প্রশ্ন
আসসালামু আলাইকুম আমি মোঃ রেজাউল করিম।
আমি বাংলাদেশ পুলিশে কনস্টেবল (সর্ব নিম্ন পদ বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগের) পদে কর্মরত আছি। আমি একটি জেলার সদর থানায় কম্পিউটার অপারেটর হিসাবে কর্মরত আছি। এমতাবস্থায় আমার দায়িত্ব হচ্ছে থানার অফিসিয়াল চিঠিপত্র কম্পিউটারে টাইপ করা।
বিভিন্ন অফিসারের বিভিন্ন প্রকারের প্রতিবেদন টাইপ করা। তো এই খানে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অফিসারের প্রতিবেদনে মিথ্যা কথা থাকে যা তার নিজেকেই স্বাক্ষর করতে হয়।
আমি শুধুমাত্র টাইপ করি। এই ক্ষেত্রে আমার কতটুকু অপরাধ? অনেক সময় হয় কি আমি জানি কোন স্থানে কোন মিথ্যা কথাটি লিখতে হবে। তাহারা আমাকে ফোন করে বলে রিপোর্ট রেডি কর আমি এসে স্বাক্ষর করব। সেই ক্ষেত্রে আমি নিজেই রিপোর্ট লিখি। অফিসার শুধু স্বাক্ষর করেন। এই খানে আমার অপরাধ কতটুকু?
থানায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোক সাধারণ ডায়েরী করতে কিংবা অভিযোগ দিতে আসে। এই ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে যে সাধারণ ডায়েরী করবে তাকেই একটি আবেদন লিখে নিয়ে আসতে হবে। তো তাদের সেই আবেদন লিখার প্রক্রিয়া অনেক সময় ঠিক হয় না। তখন আমি যদি লিখে দেই এবং টাকা নেই পারিশ্রমিক হিসাবে সেটা কি বৈধ হবে? আর যদি টাকা চেয়ে না নিই কিন্তু আমাকে দেয় সেটা যদি নেই তা কি বৈধ?
বিভিন্ন লোকের অভিযোগ অনেক সময় আরও বাড়িয়ে লিখতে হয় না হলে সেটা আসলে আমল যোগ্য হয় না। অর্থাৎ উকিলের কিংবা উকিলের মুহুরী যে অভিযোগটা লিখে সেটাই আমি আমার কাজের পাশাপাশি অনেক সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও লিখতে বাধ্য হই। এবং অনেক সময় টাকা পাই। সেটা কি বৈধ?
অনুগ্রহ করে উত্তর দিবেন। উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
উত্তরটি বুঝতে হলে পয়েন্টগুলো আলাদা করা প্রয়োজন। যেমন-
১
থানায় কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকুরী করার হুকুম কী?
২
অফিসারদের নির্দেশে অনেক সময় প্রতিবেদনের মিথ্যা তথ্য টাইপ করে দিতে হবে। এর হুকুম কী?
৩
জিডি করতে আসা লোকদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণের বিধান কী?
৪
অভিযোগপত্র তৈরীতে অনেক সময় মিথ্যা তথ্য বাড়িয়ে লিখতে হয়। এবং টাকা গ্রহণ করা হয়। এ কার্যক্রমের হুকুম কী?
এবার উত্তরগুলো খেয়ার করুন।
১নং এর উত্তর
থানায় কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকুরী করা সম্পূর্ণ বৈধ। এটি মৌলিকভাবে নাজায়েজ হবার কোন কারণ নেই।
২নং এর জবাব
জেনেশুনে মিথ্যা তথ্য লিখা জায়েজ নয়। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। যেন তা থেকে মুক্ত থাকা যায়।
৩য় এর উত্তর
আপনাকে সরকার কর্তৃক যে বেতন দেয়া হয়, যেই কাজের জন্য দেয়া হয়, সেই কাজের দায়িত্বের মাঝে যেহেতু জিডি লিখাও অন্তর্ভূক্ত। তাই উক্ত কাজের জন্য জনগণ থেকে কোন টাকা চেয়ে গ্রহণ করা ঘুষ হবে। যা সম্পূর্ণ হারাম। হ্যাঁ, যদি কেউ আপনার কাজে খুশি হয়ে দান করে, তাহলে সেটি হাদিয়া। তা গ্রহণে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু চাপ প্রয়োগে, কিংবা ইশারা ইংগীতে বুঝিয়ে হাদিয়া নামে গ্রহণ করলেও তা ঘুষই হবে। এ ঘুষ গ্রহণ সম্পূর্ণ হারাম।
৪র্থ এর উত্তর
কোন প্রকার মিথ্যা তথ্য জেনে শুনে বর্ধিত করা হারাম। কোনভাবেই তা বৈধ নয়। আর টাকা গ্রহণ ৩য় উত্তরে বর্ণিত বিধান অনুপাতে প্রযোজ্য হবে।
উপরোক্ত চারটি পয়েন্ট ও এর জবাব লক্ষ্য করলে আশা করি আপনার প্রশ্নের পূর্ণ জবাব বুঝে যাবার কথা। আপনার মূল চাকুরী ও বেতন সম্পূর্ণ জায়েজ ও হালাল।
কিন্তু এর মাঝে আপনাকে বাড়তি কিছু কাজ হারাম করতে হয়। যা পরিত্যাগ করতে হবে। কিন্তু এ কারণে আপনার মূল বেতনকে হারাম বলার সুযোগ নেই। যদি উপরোক্ত হারাম কাজ থেকে মুক্ত থাকা আপনার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে, তাহলে চেষ্টা করুন অন্য কোন হালাল চাকুরী বা হালাল রিজিকের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করার। আল্লাহ তাআলা আপনার ধর্মীয় জীবনকে সহজ ও সুন্দর করে দিন।
وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُم بَيْنَكُم بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوا فَرِيقًا مِّنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالْإِثْمِ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ [٢:١٨٨
তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না। এবং জনগণের সম্পদের কিয়দংশ জেনে-শুনে পাপ পন্থায় আত্নসাৎ করার উদ্দেশে শাসন কতৃপক্ষের হাতেও তুলে দিও না। [সূরা বাকারা-১৮৮]
لَّعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ [٣:٦١
তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত করি যারা মিথ্যাবাদী। {সূর আলেইমরান-৬১}
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا
হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেনঃ যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভূক্ত নয়। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-২৩১৪৭, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৬৪, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-২৫৮৩, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-২২২৫, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৪৯০৫}
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْمُسْلِمُونَ عَلَى شُرُوطِهِمْ
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেনঃ মুসলমানগণ তার শর্তের উপর থাকবে। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৩৫৯৪, সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং-২৮৯০, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৪০৩৯}
الرشوة ما يعطيه الشخص الحاكم وغيره ليحكم له او يحمله ما يريد (رد المحتار، كتاب القضاء، مطلب فى الكلام على الرشوة-8/34، اعلاء السنن، كتاب القضاء، تحقيق معنى الرشوة-15/61)
الرابع ما يدفع لدفع الخوف من المدفوع اليه على نفسه او ماله حلال للدافع حرام على الآخذ (رد المحتار، كتاب القضاء، مطلب فى الكلام على الرشوة-8/35، فتح القدير، كتاب اداب القضاء-7/255
আমাদের উপলব্ধি!
দ্বীনের প্রতি আপনার এ মোহাব্বত, আল্লাহর প্রতি আপনার মোহাব্বতমাখা ভীতি আমাদের প্রীত করেছে। আল্লাহ তাআলা আপনাকে কবুল করুন। হালাল ও উত্তম রিজিকের ব্যবস্থা করে দিন।
আপনি যে পোষ্টে আছেন, সেখানে গিয়ে এতকিছু ভাবার সময় পায় না আমাদের দেশের অনেক ভাই। যেভাবে ইচ্ছে সাধারণ নীরিহ মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে পয়সা কামায়। যা অনেকেরই সচক্ষে দেখা।
এরই মাঝে ব্যতিক্রমী কিছু মানুষ আছে বলেই টিকে আছে আমাদের দেশ। এখনো মানুষ ন্যায় বিচারের আশায় বুক বাঁধে।
আবেদনে বাড়তি কথা না লিখলে মামলা মজবুত হবে না। তাহলে অপরাদের তুলনায় শাস্তি বেশি দেবার প্রচেষ্টা কেন? নাকি অপরাধের পর্যায় অনুপাতে শাস্তি-বিধান দুর্বল?
আসলে এমনটিই হবার কথা। ইসলামী আইন ছাড়া মানুষের তৈরী আইন কখনোই মজলুম মানুষকে সঠিক ইনসাফ দিতে পারে না। তাই নিতে হয় মিথ্যার আশ্রয়। মামলাকারী মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা করেন। বিবাদী মিথ্যা সাক্ষ্যি পেশ করে, কিংবা টাকা ঢেলে পান খালাস। এ এক মগের মুলুকের কার্যক্রম যেন।
আল্লাহ তাআলা মিথ্যা আর প্রতারণার এ অসহনীয় পরিবেশ থেকে আমাদের মুক্ত করুন। ন্যায়নিষ্ঠা ও সত্যিকার ইনসাফপূর্ণ আইন আমাদের প্রতিষ্ঠা করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]