প্রচ্ছদ / আদব ও আখলাক / উত্তম আখলাক ও চারিত্রিক গুণাবলী

উত্তম আখলাক ও চারিত্রিক গুণাবলী

আল্লামা মনজূর নূমানী রহঃ

মানুষের আত্মশুদ্ধি এবং চারিত্রিক উন্নতি ইসলামী শিক্ষার এক অতিগুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নবীজী এরশাদ করেন,

إِنَّمَا بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ صَالِحَ الْأَخْلَاقِ
আমি তো আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে সর্বোত্তম চরিত্রমাধুরীর পূর্ণতা বিধানের জন্যই প্রেরিত হয়েছি। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৮৯৫১

সচ্চরিত্রের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে নবীজী বলেন,

إِنَّ مِنْ خِيَارِكُمْ أَحَاسِنَكُمْ أَخْلَاقًا
তোমাদের মাঝে উত্তম সে, যে চরিত্রবান। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৩২১

অন্য হাদীসে নবীজী বলেন,

إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَيَّ وَأَقْرَبِكُمْ مِنِّي مَجْلِسًا يَوْمَ القِيَامَةِ أَحَاسِنَكُمْ أَخْلَاقًا
যার চরিত্র সব চেয়ে ভালো, কেয়ামতের দিন সেই হবে আমার কাছে সবার চে প্রিয়। সুনানে তিরমিযি, হাদীস নং ২০১৮

একটি হাদীসে নবীজী বলেন,

مَا شَيْءٌ أَثْقَلُ فِي مِيزَانِ المُؤْمِنِ يَوْمَ القِيَامَةِ مِنْ خُلُقٍ حَسَنٍ
কেয়ামতের দিন মিযানের পাল্লায় সচ্চরিত্র সবচে বেশি ওজনী ও ভারী হবে। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২০০২

আরেক হাদীসে এসেছে,

أَكْثَرُ مَا يَلِجُ بِهِ الْإِنْسَانُ الْجَنَّةَ: تَقْوَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَحُسْنُ الْخُلُقِ
খোদাভীতি ও নেক চরিত্র এমন এক গুণ, যার উসিলায় অধিক হারে মানুষ জান্নাতে যাবে। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৯০৯৬

অন্য এক হাদীসে এসেছে,

إِنَّ الْمُؤْمِنَ لَيُدْرِكُ بِحُسْنِ خُلُقِهِ دَرَجَةَ الصَّائِمِ الْقَائِمِ
একজন চরিত্রবান মুমিন দিন ভর রোযা আর রাতভর নফল নামায পড়ার সওয়াব লাভ করে। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৭৯৮

অর্থাৎ যে সৌভাগ্যবানের ঈমান রয়েছে, নির্ধারিত ফরজগুলি যে আদায় করে চলে এবং যার চরিত্র ভালো, কিন্তু সে তত বেশি নফল রোযা-নামায করতে পারে না। আল্লাহ তাআলা তাকে সব সময় রোযা-নামাযে নিমগ্ন ব্যক্তির সমান সওয়াব দান করেন।

অসচ্চরিত্রের পরিণাম

একদিকে যেমন নবীজী নেক চরিত্রের উল্লিখিত ফযিলত বর্ণনা করেছেন, অন্য দিকে তেমনি দুশ্চরিত্রের অশুভ পরিণাম সম্পর্কে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। এক হাদীসে নবীজী কড়া করে বলেন,

وَالَّذِي نَفسِي بِيَدِهِ لَا يدْخل الْجنَّة إِلَّا حسن الْأَخْلَاق. أخرجه الْحَكِيم التِّرْمِذِيّ فِي نَوَادِر الْأُصُول بِإِسْنَاد فِيهِ ضعف كما قال العراقي في تخريجه علي الاحياء. وقد جاء في معناه لاَ يَدْخُلُ الجَنَّةَ سَيِّئُ الْمَلَكَةِ. أخرجه الترمذى وفيه فرقد السبخي وهو ضعيف
ঐ সত্ত্বার কসম! যার হাতে আমার জান, দুঃশ্চরিত্রের লোক তো জান্নাতে যেতে পারবে না। জান্নাতে যাবে কেবল চরিত্রবানেরা।

অতীব জরুরি কিছু গুণাবলী

কোরআন ও হাদীসে সকল প্রকার মানবীয় গুণাবলী ও সুকুমার বৃত্তিসমুহের বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। সর্ব রকম কদাচার ও অনাচার থেকে বেঁচে থাকারও সুস্পষ্ট নির্দেশনা বিবৃত হয়েছে। এখানে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সচ্চরিত্র ও সদগুণ উল্লেখ করা হচ্ছে, যেগুলো ব্যতীত কেউ নিজেকে সত্যিকারের মুসলমান দাবি করতে পারে না।

১. সততা ও সত্যবাদিতা

সততা ও সত্যবাদিতার এত গুরুত্ব যে, ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মানুষ শুধু সত্য বলেই ক্ষান্ত হবে না, বরং সত্যবাদী সাধুসজ্জন ওলী-বুযুর্গের সান্নিধ্যও গ্রহণ করবে। আল্লাহ পাক বলেন,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ
হে ঈমান-অলা বান্দারা! আল্লাহ তাআলাকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সাহচর্য অবলম্বন করো। সূরা তওবা ৯/১১৯

একবার নবীজী সাহবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বললেন,

مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُحِبَّهُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ فَلْيَصْدُقْ حَدِيثَهُ إِذَا حَدَّثَ
যে নিজের প্রতি এই শুভ কামনাটুকু করে যে, সে অন্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা পোষণ করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাকে মুহাব্বত করবেন, তবে সে যেন সদা সত্য বলে অভ্যস্ত হয়। শুআবুল ঈমান, হাদীস নং ১৪৪০

অন্য এক হাদীসে এসেছে,

সততা অবলম্বন করো, যদিও বাহ্যিকভাবে তাতে নিজের সমূহ ক্ষতি এমনকি যদি মৃত্যু লক্ষ করো তবু। কেননা প্রকৃত মুক্তি এবং আসল জিন্দেগী সততার মাঝে নিহিত। আর মিথ্যাবাদিতা পরিহার করো, যদিও সাধারণ চোখে তাতে নিজের মুক্তি ও নিষ্কৃতি দেখতে পাও। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে মিথ্যার সাথে ব্যর্থতা আর অশুভ পরিণাম ছাড়া কিছুই নেই।

অন্য হাদীসে এসেছে,

أَيَكُونُ الْمُؤْمِنُ جَبَانًا؟ فَقَالَ: نَعَمْ، فَقِيلَ لَهُ: أَيَكُونُ الْمُؤْمِنُ بَخِيلًا؟ فَقَالَ: نَعَمْ، فَقِيلَ لَهُ: أَيَكُونُ الْمُؤْمِنُ كَذَّابًا؟ فَقَالَ: لَا. قَالَ أَبُو عُمَرَ ابن عبد البر: لَا أَحْفَظُ هَذَا الْحَدِيثَ مُسْنَدًا مِنْ وَجْهٍ ثَابِتٍ، وَهُوَ حَدِيثٌ حَسَنٌ مُرْسَلٌ .
কোন এক ব্যক্তি নবীজীর কাছে জানতে চাইলো, মোমিন ব্যক্তি কি ভীরু হতে পারে? নবীজী বললেন, হ্যাঁ হতে পারে। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলো, মোমিন কি কৃপণ হতে পারে ? বললেন, হ্যাঁ। আবার জিজ্ঞেস করলো, মোমিন কি মিথ্যুক হতে পারে? নবীজী বললেন, না। মিথ্যা কোনো মোমিনের স্বভাব-দোষ হতে পারে না। মুআত্তা, হাদীস নং ৩৬৩০

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সর্বদা সত্য বলার তাওফীক দান করুন, যে সত্য মুক্তি দেয়, জান্নাতে পৌছে দেয় এবং আল্লাহ ও তার রাসুলের ভালোবাসার পাত্র বানায়। আর আমাদেরকে আল্লাহ তাআলা চিরতরে মিথ্যা পরিত্যাগ করার শক্তি দান করুন, যে মিথ্যা সর্বনাশের প্রতীক, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অসন্তুষ্টির কারণ এবং অভিশপ্ত মোনাফেকের নিদর্শন।

২. কথা দিয়ে কথা রাখা

ওয়াদা রক্ষা করা এবং কথা দিয়ে কথা রাখা সততারই একটি বিশেষ শাখা। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا
কাউকে ওয়াদা দিয়ে থাকলে তা রক্ষা করবে, নিশ্চই কেয়ামতের দিন ওয়াদা পুরণ করা না করার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সূরা বনি ইসরাঈল ১৭/৩৪

কোরআন শরীফের অন্য জায়গায় নেকী ও নেককারের গুণাবলীর আলোচনায় আল্লাহ পাক বলেন,

وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا
এবং আল্লাহ পাকের দরবারে নেককার তারা, যারা কথা দিলে কথা রাখে। সূরা বাকারা ২/১৭৭

নবীজী তার অধিকাংশ ভাষণে বলতেন,

وَلَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ
যে ব্যক্তি কৃত ওয়াদার বরখেলাপ করে তার মাঝে দীনধর্মের কোন বালাই নেই। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১২৩৮৩

একটি হাদীসে নবীজী এরশাদ করেন,

آيَةُ المُنَافِقِ ثَلاَثٌ: إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ
মোনাকে-কাফেরের আলামত তিনটি, মিথ্যা বলা, ওয়াদা খেলাপ করা, আমানতের খেয়ানত করা। সহীহ বোখরী, হাদীস নং ৩৩

অর্থাৎ যেন ওয়াদা খেলাপি ঈমানদারই নয়। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে এই মন্দ স্বভাব থেকে হেফাজত করুন।

৩. আমানতদারি

সততার আরেকটি অঙ্গ হলো আমানতদারিতা। আল্লাহ পাক বলেন,

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
মহান আল্লাহর পক্ষ হতে এই হুকুম হচ্ছে যে, তোমরা আমানতকারীর আমানত তার কাছে ফিরিয়ে দাও। সূরা নিসা ৪/৫৪

কোরআন শরীফের অন্য জায়গায় ঈমানদারের গুণাবলী উল্লেখ করে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ
ঈমানদার তারা, যারা তাদের নিকট গচ্ছিত আমানত এবং তাদের কৃত ওয়াদার হেফাজত করে। সূরা মুমিনূন ২৩/৮

নবীজী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রায় খোতবায় বলতেন,

لَا إِيمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ
ওহে! যার ভিতর আমানতদারির গুণ নেই, তার ভিতর ঈমানও নেই। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১২৩৮৩

একটি হাদীসে এসছে, হযরত ওমর বলতেন,

شَهِدَ رَجُلٌ عِنْدَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ بِشَهَادَةٍ , فَقَالَ لَهُ: لَسْتُ أَعْرِفُكَ , وَلَا يَضُرُّكَ أَلَّا أَعْرِفَكَ , ائْتِ بِمَنْ يَعْرِفُكَ , فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ: أنا أَعْرِفُهُ , قَالَ: فَبِأَيِّ شَيْءٍ تَعْرِفُهُ؟ قَالَ: بِالْعَدَالَةِ وَالْفَضْلِ , قَالَ: فَهُوَ جَارُكَ الْأَدْنَى الَّذِي تَعْرِفُ لَيْلَهُ وَنَهَارَهُ وَمُدْخَلَهُ وَمُخْرَجَهُ؟ قَالَ: لَا , قَالَ: فَمُعَامِلُكَ بِالدِّينَارِ وَالدِّرْهَمِ اللَّذَيْنِ بِهِمَا يُسْتَدَلُّ عَلَى الْوَرَعِ؟ قَالَ: لَا , قَالَ: فَرَفِيقُكَ فِي السَّفَرِ الَّذِي يُسْتَدَلُّ بِهِ عَلَى مَكَارِمِ الْأَخْلَاقِ؟ قَالَ: لَا , قَالَ: لَسْتَ تَعْرِفُهُ , ثُمَّ قَالَ لِلرَّجُلِ: ائْتِ بِمَنْ يَعْرِفُكَ
কেউ ভালো কি মন্দ এই ধারণা অর্জনের জন্য কেবল তার নামায-রোযা আর সামাজিক মর্যাদা দেখেই তুষ্ট হয়ে যেও না, বরং লক্ষ করো, তার রাত-দিন কিভাবে কাটে, কোথায় যায় কোথায় থাকে, সে কথায় সত্যবাদী কি না, তার কাছে আমানত রাখা হলে বা লেনদেন করলে ঠিকঠিক আদায় করে কি না বা সফরে-সংকটে সৎ চরিত্রের পরিচয় দেয় কি না। আল কেফায়া খতীব বাগদাদী ১/৮৩

প্রিয় দ্বীনী ভাই!

যদি আমরা সত্যিকারের মোমিন হতে চাই, আল্লাহ পাকের রহমতের হকদার হতে চাই, তাহলে আমাদেরকে আমানতদার হতে হবে, অঙ্গীকার রক্ষা করাকে জীবনের মূলনীতি বানিয়ে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, যার ভিতরে এই গুণগুলি নেই, সে পুরোপুরি মোমিন নয়, প্রকৃত মুসলমান নয়।

৪. ইনসাফ ও ন্যায়বিচার

কাজেকর্মে ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া ইসলামী শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কোরআন শরীফে এসেছে,

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই ন্যায়বিচার ও সদাচারের আদেশ দিয়ে থাকেন। সূরা নাহল ১৬/৯০

ইসলামের ন্যায়বিচার শুধু মুসলমানদের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের জন্য এমনকি জান, মাল ও ঈমানের দুশমন তার জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى
কোনো সম্প্রদায়ের সঙ্গে চলমান বিরোধ কখনো যেন তোমাদেরকে এতটা উত্তেজিত না করে যে, তোমরাও ন্যায়বিচার থেকে সরে যাবে। বরং সর্বাবস্থায় তোমরা ন্যায়নীতির উপর অবিচল থাকবে, এটাই খোদা-ভীতির দাবী। সূরা মায়েদা ৫/৮

উক্ত আয়াতে যুদ্ধরত শক্রর সঙ্গেও কোনো প্রকার ন্যায়বিচার বিরোধী আচরণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এ থেকেই সাধারণ অবস্থায় ভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে কেমন ন্যায়ানুগ আচরণ করতে হবে তা সহজেই অনুমেয়। হাদীস শরীফে নবীজী ইরশাদ করেন,

কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার সবচে’ বেশি নৈকট্য প্রাপ্ত এবং প্রিয়পাত্র হবে ন্যায়পরায়ন শাসক। অন্যদিকে জালিম শাসক হবে সবচে’ বেশি নৈকট্য-বঞ্চিত এবং কঠিন শাস্তিতে নিপতিত।

একদিন সাহাবায়ে কেরামকে নবীজী জিজ্ঞেস করলেন,

أَتَدْرُونَ مَنِ السَّابِقُونَ إِلَى ظِلِّ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟ قَالُوا: اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: الَّذِينَ إِذَا أُعْطُوا الْحَقَّ قَبِلُوهُ، وَإِذَا سُئِلُوهُ بَذَلُوهُ، وَحَكَمُوا لِلنَّاسِ كَحُكْمِهِمْ لِأَنْفُسِهِمْ
তোমরা কি বলতে পারো, কেয়ামতের রৌদ্রকঠোর দিনে কোন ধরণের লোক সর্বপ্রথম রহমতের শামিয়ানায় স্থান পাবে? সাহাবারা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন, সুতরাং আপনিই বলুন, কোন সে খোশনসীব, যে সবার আগে রহমতের ছায়াতলে স্থান পাবে! নবীজী ইরশাদ করলেন, এমন লোক তারা, যারা নিজেদের হক দেয় হলে নির্মোহভাবে গ্রহণ করে আর অন্যের হক তলব করা হলে খোলামনে আদায় করে দেয়, ইনসাফের সাথে নিজদের বিষয়ে যেমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, অন্যের বেলায়ও তেমন ফয়সালা করে। (আপন আর পর বলে কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না।) মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ২৪৩৭৯

শত আফসোস! আজ আমরা অধিকার-সচেতন, কিন্তু দায়িত্ব-সচেতন নই। আমাদের রাজা-প্রজা, মালিক-শ্রমিক সকলে যদি ইনসাফের সাথে স্ব স্ব দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়ে সচেতন হয়, তাহলে সমাজে কোনো বৈষম্য থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা ইসলামের শিক্ষা ভুলে গিয়েছি। সত্যবাদিতা ও আমানতদারিতা আমাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকে বিদায় হয়ে গেছে। তদস্থলে জেঁকে বসেছে ওয়াদা খেলাপি, দুর্নীতি ও বেইনসাফি। যদি আমরা এগুলো ত্যাগ করে ইসলামের পূতপবিত্র সার্বজনীন শিক্ষাকে গ্রহণ করি, তাহলে অতীতের মতো পৃথিবীর সমস্ত সম্মান, শান্তি ও সমৃদ্ধি আবার আমাদের পায়ে লুটিয়ে পড়বে, আর পরকালের মহাপ্রাপ্তি তো এমন মুসলমানদেরই জন্য!

৫. দয়াদ্রতা ও ক্ষমাশিলতা

কেউ ভুল করে ফেললে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া এবং দুঃখী মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র হওয়া ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। নবীজী বলেন,

ارْحَمُوا تُرْحَمُوا، وَاغْفِرُوا يَغْفِرِ اللهُ لَكُمْ
তোমরা আল্লাহ তাআলার অসহায় বান্দাদের সাঙ্গে দয়ার আচরণ করো, তোমাদের প্রতিও সদয় আচরণ করা হবে। অন্যের দোষ-ক্রটি ক্ষমার চোখে দেখো, তোমাদের ভুল ক্রটিও আল্লাহ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৭০৪১

অন্য এক হাদীসে নবীজী বলেন,

مَنْ لاَ يَرْحَمُ لاَ يُرْحَمُ
যে ব্যক্তি কাউকে ক্ষমা করে না, কারো প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তাকে ক্ষমা করেন না, তার প্রতি দয়া করেন না। সহীহ বোখারী, হাদীস নং ৫৯৯৭

আরেকটি হাদীসে নবীজী এরশাদ করেন,

الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ، ارْحَمُوا مَنْ فِي الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ
রহমকারীদের প্রতি রহমান আল্লাহ করুণা ও রহম করে থাকেন। সুতরাং জমিনের বাসিন্দাদের প্রতি দয়ামায়া করো, আসমান ওয়ালা তোমাদের প্রতি দয়া ও করুণা প্রদর্শন করবেন। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ১৯২৪

এই হাদীসগুলি থেকে বোঝা যায়, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি এমনকি পৃথিবীতে বিচরণশীল প্রতিটি জীবের প্রতি ইসলাম সহানুভূতিশীল হওয়ার কথা বলে (যদি তার প্রতি করুণা সমাজের জন্য ক্ষতিকর না হয়)। নবীজী বলেন,

بَيْنَا رَجُلٌ بِطَرِيقٍ، اشْتَدَّ عَلَيْهِ العَطَشُ، فَوَجَدَ بِئْرًا، فَنَزَلَ فِيهَا، فَشَرِبَ ثُمَّ خَرَجَ، فَإِذَا كَلْبٌ يَلْهَثُ، يَأْكُلُ الثَّرَى مِنَ العَطَشِ، فَقَالَ الرَّجُلُ: لَقَدْ بَلَغَ هَذَا الكَلْبَ مِنَ العَطَشِ مِثْلُ الَّذِي كَانَ بَلَغَ مِنِّي، فَنَزَلَ البِئْرَ فَمَلاَ خُفَّهُ مَاءً، فَسَقَى الكَلْبَ، فَشَكَرَ اللَّهُ لَهُ فَغَفَرَ لَهُ
এক ব্যক্তি প্রচ- পিপাসার্ত অবস্থায় একটি কুয়া পেলো। সে কুয়াতে নেমে পানি পান করলো। বের হয়েই দেখতে পেলো, একটি কুকুর পানি না পেয়ে প্রচ- পিপাসায় ভিজা মাটি চাটছে। সে ভাবলো, আমার মতো কুকুরটিও পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েছে। লোকটি দয়াপরবশ হয়ে আবার কুয়ায় নামলো এবং নিজের চামড়ার মুজায় পানি ভরে এনে কুকুরটিকে খাওয়ালো। এর ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে করে দিলেন। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৪৬৬

বড় আক্ষেপের বিষয়, আজ আমাদের মাঝ থেকে দয়ামায়া ও সমবেদনার গুণ উঠে গেছে। ফলে আমরাও আল্লাহ তাআলার রহমত লাভের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছি।

৬. নম্রতা ও কোমলতা

ইসলাম সকল আচরণে কোমলতা শিক্ষা দেয়। নবীজী ইরশাদ করেন,

حُرِّمَ عَلَى النَّارِكُلُّ هَيِّنٍ لَيِّنٍ سَهْلٍ قَرِيبٍ مِنَ النَّاسِ
যে ব্যক্তি মানুষের নিকট সবসময় সহজ-কোমল সুহৃদ আচরণে অভ্যস্ত, তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যায়। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৩৯৩৮

আরেক হাদীসে নবীজী বলেন,

إِنَّ اللهَ رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ، وَيُعْطِي عَلَى الرِّفْقِ مَا لَا يُعْطِي عَلَى الْعُنْفِ
আল্লাহ তাআলা নিজে সহজ আচরণ করে থাকেন, বান্দাদের থেকেও তিনি সহজ আচরণের বহিঃপ্রকাশ পছন্দ করেন। আর কোমলতাময় কাজে যে পরিমাণ বরকত দান করেন, কঠোরতাপূর্ণ কাজে সে পরিমাণ দান করেন না। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৯৩

৭. ধৈর্য ও সহনশিলতা

অন্যের দুর্ব্যবহারে ধৈর্য ধারণ করা এবং ক্রোধের সময় আত্মসংবরণ করা মহত্বের লক্ষণ। আল্লাহ ও তার রাসুলের নিকট এমন মানুষ বড়ই মর্যাদাবান। এদের জন্য আল্লাহ তাআলা জান্নাত ও তার বাগবাগিচাগুলো সাজিয়ে রেখেছেন। ইরশাদ করেন,

وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ
(জান্নাতী মানুষ তারা) যারা গোসসা নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানুষের ক্রটি ও কসুর ক্ষমা করে দেয়। সূরা আলে ইমরান ৩/১৩৪

সুতরাং ভাগ্যবান সে, যে ক্রোধ দমন করার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার আযাব থেকে আত্মরক্ষা করে।

৮. মিষ্টি ভাষা ও সদালাপ

সদালাপকারী ও মিষ্টভাষী হওয়া খুবই কাম্য বিষয়। আর অশ্লীল ও কর্কশ ভাষা একান্তই ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য বিষয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا
মানুষের সঙ্গে সুন্দরভাবে (সহাস্য বদনে) কথা বলো। সূরা বাকারা ২/২৩

নম্রকোমল ভাষা সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত। আর রুক্ষ ও রূঢ় ভাষা দুষ্কর্মের অন্তর্ভুক্ত। হাদীসে এসেছে,

وَالكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ )وَكُلُّ خَطْوَةٍ يَمْشِيهَا إِلَى الصَّلاَةِ( صَدَقَةٌ
ভদ্র ও মার্জিত ভাষায় কথাবার্তা বলাও একটি সাদকাতূল্য সওয়াবের বিষয়। সহীহ বোখারী, হাদীস নং ২৮৯১

অন্য হাদীসে এসেছে,

وَالْبَذَاءُ مِنَ الْجَفَاءِ، وَالْجَفَاءُ فِي النَّارِ
নির্লজ্জ ব্যবহার আসে রুক্ষতা থেকে। আর রুক্ষতার ঠিকানা জাহান্নাম। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১০৫১২

অন্য এক হাদীসে এসেছে,

وَالبَذَاءُ وَالبَيَانُ شُعْبَتَانِ مِنَ النِّفَاقِ.
মুখ খারাপ হওয়া এবং বকবক করা বর্ণচোরা মোনাফেকের আলামত। সুনানে তিরমিযি, হাদীস নং ২০২৭

আল্লাহ পাক আমাদের সকলের মুখের ভাষা মধুময় করে দিন। সকলের বোলচাল সুমিষ্ট বানিয়ে দিন। তিক্ত কথা, বিরস উক্তি এবং কটু ভাষা পরিহার করার তাওফীক দান করুন, আমীন ।

৯. বিনয় ও আত্মবিলোপ

সকল মানুষ বিনয়ী হোক, প্রতিটি নাগরিক অপর নাগরিককে নিজের তুলনায় অধিক শ্রদ্ধাভাজন বলে ভাবতে শিখুক, অহমিকা ও দাম্ভিকতা বিলুপ্ত হোক, আমাদের জীবন থেকে দূর হয়ে যাক সর্বনাশা অহংকার, বিনয় হোক আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যের অংশ। আল্লাহ পাক বলেন,

تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ
পরজগতের সে নিলয় আমি রচনা করেছি তাদের জন্য, যারা ইহজগতে বড়াই করে বেড়ায় না, (রেষারেষি জিইয়ে রাখে না)। সূরা কাসাস ২৮/৮৩

অন্য আয়াতে এসেছে ,

وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا
দয়াময় আল্লাহর খাঁটি বান্দা তারা, যারা নিরহংকার ভঙ্গিতে পথ চলে। সূরা ফুরকান ২৫/৬৩

নবীজী এরশাদ করেন,

مَنْ تَوَاضَعَ لِلَّهِ دَرَجَةً رَفَعَهُ اللهُ دَرَجَةً، حَتَّى يَجْعَلَهُ فِي عِلِّيِّينَ
যে ব্যক্তি আত্মবিলোপের নীতি এখতিয়ার করবে, আল্লাহ পাক তাকে এত উচ্চ মর্যাদা দান করবেন যে, জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম ‘ইল্লিইয়ীনে’ তাকে পৌঁছে দেবেন। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১১৭২৪

বিনয়ের বিপরীত বিষয় অহংকার। এটা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নিকট খুবই জঘণ্য। হাদীস শরীফে এসেছে,

لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ
অহংকার এত মারাত্মক দোষ যে, কারো ভিতর সামান্য শরিষাদানা সমান এই দোষ থেকে গেলে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯১

অন্য হাদীসে নবীজী এরশাদ করেন,

مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ مِنْ كِبْرٍ، أَكَبَّهُ اللهُ عَلَى وَجْهِهِ فِي النَّارِ
যে ব্যক্তি শরিষাদানার মতো সামান্য অহংকারও অন্তরে লালন করবে, তাকে আল্লাহ তাআলা উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৭০১৫

একটি হাদীসে এসেছে,

অহংকার থেকে বেঁচে থাকো। কেননা অহংকার এমন একটি গোনাহ, যা সর্বপ্রথম শয়তানকে শয়তান বানিয়ে ধ্বংস করেছিলো।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে বিনয় ও আত্মবিলোপের ঈমানী শোভা দান কুন, অহমিকাশূন্য মাটির মানুষ বনার শক্তি দিন। আর সকল ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এবং সত্য ধর্ম ইসলামের মান ও মর্যাদা রক্ষায় পাহাড়সম অটলতা ও অবিচলতা নসীব করুন।

১০. হিম্মত ও ধৈর্য

এই দুনিয়াতে কখনো আসে রোগ-শোক, কখনো দেখা দেয় বিপদ-মুসিবত। কখনো জালিমের জুলুম-নির্যাতন, কখনো বা অভাব-অনটন। এমতাবস্থায় ইসলামের বিশেষ শিক্ষা এই যে, যত প্রতিকূলতা আসুক আর যত কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হোক, মুমিন মাত্রই ধৈর্য, দৃঢ়তা ও বাহাদুরির সঙ্গে সময়কে অতিক্রম করবে এবং কিছুতেই সে ধৈর্যহারা হবে না, ভেঙ্গে পড়বে না। আল্লাহ তাঁর ঐ বান্দাদের খুবই পছন্দ করেন, যারা ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে সচেষ্ট থাকে।

আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন,

إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
নিশ্চয়ই দয়ালু আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। সূরা বাকারা ২/১৫৩

একটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা পূণ্য কর্মের বর্ণনায় বলেন,

وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ
(এগুলি অনেক বড় পূণ্যের বিষয় যে,) লোকেরা রোগে-শোকে ছবর করবে, অভাব-অনটনে ধৈর্য ধারণ করবে এবং যুদ্ধকালে অবিচল থাকবে। মূলত এমন লোকেরাই সত্যিকারের মুমিন ও মুত্তাকি নামে অভিহিত হবার যোগ্য। সূরা বাকারা ২/১৭৭

হাদীস শরীফ এসেছে,

مَا أُعْطِيَ أَحَدٌ مِنْ عَطَاءٍ خَيْرٌ وَأَوْسَعُ مِنَ الصَّبْرِ
দুর্যোগের সময় ছবর করতে পারার মতো উত্তম ও বড় নেয়ামত কেউ প্রাপ্ত হয়নি। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৫৩

অন্য হাদীসে এসেছে,

الصَّبْرُ نِصْفُ الْإِيمَانِ :قال الهيثمي: رِجَالُهُ رِجَالُ الصَّحِيحِ.
এক বিবেচনায় ধৈর্য হলো ঈমানের অর্ধেক। মুজামে কাবীর, হাদীস নং ৮৫৪৪

ইসলামের দৃষ্টিতে বিপদে ভেঙ্গে পড়া এবং সাহস হারিয়ে ফেলা নিতান্ত অপছন্দনীয়। নবীজী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ থেকে পানাহ চাইতেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের হিম্মত বাড়িয়ে দিন। বুজদিলি থেকে হেফাজত করুন, আমীন।

১১. এখলাছ ও বিশুদ্ধ নিয়ত

কর্মের পরম উদেশ্যটুকু সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলাকে নিবেদন করার নাম হলো এখলাছ। অর্থাৎ যে কাজই আমরা করবো আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিকে সামনে রেখে করবো, প্রবৃত্তিকে কখনো আমলে নিবো না। মনে রাখতে হবে, ইসলাম ধর্মের মূল হলো ‘তাওহীদ’ তথা একত্ববাদ। আর তাওহীদ পূর্ণতা লাভ করে এই প্রকারের এখলাস দ্বারা। তাই এখলাসকে ইসলামের রূহ বলা হয়। নবীজী ইরশাদ করেন,

مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ، وَأَبْغَضَ لِلَّهِ، وَأَعْطَى لِلَّهِ، وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيمَانَ
যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একজনকে মুহাব্বত করলো এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই অন্যজনকে অপছন্দ করলো, এবং দান করলো আল্লাহর জন্য, বিরতও থাকলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, সে তার ঈমান ও তাওহীদকে পরিপূর্ণ করে নিলো। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৬৮১

অর্থাৎ যে ব্যক্তি সম্পর্কের সকল সূত্রে এবং সবধরনের আদান প্রদানে ব্যক্তিগত কোন মতলব বা লাভালাভ নয়, বরং আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টিকেই মুখ্য বিবেচনা করে, সে ব্যক্তি তাওহীদের হক আদায়কারী পূর্ণ মুমিন। হাদীস শরীফ এসেছে,

إِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى أَجْسَادِكُمْ، وَلَا إِلَى صُوَرِكُمْ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ
আল্লাহ পাক তোমাদের অবয়ব-আকৃতি দিকে লক্ষ করেন না, লক্ষ করেন তোমাদের অন্তরে প্রচ্ছন্ন এখলাছের দিকে। মুসলিম, হাদীস নং ২৫৬৪

অর্থাৎ এখলাছ অনুপাতে তোমরা আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও ছওয়াব লাভ করবে। একটি হাদীসে এসেছে,

إِنَّ اللَّهَ لَا يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلَّا مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا، وَابْتُغِيَ بِهِ وَجْهُهُ
(লোকসকল! নেক আমলে এখলাছ আনার চেষ্টা করো।) আল্লাহ পাক তো ঐ আমলই কবুল করেন, যাতে এখলাছের সুবাস রয়েছে। যাতে কেবল তাঁর সন্তুষ্টি সন্ধান করা হয়েছে। সুনানে নাসাঈ, হাদীস নং ৩১৪০

হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু একটি হাদীস বয়ান করার সময় কখনো কখনো বেহুশ হয়ে পড়তেন। আসলেই তা সকলের কলিজা কাঁপিয়ে দেয়ার মতো। নবীজী এরশাদ করেন,

إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: قَاتَلْتُ فِيكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لِأَنْ يُقَالَ: جَرِيءٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ، وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ، وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ: عَالِمٌ، وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ: هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ، وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ كُلِّهِ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلَّا أَنْفَقْتُ فِيهَا لَكَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ: هُوَ جَوَادٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ، ثُمَّ أُلْقِيَ فِي النَّارِ
কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম কোরআনের কিছু আলেম, কতক শহীদ ও ধনী ব্যক্তিকে আল্লাহ পাকের সামনে হাজির করা হবে। জিজ্ঞেস করা হবে, তোমরা আপন আপন যিন্দেগীতে আমার জন্য কে কী করেছো বলো। আলেম ব্যক্তি বলবে, আমি আজীবন আপনার কালামের পঠন-পাঠনে নিমগ্ন থেকেছি। সবি করেছি শুধু আপনার সন্তুষ্টির জন্য। বলা হবে, তুমি অসত্য বলছো। এসব তুমি করেছো খ্যাতি লাভের জন্য। দুনিয়াতে সেই খ্যাতি পেয়ে গেছো, এখন কিছুই পাবে না। এরপর ধনীকে জিজ্ঞেস করে বলা হবে, আমি তোমাকে ধন-সম্পদ দান করেছিলাম। তা দিয়ে তুমি আমার জন্য কী করেছো? সে বলবে, আমি প্রতিটি দ্বীনী ও সামাজিক কাজে তোমার সন্তুষ্টির জন্য দু’হাত খুলে খরচ করেছি। বলা হবে, তুমি মিথ্যুক! এসব করেছো লোকমুখে তোমার দানশিলতার চর্চা হবে এ জন্য। দুনিয়াতে তোমার এ লক্ষ্য হাসিল হয়েগেছে, আমার কাছে এখন তোমার পাওয়ার কিছু নেই। এমনিভাবে শহীদকে জিজ্ঞেস করা হবে। সে বলবে, আল্লাহ! তোমার-দেয়া জিনিসগুলির মাঝে সবচে দামী ছিলো আমার জান। আমি সেটাই তোমার জন্য কোরবান করেছি। বলা হবে, তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি যুদ্ধে অংশ নিয়েছো বীরত্ব ও বাহাদুরিতে বিখ্যাত হবার আশায়। দুনিয়াতে তোমার সেই খ্যাতি হয়ে গেছে। এরপর এই তিন ব্যক্তিকে উপুড় করে হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার আদেশ দেয়া হবে এবং তদনুযায়ী তারা দোযখে নিক্ষিপ্ত হবে। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯০৫

দ্বীনী ভাই ও বোন!

উল্লিখিত হাদীসের আলোকে আমাদের আমলগুলি যাচাই করা এবং আমলের মাঝে এখলাস পয়দা করা একান্ত কতর্ব্য। আল্লাহ পাক আপন ফজল ও করমে আমাদেরকে এখলাছ দান করুন। নিয়তকে বিশুদ্ধ করার তাওফীক দিন এবং আমাদেরকে তাঁর মুখলিস বান্দাদের মাঝে শামিল করে নিন, আমীন।

আরও জানুন

তরজমাসহ কুরআন কি কুরআনের মতো সম্মানিত?

প্রশ্ন আসসালামু অলাইকুম। আমি জানতে চাই এক খন্ডের যেসব তাফসীর পাওয়া যায় সেগুলোতে পূর্ন আরবী …