আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে হবে যুক্তির ভিত্তিতে
আমরা মনে করি, আল্লাহ যদি চাইতেন সবাই আল্লাহর উপর ঈমান রাখবে সেটা আল্লাহ এক মুহূর্তেই করতে পারতেন।কিন্তু আল্লাহ চান মানুষ তার যুক্তি-বিচার দিয়ে আল্লাহকে জেনে নিক।মানুষের আসল পরীক্ষাটাই হল তার স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি( Free will)।(চলমান সংকট নিরসনে আদর্শিক লড়াইয়ের অপরিহার্যতা-১৩)
“আল্লাহ চান মানুষ তার যুক্তি-বিচার দিয়ে আল্লাহকে জেনে নিক” – এর স্বপক্ষে হিযবুত তাওহীদ কোন দলিল উল্লেখ করে নি।আল্লহ ﷻ এর উপর ঈমান আনয়নের মূল ভিত্তি যুক্তি নয় বরং ওহী।
⏩পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লহ ﷻ ইরশাদ করেনঃ
◾الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ وَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰہُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ
যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে এবং তাদেরকে আমি যা দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে।(সূরা বাক্বারাহ-৩)
উক্ত আয়াতে মুত্তাকীদের তিনটি গুণের উল্লেখ করা হয়েছে ।অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন, নামায প্রতিষ্ঠা করা এবং স্বীয় জীবিকা থেকে সৎপথে ব্যয় করা।আয়াতের মধ্যে কতগুলো জরুরি বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে তার মধ্যে একটি হল অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন ।
🔸ঈমানের সংজ্ঞাঃ ঈমানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে । (یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ )ঈমান এবং গায়েব।শব্দ দুটির অর্থ যথাযথভাবে অনুধাবন করলেই ঈমানের তাৎপর্য ও সংজ্ঞা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ ।
ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, কারো কথাকে তার বিশ্বস্ততার নিরিখে মনে-প্রাণে মেনে নেয়া।এজন্যই অনুভূতিগ্রাহ্য ও দৃশ্যমান কোন বস্তুতে কারো কথায় বিশ্বাস স্থাপন করার নাম ঈমান নয়।উদাহরণস্বরূপ বলা হয় যে,কোন ব্যক্তি যদি এক টুকরো সাদা কাপড়কে সাদা এবং কালো কাপড়কে কালো বলে এবং আরেক ব্যক্তি তার কথাকে সত্য বলে মেনে নেয় ,তাহলে একে ঈমান বলা যায় না।এতে বক্তার কোন প্রভাব বা দখল নেই।অপরদিকে রাসূল ﷺ এর কোন সংবাদ কেবল রাসূল ﷺ এর উপর বিশ্বাসবশতঃ মেনে নেয়াকেই শরীয়তের পরিভাষায় ঈমান বলে।
‘গায়েব’ (غيب) এর অর্থ হচ্ছে এমনসব বস্তু যা বাহ্যিকভাবে মানবকুলের জ্ঞানের উর্ধ্বে এবং যা মানুষ পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করতে পারে না, চক্ষু দ্বারা দেখতে পায় না, কান দ্বারা শুনতে পায় না, নাসিকা দ্বারা ঘাণ নিতে পারে না, জিহবা দ্বারা স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না, হাত দ্বারা স্পর্শ করতে পারে না, ফলে সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভও করতে পারে না।
কুরআনে ‘গায়েব'(غيب) শব্দ দ্বারা সে সমস্ত বিষয়কেই বোঝানো হয়েছে যেগুলোর সংবাদ রাসূল ﷺ দিয়েছেন এবং মানুষ যে সমস্ত বিষয়ে স্বীয় বুদ্ধিবলে ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার মধ্যমে জ্ঞান লাভে সম্পূর্ণ অক্ষম।
‘গায়েব’ শব্দ দ্বারা ঈমানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব ও সত্তা, সিফাত বা গুণাবলী এবং তাকদীর সম্পর্কিত বিষয়সমূহ, জান্নাত-জাহান্নামের অবস্থা, কেয়ামত এবং কেয়ামতে অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনাসমূহ, ফেরেশতাকুল, সমস্ত আসমানী কিতাব, পূর্ববর্তী সকল নবী ও রাসূলগণের বিস্তারিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত যা সূরা বাকারার (امن الرسول) আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঈমানের মূল ভিত্তি ‘গায়েব’ বা অদৃশ্য বিষয়াদির উপর।স্রষ্টার অস্তিত্ব, তাঁর গুণাবলী, ফিরিশতা,সৃষ্টিজগতের সাথে স্রষ্টার সম্পর্ক, পরকালীন জীবন ইত্যাদি সবই মূলত অদৃশ্য বিষয় ।পঞ্চ-ইন্দ্রিয় বা মানবীয় জ্ঞান, বুদ্ধি বা বিবেক দিয়ে এগুলোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না।মানবীয় জ্ঞান, বুদ্ধি বা বিবেক এগুলোর বাস্তবতা ও সম্ভাব্যতা অনুভব ও স্বীকার করে।কিন্তু এগুলোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারে না।এ বিষয়ে যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে অনেক বিতর্ক করা সম্ভব, তবে কোনো সুনির্ধারিত ঐকমত্যে পৌঁছানো যায় না।এজন্যই মূলত ঈমানের বিষয়ে ওহীর উপর নির্ভর করতে হয়।
বিশ্বাস বা ঈমানের ভিত্তি হলো জ্ঞান ।কোনো বিষয়ে বিশ্বাস করতে হলে তাকে জানতে হবে।মানবীয় জ্ঞানের বিভিন্ন উৎস রয়েছে ।লোকাচার,যুক্তি, অভিজ্ঞতা, দর্শন ,ল্যাবরেটরির গবেষণা ইত্যাদি বিভিন্ন উৎস থেকে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে।
এখন প্রশ্ন হলো, ঈমান-আক্বীদা বিষয়ক জ্ঞানের উৎস কি?ঈমানী জ্ঞানের একমাত্র উৎস-‘ওহী’।
এজন্য কুরআন ও হাদীসে একদিকে যেমন ওহীর জ্ঞানের উপর ঈমানের ভিত্তি স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অপরদিকে তেমনি লোকাচার, কুসংস্কার, নিজের ব্যক্তিগত যুক্তি ও পছন্দের উপর বিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপন করতে বিশেষভাবে নিষেধ করা হয়েছে এবং একে পথভ্রষ্টতার অন্যতম কারণ বলা হয়েছে ।
পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লহ ﷻ ইরশাদ করেনঃ
◾اِتَّبِعُوۡا مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکُمۡ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ لَا تَتَّبِعُوۡا مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اَوۡلِیَآءَ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَذَکَّرُوۡنَ
তোমরা অনুসরণ কর, যা তোমাদের প্রতি পালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য সাথীদের অনুসরণ করো না।(সূরা আ’রাফ-৩)
ওহীর বিপরীতে ওহীকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে যুগে যুগে মানুষের যুক্তি ও প্রমাণ ছিল সামাজিক প্রচলন, পূর্বপুরুষদের বিশ্বাস বা নিজেদের ব্যক্তিগত পছন্দ ।কুরআনে একে মানব সমাজের বিভ্রান্তির মূল কারণ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে ।
নিঃসন্দেহে, গায়েব বা অদৃশ্য জগত সম্পর্কে ওহীর বাইরে যা কিছু বলা হয় সবই ধারণা, অনুমান, আন্দায বা কল্পনা হতে বাধ্য।এরকম একটি নড়বড়ে মাধ্যমে আল্লাহ তা’য়ালাকে জেনে নেয়ার কথা বলা কোনো বুদ্ধিমানের বক্তব্য হতে পারে না।সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন বিবেক ও যুক্তিগ্রাহ্য ওহীকে প্রত্যাখ্যান করে এরূপ আন্দায বা ধারণাকে বিশ্বাসের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা নিজের মর্জি বা প্রবৃত্তির অনুসরণ বৈ কিছুই নয়।
এ বিষয়ে পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লহ ﷻ ইরশাদ করেনঃ
◾وَ مَنۡ اَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ ہَوٰىہُ بِغَیۡرِ ہُدًی مِّنَ اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ
আল্লাহর হেদায়েতের পরিবর্তে যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চাইতে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? নিশ্চয় আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে পথ দেখান না।(সূরা কাসাস-৫০)
◾بَلِ اتَّبَعَ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡۤا اَہۡوَآءَہُمۡ بِغَیۡرِ عِلۡمٍ ۚ فَمَنۡ یَّہۡدِیۡ مَنۡ اَضَلَّ اللّٰہُ ؕ وَ مَا لَہُمۡ مِّنۡ نّٰصِرِیۡنَ
বরং যালিমরা অজ্ঞতাবশত তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে, কাজেই আল্লাহ্ যাকে পথভ্রষ্ট করেন কে তাকে হিদায়াত দান করবে? আর তাদের কোন সাহাযাকারী নেই।(সূরা রূম-২৯)
এভাবে আমরা দেখতে পাই যে ,ঈমানের ভিত্তি অবশ্যই ওহীর জ্ঞানের উপর হতে হবে ।
কুরআনুল কারীমে ঈমানের মডেল হিসেবে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) কে উপস্থাপন করে আল্লহ ﷻ ইরশাদ করেনঃ
اٰمِنُوۡا کَمَاۤ اٰمَنَ النَّاسُ
অন্যান্যরা(সাহাবীরা) যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আন।(সূরা বাক্বারাহ-১৩)
ইসলামের বিশ্বাস বিষয়ক নির্দেশাবলির ক্ষেত্রে সাহাবী(রাঃ) গণের নীতি ছিল যে,কুরআনুল কারীমে বা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মুখে এ বিষয়ে যা কিছু তাঁরা শুনেছেন বা জেনেছেন, সেগুলোকে বিনা বাক্যে ও নির্দ্বিধা বিশ্বাস করেছেন ।এগুলোর বিষয়ে অকারণ যুক্তিতর্কের আরোপ করেন নি।তাদের কর্মপদ্ধতি ছিল
سَمِعۡنَا وَ اَطَعۡنَا ؕ
আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম।(সূরা নূর-৫১)
আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ
لَوْ كَانَ الدِّيْنُ بِالرَّاْىِ لَكَانَ اَسْفَلَ الْخُفِّ اَوْلى بِالْمَسْحِ مِنْ اَعْلَاهُ وَقَدْ رَاَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ يَمْسَحُ عَلى ظَاهِرِ خُفَّيْهِ
দ্বীন যদি (মানুষের জন্য) বুদ্ধি অনুসারেই হতো, তাহলে মোজার উপরের চেয়ে নীচের দিকে মাসাহ করাই উত্তম হত। আমি রসূলুল্লাহ ﷺ কে দেখেছি যে, তিনি তাঁর মোজার উপরের দিক মাসাহ করেছেন।(সুনানে আবু দাউদ-১৬২)
পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লহ ﷻ ইরশাদ করেনঃ
◾الَّذِیۡ خَلَقَ الۡمَوۡتَ وَ الۡحَیٰوۃَ لِیَبۡلُوَکُمۡ اَیُّکُمۡ اَحۡسَنُ عَمَلًا ؕ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡغَفُوۡرُ ۙ
যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন-কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়।(সূরা মূলক-২)
এই আয়াত থেকে বুঝা যায় আল্লহ ﷻ মানুষকে পরীক্ষা করছেন ।এরমধ্যে যারা ঈমান আনয়ন করবে তারা সফলকাম ।কিন্তু সেই ঈমানের ভিত্তি হতে হবে ওহী, যুক্তি নয়।উপরোক্ত আলোচনা হতে তা প্রমাণিত হয়েছে ।
সুতরাং হিযবুত তাওহীদের বক্তব্য চরম বিভ্রান্তিকর ।
ইস্তিফাদা গ্রহনঃ ফাদ্বিলাতুশ শায়খ Abdullah Al Mamun হাঃফি