প্রচ্ছদ / অপরাধ ও গোনাহ / নিজের স্ত্রীর চেয়ে অন্যের স্ত্রীকে বেশি সুন্দরী মনে হলে করণীয় কী?

নিজের স্ত্রীর চেয়ে অন্যের স্ত্রীকে বেশি সুন্দরী মনে হলে করণীয় কী?

প্রশ্ন

আসসালামু আলাইকুম।

মহোদয়, আমি তথাকথিত উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের কর্পোরেট জগতে আলহামদুলিল্লাহ ভালো অবস্থানে আছি, আমার অনেক পরিচিতজন আছে তাই আমি আমার নাম ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক। দয়াকরে, আমাকে মাফ করবেন।

প্রশ্নঃ

আমি ৬ বছর আগে বিবাহ করি। বিবাহের আগে আমার স্ত্রীকে আমি পছন্দ করি তারপর ফ্যামিলি কে বলি তারপর ফ্যামিলিগত ভাবে আমাদের বিয়ে হয়। তখন আমার কাছে মনে হয়েছিল আমার স্ত্রী অনেক সুন্দরী এবং তাকে আমার বিয়ে করতেই হবে। আসলেই সে দেখতে অনেক সুন্দর।

কিন্তু সম্প্রতি অন্যদের স্ত্রী দেখলে আমার নিজের মধ্যে প্রশ্ন জাগে আমার স্ত্রীর চাইতেও তার স্ত্রী অনেক সুন্দরী বা অনেক স্মার্ট, এজন্য আমার মনের মধ্যে এক ধরনের হিংসা কাজ করে এবং মনে হয় আমি ঠকে গেলাম আমার তো আরো সুন্দরী বউ পাওয়ার কথা ছিল।

এই নিয়ে আমার মনের মধ্যে সর্বদা অস্থিরতা এবং হতাশা কাজ করছে যে আমার বউ যদি এই মেয়েটা হতো কিংবা ওই মেয়েটা হতো। দেখা গেছে আমি দশজন আমার অন্য বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয় স্বজনের বউদের দিকে তাকালে আটজনের বউ-ই আমার বউ এর চেয়ে কোন না কোন দিক দিয়ে সুন্দরী মনে হয়।

এ নিয়ে আমার মনে তীব্র অশান্তি, অস্থিরতা, হতাশা কাজ করে।

যদিও বাস্তবিক অর্থে আমার বউ অনেকটাই সুন্দরী। কিন্তু তারপরও আমি আমার মনকে কোন ভাবেই বুঝাতে পারতেছিনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেছিনা, মনের মধ্যে বারবার শুধু প্রশ্ন জাগে আমার পরিচিত বন্ধু বা আত্নীয়ের বউ এত সুন্দরী, আমি যদি তখন বিয়ে না করতাম তাহলে একে বিয়ে করতে পারতাম বা এর চাইতে আরো সুন্দর মেয়েকে বিয়ে করতে পারতাম।

দেখা গেল, একটা মেয়েকে নিয়ে ভাবতেছি ইস তাকে যদি বিয়ে করতে পারতাম, আবার পরক্ষনে, এর চেয়ে আরো সুন্দর মেয়েকে দেখলে তখন তার দিকে ভাবনা চলে যায় আগেরটি না এটাকে বিয়ে করতে পারলে অনেক সুন্দরী বউ পাইতাম।

এভাবে প্রতিনিয়ত আমার মনের মধ্যে অস্থিরতা, পেরেশানি কাজ করে। আর মেয়ে দেখলে তার দিকে আমার দৃষ্টি চলে যায় কোনভাবে দৃষ্টি ফেরাতে পারিনা, কেননা দুনিয়াতে আল্লাহর সকল সৃষ্টির মধ্যে মেয়েদের প্রতি আমার তিব্র আকর্ষন।

শায়েখ এর কাছে আমার সবিনীত নিবেদন, দয়াকরে ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে দলিলসহ আমাকে উত্তর দিবেন এটা কেন হয় এবং এটা হলে শরীয়াহ দৃষ্টিকোণ থেকে কি করা উচিত এবং কি করলে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে ও মনের মধ্যে এই পেরেশানি অস্থিরতা কাজ করবেনা।

পরিশেষে, নিজে এবং পরিবার নিয়ে কিভাবে সুন্দরভাবে মানসিক শান্তিতে বসবাস করতে পারব এবং আল্লাহর পথে থেকে -আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা অর্জন করতে পারবো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

এ পেরেশানী থেকে পরিত্রানের একমাত্র উপায় হলো চোখের পর্দা। ইসলামী শরীয়ত যাদের দেখাকে হারাম করেছে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টিকে অবনত রাখা।

দেখবেন তখন নিজের স্ত্রীকে পৃথিবীর সবচে’ বেশি সুন্দরী মনে হবে।

নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ রব্বে কারীমের অমোঘ নিয়ম। এটা একটি স্বভাবজাত প্রকৃতি।

কুরআনে কারীমে যেখানেই পর্দার নির্দেশ করেছে। সেখানে প্রথমে পুরুষকে নারী থেকে নিজেকে পর্দা করতে বলা হয়েছে।

قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَزْكَىٰ لَهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ [٢٤:٣٠]

মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। [সূরা নূর-৩০]

পুরুষ জাতির জন্য নারী জাতিকে হাদীসে ভয়াবহ ফিতনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিসের জন্য ফিতনা? নিজের সম্ভ্রমের জন্য। নিজের ব্যক্তিত্ব নষ্টের জন্য। নিজের সামাজিক মর্যাদা নষ্টের জন্য। নিজের চরিত্র নষ্টের বিষয়ে নারী জাতি ফিতনা।

হাদীসে আসছে:

عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَا تَرَكْتُ بَعْدِي فِتْنَةً أَضَرَّ عَلَى الرِّجَالِ مِنَ النِّسَاءِ»

উসামাহ ইবনু যায়দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পুরুষের জন্য স্ত্রীজাতি অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর কোন ফিতনা আমি রেখে গেলাম না। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫০৯৬]

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «إِنَّ الدُّنْيَا حُلْوَةٌ خَضِرَةٌ، وَإِنَّ اللهَ مُسْتَخْلِفُكُمْ فِيهَا، فَيَنْظُرُ كَيْفَ تَعْمَلُونَ، فَاتَّقُوا الدُّنْيَا وَاتَّقُوا النِّسَاءَ، فَإِنَّ أَوَّلَ فِتْنَةِ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ فِي النِّسَاءِ»

আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি বলেনঃ নিশ্চয় দুনিয়া লোভনীয় ও সবুজ-শ্যামল। আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে তোমাদেরকে খলীফা (শাসক) বানিয়েছেন। তিনি দেখবেন যে, তোমরা কেমন কাজ করো। সাবধান! দুনিয়া সম্পর্কে সর্তক হও এবং নারীদের সম্পর্কেও সর্তক হও। নিশ্চয় বনী ইসরাইলের মাঝে প্রথম ফিতনা নারীদের মাধ্যমেই হয়েছে। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৭৪২]

ফিতনাটা কিভাবে ছড়ায়?

নিজের ঘরে সুন্দরী স্ত্রী থাকার পরও রাস্তার বেগানা নারী দেখলে তাকে বেশি সুন্দরী মনে হবে। হাদীসে আসছে:

عَنْ عَبْدِ اللهِ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَالْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ، فَإِذَا خَرَجَتْ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ

হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঈদ রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, নারী জাতি হল আপাদমস্তক সতর। যখনি সে বের হয়, তখনি শয়তান তাকে চমৎকৃত করে তোলে। {সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-১১৭৩, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-২০৬৫, সহীহ ইবনে খুজাইমা, হাদীস নং-১৬৮৫, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৫৯৮}

দেখুন হাদীসের মাঝে যেন আমার আপনার অবস্থাই তুলে ধরা হয়েছে। রাস্তার বের হওয়া নারীকে শয়তান চমৎকৃত হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করে। যাতে করে তাদের মাধ্যমে আমরা ফিতনায় জড়িয়ে পড়ি।

এজন্য আপনার উক্ত সমস্যার সমাধান একটাই। সেটি হলো, নিজের স্ত্রীকে প্রাণভরে মোহাব্বত করা। আর সেই সাথে বেগানা নারী থেকে নিজের  চোখকে হেফাজত রাখা। দৃষ্টি পড়ে গেলে সাথে সাথে নিজের চোখকে অবনত করে নেয়া। এটা জরুরী। এটা আবশ্যক। নতুবা আপনি  চোখের যিনার গোনাহের ভাগিদার হয়ে যাবেন।

যদি নিজের চোখকে হেফাযত করতে পারেন, তাহলে আপনার দুনিয়াবী জীবন যেমন সুখময় হবে, তেমনি ইবাদতের মজা অনুভব করে আখেরাতেও মুক্তি পেয়ে অনন্ত সুখের জান্নাত পাবেন ইনশাআল্লাহ।

নিচের তিনটি হাদীস পড়ুন এবং আমল করুন। ইনশাআল্লাহ আপনার এ সমস্যা কেটে যাবে।

عَنْ ابْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” لَا تُتْبِعِالنَّظْرَةَ النَّظْرَةَ؛ فَإِنَّمَا  لَكَ الْأُولَى وَلَيْسَتْ لَكَ الْآخِرَةُ

হযরত বুরাইদা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ  হযরত আলী রাঃ কে বলেন, হে আলী! [সহসা] একবার দেখার পর পুনরায় [কোন বেগানা নারীকে] দেখো না। কারণ, তোমার জন্য প্রথমবারে অনুমতি রয়েছে [যখন তা অনিচ্ছায় হয়ে যাবে], কিন্তু দ্বিতীয়বারের অনুমতি নেই। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২২৯৭৪, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-২৭৫১, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২১৪৯, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৭৭৭}

عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ” مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَنْظُرُ إِلَى مَحَاسِنِ امْرَأَةٍ أَوَّلَ مَرَّةٍ، ثُمَّ يَغُضُّ بَصَرَهُ إِلَّا أَحْدَثَ اللهُ لَهُ عِبَادَةً يَجِدُ حَلَاوَتَهَا 

হযরত আবু উমামা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যে কোন মুসলমান কোন নারীর সৌন্দর্যের প্রতি হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যায়, অতঃপর সে নিজ চক্ষু নিচু করে নেয়, তবে আল্লাহ তাআলা তার জন্য এক ইবাদতের সুযোগ সৃষ্টি করেন, যাতে সে তার স্বাদ পায়। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২২২৭৮}

হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত।

فَالْعَيْنَانِ زِنَاهُمَا النَّظَرُ، وَالْأُذُنَانِ زِنَاهُمَا الِاسْتِمَاعُ، وَاللِّسَانُ زِنَاهُ الْكَلَامُ، وَالْيَدُزِنَاهَا الْبَطْشُ، وَالرِّجْلُ زِنَاهَا الْخُطَا، وَالْقَلْبُ يَهْوَى وَيَتَمَنَّى، وَيُصَدِّقُ ذَلِكَ الْفَرْجُ وَيُكَذِّبُهُ

রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন, চোখের জিনা হল [হারাম] দৃষ্টিপাত। কর্ণদ্বয়ের জিনা হল, [গায়রে মাহরামের যৌন উদ্দীপক] কথাবার্তা মনযোগ দিয়ে শোনা। জিহবার জিনা হল, [গায়রে মাহরামের সাথে সুড়সুড়িমূলক] কথোপকথন। হাতের জিনা হল, [গায়রে মাহরামকে] ধরা বা স্পর্শকরণ। পায়ের জিনা হল, [খারাপ উদ্দেশ্যে] চলা। অন্তর চায় এবং কামনা করে আর লজ্জাস্থান তাকে বাস্তবে রূপ দেয় [যদি জিনা করে] এবং মিথ্যা পরিণত করে [যদি অন্তরের চাওয়া অনুপাতে জিনা না করে]। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৬৫৭, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৮৯৩২}

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী, নরসিংদী।

ইমেইল[email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *