প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / প্রসঙ্গ বুকের উপর হাত বাঁধা এবং মুজাফফর বিন মুহসিনের হাদীস নিয়ে জালিয়াতি

প্রসঙ্গ বুকের উপর হাত বাঁধা এবং মুজাফফর বিন মুহসিনের হাদীস নিয়ে জালিয়াতি

প্রশ্ন

সম্মানিত মুফতী সাহেব!

আসসালামু আলাইকুম।

আমার প্রশ্ন হল, নামাযে হাত কোথায় বাঁধবো? এ বিষয়ে ইদানিং খুবই সমস্যায় পড়ছি। বাজারে কিছু নতুন বই এসেছে যাতে এ বিষয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য ছাপছে। এ বিষয়ে দলীলসহ জানালে কৃতজ্ঞ হবো।

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

হাত বাঁধা বিষয়ে  মাসআলা দু’টি। যথা- হাত কোথায় বাঁধবে? এবং হাত কিভাবে বাঁধবে?

আমরা যখন হাত বাঁধার মাসআলা বলি, তখন উভয়টিই বলে থাকি। আমাদের কিতাবগুলোতেও দু’টি বিষয়ই পরিস্কার ভাষায় লিখা আছে। যেহেতু আমাদের কাছে হাদীস বেশি।

আর ওরা বলে একটি তথা হাত কোথায় বাঁধবে? বলে শুধু বুকের উপর হাত বাঁধতে হবে। কিন্তু কিভাবে বাঁধবে? হাতের আঙ্গুল কেমন থাকবে? কব্জির উপর হাতের কোন অংশ থাকবে? কিভাবে বাঁধবে এর কোন পূর্ণাঙ্গ বিবরণ তারা তারা বলেও না, আবার তাদের কিতাবে লিখিতও নেই। কারণ হাদীস তাদের কাছে আছেই কম। তাই বুঝেও কম। মাসআলাও বলে আধা।

একটি উদাহরণঃ

প্রথম ইসলাম কে গ্রহণ করেছে?

এ বিষয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেন হযরত খাদিজা রাঃ। কেউ বলেন হযরত আলী রাঃ। কেউ বলেন হযরত জায়েদ বিন হারেসা রাঃ। কেউ বলেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাঃ।

ইমাম আবু হানীফা রহঃ বলেন, মহিলাদের মাঝে খাদিজা রাঃ, প্রাপ্ত বয়স্কদের মাঝে আবু বকর। ছোটদের মাঝে আলী রাঃ। গোলামদের মাঝে হযরত জায়েদ বিন হারেসা।

তাহলে আমরা সব হাদীসকে মেনে নিলাম। আমাদের ইমাম ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর কাছে হাদীস সবই ছিল। তাই তিনি সব হাদীসকেই গ্রহণ করে নিলেন চমৎকার বুদ্ধিমত্বার সাথে।

তেমনি হাত বাঁধা বিষয়ে ৪ ধরণের বিষয় এবং হাদীসও রয়েছে চার ধরণের। যথা-

১- ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতে হবে।

২- ডান হাত বাম হাতের তালুর পৃষ্ঠদেশ এবং কব্জি এবং বাহুর উপর রাখতে হবে।

৩-হাত দ্বারা কব্জি চেপে ধরবে।

৪- নাভীর নিচে রাখবে।

এই হল হাত বাঁধার পূর্ণ আমল। কোথায় বাঁধবে বলার সাথে হাত কিভাবে বাঁধবে তাও কিতাবে পরিস্কার ভাষায় লিখা আছে। আমরা এ মাসআলা বলার সময় পরিস্কার ভাষায় পুরোটাই বলে থাকি। যেমন-

وَيَضَعُ بَطْنَ كَفِّهِ الْأَيْمَنِ عَلَى رُسْغِهِ الْأَيْسَرِ تَحْتَ السُّرَّةِ فَيَكُونُ الرُّسْغُ فِي وَسَطِ الْكَفِّ

ডান হাতের তালু বাম হাতের কব্জির উপর রেখে নাভির নিচে বাঁধবে।যেন [ডান]কব্জিটি [বাম]তালুর পৃষ্ঠদেশের উপরে থাকে। {কিতাবুল আসার লিমুহাম্মদ, হাদীস নং-১২০}

তাহলে আমাদের ইমামদের কিতাবে হাত বাঁধার পূর্ণ তরীকা বর্ণিত হয়েছে।

কারণ আমাদের কাছে হাত বাঁধার পূর্ণ হাদীস বিদ্যমান।

ডান হাত বাম বাহুর উপর রাখার হাদীস

عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ، قَالَ: «كَانَ النَّاسُ يُؤْمَرُونَ أَنْ يَضَعَ الرَّجُلُ اليَدَ اليُمْنَى عَلَى ذِرَاعِهِ اليُسْرَى فِي الصَّلاَةِ»

হযরত সাহাল বিন সাদ রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকদের আদেশ করা হতো, ব্যক্তি তার ডান হাতকে বাম বাহুর উপরে রাখবে নামাযের সময়। {বুখারী, হাদীস নং-৭৪০}

এ হাদীসে এসেছে ডান হাতকে বাম বাহুর উপরে রাখার কথা।

বাম হাতের তালুর পৃষ্ঠদেশ, কব্জি বাহুতে হাত রাখা

أَنَّ وَائِلَ بْنَ حُجْرٍ الْحَضْرَمِيَّ، أخْبَرَهُ قَالَ: قُلْتُ: لَأَنْظُرَنَّ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَيْفَ يُصَلِّي؟ قَالَ: فَنَظَرْتُ إِلَيْهِ قَامَ فَكَبَّرَ، وَرَفَعَ يَدَيْهِ حَتَّى حَاذَتَا أُذُنَيْهِ، ثُمَّ وَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى ظَهْرِ كَفِّهِ الْيُسْرَى، وَالرُّسْغِ وَالسَّاعِدِ،

হযরত ওয়াইল বিন হুজুর রাঃ বলেন, আমি রাসুল  সাঃ এর নামাযের দিকে লক্ষ্য করতাম, তিনি কিভাবে নামায পড়তেন? তিনি বলেন, আমি তাকে দেখেছি, তিনি দাঁড়িয়ে প্রথমে তাকবীর বলতেন। এবং হাত উঠাতেন কান পর্যন্ত। তারপর ডান হাতকে বাম তালুর পৃষ্ঠদেশ এবং কব্জি এবং বাহুতে রাখতে রাখতেন। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৮৮৭০, আবু দাউদ, হাদীস নং-৭২৭}

এখানে লক্ষ্যনীয় হল, বাম তালুর পৃষ্ঠদেশ, কব্জি এবং বাহুতে একই সাথে হাত রাখা। আর এটি আমরা যেভাবে রাখি সেভাবেই পূর্ণতা পায়।

ডান হাত দিয়ে বাম হাত ধরা

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّا مَعْشَرَ الْأَنْبِيَاءِ أُمِرْنَا أَنْ نُؤَخِّرَ سُحُورَنَا وَنُعَجِّلَ فِطْرَنَا وَأَنْ نُمْسِكَ بِأَيْمَانِنَا عَلَى شَمَائِلِنَا فِي صلاتنا

হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাঃ ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আমরা হলাম নবীদের জামাত। আমাদের দেরী করে সেহরী খেতে এবং তাড়াতাড়ি ইফতার করতে আর নামাযে মাঝে ডান হাত দিয়ে বাম হাত ধরতে আদেশ করা হয়েছে। {সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-১৭৭০, সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং-১০৯৭}

এ হাদীসের মাধ্যমে আমরা যে ডান হাত দ্বারা বাম হাতের কব্জি ধরি সেটি প্রমাণিত হল।

নাভির নিচে হাত বাঁধার প্রমাণ

حدثنا وكيع،  عن موسى بن عمير عن علقمة بن وائل بن حجر، عن أبيه قال: رأيت النبى صلى الله عليه وسلم وضع يمينه على شماله فى الصلاة تحت السرة، (مصنف ابن ابى شيبة، رقم الحديث-3959،-3/320-322، تحقيق شيخ عوامة)

হযরত ওয়াইল বিন হুজুর রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সাঃ কে দেখেছি নামাযে তিনি ডান হাতকে বাম হাতের উপর রেখে নাভির নিচে বাঁধতেন। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৩৯৫৯, তাহকীক শায়েখ মুহাম্মদ আওয়ামা, দারুল কিবলাহ, সৌদী আরব}

উল্লেখ্য,

মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবার ১৪/১৫টি পান্ডুলিপি রয়েছে।

এর মাঝে একাধিক পান্ডুলিপিতে এভাবেই অর্থাৎ ةحة السرة (নাভীর নিচে) কথাটাসহ আছে। এর মধ্যে ইমাম মুরতাযা আযাবীদী-এর পান্ডুলিপি ও ইমাম আবিদ আসসিন্দী রাহ.-এর পান্ডুলিপি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম কাসিম ইবনে কুতলূবুগা রাহ., আল্লামা আবদুল কাদির ইবনে আবু বকর আসসিদ্দীকি ও আল্লামা মুহাম্মাদ আকরাম সিন্ধীর পান্ডুলিপিতেও হাদীসটি এভাবে আছে। পক্ষান্তরে অন্য কিছু পান্ডুলিপিতে এই বর্ণনায় ةحة السرة  (নাভীর নিচে) কথাটা নেই। এ কারণে ভারতবর্ষে মুদ্রিত মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবার পুরানো সংস্করণে এই হাদীসে ةحة السرة  (নাভীর নিচে) অংশটি ছিল না। বর্তমানে মদীনা মুনাওয়ারার বিখ্যাত ফকীহ ও মুহাদ্দিস শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামার তাহকীক-সম্পাদনায় মুসান্নাফের যে মুদ্রণ পাঠক-গবেষকদের কাছে পৌঁছেছে তাতে হাদীসটি ةحة السرة (নাভীর নিচে) অংশসহ রয়েছে। কারণ শায়খের সামনে প্রথমোক্ত পান্ডুলিপিগুলোও ছিল।

হাদীসের কিতাব এবং পান্ডুলিপি সম্পর্কে অজ্ঞতা ও মুর্খতার কারণে কথিত শায়েখ মুজাফফর বিন মুহসিন রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণিত এ হাদীসকে অস্বিকার করে হাদীস অস্বিকারকারী সাব্যস্ত হয়েছেন। [দেখুন-জাল হাদীসের কবলে রাসূল সাঃ এর নামায-২১৫}

কথিত আহলে হাদীস মুজাফফর বিন মুহসিনের জালিয়াতি!

বুকের উপর কোন সহীহ বর্ণনা কথিত আহলে হাদীস ভাইদের কাছে নেই। একথা আমাদের উক্ত ভাইয়েরা ভাল করেই জানেন। তাই এ ভ্রান্ত মাসআলা প্রমাণের  জন্য তাদের আকাবীরে উলামাদের পথ অনুসরণ করে হাদীসের ক্ষেত্রে একের পর এক জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন কথিত শায়েখ মুজাফফর বিন মুহসিন সাহেব।

বুখারীতে বুকের উপর হাত বাঁধার ব্যাপারে কোন কথা না থাকলে স্বপ্নের ঘোরে তিনি খুঁজে পেয়েছেন বুকের উপর হাত বাঁধার দলীল।

দলীল হিসেবে পেশ করলেন ইমাম বুখারী রহঃ এর পেশ করা হাদীস

ইমাম বুখারী রহঃ শিরোনাম কায়েম করেছেন باب وضع اليمنى على اليسرى তথা ডান হাত বাম হাতের উপর রাখার পরিচ্ছেদ।

পরিচ্ছেদের শিরোনাম দেখেই সকল পাঠক বুঝে যাবেন ইমাম বুখারী রহঃ উক্ত বাবের অধীনে ডান হাত বাম হাতের উপরে রাখার বিষয়ে হাদীস আনবেন। আর ইমাম বুখারী রহঃ তাই করেছেন। কিন্তু চোখ থাকতেও অন্ধ কথিত আহলে হাদীস মুজাফফর বিন মুহসিন সাহেব ইমাম বুখারী রহঃ থেকেও হাদীস দুই লাইন বেশি বুঝে আবিস্কার করেছেন ইমাম বুখারী রহঃ উক্ত বাবের অধীনে বুকের উপর হাত বাঁধার হাদীস এনেছেন।

দেখুন তার হাস্যকর প্রচেষ্টা।

হাদীসটি দেখে নেই-

عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ، قَالَ: «كَانَ النَّاسُ يُؤْمَرُونَ أَنْ يَضَعَ الرَّجُلُ اليَدَ اليُمْنَى عَلَى ذِرَاعِهِ اليُسْرَى فِي الصَّلاَةِ»

হযরত সাহাল বিন সাদ রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকদের আদেশ করা হতো, ব্যক্তি তার ডান হাতকে বাম বাহুর উপরে রাখবে নামাযের সময়। {বুখারী, হাদীস নং-৭৪০}

এ হাদীস বিষয়ে ইমাম বুখারী রহঃ এবং ইমাম নববী রহঃ সম্পর্কে বিআদবীমূলক বক্তব্য দিয়ে মহাজ্ঞানী মুজাফফর বিন মুসহিন সাহেব লিখেন-

“ইমাম বুখারী রহঃ অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন “ছালাতের মধ্যে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা অনুচ্ছেদ”। উল্লেখ্য যে,ইমাম নববী রহঃ নিম্নোক্ত মর্মে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন “তাকবীরে তাহরীমার পর ডান হাত বাম হাতের উপর স্থাপন করে বুকের নিচে নাভীর উপরে রাখা”। অথচ হাদীছে ‘বুকের নীচে নাভীর উপরে’ কথাটুকু নেই। মূলত:পুরো বাম হাতের উপরে ডান হাত রাখলে বুকের উপরই চলে যায়।{জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ [ছাঃ] এর ছালাত-২১৯-২২০}

বাহ! একই বলে হাদীস বেত্তা! হাদীস বিশারদ! কি চমৎকার হাদীস বুঝেছেন আমাদের মুজাফফর সাহেব। বুকের উপর হাত বাঁধার ভ্রান্ত মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য কি শব্দে ইমাম বুখারী রহঃ এবং ইমাম মুসলিমের কথাকে আস্তাকুরে নিক্ষেপ করে দিলেন। কিন্তু একটুও খিয়াল করলেন না তিনি যা বললেন তা কতটা ডাহা মিথ্যা এবং রাসূল সাঃ এর হাদীস নিয়ে রসিকতা।

এ বিষয়ে মুজাফফর সাহেবের কয়েকটি জালিয়াতি উপস্থাপন করা হচ্ছে।

জালিয়াতী নং-১-

বিজ্ঞ পাঠক! খেয়াল করুন। মুজাফফর বলেছেন পুরো বাম হাতের উপর ডান রাখতে বলেছেন।

পুরো বাম হাত মানে কি? তিনি কি কোনদিন অভিধান দেখেছেন? হাত শব্দের আরবী কি? হাত শব্দের আরবীতো হল يد । যার সীমা হল আঙ্গুল থেকে নিয়ে বগল পর্যন্ত। আঙ্গুল থেকে নিয়ে বগল পর্যন্ত পূর্ণ অংশটির নাম হল হাত তথা আরবী يد শব্দ। তো তিনি উক্ত হাদীসে বাম يد তথা ‘বাম হাত’ শব্দ কোথায় পেলেন? হাদীসেতো এসেছে ذِرَاعِ শব্দ। যার আভিধানিক হল, আঙ্গুল থেকে নিয়ে কনুই পর্যন্ত। কারো কারো মতে কব্জি থেকে নিয়ে কনুই পর্যণ্ত।

এ মহান হাদীসবেত্তা সাহেব ذِرَاعِ আর يد শব্দের অনুবাদ সম্পর্কেই সম্পূর্ণ বেখবর। তিনি এসেছেন হাদীসের তাহকীক করতে। আফসোস! এসব জাহিল হাদীসবেত্তাদের অনুসারীদের উপর। ইমাম আবু হানীফার মত পৃথিবী বিখ্যাত মুজতাহিদের তাহকীক রেখে তাদের কপালে জুটেছে ذِرَاعِ আর يد শব্দের অনুবাদ সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিদের তাকলীদের আজাব।

তাহলে বুঝা গেল মুজাফফর বিন মুহসিন সাহেব প্রথম নাম্বার জালিয়াতি করেছেন ذِرَاعِ তথা বাহু শব্দের অনুবাদ يد তথা হাত করার মাধ্যমে।

জালিয়াতি নং-২

হাদীসে শুধুমাত্র ডান হাতকে বাম বাহুর উপর রাখার কথা এসেছে। পুরোটার উপর রাখতে হবে না আধা রাখতে হবে একথা হাদীসে বলা হয়নি। কিন্তু মুজাফফর সাহেব তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রমাণের জন্য হাদীসের অনুবাদ ভুল করে পুরো বাম হাতের উপর ডান হাত রাখার ফাতওয়া জারি করলেন। কিন্তু একবারও খেয়াল করলেন না, বাম বাহু দ্বারা যদি পুরো বাহু উদ্দেশ্য নিতে হয়, তাহলে ডান হাত দ্বারাও পুরো হাত উদ্দেশ্য নিতে হবে। সেই হিসেবে পুরো ডান হাত পুরো বাম বাহুর উপর রাখা কিছুতেই সম্ভব নয়। পারলে মুজাফফর সাহেব একটু নিজে আমল করে দেখানতো।

পুরো হাততো আঙ্গুল থেকে নিয়ে বগল পর্যন্তকে বলে। আর বাম ذِرَاعِ মানে হল বাহু। যার সীমা হল আঙ্গুল থেকে নিয়ে কনুই। তাহলে বগল থেকে নিয়ে আঙ্গুল পর্যন্ত পুরো ডান হাত আর বাম আঙ্গুল থেকে নিয়ে কনুই পর্যন্ত পুরো বাম বাহুর উপর রাখা সম্ভব?

এ কেমন জালিয়াতির আশ্রয় নিলেন মুজাফফর সাহেব? ডান হাতের ক্ষেত্রে পুরো হাত না আধা হাত কিছুই বললেন না, কিন্তু বাম বাহুর ক্ষেত্রে পুরোটা বলে কি গোঁজামিল তৈরী করতে চাইলেন? এভাবে হাদীস নিয়ে ধোঁকাবাজী আর প্রতারণার নাম আর যাই কিছু হোক সহীহ হাদীসের উপর আমল যে নয় একথা আশা করি সকল পাঠকগণই বুঝে যাবেন।

৩ নং জালিয়াতি-

আরো একটি মারাত্মক চাতুরী ও জালিয়াতী করে মুজাফফর সাহেব লিখে দিলেন ডান হাত নাকি বাম বাহুর উপরে রাখলে বুকের উপর চলে আসে।

প্রিয় পাঠকগণ! আপনি নিজেই একটু পরীক্ষা করে দেখুনতো। মুজাফফর সাহেব সত্য বলেছেন না হাদীস নিয়ে জালিয়াতি করেছেন। ডান হাতকে বাম ‘জিরা’ তথা আঙ্গুল থেকে নিয়ে কনুই পর্যন্ত বেঁধে দেখুন হাত বুকের উপর থাকে না পেটের উপর যায়?

নিশ্চিতভাবেই পেটের উপর যায়। বুকের উপর কিছুতেই আসবে না। পেটে যায় বলেই ইমাম নববী রহঃ এ হাদীসের উপর শিরোনাম দিয়েছিলেন-“তাকবীরে তাহরীমার পর ডান হাত বাম হাতের উপর স্থাপন করে বুকের নিচে নাভীর উপরে রাখা”। যা উক্ত আমল সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে মুজাফফর সাহেব পৃথিবী বিখ্যাত হাদীস বিশারদ ইমাম নববী রহঃ এর শিরোনামের ভুল ধরার ভুল করতে একবারও ভাবলেন না। কিন্তু নিজের ভ্রান্ত মতবাদকে হাস্যকরভাবে প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা করে গেলেন।

তাহলে কি বুঝা গেল? মুজাফফর সাহেবের বাতলানো ভ্রান্ত অনুবাদ অনুপাতে আমল করলেও হাত বুকের উপর না গিয়ে পেটের উপর থাকলেও তিনি বুকের উপর চলে যাবার কথা বলে জঘন্য জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা এমন জালিয়াতদের হাত থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের হিফাযত করুন।

বুকের উপর হাত বাঁধতে মুনকার হাদীসই গলার মালা!

বুকের উপর হাত বাঁধার কিছু মুনকার ও জাল বর্ণনা উপস্থাপনা করার পর মুজাফফর সাহেব তার বইয়ে আরেকটি হাস্যকর কাজ করেছেন। সেটি হল, সহীহ ইবনে খুজাইমার একটি মুনকার বর্ণনা এনে লিখেন-

“উক্ত হাদীসের টিকায় শায়খ আলবানী রহঃ বলেন,

‘এর সনদ জঈফ। কারণ তা ত্রুটিপূর্ণ। আর তিনি হলেন ইবনু ইসমাঈল। তার স্ম্রতি শক্তি দুর্বল। তবে হাদীস সহীহ। {জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ [ছাঃ] এর ছালাত-২২৩}

মুজাফফর সাহেবের কান্ড দেখে আশা করি আমার মত আপনাদেরও হাসি উঠার কথা। নিজের ভ্রান্ত মতবাদ প্রমাণের জন্য উক্ত ত্রুটিপূর্ণ বর্ণনাকারী মুআম্মাল সম্পর্কে ইমাম বুখারী রহঃ কি বলেছেন? সেটি না দেখে আলবানী রহঃ এর অন্ধ তাকলীদ করে যা আনলেন তা দেখে না হেসে পারলাম না।

আলবানী সাহেব বলছেন হাদীসটির সনদ জঈফ। সেই সাথে এটি ত্রুটিপূর্ণ। মুআম্মাল বিন ইসমাঈল সাহেবের মুখস্ত শক্তি ছিল খুবই দুর্বল। এত কিছুর পরও নাকি হাদীস সহীহ!!!

বর্ণনাকারীর স্মৃতিশক্তি দুর্বল। সনদ দুর্বল। তারপরও হাদীস সহীহ? বাহ! একেই বলে বিচার মানি তালগাছ আমার। দুর্বল স্মৃতিশক্তির দুর্বল বর্ণনাকারীর জঈফ হাদীস নাকি আবার সহীহ। এ বিষয়ে আসলে আমাদের কিছুই বলার নেই। আল্লাহ তাআলা হক বুঝার ক্ষমতা কারো কাছ থেকে কেড়ে নিলে আমরা শত চেষ্টা করেও তাদের হেদায়াতের আলোয় আনার ক্ষমতা রাখি না। বাকি মুজাফফর সাহেবের এ অন্ধ তাকলীদ এবং হাস্যকর বক্তব্যের উপর শুধু আফসোসই প্রকাশ করতে পারি।

মুজাফফর সাহেব যদি একটু কষ্ট করে আলবানী সাহেবের অন্ধ তাকলীদ না করে যার নাম বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন সেই ইমাম বুখারী রহঃ এর দিকে একবার তাকাতেন। দেখতেন ইমাম বুখারী রহঃ উক্ত হাদীসের বর্ণনাকারী মুআম্মাল বিন ইসমাঈল সম্পর্কে কি বলেছেন? আর উক্ত শব্দটির ব্যাখ্যা ইমাম বুখারী কি করেছেন? তাহলে হয়তো এমন ভুল ও প্রতারণা জাতির সাথে তিনি করতেন না।

কিন্তু আলবানী রহঃ এর অন্ধ মুকাল্লিদ মুজাফফর সাহেবের সেই নসীব হবে কি না? আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন। বাকি সাধারণ পাঠকদের জন্য আমরা উক্ত বিষয়টি উদ্ধৃত করে দিচ্ছি।

উক্ত হাদীসের রাবী মুআম্মাল বিন ইসমাঈল সম্পর্কে ইমাম বুখারী রহঃ বলেন-

مؤمل بن اسماعيل العدوى مولى آل الخطاب وقيل مولى بني بكر أبو عبدالرحمن البصري نزيل مكة.الخ

وقال البخاري منكر الحديث

অনুবাদ-মুআম্মাল বিন ইসমাঈর আল আদাবী আলুল খিতাবের মাওলা ছিলেন, কারো মতে বনী বকরের মাওলা ছিলেন। তিনি মক্কায় আগত।  ইমাম বুখারী রহঃ বলেন, তিনি ছিলেন মুনকারুল হাদীস!। {তাহজীবুত তাহজীব, রাবী নং-৬৮১}

আরো দেখুন

১-তাহজীবুল কামাল, রাবী নং-৬৩১৯

২-খুলাসাতু তাহজীবু তাহজীবিল কামাল-১/৩৯৩

৩-জিকরু মান তাকাল্লামা ফিহী ওয়াহুয়া মুআসসিকুন, রাবী নং-৩৪৭

৪-সিয়ারু আলামিন নুবালা, রাবী নং-৯

৫-লিসানুল মীযান, রাবী নং-৪৯৮৭

৬-মাগানিয়াল আখইয়ার, রাবী নং-২৪১৯

৭-মিযানুল ইতিদাল, রাবী নং-৮৯৪৯

এবার দেখে নিন ইমাম বুখারী রহঃ মুনকারুল হাদীস কাদের বলেন?

ونقل ابن القطان أن البخاري قال: كل من قلت فيه منكر الحديث فلا تحل الرواية عنه.

ইবনে কাত্তান রহঃ বর্ণনা করেন, নিশ্চয় বুখারী রহঃ বলেছেন, যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে আমি “মুনকারুল হাদীস” বলি তার থেকে বর্ণনা করা জায়েজ নয়। {মীযানুল ইতিদাল-১/৬}

ইমাম বুখারী রহঃ এর মতে তিনি যাকে মুনকারুল হাদীস বলেছেন তার থেকে বর্ণনা করা জায়েজই নয়। আর ইমাম বুখারী রহঃ মুআম্মাল বিন ইসমাঈলকে বলেছেন মুনকারুল হাদীস। মানে ইমাম বুখারী রহঃ এর মতানুসারে মুআম্মাল বিন ইসমাঈল থেকে হাদীস বর্ণনা কারা জায়েজ নয়।

কিন্তু ইমাম বুখারীকে সবচে’ বেশি মানেন দাবিকারী মুজাফফর সাহেব সেই নাজায়েজ কাজটি খুব আগ্রহের সাথে করে বই ছাপিয়ে মার্কেটে ছেড়ে দিয়েছেন। বইয়ের নাম আবার দিয়েছেন জাল হাদীসের কবলে নাকি রাসূল সাঃ এর নামায পড়েছে। অথচ আমরা দেখেতে পাচ্ছি হাদীস সম্পর্কে জাহিল অজ্ঞ মুর্খ মুজাফফরের কবলে পড়েছে আমাদের প্রিয় নবীজী সাঃ এর নামায।

আল্লাহ তাআলা আমাদের এসব অজ্ঞ গবেষকদের বিভ্রান্তিকর গবেষনা থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করুন। আমীন।

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল- [email protected]

[email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *