প্রশ্ন
লা-মাযহাবী শায়েখ তাউসীফুর রহমান সাহেব তার ভিডিও লেকচার “ফাযায়েলে আমালের হাকীকত” নামক ভিডিও লেকচারে বলেন,
“ বলেন, শিবলী! আমি এক স্থানে দেখলাম। এক পাগল ব্যক্তি। এক ছেলে তাকে পাথর মারছে। আমি ছেলেটাকে ধমকালাম, বাঁধা দিলাম। সে বলতে লাগল! জনাব! সে দাবী করছে যে, আমি আল্লাহর সাথে মুলাকাত করি, আল্লাহকে দেখি। আমি তার নিকটে এসে বললাম, কি তুমি এ দাবী কর যে, “আল্লাহর সাথে তোমার ডিরেক্ট মোলাকাত হয় দুনিয়াতে থাকা অবস্থায়? ” তুমি আল্লাহকে দেখ, “আল্লাহ থেকে শোন?”
বললেন, আচ্ছা, শোন, চিৎকার মারলেন, এবং বললেন, শিবলী ঐ সত্বার কসম! যিনি স্বীয় মোহাব্বতে আমার অবস্থা খারাপ করে রেখেছেন। যদি তিনি অল্প সময়ের জন্য আমার থেকে গায়েব হয়ে যান, আমি বিরহ জ্বালায় টুকরো টুকরো হয়ে মরে যাবো। “তিনি সর্বদা আমার সামনে থাকেন”।
নবীর দরকার নেই, হাদীসের প্রয়োজন নেই, কুরআনের প্রয়োজন নেই, এসব মৌলভী, সূফীরা ডিরেক্ট আল্লাহর সাথে মুলাকাত হয়, আল্লাহ থেকে সব কথা জেনে বলে দেয়”।
এ হল, তাউসীফুর রহমান নামক প্রতারকের বক্তব্য। এবার আমরা এ বিষয়ে আসল হাকীকত জানতে চাই।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
তাউসীফুর রহমান কত বড় প্রতারক ও ধোঁকাবাজ তা বুঝার জন্য আমরা প্রথমে ঘটনাটি মূল কিতাব থেকে দেখে নেইঃ
“আল্লাহ তাআলা এমনও বান্দা রয়েছেন, যারা কখনও জিকির হতে গাফেল হন না। হযরত শিবলী রহঃ বলেন, আমি এক স্থানে দেখলামঃ একজন পাগল লোককে ছেলেরা ঢিল ছুড়ছে। আমি তাদের ধমকালাম, ছেলেরা বলতে লাগল, এ লোক এই বলে যে, আমি আল্লাহকে দেখি।
আমি লোকটির নিকট গেলাম। তখন কিছু বলছিল। আমি গভীরভাবে শুনলাম তখন বুঝলাম সে বলছিল ‘তুমি খুবই ভাল করেছো যে, এ ছেলেদের আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছো।
আমি বললাম, এ ছেলেরা তোমার উপর অপবাদ দিচ্ছে। তিনি বললেন, তারা কি বলে? আমি বললাম, তারা বলে যে, তুমি নাকি আল্লাহকে দেখার দাবি কর? একথা শুনে সে একটি চিৎকার দিল, এবং বলল, শিবলী, ঐ সত্বার কসম! যিনি তার মোহাব্বতে আমাকে ভগ্নাবস্থা করে রেখেছেন। এবং তিনি আমাকে নিজের কাছে আবার কখনো দূরে রেখে উদভ্রান্ত করে রেখেছেন। যদি অল্প সময়ও তিনি আমার থেকে গায়েব হয়ে যান [অর্থাৎ তার উপস্থিতি হাসিল না থাকলে] তাহলে আমি বিরহের জ্বালায় টুকরা টুকরা হয়ে যাবো। [ফাযায়েলে আমাল উর্দু-৫৭৪, বাংলা ফাযায়েলে আমাল-৫৭১, ফাযায়েলে জিকির, তৃতীয় অধ্যায়-২৬৫, দারুল কিতাব প্রকাশনী, ফাযায়েল আমাল উর্দু, ভিন্ন ছাপা-১/৪৬৬]
নোট
শায়েখ জাকারিয়া রহঃ ফাযায়েলে আমালে উক্ত ঘটনায় “অর্থাৎ তার উপস্থিতি হাসিল না থাকলে” বাক্যটি লিখেছেন। কিন্তু প্রতারক তাউসীফুর রহমান তার বক্তব্যে এ বাক্যটি উচ্চারণ করেনি।
যে বাক্যটি পরিস্কার প্রমাণ করছে যে, আল্লাহ পাগল উক্ত ব্যক্তির মননে সর্বদাই আল্লাহ তাআলা উপস্থিত থাকেন। মানে তার “ইহসান” এর মর্যাদা অর্জিত হয়েছে।
যেমনটি সহীহ বুখারীর হাদীসে জিবরাঈলে এসেছে।
قَالَ: مَا الإِحْسَانُ؟ قَالَ: «أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইহসান কি? তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত কর যেন তুমি আল্লাহকে দেখতে পাও। যদি তুমি তাকে দেখতে না পাও [অর্থাৎ এ মর্তবায় উন্নীত না হতে পারলে] তাহলে কমপক্ষে আল্লাহ তাআলা তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫০]
একবার ভেবে দেখুন!
কত বড় প্রতারক হলে মানুষ এতটা প্রতারণা করতে পারে। যেখানে শাইখুল হাদীস জাকারিয়া রহঃ পরিস্কার ঘটনার মাঝে উদ্ধৃত করে দিয়েছেন যে, “অর্থাৎ তার উপস্থিতি হাসিল না থাকলে” দ্বারা ব্যক্তির প্রকৃত হালাত প্রকাশ করে দিয়েছেন। লোকটি সর্বদাই হাদীসে বর্ণিত ইহসানের হালাতে থাকেন। তিনি এমনভাবে ইবাদতে নিমগ্ন থাকেন যে, তিনি যেন আল্লাহকে দেখতে পান। সর্বদাই তার মন মননে আল্লাহর উপস্থিতি থাকে। এটিতো সর্বোত্তম হালাত। যা বুখারীতে বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
এমন একটি উত্তম ও শ্রেষ্ঠ হালাতকে জঘন্য ঠাট্টা করল এ তাউসীফুর রহমান। শুধু তা’ই নয়। নিজের পক্ষ থেকে কতগুলো মিথ্যার ফুলঝুরি উক্ত ঘটনায় বর্ধিত করে জঘন্য প্রতারণার আশ্রয় নিল।
১
আল্লাহর সাথে মুলাকাত করি,
২
“আল্লাহর সাথে তোমার ডিরেক্ট মোলাকাত হয় দুনিয়াতে থাকা অবস্থায়?”
৩
“আল্লাহ থেকে শোন?”
৪
“তিনি সর্বদা আমার সামনে থাকেন”।
এ চারটি মিথ্যা কথা উক্ত ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য তাউসীফুর রহমান নিজের পক্ষ থেকে জোড়ে দিয়েছে। অথচ উপরোক্ত চারটি কথার কোন অস্তিত্ব ফাযায়েলে আমালে উদ্ধৃত ঘটনায় নেই।
যা ছিল সেই প্রয়োজনীয় শব্দ ”অর্থাৎ তার উপস্থিতি হাসিল না থাকলে” বাদ দিয়ে দিল। আবার যা নেই এমন চারটি বাক্য জোড়ে দিল।
এমন জঘন্য প্রতারকদের মুখে সহীহ হাদীসের স্লোগান শুনলে শুধুই ঘৃণা ছাড়া আর কী হতে পারে? এমন প্রতারক ব্যক্তি যে দলের শায়েখ হন, তারা কপালপোড়া ছাড়া আর কী’ হতে পারে?
নোট
আরেকটি বিষয় হল, এ ঘটনাটিও শাইখুল হাদীস জাকারিয়া রহঃ নিজের পক্ষ থেকে উদ্ধৃত করেননি। বরং তিনি আল্লামা ইয়াফেয়ী রহঃ এর কিতাব রউজুর রাইয়্যাহীন’ থেকে নকল করেছেন। দেখুন- রউজুর রাইয়্যাহীন-৬৪]
আল্লামা ইয়াফেয়ী রহঃ এর ব্যাপারে ইমাম সুবকী রহঃ [মৃত্যু ৭৭১ হিজরী] বলেন, তিনি নেক বান্দা ছিলেন, তার অনেক তাসনীফ রয়েছে। [তাবক্বাতুস সুফিয়্যাহ লিসসুবকী-১০/৩৩]
ইমাম কাযী আবী বকর দিমাশকী শু’বা রহঃ [মৃত্যু ৮৫১ হিজরী] আল্লামা ইয়াফেয়ী রহঃ এর পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেনঃ
الشَّيْخ الإِمَام الْقدْوَة الْعَارِف الْفَقِيه الْعَالم شيخ الْحجاز
তিনি শাইখ, ইমামুল কুদওয়াতুল আরিফ, ফক্বীহ, আলেম, শাইখুল হিযাজ ছিলেন। [তাবাক্বাতুস সুফিয়্যাহ-৩/৯৫]
লা-মাযহাবী শায়েখ হাফেজ যুবায়ের আলী যা’ই সাহেবও ইমাম ইয়াফেয়ী রহঃ [মৃত্যু ৭৬৮ হিজরী] কে মুহাদ্দিস এবং উলামা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। [মাক্বালাত-৩/২৭৮, ২৯৬]
এখন প্রশ্ন হল, আল্লামা ইয়াফেয়ী রহঃ সম্পর্কে তাউসীফুর রহামান সাহেবের মন্তব্য কী?
বড় কথা হল, এভাবে ঘটনা উদ্ধৃত করে আগ পিছ কেটে দিয়ে, নিজের পক্ষ থেকে আগে পিছে শব্দ জোড়ে দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা ইহুদীদের স্বভাবে। কিন্তু বড়ই আশ্চর্যের সাথে আমরা প্রত্যক্ষ করছি, ইহুদীদের এ ঘৃণ্য স্বভাবকে খুবই আপন করে নিয়ে সহীহ হাদীসের তথা কথিত এসব দাবিদার লা-মাযহাবীরা। আল্লাহ তাআলা এসব প্রতারক লা-মাযহাবী গায়রে মুকাল্লিদদের মিথ্যাচার, ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে উম্মতকে হিফাযত করুন। আমীন।
অপবাদের কবলে ফাযায়েলে আমাল [পর্ব ৮] জনৈক ব্যক্তির দরূদলেখা সম্পর্কিত ফাযায়েলে দরূদের ঘটনার উপর অভিযোগ!
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
মুহাদ্দিস-জামিয়া উবাদা ইবনুল জাররাহ, ভাটারা ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]