekh
india
****জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই সকলের নিকট #ক্বাবা বিষয়ে আমার কয়েকটি প্রশ্নঃ– আশা করি সূধীজনেরা সঠিক ও সুন্দর উত্তর দিয়ে তৃপ্ত করিবেন——-
১. কোনটা আল্লাহর ঘর ? ক্বাবা না বায়তুল মোকাদ্দাস ?
২. কোন ঘর তাহার অধিক পছন্দ ?
বোখারী শরীফের হাদিসে বর্ণিত আছে, ক্বাবার মর্যাদা একলক্ষ গুন আর বায়তুল মোকাদ্দাসের মর্যাদা পঞ্চাশ হাজার গুন।
— ক্বাবার মর্যাদা যদি এইরূপই হইবে তাহা হইলে মেরাজের কথিত বর্ণনা অনুযায়ী রাসুল সঃ সকল নবীগণের ইমাম হইয়া বায়তুল মোকাদ্দাসে কেন নামাজ পড়িলেন ?
–উক্ত হাদিসের মর্যাদা অনুসারে ইহাতো ক্বাবা ঘরেই হইতে পারিত ?
>মোকাদ্দাস ঘরের চারিদিকে বরকত দেওয়া হইয়াছে বলিয়া কোরানে উল্লেখ আছে যাহা ক্বাবা সমন্ধে নাই [১৭/১] ।
–হাদিসটির মতে ক্বাবার মর্যাদা দ্বিগুণ: সুতরাং নবী সঃ বাকী জীবন ক্বাবার দিকে তাকাইয়া আল্লাহর মোশাহেদা করিবেন ইহাই স্বভাবিক ছিল নয় কি ?
–ক্বাবার মর্যাদা যদি দ্বিগুন হইয়াই থাকিবে তাহা হইলে রাসুল সঃ সেই মর্যাদাকে অবহেলা করিয়া মদীনায় অবস্থান লইতে গেলেন কেন ?
–মক্কা বিজয়ের পর বাকী জিন্দেগী মক্কায় থাকিয়া ক্বাবার জিয়ারতের বৃহত্তর কল্যাণ হাসিল করিতে মনস্থির করিলেন না কেন ?
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
উত্তর বুঝার সুবিধার্তে আপনার প্রশ্নগুলো আমাদের মত প্রথমে সাজিয়ে নিচ্ছি-
১- আল্লাহর ঘর কোনটি? কাবা না বাইতুল মুকাদ্দাস?
২- আল্লাহর কাছে কোন ঘর বেশি প্রিয়?
৩-মেরাজের রাতে বাইতুল মুকাদ্দেস নামায পড়লেন কেন? এ সংক্রান্ত হাদীস কি কথিত?
৪- মুকাদ্দাসের তুলনায় কাবা শ্রেষ্ঠ হলে বাইতুল মুকাদ্দাসকে কুরআনে বরকতময় বলা হল কেন?
৫-কাবা শ্রেষ্ঠ হলে নবীজী সাঃ কাবার কাছে না থাকিয়া বাকি জীবন মদীনায় থাকলেন কেন?
এবার ধারাবাহিকভাবে উত্তরগুলো খেয়াল করুন!
১ নং এর জবাব
মসজিদ মানেই আল্লাহর ঘর। পৃথিবীর প্রতিটি মসজিদই আল্লাহর ঘর। তবে সর্বোৎকৃষ্ট আল্লাহর ঘর হল কাবা শরীফ। দ্বিতীয় হল মসজিদে নববী এবং তৃতীয় হল বাইতুল মুকাদ্দাস। এরপর সারা পৃথিবীর সমস্ত মসজিদই আল্লাহর ঘর। তবে উপরোক্ত তিনটির পর সকল মসজিদই সমমর্যাদার।
২ নং এর জবাব
আল্লাহর কাছে প্রথম প্রিয় হল কাবা শরীফ, দ্বিতীয় হল মসজিদে নববী। তারপর হল বাইতুল মুকাদ্দাস।
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ [١٧:١]
পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি,যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যান্ত-যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল। [সূরা বনী ইসরাঈল-১}
উক্ত আয়াতে কারীমায় মসজিদে হারামের বেশ কিছু শ্রেষ্ঠত্ব বলা হয়েছে। যা আর কোন মসজিদের ক্ষেত্রে বলা হয়নি। যেমন-
১-মসজিদে হারামের প্রস্তুতকার স্বয়ং আল্লাহ্ কর্তৃবাচ্যের কেরাত এ কথারই প্রমাণ।
২-মসজিদে হারামকে মুবারক তথা কল্যাণময় বলা হয়েছে।
৩-মসজিদে হারামকে বিশ্ববাসীর জন্য হিদায়াত বলা হয়েছে।
৪-মসজিদে হারামে প্রবেশকারী নিরাপত্তা লাভ করে।
৫-এতে বহুসংখ্যক নিদর্শন রয়েছে।
৬-মসজিদে হারামকে জিয়ারতের স্থান বলা হয়েছে। [সূরা আলে ইমরান-৯৭}
৭- হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ এর সূত্রে হাদীসে এসেছে-
মসজিদে নববীতে এক নামায পড়া অন্যান্য মসজিদে হাজার নামায পড়া হতে উত্তম, কিন্তু মসজিদে হারামের মর্যাদা এর তুলনায় অনেক বেশি। {বুখারী মুসলিম]
সুতরাং বুঝা গেল মসজিদে হারাম তথা কাবা শরীফ তথা বাইতুল্লাহ শরীফই আল্লাহ পাকের কাছে সবচে’ শ্রেষ্ঠ স্থান। শ্রেষ্ঠ মসজিদ। শ্রেষ্ঠ ঘর।
৩ নং এর জবাব
রাসূল সাঃ বাইতুল মুকাদ্দাসে নামায পড়েছেন এটি কথিত হাদীস নয়। বরং সত্য হাদীস। যা মুসলিম হাদীস নং-১৭২ এবং মুসনাদে আহমাদের হাদীস নং ২৩২৪ দ্বারা প্রমাণিত।
তাই এটিকে কথিত বলার কোন সুযোগ নেই।
আর আপনি যে অর্থে বলছেন উক্ত ঘটনা কাবা শরীফে হতে পারতো, সেই অর্থে একই কথা বলা যায় যে, এ ঘটনাতো মদীনায়ও হতে পারতো বাইতুল মুকাদ্দাসে কেন হল?
আসলে এটি কোন যৌক্তিক প্রশ্ন হতেই পারে না।
ঘটনা যা হয়েছে তাই। আর বাইতুল মুকাদ্দাসের নিকটে যেহেতু অনেক রাসূলগণ এসেছেন, তাই মূলত সে মসজিদে নামায অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর দ্বারা কাবা শরীফের শ্রেষ্ঠত্ব কোনভাবেই কমে যায় না।
৪ নং এর জবাব
কাবা ঘরকে আরো বেশি শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করে ইরশাদ হচ্ছে-
إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِّلْعَالَمِينَ [٣:٩٦]
নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে,সেটাই হচ্ছে এ ঘর,যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হেদায়েত ও বরকতময়। [সূরা আলে ইমরান-৯৬}
এ আয়াতে কারীমায় কাবা গৃহকে মানুষের ইবাদতের জন্য নির্ধারিত প্রথম ঘর বলা হয়েছে। সেই সাথে এটিকে সমগ্র দুনিয়াবাসীর জন্য হেদায়াত ও বরকতের স্থান ঘোষণা করা হয়েছে। যা আর কোন ঘরের জন্য বলা হয়নি।
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ [١٧:١]
পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি,যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যান্ত-যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল। [সূরা বনী ইসরাঈল-১}
এ আয়াতে কারীমায় বাইতুল মুকাদ্দাসের চার পাশে বরকত থাকার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রথম গৃহ এবং সমগ্র দুনিয়ার মানুষের হেদায়াত ও বরকতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়নি।
তাই এটি মর্যাদার দিক থেকে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে। বাইতুল মুকাদ্দাসের চারপাশকে বরকতময় বলার দ্বারা কাবা শরীফের প্রধান শ্রেষ্ঠ হওয়াকে অস্বিকার করার কোন জো নেই।
৫ নং প্রশ্নের জবাব
আসলে এটি আপনার ভুল ধারণা যে, রাসূল সাঃ কাবাকে অবহেলা করেছেন। মদীনাও বরকতপূর্ণ। যেখানে আমাদের প্রিয় অবস্থান করেন, তার প্রতিটি স্থানই বরকতময়। যেমন কাবা আল্লাহর একটি সৃষ্টি, তেমনি আমাদের প্রিয় নবীজী সাঃ ও আল্লাহর সৃষ্টি। আর আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টির মাঝে আমাদের প্রিয় নবীই সবচে’ শ্রেষ্ঠ। এমনকি কাবার চেয়েও আমাদের প্রিয় নবী শ্রেষ্ঠ। তাই কাবা সম্মানী হলেও কাবাতে থেকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে এমন কোন আবশ্যকতা নেই। কাবাকে সম্মান করেন বলেই হুদাইবিয়ার ঘটনার বছর সদলবলে হজ্ব করতে এসেছিলেন। বিদায় হজ্বের সময় বিশাল বাহিনীসহ হজ্ব ও পালন করেছেন। কাবাকে মোহাব্বত করার কারণেই বাইতুল মুকাদ্দাস ছেড়ে বাইতুল্লাহের দিকে নামায পড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। যার ফলে আল্লাহ তাআলা কাবার দিকে নামায পড়ার বিধান আরোপ করে ইরশাদ করেছেন-
قَدْ نَرَىٰ تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ ۖ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا ۚ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ ۚ وَحَيْثُ مَا كُنتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ ۗ وَإِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّهِمْ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُونَ [٢:١٤٤]
নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বার বার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব,অবশ্যই আমি আপনাকে সে কেবলার দিকেই ঘুরিয়ে দেব যাকে আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনি মসজিদুল-হারামের দিকে মুখ করুন এবং তোমরা যেখানেই থাক,সেদিকে মুখ কর। যারা আহলে-কিতাব, তারা অবশ্যই জানে যে, এটাই ঠিক পালনকর্তার পক্ষ থেকে। আল্লাহ বেখবর নন, সে সমস্ত কর্ম সম্পর্কে যা তারা করে। [সূরা বাকারা-১৪৪}
কাবা শরীফের প্রতি রাসূল সাঃ এর আজমত ছিল। ছিল মোহাব্বতও। বাকি মদীনায় তিনি অবস্থান করেছেন যেহেতু মদীনার লোকজন রাসূল সাঃ কে অধিক মোহাব্বত করতো। মক্কার মুশরিকরা রাসূল সাঃ কে তাড়িয়ে দিলেও মদীনার লোকেরা নবীজী সাঃ কে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। আশ্রয় নিয়েছেন। দ্বীনের জন্য অবিস্মরণীয় কুরবানী করেছেন। সেই কৃতজ্ঞতায় রাসূল সাঃ সারা বিদায় হজ্বের পর বাকি জীবন মদীনায়ই কাটিয়েছেন। এর দ্বারা কাবাকে তথা বাইতুল্লাহকে ছোট করা হয় না কিছুতেই।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।