প্রচ্ছদ / কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা / হাদীসে জাহান্নামে নারীদের সংখ্যা বেশি হবার কথা বলা হলো কেন?

হাদীসে জাহান্নামে নারীদের সংখ্যা বেশি হবার কথা বলা হলো কেন?

প্রশ্ন

আসসালামু আলাইকুম।

গত এক-দেড় বছর ধরে আমার মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে! আল্লাহ ক্ষমা করুন।

আমি জানি, ইসলাম নারীদের অনেক মর্যাদা ও সম্মান দিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ। আমি একজন নারী।   কিন্তু, জাহান্নামে নারী বেশি কেনো?

এই একটা প্রশ্নই বার বার আমার মাথায় আসে।

কিছু দিন আগে একটা পোস্ট দেখলাম, যেখানে লেখা: অমুক ধর্মে নারীদের জাহান্নামের দরজা বলা হচ্ছে, তমুক ধর্মে আবার কি জানি একটা লেখা ছিল! লাস্টে ছিল, আর ইসলাম ধর্মে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত!

কিন্তু, আমার মাথায় সেই একটাই প্রশ্ন, ইসলাম ধর্মেও তো বলা হচ্ছে যে জাহান্নামে নারী বেশি! এই ধর্ম কিভাবে অন্য ধর্ম থেকে আলাদা হলো!  

এই একটা প্রশ্ন মনে আসলেই কান্না পায়। অনেক কান্নাকাটিও করেছি! আল্লাহ কি এতোই নিষ্ঠুর? নাউযুবিল্লাহ! নিজের কাছেই খারাপ লাগে।

আগে, এই ধরনের প্রশ্ন মাথায় আসতো না। আল্লাহর কাছে যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ। ইদানিং, কেন যেন সব কিছু থেকে মন ওঠে গেছে! আল্লাহ ক্ষমা করুন।  

প্রশ্নটি এতো বড়ো করে, ঘুড়িয়ে-পেঁচিয়ে লেখার জন্য দুঃখিত। আমি শুধু আমার মনের অবস্থা লেখাগুলোর মাধ্যমে প্রকাশ করতে চেয়েছি।  

নাম ও ঠিকানা প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক।

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

  প্রথমে এ সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসটি দেখে নেই:

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ أُرِيتُ النَّارَ فَإِذَا أَكْثَرُ أَهْلِهَا النِّسَاءُ يَكْفُرْنَ ‏”‏‏.‏ قِيلَ أَيَكْفُرْنَ بِاللَّهِ قَالَ ‏”‏ يَكْفُرْنَ الْعَشِيرَ، وَيَكْفُرْنَ الإِحْسَانَ، لَوْ أَحْسَنْتَ إِلَى إِحْدَاهُنَّ الدَّهْرَ ثُمَّ رَأَتْ مِنْكَ شَيْئًا قَالَتْ مَا رَأَيْتُ مِنْكَ خَيْرًا قَطُّ ‏    

ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমাকে জাহান্নাম দেখানো হয়। (আমি দেখি), তার অধিবাসীদের বেশির ভাগই নারীজাতি; (কারণ) তারা কুফরী করে। জিজ্ঞেস করা হল, ‘তারা কি আল্লাহর সঙ্গে কুফরী করে?’ তিনি বললেনঃ ‘তারা স্বামীর অবাধ্য হয় এবং অকৃতজ্ঞ হয়।’ তুমি যদি দীর্ঘদিন তাদের কারো প্রতি ইহসান করতে থাক, অতঃপর সে তোমার সামান্য অবহেলা দেখতে পেলেই বলে ফেলে, ‘আমি কক্ষণো তোমার নিকট হতে ভালো ব্যবহার পাইনি।’[সহীহ বুখারী, হাদীস নং-২৯]

    আরেকটি হাদীস পড়ুন:

    عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ أَوَّلُ زُمْرَةٍ تَلِجُ الْجَنَّةَ صُورَتُهُمْ عَلَى صُورَةِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ، لاَ يَبْصُقُونَ فِيهَا وَلاَ يَمْتَخِطُونَ وَلاَ يَتَغَوَّطُونَ، آنِيَتُهُمْ فِيهَا الذَّهَبُ، أَمْشَاطُهُمْ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ، وَمَجَامِرُهُمُ الأَلُوَّةُ، وَرَشْحُهُمُ الْمِسْكُ، وَلِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمْ زَوْجَتَانِ، يُرَى مُخُّ سُوقِهِمَا مِنْ وَرَاءِ اللَّحْمِ، مِنَ الْحُسْنِ، لاَ اخْتِلاَفَ بَيْنَهُمْ وَلاَ تَبَاغُضَ، قُلُوبُهُمْ قَلْبٌ وَاحِدٌ، يُسَبِّحُونَ اللَّهَ بُكْرَةً وَعَشِيًّا  

  আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জান্নাতে প্রথম প্রবেশকারী দলের আকৃতি পূর্ণিমা রাতের চাঁদের ন্যায় উজ্জল হবে। তারা সেখানে থুথু ফেলবে না, নাক ঝাড়বে না, পায়খানা করবে না। সেখানে তাদের পাত্র হবে স্বর্ণের; তাদের চিরুনী হবে স্বর্ণ ও রৌপ্যের, তাদের ধুনুচিতে থাকবে সুগন্ধ কাঠ। তাদের গায়ের ঘাম মিসকের ন্যায় সুগন্ধযুক্ত হবে। তাদের প্রত্যেকের জন্য এমন দু’জন স্ত্রী থাকবে যাদের সৌন্দর্যের ফলে গোশত ভেদ করে পায়ের নলার হাড়ের মজ্জা দেখা যাবে। তাদের মধ্যে কোন মতভেদ থাকবে না; পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না। তাদের সকলের অন্তর এক অন্তরের মত থাকবে। তারা সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর তাসবীহ পাঠে রত থাকবে।’ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩০১৮]    

প্রথম হাদীসের মাঝে যেমন মহিলাদের জাহান্নামী বেশি বলা হয়েছে। তেমনি দ্বিতীয় হাদীসের মাঝে একজন পুরুষের বিপরীতে দুইজন করে জান্নাতী স্ত্রীর কথা উদ্ধৃত হয়েছে। এর মানে দ্বিতীয় হাদীসতো প্রমাণ করে যে, পুরুষের তুলনায় মহিলা জান্নাতী ডাবল হবে।    

সুতরাং এক হাদীস দেখে মর্মাহত হবার কী হলো?    

যে হাদীসে মহিলাদের জাহান্নামী হবার সংখ্যা বেশি বলা হয়েছে, সেখানে এর কারণও উদ্ধৃত করে দেয়া হয়েছে। এক হলো: স্বামীর অবাধ্যতা, দ্বিতীয়ত হলো অকৃতজ্ঞতা। এ অপরাধে দোষী নারীরাই জাহান্নামী হবে। যদি এমন অপরাধী নারীর সংখ্যা বেশি হয়, তাহলেই কেবল সে জাহান্নামী হবে। তবে এটা চিরস্থায়ী জাহান্নাম নয়। বরং নারী মুমিন হলে তার অপরাধের শাস্তি শেষে সেও জান্নাতী হবে।    

পুরুষদের মাঝেও যদি এমন অকৃজ্ঞতা ও আল্লাহর বিধানের অবাধ্যতা, মায়ের অবাধ্যতা, মায়ের অকৃতজ্ঞতা পাওয়া যায়, সেও জাহান্নামী হবে। তাহলে এটাতো বরাবরই হয়ে গেল।    

তাছাড়া কিয়ামতের আগে পুরুষের তুলনায় নারীদের সংখ্যা অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، أَنَّهُ قَالَ أُحَدِّثُكُمْ حَدِيثًا سَمِعْتُهُ مِنْ، رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لاَ يُحَدِّثُكُمْ أَحَدٌ بَعْدِي أَنَّهُ سَمِعَهُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يُرْفَعَ الْعِلْمُ وَيَظْهَرَ الْجَهْلُ وَيَفْشُوَ الزِّنَا وَتُشْرَبَ الْخَمْرُ وَيَكْثُرَ النِّسَاءُ وَيَقِلَّ الرِّجَالُ حَتَّى يَكُونَ لِخَمْسِينَ امْرَأَةً قَيِّمٌ وَاحِدٌ    

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি এরূপ একটি হাদীস তোমাদেরকে শুনাচ্ছি যা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট শুনেছি। তোমাদের সামনে এ হাদীসটি আমার পরবর্তীতে আর কেউ বর্ণনা করবেন না, যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের নিদর্শন হলোঃ ইলম (দীনি জ্ঞান) উঠে যাবে, মূর্খতার প্রসার ঘটবে, ব্যাপকহারে যিনা-ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়বে, মদ্য পান করা হবে, স্ত্রীলোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং পুরুষের সংখ্যা কমে যাবে, এমনকি পঞ্চাশজন স্ত্রীলোকের জন্য মাত্র একজন তত্ত্বাবধায়ক পুরুষ থাকবে। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২২০৫]    

কিয়ামতের আগে পঞ্চাশ জন নারীর বিপরীতে একজন পুরুষ থাকবে। এর মানে নারীর সংখ্যা এতোই বৃদ্ধি হবে। আর এটাতো জানা কথাই যে, কিয়ামতের আগের মানুষগুলো বেশিরভাগই হবে গোনাহগার।  সুতরাং এরাতো জাহান্নামীই হবে। সেই হিসেবে নারীদের সংখ্যা অনুপাতে জাহান্নামে তারা বেশি যাবে।    

কেউ খুন করলে তাকে বিচারক ফাঁসির রায় দেয়াকে নিষ্ঠুরতা বলা বোকামী ছাড়া আর কী? যদি নারীরা বেশি গোনাহ করে তাহলে তাদের শাস্তি দেয়াটা আল্লাহর নিষ্ঠুরতা কিভাবে হলো?    

যদি পুরুষ একই অপরাধ করলে তাকে ক্ষমা করা হতো, আর নারী করলে তাকে শাস্তি দেয়া হতো তাহলে এটা নিষ্ঠুরতা হতো। কিন্তু এমন কথা কি কোন হাদীসে আছে যে, পুরুষ অপরাধ করলে তাকে ক্ষমা করে জান্নাত দেয়া হবে, আর নারী করলে তাকে জাহান্নাম দেয়া হবে?    

কিংবা কোন নারী ঈমান আনার পর ইবাদত করার পরও তাকে জাহান্নাম দেয়া হবে এমন কথা কি হাদীসে বা কুরআনে এসেছে?    

অবশ্যই আসেনি। আসতে পারে না। সুতরাং নারীরা বেশি জাহান্নামে যাবে একথা শুনেই এমন হতাশার কোন মানে নেই। এটা আপনার অজ্ঞতার কারণে হয়েছে। সুতরাং পেরেশান হবার কিছু নেই। বরং কামেল ঈমানের সাথে নেক আমল করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি জান্নাতী হবেন।  

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ইসলামিয়া দারুল হক লালবাগ ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা: জামিয়াতুস সুন্নাহ কামরাঙ্গিরচর, ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা: কাসিমুল উলুম আলইসলামিয়া, সালেহপুর আমীনবাজার ঢাকা।

পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।

শাইখুল হাদীস: জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, সনমানিয়া, কাপাসিয়া, গাজীপুর।

ইমেইল[email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *