আল্লামা আব্দুল মতীন দামাত বারাকাতুহু
নামাযে বাম কব্জির উপর ডান হাত রেখে দু’আঙ্গুল দ্বারা চেপে ধরা সুন্নত। একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা এ আমল প্রমাণিত । চার মাযহাবের সকল ইমাম ও আলেম এটাকেই সুন্নত পদ্ধতি আখ্যা দিয়েছেন। পক্ষান্তরে কনুই পর্যন্ত হাত রাখার পক্ষে কোন হাদীস নেই। পূর্বসূরিগণের কারো আমলও নেই। এমনিভাবে নাভির নীচে হাত রাখা সুন্নত। ইমাম আবূ হানীফা র. ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র. দুজনই এটাকে সুন্নত বলেছেন। ইমাম মালেক রহ. এর মত হলো, ফরজ নামাযে হাত ছেড়ে রাখা সুন্নত। আর ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেছেন, বুকের নীচে হাত বাঁধা সুন্নত।
বুকের উপর হাত বাঁধাকে চার ইমামের কেউই সুন্নত বলেননি। কোন মুহাদ্দিস বুকের উপর হাত বেঁধেছেন এমন তথ্যও পাওয়া যায়নি। এমনকি কোন মুহাদ্দিস এ সম্পর্কে কোন শিরোনামও উল্লেখ করেন নি। এসম্পর্কে যে হাদীসটি পেশ করা হয় সেটি সহীহ নয়। এ আলোচনার শেষ দিকে সেটি সম্পর্কে বিস্তারিত পর্যালোচনা আসছে। এখানে প্রথমত হাত বাঁধার পদ্ধতি সম্পর্কিত সহীহ হাদীসগুলো পেশ করা হচ্ছে। অতঃপর নাভির নীচে হাত রাখা সম্পর্কে হাদীসগুলো তুলে ধরা হচ্ছে।
হাত বাঁধার নিয়ম সম্পর্কিত হাদীস
১
হযরত সাহল ইবনে সা’দ রা. বলেন,
كَانَ النَّاسُ يُؤْمَرُونَ أَنْ يَضَعَ الرَّجُلُ الْيَدَ الْيُمْنَى عَلَى ذِرَاعِهِ الْيُسْرَى فِي الصَّلَاةِ. صحيح البخاري (٧٤٠ )، موطا مالك برواية أبي مصعب الزهري (৪২৬)، مسند أحمد (২২৮৪৯)، مستخرج أبي عوانة (১৫৯৭)، الطبراني في الكبير (৫৭৭২)، البيهقي (২৩২৬)، البغوي في شرح السنة (৫৬৮)، الأوسط لابن المنذر (১২৮৬).
অর্থ : মানুষকে এই আদেশ দেওয়া হতো যে, তারা যেন নামাযে ডান হাত বাম হাতের বাহুর উপর রাখে। বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৭৪০; মুআত্তা মালেক, হাদীস নং ৪২৬; মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ২২৮৪৯; মুসতাখরাজে আবী আওয়ানা, হাদীস নং ১৫৯৭; তাবারানী ফিল কাবীর, হাদীস নং ৫৭৭২; বায়হাকী, হাদীস নং ২৩২৬; শারহুস সুন্নাহ, হাদীস নং ৫৬৮; আওসাত লিইবনিল মুনযির, হাদীস নং ১২৮৬।
২
হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রা. বলেন,
قُلْتُ لأَنْظُرَنَّ إِلَى صَلاَةِ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- كَيْفَ يُصَلِّى فنظرت إليه فَقَامَ فَكَبَّرَ وَرَفَعَ يَدَيْهِ حَتَّى حَاذَتَا بأُذُنَيْهِ ثُمَّ وَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى كَفِّهِ الْيُسْرَى وَالرُّسْغِ وَالسَّاعِدِ. أخرجه أبو داود (٧٢٧) والنسائي (٨٨٩) واللفظ له وأحمد ٤/٣١٨ وابن خزيمة (٤٨٠) وابن حبان (১৮৬০) وابن الجارود في المنتقى (২০৮) والبيهقي في السنن (২/২৭) بإسناد صحيح.
অর্থ: আমি (মনে মনে) বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে নামায পড়েন তা আমি লক্ষ্য করবো। আমি লক্ষ্য করলাম, তিনি দাঁড়িয়ে তাকবীর বললেন এবং উভয় হাত কান বরাবর তুললেন। অতঃপর তাঁর ডান হাত বাম হাতের পিঠ, কব্জি ও বাহুর উপর রাখলেন।
আবূ দাউদ শরীফ, হাদীস নং ৭২৭; নাসাঈ শরীফ, হাদীস নং ৮৮৯; মুসনাদে আহমদ ৪খ, ৩১৮পৃ; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস নং ৪৮০; ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ১৮৬০; আলমুনতাকা লিইবনিল জারূদ, হাদীস নং ২০৮ ও বায়হাকী ২খ. ২৭ পৃ.। এ হাদীসটি সহীহ।
ইবনে খুযায়মা র. উক্ত হাদীসের উপর শিরোনাম দিয়েছেন,
باب وضع بطن الكف اليمنى على الكف اليسرى والرسغ والساعد جميعا
অর্থাৎ ডান হাতের তালু বাম হাতের তালুর পিঠ, কব্জি ও বাহু সবগুলোর উপর রাখবে।
একইভাবে ইবনুল মুনযির রহ. তার আল আওসাত গ্রন্থে শিরোনাম দিয়েছেন,
ذكر وضع بطن كف اليمنى على ظهر كف اليسرى والرسغ والساعد جميعا
অর্থাৎ ডান হাতের তালু বাম হাতের তালুর পিঠ কব্জি ও কব্জিসংলগ্ন বাহুর উপর রাখার আলোচনা।
وعند الدارمي ١/٢٨٣ بإسناد صحيح في حديث وَائِلٍ قَالَ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ يَضَعُ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى الْيُسْرَى قَرِيباً مِنَ الرُّصْغِ .
অর্থাৎ দারিমী র. এর এক বর্ণনায় সহীহ সনদে ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডান হাত বাম হাতের কব্জির কাছাকাছি রাখতে দেখেছি। সুনানে দারিমী, ১খ, ২৮৩পৃ।
আবূ দাউদ শরীফের আরেক বর্ণনায় আছে,
ثم أخذ شماله بيمينه
অর্থাৎ অতঃপর তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ডান হাত দ্বারা বাম হাত ধরলেন।
সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৭২৬; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৮৮৫০; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ১২৬৫; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ৪৭৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৯৪৫; মুজামে কাবীর লিত তাবারানী, ২২/৩৩; সুনানে বায়হাকী, হাদীস ২৫১৬।
৩
হযরত হুলব আততাঈ রা. বলেন,
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يؤمنا فيأخذ شماله بيمينه. أخرجه الترمذي (٢٥٢) وابن ماجه (٨٠٩) وابن أبي شيبة (٣٩٥٥) والدارقطني ١/٢٨٥ وقال الترمذي: حديث حسن.
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ইমাম হতেন। তিনি ডান হাত দ্বারা বাম হাত চেপে ধরতেন। তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং ২৫২; তিরমিযী বলেছেন, এ হাদীসটি হাসান। ইবনে মাজা, হাদীস নং ৮০৯; ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৩৯৫৫।
মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় আছে, বাম হাতের উপর ডান হাত রাখার বিবরণ দিতে গিয়ে ইয়াহইয়া র. ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর রেখেছেন।
৪
হযরত ওয়াইল রা. বর্ণনা করেন,
رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا كان قائما في الصلاة قبض بيمينه على شماله. أخرجه النسائي رقم ٨٨٧ ، والدارقطني رقم ١١٠٤. وقال الألباني : صحيح الإسناد
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তিনি যখন নামাযে দাঁড়াতেন ডান হাত দিয়ে বাম হাত চেপে ধরতেন। নাসাঈ, হাদীস নং ৮৮৭, দারাকুতনী, হাদীস নং ১১০৪। আলবানী বলেছেন, সনদ সহীহ।
৫
হযরত শাদ্দাদ ইবনে শুরাহবীল রা. বলেন,
رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم قائما يده اليمنى على يده اليسرى قابضا عليها يعني في الصلاة . رواه البزار والطبراني .ذكره الهيثمي في مجمع الزوائد ٢/٢٢٥ وقال: وفيه عباس بن يونس ولم أجد من ذكره تعليق-١
অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলাম, তিনি দাঁড়ানো অবস্থায় ডান হাত দিয়ে বাম হাত চেপে ধরে আছেন। অর্থাৎ নামাযে। বাযযার ও তাবারানী এটি উদ্ধৃত করেছেন। (দ্র, মাজমাউয যাওয়াইদ, ২খ, ২২৫ পৃ)
৬
জারীর আদ দাব্বী বলেন,
كان عليّ إذا قام في الصلاة وضع يمينه على رسغه .أخرجه ابن أبي شيبة (٣٩٦١) موصولا والبخاري تعليقا قبل حديث رقم ١١٩٨. كتاب العمل في الصلاة ، باب إستعانة اليد في الصلاة الخ ولفظ البخاري : ووضع عليّ كفه على رسغه الأيسر إلا أن يحكَّ جلدا أو يصلح ثوبا.
অর্থ: আলী রা. যখন নামাযে দাঁড়াতেন তখন তাঁর ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর রাখতেন।
মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৩৯৬১; বুখারী শরীফ, ১১৯৮নং হাদীসের পূর্বে, বায়হাকী, হাদীস নং ২৩৩৩। এ হাদীসটির সনদ সহীহ।
বুখারী শরীফে এটি এভাবে এসেছে, আলী রা. তার (ডান) হাতের তালু বাম হাতের কব্জির উপর রাখেন। তবে শরীর চুলকানো বা কাপড় ঠিক করার জন্য হলে ভিন্ন কথা। (অর্থাৎ তখন ডান হাত সরানোর প্রয়োজন পড়ত।)
এ হাদীসগুলোর কোন কোনটি থেকে বোঝা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাম হাতের উপর ডান হাত রাখতেন। আর কোন কোনটি থেকে বোঝা যায়, তিনি ডান হাত দ্বারা বাম হাত চেপে ধরতেন। কিন্তু বাম হাতের কোন জায়গা চেপে ধরতেন? অধিকাংশ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তিনি বাম হাতের কব্জি চেপে ধরতেন।
এসব হাদীসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে চার মাযহাবের আলেমগণ সেই পদ্ধতিকেই অবলম্বন করেছেন যেভাবে হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণ আমল করে থাকেন।
ইমাম মুহাম্মদ বলেছেন, ويضع بطن كفه الأيمن على رسغه فيكون الرسغ في وسط الكف অর্থাৎ ডান হাতের তালু বাম হাতের কব্জির উপর রেখে নাভির নীচে বাঁধবে। তাহলে কব্জি হাতের তালুর মাঝখানে থাকবে। (কিতাবুল আছার, হা. ১২০)
হালবী র. মুনয়াতুল মুসাল্লী এর ভাষ্যগ্রন্থে লিখেছেন,
السنة أن يجمع بين الوضع والقبض جمعا بين ما ورد في الأحاديث المذكورة إذ في بعضها ذكر الأخذ وفي بعضها ذكر وضع اليد وفي البعض وضع اليد على الذراع فكيفية الجمع أن يضع الكف اليمنى على الكف اليسرى ويحلق الإبهام والخنصر على الرسغ ويبسط الأصابع الثلاث على الذراع فيصدق أنه وضع اليد على اليد وعلى الذراع وأنه أخذ شماله بيمينه اهـ
অর্থাৎ উল্লিখিত হাদীসগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের পর সাব্যস্ত হয় যে, হাত রাখা ও বাঁধা দুটির উপরই একসঙ্গে আমল করা সুন্নত। কারণ, কিছু হাদীসে চেপে ধরার কথা এসেছে। আর কিছু হাদীসে হাত রাখার কথা এসেছে। অপর কিছু হাদীসে বাহুর উপর হাত রাখার কথা এসেছে। এগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের পদ্ধতি হলো, ডান হাতের তালু বাম হাতের পিঠের উপর রাখবে, বৃদ্ধাঙ্গুলি ও কনিষ্ঠা আঙ্গুলি দ্বারা কব্জি চেপে ধরবে, আর বাকি তিন আঙ্গুল বাহুর উপর বিছিয়ে দিবে। তাহলে হাতের উপর হাত রাখা, বাহুর উপর হাত রাখা এবং ডান হাত দ্বারা বাম হাত (চেপে) ধরা, সবগুলোই হাসিল হবে।
লক্ষ্য করুন, হানাফী আলেমগণ কিভাবে হাদীসগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে সবগুলো অনুসারে আমল করতে বলেছেন! একেই বলে হাদীসের অনুসরণ!
উল্লেখ্য যে, আহলে হাদীস ভাইয়েরা যেভাবে বাহুর উপর বাহু রাখেন তাতে ওয়াইল রা., হুলব রা. ও শাদ্দাদ রা. প্রমুখ সাহাবীগণ কর্তৃক বর্ণিত হাদীস তিনটি অনুযায়ী কোন আমল হয় না। কারণ এ তিনটি হাদীসে ডান হাত দিয়ে বাম হাত চেপে ধরার কথা বলা হয়েছে।
ইমাম মালেক র. এর প্রসিদ্ধ মত হলো ফরজ নামাযে হাত বাঁধবে না, ছেড়ে রাখবে। সুন্নত ও নফল নামাযে হাত বাঁধবে। হাত বাঁধলে কিভাবে বাঁধবে? আল্লামা উব্বী মালেকী র. মুসলিম শরীফের ভাষ্যগ্রন্থে লিখেছেন,
واختار شيوخنا أن يقبض بكف اليمنى على رسغ اليسرى واختار بعضهم مع ذلك أن تكون السبابة والوسطى ممتدين على الذراع اهـ ٢/٢٧٨
অর্থাৎ আামাদের শায়েখগণ বলেছেন, ডান হাতের তালু দ্বারা বাম হাতের কব্জি চেপে ধরবে। কেউ কেউ একথাও যোগ করেছেন, শাহাদাত ও মধ্যমা আঙ্গুলি যেন বাহুর উপর বিস্তৃত থাকে। (২খ, ২৭৮পৃ)
শাফেয়ী মাযহাব সম্পর্কে ইমাম নববী র. তার ‘আর রাওজাহ’ গ্রন্থে লিখেছেন,
السنة وضع اليمنى على اليسرى فيقبض بكفه اليمنى كوع اليسرى وبعض رسغها وساعدها ١/٣٣٩
অর্থাৎ সুন্নত হলো ডান হাত বাম হাতের উপর এভাবে রাখবে যে, ডান হাতের তালু দ্বারা বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির গোড়ার হাড় এবং কব্জি ও বাহুর অংশবিশেষ চেপে ধরবে। (২খ, ৩৩৯পৃ)
হাম্বলী মাযহাব সম্পর্কে ইবনে মানসূর হাম্বালী র. আররাওযুল মুরবি’ গ্রন্থে লিখেছেন,
ثم يقبض كوع يسراه بيمينه ويجعلهما تحت سرته اهـ ١/١٦٥ وكذا في الإنصاف للمرداوي ٢/٤٥ والفروع لابن مفلح ١/٣٦١
অর্থাৎ অতঃপর বাম হাতের কব্জি ডান হাত দ্বারা চেপে ধরবে, এবং নাভির নীচে রাখবে। (১খ, ১৬৫পৃ); মারদাবী র. আল ইনসাফ গ্রন্থে (২/৪৫) ও ইবনে মুফলিহ র. আল ফুরু’ গ্রন্থে (১/৩৬১) একই কথা বলেছেন।
ইবনে হাযম রহ. এর মত :
আল মুহাল্লা গ্রন্থে ইবনে হাযম জাহিরী লিখেছেন,
ويُستحب أن يضع المصلي يده اليمنى على كوع يده اليسرى في الصلاة.
অর্থাৎ মুস্তাহাব হলো মুসল্লী নামাযে তার ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর রাখবে। (মাসআলা নং ৪৪৮)
শায়খ সালেহ ইবনে ফাওযানের মত :
আরব বিশ্বের খ্যাতিমান আলেম শায়খ সালেহ ইবনে ফাওযানও বলেছেন, السنة أن يقبض المصلي كفه اليسرى بيده اليمنى অর্থাৎ সুন্নত হলো ডান হাত দিয়ে বাম হাতে কব্জি চেপে ধরবে। (ফাতাওয়ায়ে সালিহ ইবনে ফাওযান)
লক্ষ করুন, পৃথিবীর অধিকাংশ আলেম-ওলামার মত কি, আর লা-মাযহাবী ভাইয়েরা কি করেন?
একটি ভুলব্যাখ্যা
যে হাদীসটির ভুল ব্যাখ্যা করে লা-মাযহাবী বন্ধুরা বাম হাতের কনুই পর্যন্ত ডান হাত বিস্তার করে দেন সেটি এখানে ১নং দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসটি বুখারী শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে। হাদীসটি সম্পর্কে বুখারী শরীফের বিখ্যাত ভাষ্যকার হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী র. ফতহুল বারী গ্রন্থে বলেছেন,
أبهم موضعه من الذراع وفي حديث وائل عند أبي داود والنسائي ثم وضع يده اليمنى على ظهر كفه اليسرى والرسغ والساعد وصححه ابن خزيمة وغيره وسيأتي أثر علي نحوه في أواخر الصلاة. ٢/٢٧٥
অর্থাৎ বাম বাহুর কোন জায়গায় ডান হাত রাখতেন সেটা এই হাদীসে অস্পষ্ট। আবূ দাউদ ও নাসাঈ বর্ণিত ওয়াইল রা. এর হাদীসে বলা হয়েছে: অতঃপর তিনি তাঁর ডান হাত বাম হাতের পিঠ, কব্জি ও বাহুর উপর রাখলেন। ইবনে খুযায়মা র. প্রমুখ এটিকে সহীহ বলেছেন। সালাত অধ্যায়ের শেষ দিকে হযরত আলী রা. এর অনুরূপ আছার (আমল) এর উল্লেখ আসছে। (২খ, ২৭৫ পৃ)
একইভাবে শাওকানী সাহেবও নায়লুল আওতার গ্রন্থে বলেছেন,
قوله ( على ذراعه اليسرى ) أبهم هنا موضعه من الذراع وقد بينته رواية أحمد وأبي داود في الحديث الذي قبل هذا . )وقال تحت الحديث الذي قبله:( والمراد أنه وضع يده اليمنى على كف يده اليسرى ورسغها وساعدها . ولفظ الطبراني : ( وضع يده اليمنى على ظهر اليسرى في الصلاة قريبًا من الرسغ ) ٢/١٨٧
অর্থাৎ হাদীস শরীফে যে বলা হয়েছে ‘বাম বাহুর উপরে’, বাহুর কোন জায়গায় তা এখানে অস্পষ্ট। আহমদ ও আবূ দাউদ শরীফে বর্ণিত পূর্বের হাদীসটিতে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
আহমদ ও আবূ দাউদ বর্ণিত পূর্বের হাদীসটি আলোচনা প্রসঙ্গে শাওকানী সাহেব বলেছেন, এর মর্ম হলো তিনি তাঁর ডান হাত বাম হাতের তালুর পিঠ, কব্জি ও বাহুর উপরে রেখেছেন। তাবারানী র. এর বর্ণনায় এসেছে: তিনি নামাযে তাঁর ডান হাত বাম হাতের পিঠের উপর কব্জির কাছাকাছি রেখেছেন। (২খ. ১৮৭ পৃ)
লা-মাযহাবী ঘরানার শীর্ষ আলেম নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান তাঁর বুখারী শরীফের আরবী ভাষ্যগ্রন্থ আওনুল বারীতে বুখারীর হাদীসটির ব্যাখ্যায় লিখেছেন:
أي على ظهر كفه اليسرى والرسغ من الساعد (২/৫৪০)
অর্থাৎ বাম হাতের তালুর পিঠ ও কব্জির উপর রাখবে। (২/৫৪০)
শায়খ আব্দুল আযীয ইবনে বায রহ.ও তাঁর ফাতাওয়ায় বলেছেন, فيضع كف اليمنى على كف اليسرى অর্থাৎ ডান হাতের তালু বাম হাতের তালুর পিঠে রাখবে। তিনি বুখারী রহ. বর্ণিত হযরত সাহল ইবনে সাদ রা. এর হাদীসটি উল্লেখ করার পর বলেন,
فدل ذلك على أن المصلي إذا كان قائما يضع يده اليمنى على ذراعه اليسرى , والمعنى على كفه والرسغ والساعد لأن هذا هو الجمع بينه وبين رواية وائل بن حجر فإذا وضع كفه على الرسغ والساعد فقد وضعت على الذراع ؛ لأن الساعد من الذراع , فيضع كفه اليمنى على كفه اليسرى وعلى الرسغ والساعد كما جاء مصرحا في حديث وائل المذكور
অর্থাৎ বোঝা গেল মুসল্লি দাঁড়ানো অবস্থায় তার ডান হাত বাম যেরার উপর রাখবে। তার মানে বাম হাতের তালুর পিঠ, কব্জি ও কব্জি সংলগ্ন বাহুর উপর রাখবে। কেননা এতে করে এই হাদীস এবং হযরত ওয়াইল রা. এর বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় সাধিত হবে। সে যখন ডান হাত বাম হাতের পিঠ, কব্জি ও কব্জি সংলগ্ন বাহুতে রাখবে তখন যেরার উপর রেখেছে বলেও বিবেচিত হবে। কারণ কব্জি সংলগ্ন বাহু (الساعد) তো যেরা বা বাহুরই অংশ। তাই মুসল্লি তার ডান হাতের তালু বাম হাতের পিঠ, কব্জি ও কব্জি সংলগ্ন বাহুর উপর রাখবে। যেমনটি হযরত ওয়াইল রা.এর হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। (মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে বায, ১১/৩১)
আলবানী সাহেবও আসলু সিফাতিস সালাহ, তালখীসু সিফাতিস সালাহ (নং ৩৭) ও আহকামুল জানাইয (নং ৭৬) গ্রন্থত্রয়ে লিখেছেন,
وكان صلى الله عليه وسلم يضع اليمنى على ظهر كفه اليسرى والرسغ والساعد
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ডান হাত বাম হাতের তালুর পিঠ, কব্জি ও বাহুর উপর রাখতেন।
এসব থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, লা-মাযহাবী ভাইয়েরা হাদীসটির ভুল অর্থ বুঝে কনুই পর্যন্ত হাত বিস্তার করে থাকেন।
নাভির নীচে হাত রাখার দলিল
১
হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রা. বলেন,
رأيت النبي صلى الله عليه وسلم وضع يمينه على شماله في الصلاة تحت السرة. أخرجه ابن أبي شيبة قال: حدثنا وكيع عن موسى بن عمير عن علقمة بن وائل عن أبيه وإسناده صحيح. قال الحافظ قاسم بن قطلوبغا في تخريج أحاديث الاختيار شرح المختار : هذا سند جيد وقال الشيخ أبو الطيب السندي في شرحه على الترمذي : هذا حديث قوي من حيث السند وقال الشيخ عابد السندي في طوالع الأنوار: رجاله كلهم ثقات أثبات اهـ
অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে নাভির নীচে রাখতে দেখেছি। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৩৯৫৯। এর সনদ সহীহ।
হাফেজ কাসিম ইবনে কুতলূবুগা র., তিরমিযী শরীফের ভাষ্যকার আবুত্ তায়্যিব সিন্ধী র. ও আল্লামা আবেদ সিন্ধী র. প্রমুখ হাদীসটিকে মজবুত ও শক্তিশালী বলেছেন। এর সনদ এরূপ: ইবনে আবী শায়বা র. বর্ণনা করেছেন ওয়াকী’ থেকে, তিনি মূসা ইবনে উমায়ের থেকে, তিনি আলকামার সূত্রে হযরত ওয়াইল রা. থেকে। এই সনদে কোন দুর্বল রাবী নেই।
এ হাদীসটি সম্পর্কে কেউ কেউ শুধু এতটুকু আপত্তি উত্থাপন করেছেন যে, মুসান্নাফের কোন কোন পা-ুলিপিতে এটি বিদ্যমান নেই। কিন্তু এ আপত্তি হাদীসের অনেক কিতাবের ক্ষেত্রেই চলে। তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ, সহীহ ইবনে হিব্বান প্রভৃতি কিতাব দেখুন, এক পা-ুলিপিতে এমন কিছু হাদীস পাওয়া যায়, যা অন্য পা-ুলিপিতে নেই। তিরমিযী শরীফের মুবারকপুরী, আহমাদ শাকের ও শুআয়ব আরনাউতের তিন কপিতেই এ তারতম্য দেখা যায়। সুতরাং এটা কোন আপত্তি হতে পারে না। যারা নিজের চোখে হাদীসটি মুসান্নাফে দেখেছেন তাদের কথাই গ্রহণযোগ্য হবে।
২
হযরত আলী রা. বলেন,
السُّنَّةُ وَضْعُ الْكَفِّ عَلَى الْكَفِّ فِى الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّةِ. أخرجه أبو داود (في رواية ابن الأعرابي وابن داسة) ٧٥٦ وأحمد ١/١١٠ (٨٧٥) وابن أبي شيبة (٣٩٦٦) والدارقطني ١/٢٨٦ والضياء في المختارة ٢/٧٧٢ وفيه عبد الرحمن بن إسحاق الواسطي وهو ضعيف. ولكن يشهد له الحديث السابق.
অর্থ: সুন্নত হলো তালু নামাযের সময় তালুর উপর রেখে নাভির নীচে রাখা। আবূ দাউদ শরীফ, হাদীস নং ৭৫৬; মুসনাদে আহমদ ১খ, ১১০ পৃ, হাদীস নং ৮৭৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৩৯৬৬; দারাকুতনী, ১খ, ২৮৬পৃ; যিয়া ফিল মুখতারা, ২খ, ৭৭২পৃ।
এর সনদে আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক রয়েছেন। তিনি দুর্বল। তবে প্রথম হাদীসটি এর সমর্থন করছে।
৩
হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেছেন,
أَخْذُ الأَكُفِّ عَلَى الأَكُفِّ فِى الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّةِ. أخرجه أبو داود (٧٥٨) وفيه عبد الرحمن المذكور.
অর্থ: নামাযে হাতের তালু অপর তালুর উপর রেখে নাভির নীচে রাখতে হবে। আবূ দাউদ শরীফ, হাদীস নং ৭৫৮।
এতেও পূর্বোক্ত আব্দুর রহমান রয়েছেন।
৪
হযরত আনাস রা. বলেছেন,
ثلاث من أخلاق النبوة تعجيل الإفطار وتأخير السحور ووضع البد اليمنى على اليسرى في الصلاة تحت السرة. أخرجه ابن حزم في المحلى تعليقا ٣/٣٠
অর্থ: তিনটি বিষয় নবীস্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। ইফতারে বিলম্ব না করা, সাহরী শেষ সময়ে খাওয়া, এবং নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে নাভির নীচে রাখা। ইবনে হাযম, আল মুহাল্লা, ৩খ, ৩০পৃ। তিনি এর সনদ উল্লেখ করেন নি।
৫
হাজ্জাজ ইবনে হাসসান র. বলেন,
سمعت أبا مجلز أو سألته قال : قلت كيف يصنع قال : يضع باطن كف يمينه على ظاهر كف شماله ويجعلها أسفل من السرة . أخرجه ابن أبي شيبة في مصنفه. (٣٩٦٣)
অর্থ: আমি আবূ মিজলায র. (বিশিষ্ট তাবেয়ী)কে বলতে শুনেছি, অথবা হাজ্জাজ বলেছেন, আমি আবূ মিজলায র.কে জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে হাত বাঁধবে? তিনি বললেন, ডান হাতের তালু বাম হাতের তালুর পিঠে রেখে নাভির নীচে বাঁধবে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৩৯৬৩। এর সনদ সহীহ।
৬
ইবরাহীম নাখায়ী র. (যিনি তাবেয়ী ছিলেন) বলেন,
يضع يمينه على شماله في الصلاة تحت السرة . أخرجه ابن أبي شيبة ٣٩٦٠
অর্থ: নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে নাভির নীচে বাঁধবে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৩৯৬০ । এর সনদ হাসান।
ইমাম বুখারীর উস্তাদ ইসহাক ইবনে রাহাওয়াই বলেছেন,
تحت السرة أقوى في الحديث وأقرب إلى التواضع.
অর্থাৎ নাভির নীচে হাত বাঁধার হাদীস অধিক শক্তিশালী এবং বিনয়ের নিকটতর। মাসাইলুল ইমাম আহমদ ওয়া ইসহাক, লি ইসহাক ইবনে মানসুর আলকাওসাজ, মৃত্যু ২৫১, নং ২১৪ ; ইবনুল মুনযির, আলআওসাত, ৩খ,২৪৩ পৃ|
পরবর্তী লেখাটি পড়ুন