প্রচ্ছদ / ইতিহাস ও ঐতিহ্য / মুয়াবিয়া রাঃ হযরত আলী রাঃ কে গালাগাল করতেন অন্যকে গালাগাল করতে উৎসাহ দিতেন?

মুয়াবিয়া রাঃ হযরত আলী রাঃ কে গালাগাল করতেন অন্যকে গালাগাল করতে উৎসাহ দিতেন?

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

কিছু রেওয়াতে আসছে যে, হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাঃ এবং হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর সাক্ষাতে কথোপথনের মাঝে হযরত মুয়াবিয়া রাঃ সাদকে বললেন:
فقال ما منعك ان تسب ابا تراب؟ অর্থাৎ হে সাদ! হযরত আলী রাঃ কে মন্দ বলতে কোন জিনিস তোমাকে বারণ করেছে?
বুঝা গেল যে, হযরত মুয়াবিয়া রাঃ হযরত আলী রাঃ কে গালাগাল করতেন। অন্যদেরও গালাগাল করতে উৎসাহ প্রদান করতেন!

উত্তর

প্রথমে আমরা সহীহ সূত্রে বর্ণিত উক্ত ঘটনা নির্ভর বর্ণনাটি দেখে নেই:

عَنْ عَامِرِ بْنِ سَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: أَمَرَ مُعَاوِيَةُ بْنُ أَبِي سُفْيَانَ سَعْدًا فَقَالَ: مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسُبَّ أَبَا التُّرَابِ؟ فَقَالَ: أَمَّا مَا ذَكَرْتُ ثَلَاثًا قَالَهُنَّ لَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَنْ أَسُبَّهُ، لَأَنْ تَكُونَ لِي وَاحِدَةٌ مِنْهُنَّ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ، سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ لَهُ، خَلَّفَهُ فِي بَعْضِ مَغَازِيهِ، فَقَالَ لَهُ عَلِيٌّ: يَا رَسُولَ اللهِ خَلَّفْتَنِي مَعَ النِّسَاءِ وَالصِّبْيَانِ؟ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَمَا تَرْضَى أَنْ تَكُونَ مِنِّي بِمَنْزِلَةِ هَارُونَ مِنْ مُوسَى؟ إِلَّا أَنَّهُ لَا نُبُوَّةَ بَعْدِي» وَسَمِعْتُهُ يَقُولُ يَوْمَ خَيْبَرَ «لَأُعْطِيَنَّ الرَّايَةَ رَجُلًا يُحِبُّ اللهَ وَرَسُولَهُ، وَيُحِبُّهُ اللهُ وَرَسُولُهُ» قَالَ فَتَطَاوَلْنَا لَهَا فَقَالَ: «ادْعُوا لِي عَلِيًّا» فَأُتِيَ بِهِ أَرْمَدَ، فَبَصَقَ فِي عَيْنِهِ وَدَفَعَ الرَّايَةَ إِلَيْهِ، فَفَتَحَ اللهُ عَلَيْهِ، وَلَمَّا نَزَلَتْ هَذِهِ الْآيَةُ: {فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ} [آل عمران: 61] دَعَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلِيًّا وَفَاطِمَةَ وَحَسَنًا وَحُسَيْنًا فَقَالَ: «اللهُمَّ هَؤُلَاءِ أَهْلِي»

সা’দ ইবনু আবূ ওয়াককাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, মুআবিয়া ইবনু আবূ সুফিয়ান (রাঃ) সা’দ (রহঃ) কে আমীর বানালেন এবং বললেন, আপনি আলী (রাঃ) কে কেন মন্দ বলেন না? সা’দ বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে যে তিনটি কথা বলেছেনঃ তা মনে করে এ কারণে আমি কখনও তাকে মন্দ বলবো না। ওসব কথার মধ্য হতে যদি একটিও আমি লাভ করতে পারতাম তাহলে তা আমার জন্য লাল উটের চেয়েও বেশি পছন্দনীয় হতো।
রাসুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আলী (রাঃ) এর উদ্দেশ্যে বলতে শুনেছি, আলী (রাঃ) কে কোন যুদ্ধের সময় প্রতিনিধি বানিয়ে রেখে গেলে তিনি বললেন, মহিলা ও শিশুদের মাঝে আমাকে রেখে যাচ্ছেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! তখন রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি কি এতে আনন্দবোধ কর না যে, আমার কাছে তোমার মর্যাদা মূসা (আলাইহিস সালাম) এর কাছে হারুন (আলাইহিস সালাম) এর মতো। তবে মনে রাখতে হবে যে, আমার পর আর কোন নাবী নেই।
খায়বারের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আমি বলতে শুনেছি, আমি এমন এক ব্যক্তিকে পতাকা দেবো যে আল্লাহ ও তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসে আর আল্লাহ ও তার রাসুলও তাকে ভালবাসেন। এ কথা শুনে আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম। তখন তিনি বললেন, আলীকে ডাকো। আলী আসলেন, তাঁর চোখ উঠেছিলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চোখে লালা দিলেন এবং তাঁর হাতে পতাকা অর্পণ করলেন। পরিশেষে তাঁর হাতেই বিজয় তুলে দিলেন আল্লাহ।
আর যখন (মুবাহালা সংক্রান্ত) আয়াতঃ “আমরা আমাদের এবং তোমাদের সন্তান-সন্তুতিকে ডাকি” (৩ঃ ৬১) অবতীর্ণ হলো, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসায়ন (রাঃ) কে ডাকলেন। অতঃপর বললেন হে আল্লাহ! এরাই আমার পরিবার। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৪০৪, ইফাবা-৬০০২]

এখানে আমীর বানানোর পর মুয়াবিয়া রাঃ সাদ রাঃ কে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কেন অন্যান্যদের মত এ ঘৃণ্য কাজটি করেন না। তখন সাদ রাঃ হযরত আলী রাঃ এর বিশেষ তিনটি গুণের কথা বললেন। এ গুণগুলোর কারণে তিনি কখনোই হযরত আলী রাঃ এর বদনাম করতে পারেন না বলে জানিয়ে দিলেন।

এখানে হযরত মুয়াবিয়া রাঃ সাদকে আলী রাঃ কে গালাগাল করতে বলার কোন আদেশ নেই। কেবলি জিজ্ঞাসা ছিল। যেহেতু অনেকেই এ নোংরা কাজ করতো। কিন্তু সাদ রাঃ কখনো একাজ করতেন না। তাই তিনি এর কারণ জানতে চেয়েছেন মাত্র। [শরহে মুসলিম লিননাবাবী-২/২৭৮]

কারণ, জানার পর তিনি কোন জবাব দেননি। সেই সাথে তার যদি সত্যিই হযরত আলী রাঃ কে গালাগাল করারই উদ্দেশ্য থাকতো, তাহলে সাদ রাঃ এর স্পষ্ট ঘোষণার পরও কিভাবে তাকে আমীর হিসেবে নিযুক্ত করলেন?
সুতরাং বুঝা গেল যে, উক্ত প্রশ্ন দ্বারা গালাগাল করাতে উৎসাহ দেয়া উদ্দেশ্য ছিল না। বরং কেবলমাত্র কারণ জানা মাকসাদ ছিল।

فَقَوْلُ مُعَاوِيَةَ هَذَا لَيْسَ فِيهِ تَصْرِيحٌ بِأَنَّهُ أَمَرَ سَعْدًا بِسَبِّهِ وَإِنَّمَا سَأَلَهُ عَنِ السَّبَبِ الْمَانِعِ لَهُ مِنَ السَّبِّ كَأَنَّهُ يَقُولُ هَلِ امْتَنَعْتَ تَوَرُّعًا أَوْ خَوْفًا أَوْ غَيْرَ ذَلِكَ فَإِنْ كَانَ تَوَرُّعًا وَإِجْلَالًا لَهُ عَنِ السَّبِ فَأَنْتَ مُصِيبٌ مُحْسِنٌ وَإِنْ كَانَ غَيْرُ ذَلِكَ فَلَهُ جَوَابٌ آخَرُ (شرح النووى على مسلم-2\278)

“ছাব্ব” শব্দের অর্থ আরবে অন্যের মতামতকে ভুল সাব্যস্ত করা ও নিজের মতামতকে সঠিক সাব্যস্ত করার জন্যও ব্যবহৃত হয়।

أَنَّ مَعْنَاهُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تُخَطِّئَهُ فِي رَأْيِهِ وَاجْتِهَادِهِ وَتُظْهِرَ لِلنَّاسِ حُسْنَ رَأْيِنَا وَاجْتِهَادِنَا

এর অর্থ হল, তোমাকে তার সিদ্ধান্ত এবং ইজতিহাদের ভুল এবং আমার সিদ্ধান্ত ও ইজতিহাদের সঠিকতা তুলে ধরতে তোমাকে কে বাঁধা দিচ্ছে? [শরহে নববী আলা মুসলিম-২/২৭৮]

ان يحمل السب على التغير فى المذهب والرأى فيكون ما منعك من ان تبين للناس خطاه وان ما نحن  عليه اسد واصوب، ومثل هذا يسمى سبا فى العرف (إكمال اكمال المعلم شرح مسلم لامام عبد الله محمد بن خلفة الوشتانى-6\224)

ছাব্ব এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, পথ ও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা। সুতরাং উক্ত কথার অর্থ হল, লোকদের কাছে তার ভুল হওয়া এবং আমার যথার্থতা প্রকাশ করতে তোমাকে কোন জিনিস বাঁধা দিচ্ছে? আরবে এমন অর্থেও “ছাব্ব” শব্দ ব্যবহৃত হয়। [ইকমালু ইকমালিল মুআল্লিম শরহে মুসলিম-৬/২২৪]

সারমর্ম হল, বর্ণনায় উল্লেখিত “ছাব্ব” শব্দ দ্বারা গালিগালাজ উদ্দেশ্য নয়। বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, অন্যের মতামতকে ভুল সাব্যস্ত করা। আর আরব প্রচলনে এটাকেও “ছাব্ব” বলা হতো।

একথাতো স্বীকৃত যে, হযরত আলী রাঃ এবং হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর পরস্পর লোকদের মাঝে দৃষ্টিভঙ্গিগত ইজতিহাদী মতভেদ ছিল। দুই দলই নিজেদের অবস্থান সঠিক এবং অপর দলের অবস্থান ভুল মনে করতেন।

সেই হিসেবে এখানে “ছাব্ব” বলে অপর দলকে ভুল সাব্যস্তকরণ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। গালাগাল অর্থে নয়।
আর গালাগাল করাতো নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের কাজ। হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর মত সাহাবী এবং নবীজীর বিশ্বস্ত ওহী লেখক, সভ্রান্ত বংশের, সর্দার বংশের মত উঁচু বংশের ব্যক্তির জন্য এমন নিম্নমানের বিষয় ভাবাই যায় না।

والتصريح بالسب وقبيح القول انما كان يفعله جهال بنى امية وسفلتهم…. واما معاوية فحاشه من ذالك لما كان عليه من الصحبة والدين ذاالفضل وكرم الاخلاق (اكمال اكمال شرح مسلم-6\224)

সুতরাং মুয়াবিয়া রাঃ গালাগাল করতেন, অন্যদের গালাগাল করতে উৎসাহ দিতেন এমন দাবী সরাসরি মিথ্যাচার ছাড়া কিছু নয়।

হযরত মুয়াবিয়া রাঃ গালাগাল করতেন এমন ভ্রান্ত দাবীর স্বপক্ষে উপরোক্ত বর্ণনাটিই একমাত্র বিশুদ্ধ বর্ণনা। যার হাকীকত আমরা উপরে তুলে ধরলাম।

এছাড়া আর যত বর্ণনা গালাগাল সম্পর্কে পেশ করা হয়, এর কোনটিই বিশুদ্ধ নয়। সবই বানোয়াট ও মিথ্যাচার।

وما يذكر عنه من ذلك فكذب (اكمال اكمال شرح مسلم-6\224)

وكل ما يروى سوى هذا فيما جرى بين الطائفتين وبين الرجلين فلا تصنعوا اليه اذنا ولا تلتفتوا اليه واسمعوا المتكلم بذالك تكبيتا (عارضة الأحوذى شرح صحيح ترمذى-13\231)

উপরোক্ত বর্ণনা ছাড়া আর যা কিছু বলা হয় উক্ত দুই দলকে নিয়ে এবং দুই ব্যক্তিত্বকে নিয়ে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করার কোন প্রয়োজন নেই। [আরিজাতুল আহওয়াজী লিইবনুল আরাবী-১৩/২৩১]

আরো একটি বর্ণনার হাকীকত

একবার মুগীরা বিন শোবা রাঃ কুফার মসজিদে তাশরীফ আনলেন। তারপর প্রসিদ্ধ সাহাবী সাঈদ বিন জায়েদ রাঃ আসলেন। মজলিশে আরো লোকেরাও ছিল। তখন কুফার অধিবাসী কায়েস বিন আলকামা নামী ব্যক্তি ঐ মজলিসে আসল। এসেই হযরত আলী রাঃ এর শানে বদনাম করা শুরু করল।

এতে করে সাঈদ বিন জায়েদ রাঃ হযরত মুগীরা বিন শোবা রাঃ এর উপর অসন্তুষ্ট হয়ে বলতে লাগলেন, আপনার সামনে আল্লাহর নবীর সাহাবীকে মন্দ বলা হচ্ছে, অথচ আপনি কিছুই বলছেন না?
অভিযোগকারীরা উক্ত বর্ণনাটি পেশ করে হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এবং সহযোগী সাহাবাগণের উপর এ অপবাদ আরোপ করে যে, তারা সকলেই হযরত আলী রাঃ কে গালাগাল করতো। আর তারা সেটাকে সাপোর্ট করতেন।

উত্তর

হযরত সাঈদ বিন জায়েদ রাঃ এর উপস্থিতিতে যে ঘটনা ঘটল। এর যতগুলো বর্ণনা পাওয়া যায়, কোন বর্ণনায় একথা নেই যে, উক্ত ঘটনার সময় হযরত মুয়াবিয়া রাঃ উপস্থিত ছিলেন কিংবা তার আদেশে এমনটি করা হয়েছে।
তারপরও কিভাবে উক্ত ঘটনার মাধ্যমে হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর গালাগালের সাপোর্টদাতা সাব্যস্ত করা হচ্ছে?

সকলের তবিয়ত ও ধৈর্য্য শক্তি সমান হয় না। অনেকে দোষণীয় কোন কিছু দেখলেই সাথে সাথে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিবাদ করেন। অনেকে আবার ধৈর্য্য ধরে চুপ থাকেন। ধীরে ধীরে প্রতিবাদ করেন।
তেমনি উক্ত ঘটনায় কায়েস বিন আলকামা কর্তৃক ঘৃণ্য কাজের প্রতিবাদ হযরত সাঈদ বিন জায়েদ দ্রুত প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু মুগীরা বিন শো’বা রাঃ এর মাঝে ধৈর্য্য শক্তি বেশি ছিল। তিনি মন্দ কথা শুনেও সবর করতেন। তার স্বভাবের মাঝে সহনশীলতা থাকায় তিনি চুপ ছিলেন।

কিন্তু এটাকে পূঁজি করে মুয়াবিয়া রাঃ বা মুগীরা বিন শো’বা রাঃ গালাগাল করতে উৎসাহ দিচ্ছেন বা আদেশ করেছেন বলা পরিস্কার অপবাদ ছাড়া আর কিছু নয়।

আরো একটি বর্ণনা

এক রেওয়ায়েত বলা হয়, যাতে উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি আবু আব্দুল্লাহ জাদালীকে বললেন, তোমাদের এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করা হয়।
তখন আবু আব্দুল্লাহ জাদালী বললেন, সুবহানাল্লাহ! মাআজাল্লাহ! এটা কিভাবে সম্ভব?

জবাবে উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামা রাঃ বলেন, তোমাদের এখানে আলী বিন আবী তালেব রাঃ কে গালমন্দ করা হয় না? অথচ আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, من سب عليا فقد سبنى অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলীকে গালি দেয়, সে যেন আমি নবীকেই গালি দেয়।

আরেক বর্ণনায় আসছে যে, উম্মে সালামা রাঃ বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নবীজী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রাঃ কে মোহাব্বত করেন। অথচ তোমরা তাকে গালাগাল কর।

উপরোক্ত বর্ণনা পেশ করে অভিযোগকারীরা বলতে চায় যে, এ বর্ণনা একাধিক সহীহ সূত্রে বর্ণিত। যদ্বারা বুঝা যায় যে, আলী রাঃ এর বিরোধী তথা আহলে শাম তথা মুয়াবিয়া রাঃ এর অনুসারীরা আলী রাঃ কে গালাগাল করতো।

উত্তর

উক্ত বর্ণনাটি মূলত কট্টর গালী শিয়া আবু আব্দল্লাহ জাদালীর সূত্রে বর্ণিত। যত কিতাবেই তা আসছে এর মূল রাবী আবু আব্দুল্লাহ জাদালী।
যার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের মন্তব্য হল:

ويستضعف فى حديثه وكان شديد التشيع (طبقات ابن سعد-6\159)

ابو عبد الله الجدلى شيعى… يغيض (ميزان الاعتدال-4\544، رقم-10357)

شيعى ثقل (المغنى للذهبى-2\749، رقم-7573)

يستضعف فى حديثه وكان شديد التشيع ويزعمون انه كان على شرطة المختار (تهذيب التهذيب-12\148-149)

এমন কট্টরপন্থী শিয়া। যে মুখতার সাক্বাফীর দলের উঁচু দরজার নেতা ছিল।
আর আহলে ইলমদের কাছে এ রীতি সর্বসিদ্ধ যে, আহলে বিদআতের যে বর্ণনা তাদের নিজেদের মতামতকে সমর্থন করে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।

সুতরাং আবু আব্দল্লাহ জাদালী বর্ণিত রেওয়ায়াতটি একটি বানোয়াট ও মনগড়া বক্তব্য তা পরিস্কার। এটি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

শিয়ারা তাদের মতাদর্শকে প্রমাণ করার জন্য এমন অসংখ্য ঘটনা ও বর্ণনা বানিয়ে উম্মতে গোমরাহ করার চেষ্টা করেছে। এর মাঝে এটিও একটি।

আরেক বর্ণনার হাকীকত

অভিযোগকারীরা বলে যে, এক বর্ণনায় আসছে যে, হযরত উম্মে সালামা রাঃ হযরত মুয়াবিয়া রাঃ কে চিঠি লিখলেন, “তুমি আল্লাহ ও রাসূলের উপর মিম্বরে বসে লানত করে থাকো। এটা এভাবে যে, তুমি আলী বিন আবী তালেব রাঃ এবং তার মুহিব্বীনগণের উপর লানত করে থাকো। ….. মুয়াবিয়া রাঃ উক্ত চিঠি বিষয়ে কোন ভ্রুক্ষেপই করলেন না”।
উক্ত বর্ণনাটি ‘ইকদুল ফরীদ’ লিইবনে আবদে রাব্বিহী এর সূত্রে নকল করে থাকে অভিযোগকারীরা। আর এটাকে খুব বড় করে প্রোপাগাণ্ডায় ব্যবহার করে থাকে।

উত্তর

يَدُلُّ كَثِيرٌ مِنْ كَلَامِهِ عَلَى تَشَيُّعٍ فِيهِ، وَمَيْلٍ إِلَى الْحَطِّ عَلَى بَنِي أُمَيَّةَ، وَهَذَا عَجِيبٌ مِنْهُ ; لِأَنَّهُ أَحَدُ مَوَالِيهِمْ، وَكَانَ الْأَوْلَى بِهِ أَنْ يَكُونَ مِمَّنْ يُوَالِيهِمْ لَا مِمَّنْ يُعَادِيهِمْ (البداية والنهاية لابن كثير-11/193-194 تحت سنة 328 صاحب كتاب العقد الفريد)

আহমদ বিন আবদে রাব্বিহীর অধিকাংশ কথার মাধ্যমে শিয়া হবার প্রমাণ বহন করে। বনু উমাইগণকে অপমান ও অপদস্তকরণ বিষয়ে আগ্রহী পাওয়া যায়। তবে এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে, সে বনু উমাইয়াদেরই আযাদকৃত গোলাম ছিল। তার উচিত ছিল বনু উমাইয়াগণের সাথে বন্ধুত্বের পরিচয় দিবে। বনু উমাইয়াদের সাথে শত্রুতা রাখা নয়। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-১১/১৯৩-১৯৪]

আল্লামা ইবনে কাছীর রহঃ অন্যত্র বলেন,

لِأَنَّ صَاحِبَ الْعِقْدِ كَانَ فِيهِ تَشَيُّعٌ شَنِيعٌ ومغالاة في أهل البيت، وربما لا يفهم أحد من كلامه ما فيه من التشيع، وَقَدِ اغْتَرَّ بِهِ شَيْخُنَا الذَّهَبِيُّ فَمَدَحَهُ بِالْحِفْظِ وغيره

ইকদুল ফরীদ প্রণেতা তথা আহমদ বিন আবদে রাব্বিহী নিকৃষ্ট শিয়া এবং আহলে বাইত বিষয়ে সীমালঙ্ঘণের শিকার ছিল। অনেক সময় অনেকে তার কথা থেকে তার শিয়া হওয়াটি ধরতে পারেন না। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-১০/২১] এমন একজন কট্টরপন্থী শিয়া। যিনি বনু উমাইয়াদের বিষয়ে বিদ্বেষী ছিল। আহলে বাইত বিষয়ে যুক্তি ও বাস্তবতা বিহীন সীমালঙ্ঘণের অভ্যস্ত ব্যক্তির বক্তব্য কিছুতেই দলীল হিসেবে পেশ করা যায় না।
সুতরাং এ বর্ণনাটিও বাতিল হিসেই সাব্যস্ত হয়।

মোদ্দাকথা

সেই সময়ে রাজনৈতিকভাবে লোকজন দুইদলে বিভক্ত ছিল। একদল অপর দলের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করতো। কখনো কখনো নিজের ক্ষোভের প্রকাশ মন্দ কথার দ্বারাও প্রকাশ করতো।
সুতরাং প্রতিপক্ষকে মন্দ বলার এ মানসিকতা শুধুমাত্র হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর অনুসারীদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং হযরত আলী রাঃ এর অনুসারী অনেকের মাঝেই এ আচরণ বিদ্যমান ছিল। যেমন-

ولبني الأرقم مسجد بالكوفة. فلما قدم الكوفة علي رضي الله عنه، جعل أصحابه يتناولون عثمان. فقال بنو الأرقم: لا نقيم ببلد يشتم فيه عثمان. فخرجوا إلى الجزيرة فنزلوا الرها. وشهدوا مع معاوية صفين

কুফার মাঝে বনু আরকাম গোত্রের একটি মসজিদ ছিল। যখন হযরত আলী রাঃ কুফায় আগমণ করলেন। তখন তার অনুসারীগণ হযরত উসমান রাঃ এর ব্যাপারে মন্দ কথা বলতো। এসব দেখে বনু আরকাম গোত্রের লোকেরা বলতে লাগল যে, আমরা ঐ শহরে বসবাস করবো না, যাতে হযরত উসমান রাঃ এর ব্যাপারে গালমন্দ করা হয়। তখন তারা সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ল। এবং জাযিরাতুল আরবের ‘আর রাহা’ নামক স্থানে গিয়ে নিজেদের বাসস্থান বানালো। পরবর্তীতে তারা হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে জঙ্গে সিফফীনে শামিল হোন। [কিতাবুল মুহাব্বার, আবু যাফর বাগদাদীকৃত-২৯৫, শুহাদায়ে সিফফীন অধ্যায়]


কুফায় যখন মুগীরা বিন শোবা রাঃ ৫০ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তখন হযরত মুয়াবিয়া রাঃ তার স্থলে যিয়াদকে কুফার গভর্ণর নিযুক্ত করেন। হুজুর বিন আদী এ নিয়োগের চরম বিরোধী ছিলেন।

এ কারণে হযরত আলী রাঃ এর অনুসারী দাবীদার ব্যক্তিরা একে একে হুজুর বিন আদী এর দলে শামিল হতে থাকে। তখন তারা সকলে ويسبون معاوية ويتبرون منه তথা তারা খলীফা হযরত মুয়াবিয়া রাঃ কে গালমন্দ করতো, এবং চরম বিরোধীতা করতো। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৮/৫০]

সুতরাং বুঝা গেল যে, এহেন কর্ম শুধুমাত্র এক পক্ষ থেকে হতো এমন নয়। বরং উভয় পক্ষ থেকেই এমন সব কথা অন্য পক্ষকে বলা হতো, যা অপর পক্ষের জন্য মেনে নেয়া কঠিন ছিল।
কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া রাঃ সহ কোন আকাবির সাহাবা এহেন কাজে লিপ্ত হতেন বলে গ্রহণযোগ্য কোন প্রমাণ নেই। এছাড়া যেসব বর্ণনা পেশ করে হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর পক্ষ থেকে গালমন্দ করার উৎসাহদান সম্পর্কে বর্ণনা করা হয় এসব কিছুই অগ্রহণযোগ্য ও বাতিল।

সুতরাং এমন সব বর্ণনা পেশ করে আল্লাহর নবীর প্রিয় সাহাবীগণ সম্পর্কে মন্দ ধারণা করা কিছুতেই সমীচিন নয়।

 

এ বিষয়ে আরো পড়ুন:

মুয়াবিয়া রাঃ বাগী বা বিদ্রোহী হবার কারণে ফাসিক ও জাহান্নামী?

হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর জন্য হযরত উসমান রাঃ এর খুনের কিসাসের দাবি করা কি অন্যায় ছিল?

প্রসঙ্গ আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ ইতিহাসের ইতিহাস পর্যালোচনা

0Shares

আরও জানুন

নফল আদায়কারীর পিছনে কি ফরজ আদায়কারীর ইক্তিদা সহীহ হয়?

প্রশ্ন হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ নাকি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ইশার নামায পড়তেন। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *