প্রশ্ন
হাকীমুল উম্মাত মাওলানা থানবীর জন্ম বৃত্তান্ত অলৌকিক ঘটনার সহিত জড়িত। তাঁর পিতার কোন পুত্র সন্তানই জীবিত থাকত না। তদুপরি তিনি এক দূরারোগ্য চর্মরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকদের পরামর্শে এমন এক ঔষধ সেবন করেন যাতে তার প্রজনন ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে রহিত হয়ে যায়। এতে হাকীমুল উম্মাতে মাতামহী নেহায়েত বিচলিত হয়ে পড়েন। একদা তিনি হাফিয গোলাম মর্তজা সাহেব পানিপথীর খিদমাতে এ বিষয়টি আরয করেন। হাফিজ সাহেব ছিলেন মজযুব। তিনি বলেন, “উমার ও ‘আলীর টানাটানিতেই পুত্র সন্তানগুলো মারা যায়। এবার পুত্র সন্তান জন্মিলে ‘আলীর সোপর্দ করে দিও। ইনশাআল্লাহ জীবিত থাকবে। তাঁর এ হেয়ালী কেউই বুঝতে পারলেন না। পূর্ণ কথার সারমর্ম একমাত্র মাওলানার বুদ্ধিমতী জননীই বুঝলেন, আর তিনি বললেন, হাফিয সাহেবের কথার অর্থ সম্ভবত: এই যে, ছেলের পিতৃকুল ফারূকী। আর আমি ‘আলি (রাঃ) এর বংশধর। এযাবৎ পুত্র সন্তানদের নাম রাখা হচ্ছিল পিতার নামানুকরণে, অর্থাৎ ‘হক’ শব্দ যোগে রাখা হয়েছিল। যেমন আব্দুল হক, ফাজলে হক ইত্যাদি।
এবার পুত্র সন্তান জন্মিলে মাতৃকূল অনুযায়ী নাম রাখতে অর্থাৎ আমার উর্দ্ধতন আদি পুরুষ ‘আলী (রাঃ) এর নামের সহিত মিল রেখে নামকরণের কথা বলেছেন। এটা শুনে হাফিয সাহেব সহাস্যে বলে উঠলেন, বাহবা! মেয়েটি বড়ই বুদ্ধিমতী বলে মনে হয়। আমার উদ্দেশ্য এটাই ছিল। এর গর্ভে দু‘টি ছেলে হবে। ইনশাআল্লাহ উভয়ই বেঁচে থাকবে এবং ভাগ্যবান হবে। একজনের নাম রাখবে আশরাফ আলী, অপরজনের নাম রাখবে আকবর আলী। একজন হবে আমার অনুসারী, সে হবে আলিম ও হাফিয। অপরজন হবে দুনিয়াদার। বস্তুতঃ তা-ই হয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা এক বুযুর্গের দ্বারা থানবী মাতৃগর্ভে আসার পূর্বে অর্থাৎ আলমে আরওয়াহে থাকাকালীন তাঁর নাম রেখে দিলেন। আল্লাহ তা‘আলার কত বড় মেহেরবানী। কত বড় সৌভাগ্যের কথা!
বইটির ১ম পৃষ্ঠা পড়লে পাঠক অবগত হবেন যে, আশরাফ আলী থানবীর পিতৃপুরুষ ‘উমার (রাঃ) এবং মাতৃকূল আলী (রাঃ) থেকে। থানবী সাহেবের পিতার কোন সন্তান জীবিত থাকত না, কেননা তাদের নাম রাখ হয়েছিল ‘উমার (রাঃ) এর নামে। ফলে ‘উমার ও ‘আলীর টানাটানিতেই পুত্র সন্তানগুলো মারা যায়। এ যেন ঠিক চাঁদসাওদাগরের কিসসা কাহিনীর মত এক দেবতা তুষ্ট হলে অন্য দেবতা রুষ্ট হয়।
আল্লাহ ইরশাদ করেন :
“তিনিই হাসান, তিনিই কাঁদান, তিনিই মৃত্যু দেন, তিনিই জীবন দান করেন। তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল পুরুষ ও নারী স্খলিত কীট বিন্দু হতে।” (সূরা আন-নাজম ৪৩-৪৬)
মহান আল্লাহ আরো বলেন :
“আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদেরকে রিযক (জিবনোপকরণ) দিয়েছেন। তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটান ও পরে তোমাদের জীবিত করেন। আল্লাহতো তাঁর কার্যে কোন অংশীদারী থেকে বহু ঊর্দ্ধে এবং পূতময় মহান। (সূরা রূম-৪০)
মুশরিকদের জবাবে নাবী ইবরাহীম (আঃ) বলেন ঃ
“তিনি আমাকে দান করেন আহার্য ও পানীয় এবং রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন। তিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর পুনর্জীবিত করবেন।” (সূরা শু‘আরা-৭৯৮১)
এছাড়াও কুরআন মাজীদের আরও বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, একমাত্র তিনি প্রাণ ও মৃত্যু ঘটানোর মালিক।
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূল (সঃ) বলেন, মানুষের মৃত্যু হলে তার সমস্ত ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। (সহীহ মুসলিম)
তাহলে ‘উমার বা ‘আলী (রাঃ) কারোর মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম? ‘আলী (রাঃ) -এর সেই ক্ষমতা থাকলে কারবালার ময়দানে তাঁর পুত্র-পৌত্র হত্যাকারীদের ‘টানাটানি’ করে মেরে ফেলতে পারতেন না? জীবিতবস্থায় ‘আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ) রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে সম্মুক-সমরে অবতীর্ণ হয়েছেন, তাদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। তাদের মৃত্যুর পরে সব দ্বন্দ্বের অবসান ঘটেছে। ‘আলী ও মু‘আবিয়ার মরণোত্তর ‘টানাটানির’ খবর তো কেউ শোনে নি কোনদিন। ‘উমার (রাঃ) এর সাথে ‘আলী (রাঃ) জীবিতবস্থায় এমন কোন দ্বন্দ্ব বা রেষারেষি ছিল না যে মৃত্যুর পরেও তা অব্যাহত থাকবে! বরং পরষ্পরের মধ্যে ছিল সুগভীর শ্রদ্ধা, পরম ভালবাসা। খলীফা ‘উমার ইবনুল খাত্তাব ‘আলী (রাঃ)-এর শিশুকন্যা উম্মু কুলসুমকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেন। ‘আলী (রাঃ) বিস্মিত হয়ে বলেন: হে আমীরুল মু‘মিনীন আমার এ ছোট মেয়েটি আপনার কি উপকারে লাগবে? আমীরুল মু‘মিনীন ‘উমার ইবনুল খাত্তাব বললেন : হে ‘আলী! আমি কি কোন উপকারের আশায় তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। আমি তো আত্মীয়তার বাঁধনে আহলুল বায়াতের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করতে চাইছি। ‘আলী (রাঃ) খুশি হয়ে ‘উমার (রাঃ)-এর সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিলেন। খুলাফায়ে রাশেদীনের ইতিহাসে দেখা যায়, ‘উমার ও ‘আলী (রাঃ) পরষ্পরের প্রতি আনুগত্য, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। তাহলে মৃত্যুর পরে তাদের মধ্যে কিভাবে ‘টানাটানি’ শুরু হয়। (নাউযুবিল্লাহিল মিন যালিক। লেখকতো কোন শী‘আ প্রভাবে প্রভাবিত হন নি?)
উপরিউক্ত কথাগুলোর মধ্যে ‘উমার ও ‘আলী (রাঃ) -এর জীবন দান; মৃত্যু ঘটানোর ক্ষমতা ও পরষ্পরের মধ্যে রেসারেষির কথা সুষ্পষ্ট। কিন্তু প্রত্যেক মুসলিম জানে এবং বিশ্বাস করে একমাত্র আল্লাহই পারেন মানুষের জীবন দান করতে এবং মৃত্যু ঘটাতে। আল্লাহ নিজেকে যে বিভিন্ন নামে নামকরণ করেছেন; সে হলো ‘আল-মহী ওয়াল মুমী’ (জীবনদাতা ও মৃত্যুদাতা)।
ওই বইয়ের একই পৃষ্ঠায় ইলমুল গায়িবের খবর জানা পীর গোলাম মুর্তজা পানিপথী সাহেব বলেন, এর গর্ভে দু‘টি ছেলে হবে ইনশাআল্লাহ, উভয়ই বেঁচে থাকবে এবং ভাগ্যবান হবে। একজনের নাম রাখবে আশরাফ আলী, অপরজনের নাম রাখবে আকবর আলী। একজন হবে আমার অনুসারী, সে হবে আলিম ও হাফিয। অপরজন হবে দুনিয়াদার। বস্তুতঃ তা-ই হয়েছিল…………। এ যেন রাম জন্মের পূর্বে রামায়ণের কাহিনী লেখার মত। পীর হাফিয গোলাম মুর্তজা কল্পনা-বিশিষ্ট কবি বাল্মিলিকীর সুন্নাতের অনুসরণ করেছেন।
কুরআন-হাদীস অনুযায়ী ইলমুল গায়িব একমাত্র আল্লাহই জানেন। রসূল ও নাবীগণ ও গায়িবের খবর জানতেন না। অথচ পীর সাহেব গোলাম মুর্তজা (নামটি অশুদ্ধ শিরক ফি তাসমীয়াহ শিরকী নাম বলে মনে হয়)। আশরাফ আলী থানবী ও তার ভাই আকবর আলীর জন্মের অভিষ্যদ্বাণী করেছেন, তাদের নামকরণ করেছেন এবং তাদের ভাগ্য নির্ধারণেরও (ক্বাদর) ভবিষ্যদ্বানী করেছেন। অথচ আল্লাহ কুরআনে বলেন :
“কখন ক্বিয়ামাত হবে তা কেবল আল্লাহই জানেন। তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করে এবং এবং তিনি জানেন যা (জরায়ুতে) মাতৃগর্ভে আছে। কেউ জানে না আগামীকাল সে কি অর্জন করবে এবং জানে না কোন দেশে তার মৃত্যু ঘটবে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে অবহিত।” (সূরা লুক্বমান-৩৪)
উপরোক্ত বক্তব্যটি শায়েখ মুরাদ বিন আমজাদ রচিত “সহীহ আক্বীদার মানদণ্ডে বেহেশতী জেওর ১ম খন্ড থেকে নেয়া।
এক্ষেত্রে আমাদের জানার বিষয় হল, শায়েখ মুরাদ বিন আমজাদের উপরোক্ত অভিযোগের জবাব কী? দয়া করে জানালে কৃতজ্ঞ হবো।
আপনাদের তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার এবং আহলে হক মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর রহমাতে অনেক বিষয়ে সন্তুষজনক জবাব পেয়ে আসছি। আশা করি এবারো মাহরূম হবো না। বিষয়টি নিয়ে খুবই পেরেশানীতে আছি। জানি আপনাদের লোকবল এবং প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক দৈন্যতা রয়েছে। তবু আশা করছি দ্রুত উত্তর প্রদান করে চিন্তা মুক্ত করবেন। আল্লাহ তাআলা আপনাদের ইলম আমলে বরকত দান করুন। দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ দান করুন।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
প্রশ্নে উল্লেখিত বক্তব্যটি জনৈক লা-মাযহাবী শায়েখ মুরাদ বিন আমজাদ সাহেবের বিতর্কিত গ্রন্থ “সহীহ আক্বীদার মানদণ্ডে বেহেশতী জেওর ১ম খন্ড” এর ৩০ নং পৃষ্ঠা থেকে ৩৪ নং পৃষ্ঠা পর্যন্ত উদ্ধৃত হয়েছে।
এখানে দু’টি বড় ও মারাত্মক অভিযোগ মুরাদ বিন আমজাদ সাহেব উত্থাপন করেছেন। যথা-
১
হাফেজ গোলাম মুর্তাজা পানিপথী রহঃ এর হেঁয়ালী বক্তব্য “উমার ও ‘আলীর টানাটানিতেই পুত্র সন্তানগুলো মারা যায়” দ্বারা হযরত উমর রাঃ ও হযরত আলী রাঃ এর পারস্পরিক ঝগড়া করা উদ্দেশ্য নিয়েছেন।[নাউজুবিল্লাহ]
সেই সাথে তারা সত্যিকার টানাটানি করে সন্তান হত্যা করে ফেলেন অর্থ করেছেন। [নাউজুবিল্লাহ]
২
গোলাম মর্তুজা পানিপথী রহঃ এর ভবিষ্যতবাণীকে ইলমে গায়েবের অধিকারী বলে শিরকের গন্ধ খুঁজেছেন।
আমরা বিস্তারিতভাবে উপরোক্ত দু’টি অভিযোগের জবাব প্রদান করছি।
১ম অভিযোগের জবাব
আসলে বিষয়টি বুঝতে হবে সমঝের সাথে। লা-মাযহাবীদের মত অল্প বিদ্যা নিয়ে বিষয়টি বুঝা যাবে না। পূর্ণাঙ্গ অবস্থানটি আমাদের সামনে রাখতে হবে। বুঝতে হবে কোন পরিস্থিতিতে কথাটি বলা হয়েছে? কি হিসেবে বলা হয়েছে?
থানবী রহঃ এর বাবার বংশ ছিল হযরত উমর রাঃ। আর মায়ের বংশ ছিল হযরত আলী রাঃ। ছেলে সন্তান হলেই হযরত উমর ফারুক রাঃ এর দিকে নিসবত করে “হক” লকব দিয়ে নাম রাখা হতো।
আল্লাহর ফায়সালা অনুপাতে ছেলে সন্তান একজনও জীবিত থাকেনি।
এমতাবস্থায় আল্লাহর ওলী গোলাম মর্তুজা পানিপথী রহঃ হেঁয়ালী করে, মজাক করে বললেনঃ ফারুক আর আলী দুই বংশের টানাটানিতে সন্তান জীবিত থাকছে না।
হযরতের কথাটি কেবলি মজা করে বলা। যেহেতু আগের ছেলেদের নাম শুধু ফারুকী বংশের দিকে নিসবত করে রাখা হচ্ছিল। আলী রাঃ এর বংশের দিকে নিসবত করে রাখা হচ্ছে না। আর সন্তানগুলো মারাও যাচ্ছে। তাই তিনি মজা করে বললেন “দুই বংশের টানাটানিতে সন্তান টিকছে না”।
তাই এবার হযরত আলী রাঃ এর বংশের দিকে নিসবত করে নাম রাখার পরামর্শ দেন নেক ফালি [শুভ ধারণা] হিসেবে।
আর নেক ফালি তথা শুভ ধারণা করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুবারক সুন্নত।
যেমন হাদীসে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নেক ফালি হিসেবে অনেক সাহাবীর নাম পরিবর্তন করে দিয়েছেন।
মদীনার নাম ছিল “ইয়াছরিব” যা পাল্টে নাম রেখেছেন “তাইয়্যিবাহ”।
এক সাহাবীয়ার নাম ছিল “আছিয়া” তার নাম পাল্টে রেখেছেন “জামীলা”। [সহীহ মুসলিম] এক সাহাবীর নাম ছিল “হাযন” তার নাম পাল্টে রাখলেন “সাহল”। [বুখারী-৬১৯০]
শুধু কি তাই? নামের কারণে নিজের প্রয়োজনীয় কাজে লাগানো থেকেও বিরত রেখেছেন কোন কোন সাহাবীকে।
যেমন এক বর্ণনায় এসেছেঃ
عَنْ يَعِيشَ الْغِفَارِيِّ قَالَ: دَعَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِنَاقَةٍ يَوْمًا فَقَالَ: «مَنْ يَحْلُبُهَا» ، فَقَالَ رَجُلٌ: أَنَا، قَالَ: «مَا اسْمُكَ؟» ، قَالَ مُرَّةُ، قَالَ: «اقْعُدْ» ، ثُمَّ قَامَ آخَرُ، فَقَالَ: «مَا اسْمُكَ؟» ، قَالَ مُرَّةَ: قَالَ: «اقْعُدْ» ، ثُمَّ قَامَ آخَرُ، فَقَالَ: «مَا اسْمُكَ؟» ، قَالَ: جَمْرَةُ، قَالَ: «اقْعُدْ، ثُمَّ قَامَ يَعِيشُ» ، فَقَالَ: «مَا اسْمُكَ؟» قَالَ: يَعِيشُ، قَالَ: «احْلُبْهَا»
হযরত ইয়ায়িশ গিফারী রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটের দুধ দোহনের জন্য ডেকে বললেনঃ এর দুধ কে দোহন করবে? তখন একজন বললেনঃ আমি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমার নাম কি?
লোকটি জবাব দিলঃ মুররাহ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি বস। তখন আরেকজন দাঁড়াল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমার নাম কি? লোকটি জবাব দিলঃ মুররাহ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমিও বস। এবার আরেকজন দাঁড়ালেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমার নাম কি? লোকটি জবাব দিলঃ জামরাহ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমিও বস। এবার ইয়ায়িশ দাঁড়াল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমার নাম কি? বললেনঃ ইয়ায়িশ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি দুধ দোহন কর। [আলমুজামুল কাবীর, লিততাবরানী, হাদীস নং-৭১০, আলজামে লিইবনে ওয়াহাব, হাদীস নং-৬৫২]
উপরোক্ত বর্ণনাগুলো প্রমাণ করে, ব্যক্তির নামেরও কিছুটা প্রভাব পড়ে তার ব্যক্তিসত্মায়। যদিও মূল কারিগর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা কিছু কিছু বস্তুতে, শব্দে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষমতা দান করেন। যা স্থান বিশেষে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে থাকে। যেমন বিষের মাঝে মৃত্যুর ক্ষমতা, সূরা ফাতিহার মাঝে রোগ আরোগ্যের প্রভাব সৃষ্টির ক্ষমতা আল্লাহ প্রদান করেছেন।
এর কোনটিই উপরোক্ত বস্তু ও কালামকে নিজস্ব ক্ষমতাবান হবার প্রমাণবাহী নয়। বরং আল্লাহ প্রদত্ব বিশেষ ক্ষমতা হিসেবেই আমরা জানি। বিষ খেলে মানুষ মারা যাবে বলার কারণে আমরা কেউ শিরকের ফাতওয়া প্রদান করি না। করতে পারি না। করলে তা মুর্খতা ছাড়া আর কী’বা হতে পারে?
প্রশ্নে উল্লেখিত কথোপকথনে মূলত পানিপথী রহঃ নেক ফালি হিসেবে আলী রাঃ এর দিকে নিসবত করে নাম রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন। আর একের পর এক ছেলে সন্তান মারা যাওয়া নিয়ে পরিবারের লোকজন পেরেশান থাকায় তাদের সাথে মজাক ও হেঁয়ালী করেছেন।
এরকম একটি সাধারণ কথোপকথনকে জটিল বানিয়ে হযরত উমর রাঃ ও হযরত আলী রাঃ এর মধ্যকার ঝগড়া, মারা যাবার পর তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ, শিয়া মানসিকতা ইত্যাদি সব উদ্ভট ও আজগুবি বিষয়ের অবতারণা করা মুরাদ সাহেবের বিকৃত মস্তিস্কের প্রমাণবাহী ছাড়া আর কিছু নয়।
সুতরাং বুঝা গেল যে, মুরাদ বিন আমজাদ সাহেবের প্রথমোক্ত অভিযোগটি আসলে ভিত্তিহীন। জ্ঞানে স্বল্পতার কারণে তিনি এমন উদ্ভট অভিযোগ উত্থাপন করেছেন।
মুরাদ বিন আমজাদ সাহেবদের উচিত বই লেখার আগে প্রথমে মাথার চিকিৎসা করানো। সামাজিক কথোপকথন সম্পর্কে আগে অবগতি লাভ করা। মুরাদ সাহেব “লোকটা বাঘের মত” বাগধারা শুনে সেই লোকের লেজ খুঁজতে শুরু করা টাইপ আহমকী মানসিকতা পোষণ করেন। এমন অল্প জ্ঞান নিয়ে এত বড় ব্যক্তিদের সম্পর্কে কলম ধরা তার জন্য মোটেও উচিত হয়নি। আমরা তার মানসিক সুস্থ্যতা কামনা করছি।
২য় অভিযোগের জবাব
এক হল কাশফ ও ইলহাম। আরেক হল ইলমে গায়েব।
ইলমে গায়েব হল কোন প্রকার মাধ্যম ব্যতিত অদৃশ্যের কোন সংবাদ অবগত হওয়া। এর নাম ইলমে গায়েব। যা কেবলি আল্লাহর সিফাত। আর কারো এ সিফাত নেই। আল্লাহ ছাড়া কারো সম্পর্কে ইলমে গায়েবের আকিদা রাখা পরিস্কার শিরক।
কিন্তু কোন মাধ্যম দ্বারা অদৃশ্যের সংবাদ সম্পর্কে অবগতিলাভের নাম ইলমে গায়েব নয়। নবীরা জানলে এর নাম ওহী। আর অন্যরা জানলে এর নাম হয় কাশফ বা ইলহাম।
যা আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় বান্দাদের বিশেষ সময়ে কখনো কখনো জানান। সব সময় নয়। বরং তিনি যখন ইচ্ছে করেন তখন জানান।
এ সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রমাণিক আলোচনা দেখতে হলে পড়ুন আমাদের প্রকাশিত “ফাযায়েলে আমাল ও উলামায়ে দেওবন্দঃ আপত্তি ও খণ্ডন” নামক বইটি।
এখানে সংক্ষেপে বলছিঃ
হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাঃ এর কাশফ
وقال أبو بكر الصديق رضي الله عنه لعائشة رضي الله عنها عند موته إنما هما أخواك وأختاك وكانت زوجته حاملاً فولدت بنتاً فكان قد عرف قبل الولادة أنها بنت
হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাঃ তার কন্যা আয়শা রাঃ মৃত্যুর সময় বললেন, তোমার ভাই এবং তোমার দুই বোন। [অথচ সে ময় বোন ছিল একজন] সে সময় আবু বকর রাঃ এর স্ত্রী গর্ভবতী ছিলেন। [আবু বকর সিদ্দীক রাঃ এর ইন্তেকালের পর] তারপর তার স্ত্রী কন্যা সন্তান প্রসব করেন। অথচ জন্ম গ্রহণের আগেই আবু বকর রাঃ কন্যা সন্তান হবার বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন। [ইহয়াউ উলুমিদ্দীন-৩/২৩]
মুসনিদুল হিন্দ শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ লিখেছেনঃ
হযরত সিদ্দিকে আকবর রাঃ হযরত আয়শা রাঃ কে বললেন, যে সম্পদ আমি তোমাকে দিয়েছি, যদি তুমি তা হাসিল করে থাকো, তাহলে ঠিক আছে, নতুবা আমার মৃত্যুর পর তোমার সাথে তোমার দুই ভাই এবং দুই বোনও মিরাছের মাঝে শরীক হবে।
একথা শুনে হযরত আয়শা রাঃ বললেন, আমার বোনতো হল, একজন আসমা, দ্বিতীয় বোনটা কে? তখন আবু বকর সিদ্দীক রাঃ বললেন, বিনতে খারেজা গর্ভবতী। আমার মনে হচ্ছে সে কন্যা সন্তান প্রসব করবে।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ বলেন, সিদ্দিকে আকবর রাঃ এর মৃত্যুর পর হযরত আয়শা রাঃ এর বোন উম্মে কুলসুম জন্ম গ্রহণ করেন।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ উক্ত ঘটনাকে কাশফের দলীল হিসেবে উপস্থাপন করে বলেন, “এ ঘটনা হযরত সিদ্দিকে আকবর রাঃ এর কাশফ। যার দ্বারা আল্লাহ তাআলা তাকে লুকানো বিষয়কে তার কাছে প্রকাশ করে দিয়েছেন। [ইযালাতুল খাফা-৩/৭৭]
আবু বকর সিদ্দীক রাঃ এর উক্ত ঘটনা ইমাম মালিক রহঃ তার বিখ্যাত গ্রন্থ “মুয়াত্তা মালিক” এর মাঝেও সনদসহ নকল করেছেন। দেখুন মুয়াত্তা মালিক-৩১৪, ভিন্ন ছাপা, হাদীস নং-২৭৮৩]
সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং-১১৯৪৮।
লক্ষ্য করুন!
উক্ত ঘটনায় হযরত আবু বকর রাঃ এর স্ত্রীর গর্ভে থাকা সন্তানের কন্যা সন্তান হবার সংবাদ কিভাবে জানতে পারলেন? তার কাছে কি ওহী আসতো? নিশ্চয় নয়। তাহলে তিনি কিভাবে জানলেন?
তাহলে মুরাদ বিন আমজাদের দাবী অনুপাতে আবু বকর রাঃ ইলমে গায়েবের অধিকারী ছিলেন?
নিশ্চয় নয়। আমরা পরিস্কার বলি যে, এটি কাশফের মাধ্যমে আবু বকর রাঃ কে জানানো হয়েছিল।
হযরত উমর রাঃ এর কাশফ
লা-মাযহাবী বন্ধুদের নিজস্ব প্রকাশনী “তাওহীদ পাবলিকেশন্স” থেকে আক্বিদা বিষয়ক একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। যার মূল লেখক হাফেজ বিন আহমাদ বিন আল-হাকামী। আর অনুবাদ করেছেন লা-মাযহাবী শায়েখ আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী। বইটির নাম হল, ‘কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে দুই শতাধিক প্রশ্নোত্তরসহ নাজাতপ্রাপ্ত দলের আকীদাহ’।
উক্ত বইয়ে কারামত সত্য হবার প্রমাণ দিতে গিয়ে ২৮২ নং পৃষ্ঠায় ৩২২ নং টিকায় আনা হয়েছে “সারিয়ার সাথে উমার রাঃ এর কারামাতের বিস্তারিত বিবরণ এই যে, উমার রাঃ একদল সৈনিক পাঠালেন এবং সারিয়া নামক এক ব্যক্তিকে সেনাবাহিনীর আমীর নিযুক্ত করলেন। উমার রাঃ মদীনার মিম্বরে খুৎবারত অবস্থায় ইয়া সারিয়া! আল জাবাল! বলে উচ্চসরে ডাক দিলেন। সৈনিকদের দূত মদীনায় এসে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমরা শত্রুদের মুকাবিলা করতে গেলে তারা আমাদেরকে পরাজিত করে ফেলে। তখন আমরা একজন লোককে চিৎকার করে বলতে শুনলামঃ ইয়া সারিয়া! আল জাবাল! অর্থাৎ হে সারিয়া পাহাড়ে আশ্রয় নাও। এতে আমরা সতর্কতা অবলম্বন করে পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করলাম। শত্রুদের আক্রমণের কবল হতে নিরাপদ হলাম। আল্লাহ তাআলা শত্রুদেরকে পরাজিত করলেন। [মাজমূআয়ে ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া-১১/২৭৮]
খেয়াল করুন। শত মাইল দূরে সাহাবাগণ যুদ্ধ করছেন। সেই যুদ্ধ ময়দানে সাহাবাগণ পরাজিত হয়ে গেছেন। কি করবেন? বুঝতে পারছিলেন না। যুদ্ধের এ হালাত শত মাইল দূরে মসজিদের মিম্বরে বসা হযরত উমর রাঃ এর কাছে কাশফ হয়ে গেল। আর তিনি সেখান থেকেই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিলেন। তা আবার যুদ্ধরত সাহাবীগণ শুনে কার্যকরও করলেন।
এ ঘটনা আমাদের লা-মাযহাবী বন্ধুগণ তাদের নিজেদের প্রকাশনী থেকে আকিদার কিতাবে নকল করেছেন। সেই সাথে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াও উক্ত কাশফের ঘটনাটি নকল করেছেন মর্মে পরিস্কার জানিয়েছেন।
কি বুঝা গেল? হযরত উমর রাঃ থেকে কাশফ প্রমাণিত। সাক্ষ্যিতো লা-মাযহাবী বন্ধুদের নিজেদের আকিদার বই।
হযরত উসমান রাঃ এর কাশফ
ইমাম নববী রহঃ, ইমাম ইবনে কাইয়্যিম রহঃ, ইমাম কুরতুবী রহঃ, ইমাম রাজী রহঃ, ইমাম গাযালী রহঃ এ ৫ জন ইমাম হযরত উসমান রাঃ এর একটি ঘটনা নকল করেছেন।
قال دخلت على عثمان رضي الله عنه وكنت قد لقيت امرأة في طريقي فنظرت إليها شزراً وتأملت محاسنها فقال عثمان رضي الله عنه لما دخلت يدخل علي أحدكم وأثر الزنا ظاهر على عينيه أما علمت أن زنا العينين النظر لتتوبن أولأعزرنك فقلت أوحي بعد النبي فقال لا ولكن بصيرة وبرهان وفراسة صادقة
তিনি বলেন, আমি হযরত উসমান রাঃ এর নিকট আসলাম। পথিমধ্যে আমি এক নারীর সাথে সাক্ষাৎ হল। তখন আমি তার দিকে আড়চোখে তাকালাম। আর তার সৌন্দর্যতা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলাম। এরপর হযরত হযরত উসমান রাঃ এর খিদমাতে উপস্থিত হলে, তিনি আমাকে বললেন, তোমাদের কেউ কেউ আমার কাছে আগমন করে এমতাবস্থায় যে, তার চোখে মুখে যিনার চিহ্ন থাকে। তোমার কি জানা নেই যে, কুদৃষ্টি করা হচ্ছে চোখের যিনা? তুমি তওবা কর। নতুবা তোমাকে সাজা দেব। আমি জিজ্ঞাসা করলামঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরেও ওহী আগমন করে কি? তিনি বললেন, না, কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদর্শীতার মাধ্যমে জানা যায়।
উক্ত ঘটনাটি বিভিন্ন শব্দে নিম্ন বর্ণিত গ্রন্থগুলোতে বিদ্যমানঃ
১
ইহয়াউ উলুমিদ্দীন-৩/২৩-২৪।
২
তাফসীরে কুরতুবী-১২/২৩৬।
৩
তাফসীরে রাজী-২১/৮৯।
৪
কিতাবুর রূহ-২৮৯, ভিন্ন ছাপা-৬৭৫।
৫
বুস্তানুল আরেফীন-৩৮৮
হযরত আলী রাঃ এর কাশফ
ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ হযরত আলী রাঃ এর বিষয়ে একটি ঘটনা নকল করেন। যাতে এসেছেঃ
হারছামা বিন সালমা রহঃ বলেন, আমরা হযরত আলী রাঃ এর সাথে সফরে বের হলাম। তিনি চলতে চলতে কারবালায় গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানকার এক গাছের নিচে গিয়ে নামলেন। তারপর নামায পড়লেন। নামায শেষে জমিন থেকে কিছু মাটি হাতে নিয়ে ঘ্রাণ নিলেন। তারপর বললেন, ‘হে মাটি! তোমার জন্য আফসোস! তোমার উপর এমন কিছু লোককে হত্যা করা হবে, যারা বিনা হিসেবে জান্নাতে গমণ করবে।’
এরপর রাবী নিজেই বলেন যে, আমি নিজে দেখেছি যে, উক্ত স্থানেই হযরত হুসাইন রাঃ শহীদ হয়েছিলেন। [তাহযীবুত তাহযীব-২/২০২, ভিন্ন ছাপা-২/৩৪৮]
এখানে খেয়াল করুন। যে জমিনে হযরত হুসাইন রাঃ শহীদ হবেন। জান্নাতী মানুষ শহীদ হবেন, তা হযরত আলী রাঃ কিভাবে মাটির ঘ্রাণ নিয়ে বলে দিলেন? এটি কি ইলমে গায়েব? নাকি কাশফ?
নিশ্চয় কাশফ।
এখন প্রশ্ন হল, যারা কাশফকে ইলমে গায়েব বলেন। যারা এসব ঘটনা বর্ণনাকারীকে শিরকের অপবাদ আরোপ করে থাকেন। তারা হযরত আলী রাঃ কে কী বলবেন? তিনি কি ইলমে গায়েব জানতেন? আর হযরত ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ উক্ত ঘটনা নকল করে কি শিরক করেছেন? তাহযীবুত তাহযীব কি শিরকী কিতাব?
একবার ভেবে চিন্তে জবাব দিতে অনুরোধ মুরাদ বিন আমজাদের কাছে।
শুধু তাই নয়, এরকম ঘটনা সাহাবায়ে কেরাম থেকে আরো অসংখ্য বর্ণিত।
দেখুন- তাফসীরে কাবীর-২১/৭৫]
ইমাম কুরতুবী রহঃ বলেন, এমন ঘটনা সাহাবী ও তাবেয়ীগণ থেকে প্রচুর পরিমাণ বর্ণিত। [তাফসীরে কুরতুবী-৫/৩৩]
ইমাম ইবনে কাসীর রহঃ ও বলেন, হাদীস ও আছারে এসব [কাশফ ও কারামত] এর ঘটনা বহু রয়েছে। [তাফসীরে ইবনে কাসীর-৬/২২৯]
মোটকথা!
উপরোক্ত বিশুদ্ধ প্রমাণ পেশ করার উদ্দেশ্য হল, যেন আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে যায় যে, কাশফ প্রকাশিত হওয়া মানে ইলমে গায়েব নয়। বরং এটি একটি কারামত। যা আল্লাহ তাআলা যখন ইচ্ছে, যার দ্বারা ইচ্ছে প্রকাশ করেন। আবার ইচ্ছে হলে প্রকাশ করেন না।
কাশফ ও ইলমে গায়েবের মাঝে পার্থক্য
আমাদের কতিপয় ভাইয়েরা ইলমে গায়েব এবং কাশফ ও কারামতের মাঝে পার্থক্য বুঝতে পারেন না। দু’টিকে একই মনে করে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।
অথচ ইলমে গায়েবের সাথে কাশফের ন্যুনতম কোন সম্পর্ক নেই।
ইলমে গায়েব এবং কাশফ কারামাত দু’টি আলাদা জিনিস। যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ, সাহাবা যুগ, তাবেয়ীগণের যুগ এবং উম্মতের সালাফ থেকেই চলে আসছে যে, তারা কোন বুযুর্গ ব্যক্তির মাধ্যমে অস্বাভাবিক, অভ্যাসের বিপরীত, গায়েবী বিষয় প্রকাশিত হওয়াকে কাশফ ও কারামত হিসেবে হক মনে করেন। এটাকে কেউ ইলমে গায়েব বলে শিরকের ফাতওয়া দেননি।
কিন্তু আজকালকের লা-মাযহাবী বন্ধুরা কাশফকে ইলমে গায়েব সাব্যস্ত করে বুযুর্গানে দ্বীনের উপর কুফরীর ফাতওয়া আরোপ করা শুরু করে দিয়েছে।
অথচ কাশফ প্রকাশিত হওয়ার বিষয়ে বান্দার কোন দখল নেই। কাশফ আল্লাহ তাআলারই কর্ম। এটা আল্লাহরই হুকুম। কিন্তু প্রকাশিত হয় যে বান্দাকে তিনি নির্বাচিত করেন সেই পছন্দনীয় বান্দার মাধ্যমে।
আর ইলমে গায়েব হল, যিনি নিজের ক্ষমতায় বর্তমানে ঘটমান সকল অদৃশ্যের বিষয়বালী জানতে পারেন।
কেউ জানিয়ে দিলে জানাকে ইলমে গায়েব বলে না। বরং নিজের ক্ষমতায়, বর্তমানে ঘটমান, বা অতীত ভবিষ্যতের সংবাদ নিজের ক্ষমতায় যিনি জানতে পারেন, তিনি হলেন ইলমে গায়েবের অধিকারী। আর একমাত্র ইলমে গায়েবের অধিকারী হলেন আল্লাহ তাআলা।
অথচ কাশফ বিষয়টি এমন নয়। কাশফ সংশ্লিষ্ট বুযুর্গ ব্যক্তি নিজের ক্ষমতায় জানতে পারেন না। বরং আল্লাহ তাআলা যখন ইচ্ছে, যার মাধ্যমে ইচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছে তিনি প্রকাশ করে থাকেন। যার মাধ্যমে প্রকাশ করেন, উক্ত বিষয়ে তার কোন ক্ষমতা থাকে না।
তাহলে ইলমে গায়েব ও কাশফ এক হবে কিভাবে?
দেখুন এ বিষয়টিই পরিস্কারভাবে লা-মাযহাবী বন্ধুদের প্রকাশিত আকীদার কিতাবে তাদের আকীদাহ হিসেবেই উদ্ধৃত করা হয়েছে।
“আউলীয়াদের কারামত সত্য। আল্লাহ তাআলা তাদের হাতে অলৌকিক ও সাধারণ নিয়মের বিপরীত এমন ঘটনা প্রকাশ করে থাকেন, যাতে তাদের কোন হাত নেই। তবে কারামত চ্যালেঞ্জ আকারে প্রকাশিত হয় না। বরং আল্লাহ আল্লাহই তাদের হাতে প্রকাশ করেন।” [নাজাতপ্রাপ্ত দলের আকীদাহ, অনুবাদক-আব্দুল্লাহ শাহেদ আলমাদানী, প্রকাশক-তাওহীদ পাবলিকেশন্স]
তাহলে কী বুঝা গেল?
কাশফ কারামত প্রকাশে সংশ্লিষ্টদের কোন হাত নেই। এটি আল্লাহর ক্ষমতাধীন। তিনি যখন ইচ্ছে প্রকাশ করেন। যখন ইচ্ছে প্রকাশ করেন না।
উপরোক্ত আকীদাহ বইয়ের বক্তব্য অনুপাতে আরেকটি প্রশ্নের জবাব বুঝে আসে। তাহল,
অনেক লা-মাযহাবী বন্ধুরা প্রশ্ন করেন। এখানে শায়েখ মুরাদ বিন আমজাদ সাহেবও প্রশ্ন করলেন যে, যদি কাশফ সত্য হতো, তাহলে হযরত উমর রাঃ, হযরত উসমান রাঃ, হযরত আলী রাঃ, হযরত হুসাইন রাঃ তাদের শাহাদতের বিষয়টি কেন কাশফের মাধ্যমে জানতে পারলেন না?
এসব প্রশ্নের আশা করি জবাব দেবার প্রয়োজন নেই। উপরোক্ত প্রশ্নটি করা হয় কাশফ ও কারামতের হাকীকত না বুঝার কারণে। কাশফ ও কারামততো ব্যক্তির নিজের ক্ষমতাধীন বিষয় নয়। যখন প্রয়োজন তখনি জানতে পারবেন। বরং এটি সম্পূর্ণই আল্লাহর কর্ম। তার ক্ষমতাধীন। তিনি যখন ইচ্ছে, যেখানে ইচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু ইচ্ছে হলে প্রকাশ করেন না।
আল্লাহর যখন ইচ্ছে হল, তখন শত মাইল দূরের যুদ্ধরত সাহাবীদের হালাত মদীনার মসজিদে থাকা অবস্থায় হযরত উমর রাঃ এর সামনে কাশফ বা প্রকাশ করে দিলেন। আবার যখন ইচ্ছে হল, তখন তার মিম্বরের পাশে লুকানো ঘাতকের বিষয়টি কাশফ করা হল না।
এটিই কাশফের হাকীকত। এটি সংশ্লিষ্ট বুযুর্গের কর্ম নয়। তাই যখন ইচ্ছে তা প্রকাশিত হয় না। আল্লাহর কর্ম। তিনি যখন ইচ্ছে প্রকাশ করেন।
উপরোক্ত দীর্ঘ আলোচনা দ্বারা আমাদের কাছে পরিস্কার যে, হাফেজ গোলাম মর্তুজা পানিপথী রহঃ এর ভবিষ্যতবাণীটি কেবলি কাশফ বা ইলহাম। যা পানিপথী রহঃ এর কারামত। আল্লাহ তাআলা তার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এর সাথে ইলমে গায়েবের ন্যুনতম কোন সম্পর্ক নেই।
কাশফ কারামত সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে শায়েখ মুরাদ বিন আমজাদ সাহেবরা উক্ত বিষয়কে নিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছেন।
আমরা তাকে অনুরোধ করবোঃ
মুরাদ সাহেব! আগে পড়াশোনা করুন। জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করুন। কূপমণ্ডুক মানসিকতা পরিহার করুন। তাহলেই এমন অহেতুক অভিযোগ উত্থাপন করে ইলমী ব্যক্তিদের কাছে হাসির খোরাক হওয়া থেকে রক্ষা পাবেন। জাহালত সত্বেও পণ্ডিতি করলে যেমন দুনিয়াতে হাসির খোরাক হয়ে লাঞ্ছিত হবেন। তেমনি বুযুর্গানে দ্বীনের বিরুদ্ধে গোস্তাখী করায় আখেরাতেও অপেক্ষা করছে লাঞ্ছনা। তাই এ গোমরাহ পথ থেকে ফিরে আসুন।
আর আপনার লিখার শিরোনাম “বেহেশতী জেওরের ভূমিকাতেই শিরক” না দিয়ে রাখা উচিত “মুরাদ বিন আমজদের বইয়ের শুরুতেই মুর্খতা”।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সহীহ বুঝ দান করুন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com