প্রশ্ন
From: মুহাম্মাদ জহিরুল ইসলাম
বিষয়ঃ ছিলাহুল মুমিনীন কিতাবের রিজিক বৃদ্ধির হাদিস কি সহিহ?
প্রশ্নঃ
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ
হযরত
ছিলাহুল মুমিনিন কিতাবের ৬১পৃষ্ঠার ৭১নং নিম্নের হাদিসটি কি সহিহ, মেহেরবানী করে জানাবেন , হাদিসটি ঠিক নাকি ঠিক না এই আশংকায় আমলও করতে পারছি না ৷
রিজিক বৃদ্ধির দোয়া:
উচ্চারণঃ সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহী সুবহানাল্লাহীল আজীমি ওয়া বিহামদিহী আস্তাগফিরুল্লাহ
ফজিলতঃ হুজুর সাঃ বলেন, এই দোয়া প্রত্যহ ফজর নামাজের পূর্বে বা পরে ১০০ বার করে পড়, সংসার দুনিয়া আপনা আপনি তোমার দিকে ফিরবে অর্থাত দুনিয়া তোমাকে হেয় ও লাঞ্ছিত অবস্থায় ধরা দিবে এবং এতদ্ভিন্ন আল্লাহতায়ালা এর একেকটি শব্দ হতে এক একেক জন ফেরেশতা তৈরী করে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত তসবীহ পাঠে নিযুক্ত করে দিবেন উহার সমুদয় সোয়াব তুমি পাবে এর মুল বক্তব্য হচ্ছে এস্তেগফার। বলাবাহুল্য গুনাহের কারনেই মানুষের রিজিকের সঙ্কীর্নতা এবং সকল প্রকার দুঃখ কষ্ট ও পেরেশানী ঘটে থাকে। এই আমল নিয়মিত করার মাধ্যমে সংসারে কোন অভাব অনটন থাকতেই পারে না।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
আমরা প্রথমে ছিলাহুল মুমিনীন কিতাবের বর্ণনাটি আগে দেখে নেইঃ
হযরত ইবনে ওমর রাঃ বর্ণনা করেন, এক সময় জনৈক ব্যক্তি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমীপে আরয করলঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! দুনিয়া আমাকে পরিত্যাগ করেছে এবং আমি রিক্ত হস্তে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। আমার পরিত্রানের কোন উপায়া আছে কি? তদুত্তরে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি কোথায় আছ? (ইহলোকে না পরলোকে) সালাতে মালায়েকা (ফেরেশতাগণের দুআ) এবং তাসবীহে খালায়েক যার বদৌলতে ফেরেশতাগণকে রিজিক প্রদান করা হয় তা তোমার কাছে থেকে কোথায় গেল? যে দুআ ও প্রার্থনার বরকতে ফেরেশতাকুল এবং মানব জাতি স্ব স্ব জীবিকা প্রাপ্ত হয়ে থাকে তা কি তুমি জান না? সে ব্যক্তি আরয করলঃ সেই দুআ কি? তিনি বলেলনঃ
سبحان الله وبحمده سبحان الله العظيم وبحمده استغفر الله
এই দুআ প্রত্যতহ ফজরের নামাযের পূর্বে কিংবা পরে একশত বার করে পড়তে আরম্ভ কর। সংসার, দুনিয়া আপনা আপনি তোমার দিকে ফিরবে অর্থাৎ দুনিয়া তোমাকে হেয় ও লাঞ্ছিত অবস্থায় ধরা দিবে এবং এতদ্ভিন্ন আল্লাহ তাআলা এর এক একটি শব্দ হতে এক একজন ফেরেশতা সৃষ্টি করে কিয়ামত দিব স পর্যন্ত তাসবীহ পাঠে নিযুক্ত করে দিবেন উহার সমুদয় সওয়াব তুমি পাবে। [ছিলাহুল মু’মিন-৬১-৬২]
উপরোক্ত বর্ণনাটির আরবী পাঠ হল,
جاء رجلٌ إلى رسولِ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم فشكَا إليه فقرًا أو ديْنًا فقال له رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم : فأين أنت من صلاةِ الملائكةِ ، وتسبيحِ الخلائقِ ، وبها يُنزِلُ اللهُ الرِّزقَ من السَّماءِ ؟ قال ابنُ عمرَ : فقلتُ : وما ذاك يا رسولَ اللهِ ؟ قال : فاستوَى رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم قاعدًا ، وكان مُتَّكِئًا ، فقال : يا بنَ عمرَ تقولُ من طلوعِ الفجرِ إلى صلاةِ الصُّبحِ : سبحانَ اللهِ وبحمدِه سبحانَ اللهِ العظيمِ ، وأستغفِرُ اللهَ مائةَ مرَّةٍ ، تأْتِك الدُّنيا راغمةً ذاخرةً ، ويخلقُ اللهُ عزَّ وجلَّمن كلِّ كلمةٍ تقولُها ملَكًا يُسبِّحُ ، لك ثوابُه إلى يومِ القيامةِ
বর্ণনাটির ব্যাপারে মুহাদ্দিসীনে কেরামের মন্তব্য হলঃ
১
ইবনে হিব্বান রহঃ বলেনঃ এটি জাল বর্ণনা। [আলমাজরূহীন-১/১৪৮]
২
ইবনে যাওজী রহঃ বলেন, এটি সহীহ নয়। [মাওযূআতে ইবনুল যাওজী-৩/৪১৮]
৩
ইবনে ইরাক আলকিনানী বলেন, জঈফ। [তানযীহুশ শরীয়াহ-২/৩১৮]
৪
ইবনে আদী রহঃ বলেন, এটির সনদ বাতিল। [আলকামিল ফিজযুআফা-১/৫৫৮]
৫
ইমাম যাহাবী বলেন, এর সনদে ইসহাক রয়েছে তিনি মারাত্মক পর্যায়ের মুনকারুল হাদীস। [তারতীবুল মাওযূআত-২৭৬]
মুহাদ্দিসীনে কেরামের উপরোক্ত মন্তব্য থেকে আমাদের কাছে পরিস্কার যে, উপরোক্ত বর্ণনাটি জাল ও বানোয়াট। সুতরাং এটিকে হাদীস বিশ্বাস করার কোন সুযোগ নেই।
উপরোক্ত বর্ণনাটি এবং তাতে বর্ণিত ফযীলতটি জাল ও বানোয়াট হলেও এখানে বর্ণিত দুআটি জাল বা বানোয়াট নয়। বরং বিশুদ্ধ। এর অনেক ফযীলত হাদীসের কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَلِمَتَانِ خَفِيفَتَانِ عَلَى اللِّسَانِ ثَقِيلَتَانِ فِي الْمِيزَانِ حَبِيبَتَانِ إِلَى الرَّحْمٰنِ سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ سُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيمِ
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দু’টি কলেমা যা জবানে অতি হাল্কা, মীযানে ভারী, আর রাহমানের নিকট খুব পছন্দনীয়; তা হচ্ছে ‘সুবহানাল্লাহ্ ওয়া বিহামদিহী, সুবহানাল্লাহিল আযীম’। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৬৬৮২]
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ “ مَنْ قَالَ سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ. فِي يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ حُطَّتْ خَطَايَاهُ، وَإِنْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ الْبَحْرِ
আবূ হুরাইরাহ হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক প্রতিদিন একশ’বার সুবাহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহ বলবে তার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেয়া হবে তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হলেও। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৬৪০৫]
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” مَنْ قَالَ: حِينَ يُصْبِحُ وَحِينَ يُمْسِي: سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ، مِائَةَ مَرَّةٍ، لَمْ يَأْتِ أَحَدٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، بِأَفْضَلَ مِمَّا جَاءَ بِهِ، إِلَّا أَحَدٌ قَالَ مِثْلَ مَا قَالَ أَوْ زَادَ عَلَيْهِ
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সকাল ও সন্ধ্যায় পাঠ করবে “সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহী” একশত বার। কিয়ামতের দিন সে যত বেশি সওয়াব নিয়ে উঠবে তার সমতূল্য কেউ হবে না। তবে যদি তার মত কেউ পড়ে বা এর চেয়ে কেউ বেশি পড়ে। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৬৯২]
يُحَدِّثُ ابْنَ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللهِ، فَإِنِّي أَتُوبُ، فِي الْيَوْمِ إِلَيْهِ مِائَةَ، مَرَّةٍ
হযরত ইবনে উমর রাঃ বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, হে লোকেরা! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর, কেননা, আমি প্রতিদিন একশতবার আল্লাহর কাছে তওবা করি। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৭০২]
উপরোক্ত হাদীসগুলো প্রমাণ করে প্রশ্নে উল্লেখিত জিকির বা দুআটি মূলত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু এর যে ফযীলত প্রশ্নের হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে উপরোক্ত হাদীসটি সঠিক নয়। জাল ও বানোয়াট।
তবে যেহেতু দুআটি সহীহ। এর দ্বারা অনেক সওয়াব পাওয়া যায়। তাই এটি পড়া উচিত।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা-জামিয়া ফারুকিয়া দক্ষিণ বনশ্রী ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]