প্রশ্ন
সম্মানিত মুফতী সাহেব! বেআদবী না নিলে একটি প্রশ্ন করতে চাচ্ছিলাম। সময় করে দ্রুত উত্তর দিলে কৃতজ্ঞ হবো। আমার মত অনেকের মনেই এ প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটি হল,কথিত আহলে হাদীস ভাইয়েরা প্রচার করে থাকে যে, নামাযের মাসায়েলগত যে মতভেদ চার মাযহাবে রয়েছে। যদি সবাই সহীহ হাদীসের উপর আমর করে তাহলে আর কোন মতভেদ থাকবে না। সবাই এক হয়ে যাবে নামাযের মাসআলায়। একথাটি কতটুকু সত্য? যদি একই হওয়া যায় সহীহ হাদীস অনুপাতে নামায আদায় করলে। তাহলে আপনারা কেন মাযহাবের অনুসরণ রেখে সহীহ হাদীস অনুপাতে নামাযের মাসায়েলগুলোকে একত্রিত করে উম্মতের মাঝে একতা সৃষ্টি করছেন না?
এ বিষয়টি একটু ব্যাখ্যাসহ জানালে কৃতজ্ঞ হবো।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
আসলে লামাযহাবী ভাইদের উপরোক্ত বক্তব্যটি বাহ্যিক দৃষ্টিতে খুবই মুখরোচক। কিন্তু বাস্তবতা বিবর্জিত। মূলত ও উপরোক্ত বক্তব্যটি তারা প্রদান করে থাকেন দু’টি অজ্ঞতার কারণে। যথা-
১ নং অজ্ঞতা
“মতভেদ মানেই খারাপ” এ ধারণা থাকার কারণে। আসলে কোন শাখাগত বিষয়ে মতভেদ হওয়া এটি কোন দোষণীয় বিষয় নয়। বরং এটি সাহাবায়ে কেরাম রাঃ থেকে রাসূল সাঃ এর জমানা থেকেই ছিল। কিন্তু এ মতভিন্নতাকে রাসূল সাঃ খারাপ হিসেবে উপস্থাপন করেননি।
যেমন
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَنَا لَمَّا رَجَعَ مِنَ الأَحْزَابِ: «لاَ يُصَلِّيَنَّ أَحَدٌ العَصْرَ إِلَّا فِي بَنِي قُرَيْظَةَ» فَأَدْرَكَ بَعْضَهُمُ العَصْرُ فِي الطَّرِيقِ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ: لاَ نُصَلِّي حَتَّى نَأْتِيَهَا، وَقَالَ بَعْضُهُمْ: بَلْ نُصَلِّي، لَمْ يُرَدْ مِنَّا ذَلِكَ، فَذُكِرَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَلَمْ يُعَنِّفْ وَاحِدًا مِنْهُمْ
হযরত ইবনে উমর রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ যখন আহযাব ফিরলেন, তখন বললেন, [সাহাবীদের] “তোমাদের কেউ বনু কুরাইযায় গিয়ে আসর নামায পড়”। তখন কতিপয় সাহাবীদের পথিমধ্যেই আসরের সময় হয়ে যায়। তখন কতিপয় সাহাবী বলেন, আমরা বনু কুরাইযায় পৌঁছার আগে নামায পড়বো না। কিন্তু বাকিরা বললেন, আমরা এখনি পড়ে নিব। তখন তাদের কেউ বাঁধা দেয়নি। এ বিষয়টি পরবর্তীতে রাসূল সাঃ এর কাছে উল্লেখ করা হলে রাসূল সাঃ কারো ব্যাপারে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৯৪৬}
লক্ষ্য করুন। উক্ত ঘটনায় পরিস্কার দু’টি মতভেদ হয়ে গেল। একদল পথিমধ্যে নামায পড়লেন রাসূল সাঃ এর বাহ্যিক আদেশের লঙ্ঘণ করে। আরেক দল বাহ্যিক আদেশ মান্য করে বনু কুরাইযায় পৌঁছে নামায পড়লেন। এ দুই মতভেদের কথা জেনে রাসূল সাঃ কাউকে মন্দ বলেননি। কাউকে একথা বলেননি যে, তুমি গলদ করেছো।
যা পরিস্কার প্রমাণ করে সকল মতভেদই নিন্দনীয় নয়।
যে মতভেদে এসে একদল আরেক দলকে গোমরাহ বলে সেটি ক্ষেত্রবিশেষে নিন্দনীয় হয়। কিন্তু পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ রেখে, অপরকেও সঠিক বলে যে কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যাগত ভিন্নতার কারণে যে শাখাগত মতভেদ আছে, সেটি কিছুতেই নিন্দনীয় নয়।
নিন্দনীয় হল,কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যাগত ভিন্নতার কারণে শাখাগত মাসায়েল মতভিন্নতা করে একদল আরেক দলকে গোমরাহ বললে সেটি হয় নিন্দনীয়।
যেমন চার মাযহাবের মতভেদ কিছুতেই নিন্দনীয় নয়। কারণ এ মতভেদ হয়েছে কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যাগত মতভেদের কারণে। আর এ মতভেদের কারণে কোন মাযহাবের অনুসারী অন্য মাযহাবের অনুসারীকে গোমরাহ বা ভুল পথে আছেন বলে মন্তব্য করেন না। তাই মাযহাবের মতভেদ কোন নিন্দনীয় মতভেদ নয়। এর দ্বারা কোন ফাটলও সৃষ্টি হচ্ছে না।
হ্যাঁ, ফাটল তখনি সৃষ্টি হতো, যদি এক মাযহাবের অনুসারী আরেক মাযহাবের অনুসারীকে গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট বলতো।
এ হিসেবে বর্তমান লামাযহাবী সম্প্রদায় হল গোমরাহ ফিরক্বা। তারা নিজেদের বুঝ মত একটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে আরেকটি ভুল ও গোমরাহ সাব্যস্ত করে। ফলে তারা উম্মতের মাঝে ফাটল ও বিভেদ সৃষ্টি করে থাকে। তাই এ লামাযহাবী সম্প্রদায়ের কারণে উম্মতের মাঝে বিভক্তি ও ফিতনা হচ্ছে। চার মাযহাবের কারণে কোন বিভক্তি ও ফিতনা হয়নি। যেহেতু প্রতিটি মাযহাবের অনুসারীই অপর মাযহাবকে শ্রদ্ধা করে ও সঠিক মানে। তাই এতে উম্মতের মাঝে কোন ফাটল ও বিভক্তি আসেনি। বিভক্তি এসেছে মূলত লামাযহাবীদের কারণে।
অজ্ঞতা নং-২
কুরআন ও হাদীস নিয়ে গভীর পড়াশোনা না থাকার কারণেও এ জাহিলী মতটি প্রকাশ হয়ে থাকে। যদি কুরআন ও হাদীস ভাল করে উক্ত ভাইয়েরা অধ্যায়ন করতেন। তাহলে এ বোকামীসূলভ বক্তব্য তারা প্রদান করতেন না। কারণ অসংখ্য হাদীসের মাঝে বাহ্যিক মতভেদ বিদ্যমান। মতভেদ সাহাবায়ে কেরামের মাঝেও বিদ্যমান ছিল শাখাগত মাসায়েলে। সুতরাং এ মতভেদ তুলে দিয়ে সব মাসআলায় একতা এটি হাস্যকর কথা। সেই সাথে অসম্ভব কথা। এটি কিছুতেই সম্ভব নয়।
শুধু সহীহ হাদীস মানলে মতভেদ দূর হয়ে যায় এটিও একটি অজ্ঞতাসূচক বক্তব্য ছাড়া কিছু নয়। কয়েকটি উদাহরণ নিচে উদ্ধৃত করছি।
আমাদের দেশে যারা সহীহ হাদীসের ধোঁয়া তুলে উম্মতকে বিভক্ত করে চলেছেন। যারা সহীহ হাদীসের আলোকে তাদের মনগড়া নামায উপস্থাপন করে যাচ্ছেন, তাদের কয়েকটি নামাযের বইয়ে উদ্ধৃত নামাযের মাসআলায় মতভেদ লক্ষ্য করুন-
১–কিরাত পড়া প্রসঙ্গে
ক) আলবানীর মতে জোরে জেহরী নামাযে কিরাত পড়া রহিত।{শায়েখ আলবানীর “নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছলাত সম্পদনের পদ্ধতি-৮৩}
খ) আসাদুল্লাহ গালিব বলে ফরজ। {আসাদুল্লাহ গালিব সাহেব রচিত ছালাতুর রাসূল সাঃ-৮৮}
২–বিসমিল্লাহ প্রসঙ্গে
ক) বিসমিল্লাহ সূরা ফাতিহার অংশ হবার পক্ষে কোন ছহীহ দলীল নেই। {আসাদুল্লাহ গালিব সাহেব রচিত ছালাতুর রাসূল সাঃ -৮৬}
খ) সূরা ফাতিহা কুরআনের অংশ। {অধ্যাপক হাফিজ আইনুল বারী রচিত “আইনী তুহফা সলাতে মুস্তাফা”-১০৫}
৩–বিসমিল্লাহ জোরে পড়া
ক) গালিব সাহেবের মতে এর কোন ভিত্তি নেই। [আসাদুল্লাহ গালিব সাহেব রচিত ছালাতুর রাসূল সাঃ -৮৬}
খ) জোরে আস্তে উভয়ভাবে পড়া ছহীহ সনদে বর্ণিত। {আকরামুজ্জামান বিন আব্দুস সালাম সম্পাদিত “ছালাত আদায় পদ্ধতি”-২৮}
৪-রুকু
ক) রুকু পেলে রাকাআত পাওয়া যায়। {আকরামুজ্জামান বিন আব্দুস সালাম সম্পাদিত “ছালাত আদায় পদ্ধতি”-৩৩}
খ) রুকু পেলে উক্ত রাকাত পায়নি। { আসাদুল্লাহ গালিব সাহেব রচিত ছালাতুর রাসূল সাঃ -৯৬}
৫-সালাম
ক) ডান দিকে ফিরে ওয়াবারাকাতুহু বলতে হবে {আকরামুজ্জামান সম্পাদিত ছালাত আদায় পদ্ধতি-৬২}
খ) উভয় দিকেই ওয়াবারাকাতুহু বলতে হবে। {ইবনে ফজলের সহীহ নামায ও দুআ শিক্ষা-১০৩}
৬-জনাযায় ফাতিহা
ক) আসাদুল্লাহ গালিব বলেন পড়া ওয়াজিব। {ছালাতুর রাসূল-২১৩}
খ) আলবানী বলে সুন্নত। {সিফাতু সালাতিন্নবী-১১১}
এরকম অসখ্য মতবিরোধ শুধু নামাযের মাসআলার ক্ষেত্রে দেখানো যাবে। যা কথিত আহলে হাদীস বা লামাযহাবী/শব্দধারী মুসলিম জামাতের ভাইদের রচিত সহীহ হাদীসের আলোকে রচিত নামাযের বইয়ে রয়েছে। প্রশ্ন হল, যদি সহীহ হাদীস মানলে মতভেদ না থাকে, তাহলে এসব মতভেদ কেন তাদের প্রকাশিত এসব বাংলা নামাযের বইয়ে? কেন তারা সহীহ হাদীসের অনুসারীরাই শুধু নামাযের মাসআলায়ই এক হতে পারছেন না?
তাহলে কি বুঝা যাচ্ছে?
পরিস্কার ভাষায় বুঝা যাচ্ছে, আসলে সহীহ হাদীসের নামে একতাবদ্ধ হবার স্লোগান কেবলি একটি মুখরোচক ও ধোঁকাবাজীমূলক স্লোগান। যা কেবলি অন্তসারশূণ্য। মানুষকে প্রতারণায় ফেলার জন্য এ ধোঁকাবাজীমূলক বক্তব্যটি প্রদান করা হয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা আমাদের এ ভ্রান্ত ফিরকার ধোঁকা থেকে উম্মতে মুসলিমাকে হিফাযত করুন। আমীন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।