প্রশ্ন
From: মোঃ আজগার আলী, কুয়েত থেকে
বিষয়ঃ মিশিনের মাধ্যমে জবাইকৃত ফ্রোজেন মুরগী জবাই, প্রসেসিং ও খাওয়া প্রসঙ্গে।
প্রশ্নঃ
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু ভাই। আমার প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমানে প্রায় সারা বিশ্বে বিভিন্ন কোম্পানী কর্তৃক তৈরীকৃত মেশিনের চেনের মাধ্যমে একসাথে একের পর এক মুরগী জবাই করে প্রসেসিং করে ফ্রোজেন করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হয়। এভাবে জবাই করে সরবরাহকৃত ফ্রোজেন মুরগী খাওয়া কতটুকু শরীয়ত সম্মত? এখানে উল্লখ্য, ইন্টারনেটে মেশিনের মাধ্যমে মুরগী জবাই এর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, জবাইয়ের সময় শরীয়ত সম্মত পদ্ধতি অনুসরন করা হয় না। আর কোন জায়গায় যদি কোন কিছু রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকে সেক্ষেত্রে করনীয় কি? উল্লেখ্য সেখানে ফ্রোজেন মুরগী ব্যতিত বর্তমানে অন্য কিছু সরবরাহ করা হয় না। এছাড়া বর্তমানে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক শায়েখদের এই ফ্রোজেন মুরগী খেতে দেখা যায়। তাই শরীয়তের আলোকে ফ্রোজেন মুরগী সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করলে অনেক উপকৃত হতাম। আল্লহপাক আপনাদের এই খেদমতকে কবুল করুন। আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
হালাল প্রাণী খাওয়া হালাল হবার জন্য শর্ত কয়েকটি। যথা-
১
সেটিকে আল্লাহর নামে জবাই করতে হবে। যদি আল্লাহর নামে জবাই না করা হয়, তাহলে প্রাণীটি হালাল হবার পরও জবাই শরয়ী পদ্ধতিতে না হওয়ায় তা খাওয়া জায়েজ হবে না।
২
প্রাণীটিকে জবাই করতে হবে। অন্য কোন পদ্ধতিতে হত্যা করলে তা খাওয়া যাবে না। যেমন গলাটিপে হত্যা, গুলি করে হত্যা ইত্যাদি।
৩
প্রাণীটির সামনের দিক থেকে জবাই করা। এবং কমপক্ষে তার তিনটি রগ কর্তন করা।
৪
প্রাণীটির গর্দান একেবারে আলাদা না করা।
উপরোক্ত ৪টি পদ্ধতিতে জবাই করা সুন্নাহ সম্মত।
এভাবেই জবাই করা উচিত। এছাড়া অন্য পদ্ধতিতে জবাই করা উচিত নয়। বরং তা অনেক ক্ষেত্রেই গোনাহের কারণ হবে।
যদি প্রথম দু’টি ছাড়া বাকি দু’টি না পাওয়া যায়, তাহলে তা সুন্নাহ সম্মত জবাই না হলেও প্রাণীটি খাওয়া জায়েজ হবে। যদি প্রথম দু’টি তথা আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করা হয়।
কিন্তু আল্লাহর নাম ছাড়া জবাই করলে উক্ত প্রাণী খাওয়া বৈধ হবে না। তেমনি জবাই ছাড়া প্রাণীটি হত্যা করলেও তা খাওয়া যাবে না।
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَن تَسْتَقْسِمُوا بِالْأَزْلَامِ ۚ ذَٰلِكُمْ فِسْقٌ ۗ الْيَوْمَ يَئِسَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن دِينِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ ۚ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ۚ فَمَنِ اضْطُرَّ فِي مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِّإِثْمٍ ۙ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ [٥:٣
তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে মৃত জীব, রক্ত, শুকরের মাংস, যেসব জন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গকৃত হয়, যা কন্ঠরোধে মারা যায়, যা আঘাত লেগে মারা যায়, যা উচ্চ স্থান থেকে পতনের ফলে মারা যা, যা শিং এর আঘাতে মারা যায় এবং যাকে হিংস্র জন্তু ভক্ষণ করেছে, কিন্তু যাকে তোমরা যবেহ করেছ। যে জন্তু যজ্ঞবেদীতে যবেহ করা হয় এবং যা ভাগ্য নির্ধারক শর দ্বারা বন্টন করা হয়। এসব গোনাহর কাজ। আজ কাফেররা তোমাদের দ্বীন থেকে নিরাশ হয়ে গেছে। অতএব তাদেরকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় কর। আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। অতএব যে ব্যাক্তি তীব্র ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে; কিন্তু কোন গোনাহর প্রতি প্রবণতা না থাকে, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল। {সূরা মায়িদা-৩}
وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ ۗ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَىٰ أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ ۖ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ [٦:١٢١
যেসব জন্তুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয় নি, সেগুলো থেকে ভক্ষণ করো না; এ ভক্ষণ করা গোনাহ। নিশ্চয় শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে প্রত্যাদেশ করে-যেন তারা তোমাদের সাথে তর্ক করে। যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তোমরাও মুশরেক হয়ে যাবে। {সুরা আনআম-১২১}
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، ” أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقِيَ زَيْدَ بْنَ عَمْرِو بْنِ نُفَيْلٍ بِأَسْفَلِ بَلْدَحٍ، قَبْلَ أَنْ يَنْزِلَ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الوَحْيُ، فَقُدِّمَتْ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُفْرَةٌ، فَأَبَى أَنْ يَأْكُلَ مِنْهَا، ثُمَّ قَالَ زَيْدٌ: إِنِّي لَسْتُ آكُلُ مِمَّا تَذْبَحُونَ عَلَى أَنْصَابِكُمْ، وَلاَ آكُلُ إِلَّا مَا ذُكِرَ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ،
হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ এর কাছে ওহী নাজিল হবার আগে জায়েদ বিন নুফাইল এর সাথে আসফালি বালদাহ নামক স্থানে সাক্ষাৎ হয়। তখন রাসূল সাঃ এর সামনে দস্তরখান বিছানো হয়। [আর কিছু গোস্ত উপস্থিত করা হয়] রাসূল সাঃ তা খেতে অস্বিকৃতি জানালেন। তারপর জায়েদ বলেন, আমি সে প্রাণী খাই না, যা তোমরা মুর্তির নামে জবাই কর। আমি শুধু ঐ প্রাণীই ভক্ষণ করি যার উপর আল্লাহর নাম নেয়া হয়েছে। {বুখারী, হাদীস নং-৩৮২৬, ৩৬১৪}
হযরত আবায়া বিন রিফায়া রাঃ থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে একাংশে তার দাদা রাসূল সাঃ কে প্রশ্ন করেন-
أَفَنَذْبَحُ بِالقَصَبِ؟ فَقَالَ: ” مَا أَنْهَرَ الدَّمَ وَذُكِرَ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ فَكُلْ
আমরা কি বাঁশের কঞ্চি দিয়ে প্রাণী জবাই করতে পারি? তখন রাসূল সাঃ জবাবে বলেন, যে প্রাণীর রক্ত প্রবাহিত করা হয়, আর তাতে বিসমিল্লাহ বলা হয়, তা খাও। {বুখারী, হাদীস নং-৩০৭৫,২৯১০, ৫৪৯৮,৫১৭৯}
عَنْ عَدِيِّ بْنِ حَاتِمٍ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ أَحَدُنَا أَصَابَ صَيْدًا وَلَيْسَ مَعَهُ سِكِّينٌأَيَذْبَحُ بِالْمَرْوَةِ وَشِقَّةِ الْعَصَا؟ فَقَالَ: «أَمْرِرِ الدَّمَ بِمَا شِئْتَ، وَاذْكُرِ اسْمَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ»
হযরত আদী বিন হাতিম রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমাদের মাঝে কেউ শিকারের প্রাণী ধরে। তারপর তার কাছে ছুড়ি না থাকে, এমতাবস্থায় সে কি কাঁচ ও লাকড়ির কঞ্চি দিয়ে জবাই করতে পারে? রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন, যেটা দিয়ে চাও রক্ত প্রবাহিত কর। আর রক্ত প্রবাহিত করার সময় আল্লাহর নাম নিয়ে নাও। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২৮২৪}
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ বিষয়টি পরিস্কার হলাম যে, হালাল প্রাণী খাওয়া বৈধ হবার জন্য শর্ত হল মূলত দু’টি। যথা-১
১
প্রাণীটিকে জবাই করতে হবে।
২
জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম নিতে হবে।
এ দু’টি বিষয় না পাওয়া গেলে হালাল প্রাণী হলেও তা খাওয়া জায়েজ হবে না।
মেশিনে জবাইকৃত পশুর বিধান
এখন প্রশ্ন হল, মেশিনে জবাইকৃত পশু হালাল কি না? বর্তমানে পশ্চিমারা মেশিনের মাধ্যমে প্রাণী জবাই করে থাকে। যাতে মেশিনের সুইচ টিপলে এক সাথে অনেকগুলো প্রাণীর মাথা আলাদা হয়ে যায়।
একাজটি অন্যায় ও গর্হিত কাজ। কিন্তু খাওয়ার বৈধতার বিষয়ে বিস্তারিত কথা হল,
এক্ষেত্রে প্রাণীটি খাওয়া জায়েজ হবার জন্য ৩টি বিষয় জরুরী। যথা-
১
জবাইকারী মুসলিম, বা খৃষ্টান কিংবা ইহুদী ধর্মানুসারী হতে হবে। নাস্তিক বা অন্য কোন ধর্মাবলম্বী না হতে হবে।
২
জবাইয়ের সুইচে চাপ দিলে জবাইয়ের জন্য নির্ধারিত প্রাণীর গলা/গর্দান কাটতে হবে।
অন্য অঙ্গ কাটতে পারবে না। যেমন পেট ইত্যাদি।
৩
সুইচে চাপ দেবার সময় বিসমল্লিাহ বলতে হবে।
এ পদ্ধতিতে সুইচে টিপে জবাই করলে বিসমিল্লাহ বলে সুইচে চাপ দেবার পর এক সাথে যে কয়টি প্রাণীর গলায় ছুড়িটি চলবে, সেই কয়টি প্রাণী হালাল হবে।
যাদের গলায় পরে আসবে সে প্রাণী হালাল হবে না। [ফাতাওয়া বাইয়্যিনাত-৪/৪৯১-৫০০]
উদাহরণতঃ
বিসমিল্লাহ বলে সুইচে চাপ দেবার পর মেশিনে ফিট করা বিশটি ছুড়ি একই সাথে বিশটি মুরগী জবাই করে দিল।
তাহলে উপরোক্ত বিশটি মুরগী খাওয়া হালাল হয়ে যাবে।
কিন্তু এ বিশটি জবাই হবার পর আরো বিশটি জবাই হল, যার জন্য আবার সুইচে চাপ দিয়ে বিসমিল্লাহ বলা হয়নি। তাহলে উপরোক্ত বিশটি জায়েজ হবে না।
যদি বারবার সুইচ চাপতে হয় জবাই হবার জন্য, আর প্রতিবারই বিসমিল্লাহ বলা হতে থাকে, আর একই সাথে গলায় ছুড়ি আসতে থাকে, তাহলে উক্ত জবাই বিশুদ্ধ বলে ধর্তব্য হবে।
কিন্তু যদি সিরিয়াল অনুপাতে আসে। তথা বিসমিল্লাহ বলে সুইচ চাপার পর প্রথমে একটি জবাই হয়, তারপর আরেকটি হয়, এভাবে হতে থাকে, তাহলে কেবল প্রথমটির জবাই শুদ্ধ হবে। বাকিগুলো হবে না। কারণ প্রথমটির ক্ষেত্রে বিসমিল্লাহ শেষ হয়ে গেছে। বাকিগুলো বিসমিল্লাহ ছাড়া জবাই হবার কারণে হারাম হয়ে যাবে।
(أَمَّا) وَقْتُ التَّسْمِيَةِ فَوَقْتُهَا فِي الذَّكَاةِ الِاخْتِيَارِيَّةِ وَقْتُ الذَّبْحِ لَا يَجُوزُ تَقْدِيمُهَا عَلَيْهِ إلَّا بِزَمَانٍ قَلِيلٍ لَا يُمْكِنُ لتَّحَرُّزُ عَنْهُ لِقَوْلِهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى {وَلا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ} [الأنعام: 121] وَالذَّبْحُ مُضْمَرٌ فِيهِ مَعْنَاهُ وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرْ اسْمُ اللَّهِ تَعَالَى عَلَيْهِ مِنْ الذَّبَائِحِ وَلَا يَتَحَقَّقُ ذِكْرُ اسْمِ اللَّهِ تَعَالَى عَلَى الذَّبِيحَةِ إلَّا وَقْتَ الذَّبْحِ (بدائع الصنائع، كتاب الذبائع والصيود، فَصْلٌ فِي بَيَان شَرْطِ حِلِّ الْأَكْلِ فِي الْحَيَوَانِ الْمَأْكُولِ-4/171)
وَذُكِرَ فِي الْأَصْلِ أَرَأَيْتَ الذَّابِحَ يَذْبَحُ الشَّاتَيْنِ وَالثَّلَاثَةَ فَيُسَمِّي عَلَى الْأُولَى وَيَدَعُ التَّسْمِيَةَ عَلَى غَيْرِ ذَلِكَ عَمْدًا قَالَ: يَأْكُلُ الشَّاةَ الَّتِي سَمَّى عَلَيْهَا وَلَا يَأْكُلُ مَا سِوَى ذَلِكَ لِمَا بَيَّنَّا (بدائع الصنائع، كتاب الذبائع والصيود، فَصْلٌ فِي بَيَان شَرْطِ حِلِّ الْأَكْلِ فِي الْحَيَوَانِ الْمَأْكُولِ-4/171)
لَوْ أَضْجَعَ شَاتَيْنِ وَأَمَرَّ السِّكِّينَ عَلَيْهِمَا مَعًا أَنَّهُ تُجْزِئُ فِي ذَلِكَ تَسْمِيَةٌ وَاحِدَةٌ (بدائع الصنائع، كتاب الذبائع والصيود، فَصْلٌ فِي بَيَان شَرْطِ حِلِّ الْأَكْلِ فِي الْحَيَوَانِ الْمَأْكُولِ-4/173)
শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা.বা. এর তাহকীক
বর্তমানে প্রচলিত মেশিনের মাধ্যমে মুরগী জবাইয়ের বিষয়ে অনেকগুলো খারাবী রয়েছে। যেমন-
১
কিছু জবাইখানায় মুগরীটি জবাই করার আগে কারেন্টযুক্ত ঠান্ডা পানি দিয়ে ভিজানো হয়। এর মাধ্যমে এ সম্ভাবনা থাকে যে, জবাই করার আগেই মুরগীটি মরে যাবে। কারণ বিশেষজ্ঞের মত হল, এ কারেন্টর কারণে ৯০ ভাগ মুরগীরই শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।
২
অধিকাংশ সময় মেশিনে ফিট করা ঘুর্ণায়মান ছুড়ি মুরগীর গলার রগ কাটার জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু কখনো কখনো ছুড়িটি মুরগীর গলা পর্যন্ত পৌছে না। যার ফল মুরগীর গলা একেবারেই কাটে না, কিংবা অল্প কাটে যদ্দারা জবাই শুদ্ধ হয় না।
৩
মেশিনী ছুড়ির মাঝে প্রতিটি জবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ বলা সম্ভব হয় না। আর ছুড়ি ঘুড়ার সময় পাশে দাড়িয়ে বিসমিল্লাহ বললেও তা বিসমিল্লাহ বলে সাব্যস্ত হয় না।
৪
যে গরম পানি দিয়ে মুরগীটিকে অতিক্রম করতে হয়। এখানে যে মুরগীর গলা কাটেনি, বা রগ কাটেনি, তা গরম পানিতে অতিক্রম করার দ্বারা মরে যায়।
উপরোক্ত চারটি খারাবীর উপর চিন্তা ফিকির করার পর প্রতিভাত হল যে, এ খারাবীগুলো দূর করা কঠিন নয়। এভাবে জবাই করার মাঝে কয়েকটি সংস্কার সাধন করলে তা শরীয়ত সিদ্ধ হয়ে যাবে। যথা-
১ম সংস্কার!
ঠান্ড পানিতে কারেন্টের শকড না দেয়া হোক। কিংবা এ বিষয়টি সুনিশ্চিত হতে হবে যে, তারা এতে কারেন্টের শকড দেয় কি না? কিংবা এর দ্বারা মুরগী মরে যায় কি না?
২য় সংস্কার
মেশিন থেকে ছুড়ি বের করে দিতে হবে। যেখানে জবাইয়ের ছুড়ি চলতো, সেখানে কয়েকজন ব্যক্তিকে দাঁড় করিয়ে দিবে, মুরগীটি যখন মেশিনে ঘুরে ছুড়িটির কাছে আসবে, তখন সেখানে দাঁড়ানো মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহু আকবার বলে তার গলা কেটে দিবে। এভাবে করলে হারামের কোন সম্ভাবনা বাকি থাকবে না।
৩য় সংস্কার
যে গরম পানি দিয়ে মুরগীটি অতিক্রান্ত হয়, তা মুরগী মারা যেতে পারে পরিমাণ গরম না হতে হবে।
উপরোক্ত তিনটি সংস্কার উক্ত মেশিনী জবাইতে প্রয়োগ করলে মেশিনের মাধ্যমে জবাইকৃত মুরগী হালাল হবে। [ফিক্বহী মাকালাত-৪/২৭৯-২৮১]
শেষ কথা!
উপরে যা বর্ণিত হল, তাতে পরিস্কার হয়ে যাবার কথা যে, মেশিনের মাধ্যমে জবাই হলেই উক্ত প্রাণী হারাম হয়ে যায় না। বরং হালাল হবারও সূরত রয়েছে।
মুফতী তাকী উসমানী দা.বা. এর বক্তব্য হল, তিনি কানাডাসহ ইউরোপ ও আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে বড় বড় জবাইখানায় হযরতের উদ্ভাবিত জায়েজ পদ্ধতির কথা বললে তারা তা গ্রহণ করে জায়েজ পদ্ধতিতে মেশিনের মাধ্যমে মুরগী জবাই করছেন।
যারা জায়েজ পদ্ধতিতে জবাই করছেন। তারপর প্যাকেটজাত করছেন। নিশ্চয় তাদের সরবরাহকৃত মুরগী বৈধ হবে।
আর যারা করছেন না, তাদেরটা বৈধ হবে না।
এখন প্রশ্ন হল, কোন কোম্পানী করছে, আর কোনটি করছে না? এটি আসলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যাচাই করে নিতে হবে।
আরেকটি বিষয় হল, মুসলিম কোম্পানী বা কিতাবী ধর্মাবলম্বী কোম্পানী থেকে এমন পণ্য এলে এবং তাতে হালাল হবার বিষয়টি লিখা থাকলে তা ভক্ষণ করাতে কোন সমস্যা নেই। যদি না তাতে হারাম কিছু থাকা বা হারাম পদ্ধতিতে জবাই করার বিষয়টি প্রবল ধারণা না হয়।
কিন্তু কিতাবী ছাড়া মুশরিক যেমন হিন্দু ইত্যাদি কোম্পানীর জবাইকৃত মুরগী হলে তা ভক্ষণ করা যাবে না।
উপরোক্ত ব্যাখ্যার আলোকে যদি প্রমাণিত হয় যে, মুরগীটি হারাম পদ্ধতিতে জবাই করা। তাহলে তা খাওয়া জায়েজ নয়। এক্ষেত্রে যদি এছাড়া আর কোন খাবার না থাকে, কোথাও থেকে সংগ্রহ করার সুযোগও না থাকে, তাহলে উক্ত খাবার গ্রহণ ছাড়া যদি জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে, তাহলে তা খাওয়া যাবে। পেট ভরে নয়।, বরং যতটুকু খেলে বেচে থাকা যাবে, ততটুকু খাওয়া জায়েজ। বেশি খাওয়া জায়েজ নয়।
وَأَمَّا التَّسْمِيَةُ عَلَى ذَبْحٍ تَوَلَّاهُ غَيْرُهُمْ مِنْ غَيْرِ عِلْمِهِمْ فَلَا تَكْلِيفَ عَلَيْهِمْ فِيهِ وَإِنَّمَا يُحْمَلُ عَلَى غَيْرِ الصِّحَّةِ إِذَا تَبَيَّنَ خِلَافُهَا وَيَحْتَمِلُ أَنْ يُرِيدَ أَنَّ تَسْمِيَتَكُمُ الْآنَ تَسْتَبِيحُونَ بِهَا أَكْلَ مَا لَمْ تَعْلَمُوا أَذُكِرَ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ أَمْ لَا إِذَا كَانَ الذَّابِحُ مِمَّنْ تَصِحُّ ذَبِيحَتُهُ إِذَا سَمَّى وَيُسْتَفَادُ مِنْهُ أَنَّ كُلَّ مَا يُوجَدُ فِي أَسْوَاقِ الْمُسْلِمِينَ مَحْمُولٌ عَلَى الصِّحَّةِ وَكَذَا مَا ذَبَحَهُ أَعْرَابُ الْمُسْلِمِينَ لِأَنَّ الْغَالِبَ أَنَّهُمْ عَرَفُوا التَّسْمِيَةَ وَبِهَذَا الْأَخير جزم بن عَبْدِ الْبَرِّ (فتح البارى، قَوْلُهُ بَابُ ذَبَائِحِ أَهْلِ الْكِتَابِ وَشُحُومِهَا مِنْ أَهْلِ الْحَرْبِ-9/635-536)
ثُمَّ ذَكَرَ حُكْمَ ذَبَائِحِ أَهْلِ الْكِتَابَيْنِ مِنَ الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى، فَقَالَ: {وَطَعَامُ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَبَ حِلٌّ لَكُمْ} قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ، وَأَبُو أُمَامَةَ، وَمُجَاهِدٌ، وَسَعِيدُ بْنُ جُبَيْر، وعِكْرِمة، وعَطاء، وَالْحَسَنُ، ومَكْحول، وَإِبْرَاهِيمُ النَّخَعِي، والسُّدِّي، ومُقاتل بْنُ حيَّان: يَعْنِي ذَبَائِحَهُمْ.
وَهَذَا أَمْرٌ مُجْمَعٌ عَلَيْهِ بَيْنَ الْعُلَمَاءِ: أَنَّ ذَبَائِحَهُمْ حَلَالٌ لِلْمُسْلِمِينَ؛ لِأَنَّهُمْ يَعْتَقِدُونَ تَحْرِيمَ الذَّبْحِ لِغَيْرِ اللَّهِ، وَلَا يَذْكُرُونَ عَلَى ذَبَائِحِهِمْ إِلَّا اسْمَ اللَّهِ، وَإِنِ اعْتَقَدُوا فِيهِ تَعَالَى مَا هُوَ مُنَزَّهٌ عَنْ قَوْلِهِمْ، تَعَالَى وَتَقَدَّسَ. (تفسير ابن كثير، سورة المائدة-5، ج-2/19)
وقد علمنا ان المشركين وان سموا على ذبائحهم لم تؤكل، (احكام القران للجصاص-3/6)
إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ ۖ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ [٢:١٧٣
তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন,মৃত জীব,রক্ত,শুকর মাংস এবং সেসব জীব-জন্তু যা আল্লাহ ব্যাতীত অপর কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয়, তার জন্য কোন পাপ নেই। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহান ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু। [সূরা বাকারা-১৭৩]
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com