প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / অপবাদের কবলে ফাযায়েলে সাদাকাতঃ [পর্ব-১] প্রসঙ্গ আবূ আলী রোযবারী রহঃ এর ঘটনা!

অপবাদের কবলে ফাযায়েলে সাদাকাতঃ [পর্ব-১] প্রসঙ্গ আবূ আলী রোযবারী রহঃ এর ঘটনা!

প্রশ্ন

ফাযায়েলে আমালের, ফাযায়েলে সাদাকাত এর দ্বিতীয় খন্ডে আবূ আলী রোযবারী রহঃ এর একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। যার দ্বারা মৃত্যুকে অস্বিকার করা হয়েছে। সেই সাথে এতে কুরআনের আয়াতকে অস্বিকার করা হয়েছে।

আমাদের দেশের কিছু লা-মাযহাবী ভাইয়েরা এ দাবী করছেন।

এ বিষয়ে আপনাদের কাছে জানতে চাই। আসলে এর হাকীকত কী?

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

এটি সম্পূর্ণই একটি অজ্ঞতাসূচক অভিযোগ। কুরআন ও হাদীস্ এবং সালাফদের লিখিত কিতাবাদী সম্পর্কে পড়াশোনা না থাকার দরূন এমন অজ্ঞতাসূচক অভিযোগটি উত্থাপন করা হয়ে থাকে।

আমরা অভিযোগকৃত ঘটনাটি প্রথমে দেখে নেই।

আবূ আলী রোযবারী রহঃ বলেন, অত্যান্ত দুর্দশাগ্রস্থ পুরাতন কাপড় পরিহিত একজন ফকীর ঈদের দিন আমার নিকট আসিল এবং বলিতে লাগিল, এখানে কোন পবিত্র ও পরিস্কার জায়গা এমন আছে কি? যেখানে কোন গরীব ফকীর মৃত্যুবরণ করিতে পারে? আমি বেপরওয়াভাবে অহেতুক কথা মনে করিয়া বলিয়া দিলাম, ভিতরে আসিয়া যাও এবং যেখানে ইচ্ছে পড়িয়া মরিয়া যাও। সে ভিতরে আসিল, অজু করিল, কয়েক রাকাত নামায পড়িল, অতঃপর শুইয়া মরিয়া গেল। আমি তাহার গোসল ও কাফনের কাজ সমাধা করিলাম। যখন তাহাকে দাফন করিতে লাগিলাম, তখন আমার মনে হইল যে, তাহার মুখের উপর হইতে কাফন সরাইয়া তাহার মুখ জমিনের উপর রাখিয়া দেই। যাহাতে আল্লাহ তাআলা তাহার অসহায় অবস্থার উপর দয়া করেন। আমি তাহার মুখ খুলিলাম, সে চোখ মেলিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, হে আমার সরদার! মৃত্যুর পরেও কি জিন্দেগী আছে? সে বলিতে লাগিল, আমি জিন্দা আছি। আর আল্লাহ তাআলার প্রত্যেক আশেক জিন্দা থাকে। আমি কাল কিয়ামতে আমার মর্যাদা দ্বারা তোমার সাহায্য করিব। [ফাযায়েলে সাদাকাত, ২য় খন্ড, ৩৪২-৩৪৪ পৃষ্ঠা, দারুল কিতাব প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ, উর্দু ফাযায়েলে আমাল, ২য় খন্ড, ফাযায়েলে সাদাকাত-৪৮৪ পৃষ্ঠা]

উক্ত ঘটনার দ্বারা আমরা বুঝতে পারলাম যে, মৃত্যু মানেই সব একদম নিঃশেষ হয়ে যাওয়া নয়। বরং রূহ শরীর থেকে আলাদা হয়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে স্থানান্তর হওয়া। এ কারণেই আমরা মৃত্যুকে ইন্তেকাল বলে থাকি। ইন্তেকাল অর্থ হল স্থানান্তর হওয়া। মৃত্যু মানেই একদম ধ্বংস হয়ে যাওয়া নয়। বরং ইন্তেকাল তথা স্থানান্তর হওয়া।

উপরোক্ত বক্তব্যই বিভিন্ন শব্দে অনেক শরীয়ত বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন। যেমন

জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহঃ, [মৃত্যু ৯১১ হিজরী] {শরহুস সুদূর-১৪, আলহাওয়ী লিসসুয়ূতী-২/১৪৯}

ইমাম আবূ আব্দুল্লাহ কুরতুবী রহঃ [মৃত্যু ৬৭১ হিজরী] {তাফসীরে কুরতুবী-৯/৪৬৬}

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ [মৃত্যু ৭৫১ হিজরী] {কিতাবুর রূহ-৩৬}

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহঃ, [মৃত্যু-৮৫৫ হিজরী] {উমদাতুল কারী-১২/২৫১]

ইমাম আবু বকর ইবনুল আরাবী রহঃ, [মৃত্যু-৫৪৩ হিজরী] {আহকামুল কুরআন-২/৩৮৪}

ইমাম আবূল ফযল ইরাকী রহঃ, [মৃত্যু ৮০৬ হিজরী] {তরহুত তাসরীব-৩/৩০৭]

আল্লামা মুহাম্মদ বিন ইউসুফ সালেহ রহঃ, [মৃত্যু ৯৪২ হিজরী] {সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ]

আল্লামা সামসুদ্দীন আবুল আউন মুহাম্মদ বিন আহমাদ সালিম রহঃ, [মৃত্যু ১১৮৮ হিজরী] {লামেউল আনওয়ার-২/৩৯

আল্লামা আবুল ফিদা ইসমাঈল বিন মুস্তাফা আলখালুতী রহঃ, [মৃত্যু ১১২৭ হিজরী] {রূহুল বয়ান-৩/৪৬]

১০

ইমাম আহমাদ বিন ইবরাহীম আলকুরতুবী রহঃ। [মৃত্যু ৬৫৬ হিজরী] {আততাযকিরাহ লিলকুরতুবী-১১২}

উপরোক্ত মুহাক্কিকদের বক্তব্য দ্বারা একথা পরিস্কার হয়ে গেল যে, মৃত্যুর মাধ্যমে ব্যক্তি পুরোপুরি ধ্বংস হয় না। বরং স্থানান্তর হয়।

যারা মৃত্যুর মাধ্যমে ব্যক্তি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়, বিশ্বাস করে, তারা ইলম ও হাকীকত সম্পর্কে জাহিল ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

হযরত উমর বিন আব্দুল আজীজ রহঃ [মৃত্যু ১০১ হিজরী] বলেন,

عَن بِلَال بن سعد أَنه قَالَ فِي وعظه يَا أهل الخلود وَيَا أهل الْبَقَاء إِنَّكُم لم تخلقوا للفناء وَإِنَّمَا خلقْتُمْ للخلود والأبد وَإِنَّكُمْ تنقلون من دَار إِلَى دَار

হে লোক সকল! তোমাদের ধ্বংস করার জন্য জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। বরং তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে সর্বদা থাকার জন্য। তোমরা কেবল এক স্থান থেকে অপর স্থানে স্থানান্তর হবে। [শরহুস সুদূর লিসসুয়ুতী-১৪, ১৯]

এখন প্রশ্ন হল, যদি ওলী আল্লাহরা মারা না গিয়ে থাকেন, তাহলে তাদের মৃত কেন বলা হয়?

জবাব

আল্লাহ তাআলা নিজেই পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেনঃ

وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ [٣:١٦٩]

আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনোই মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত। [সূরা আলেইমরান-৩: ১৬৯]

এখন প্রশ্ন হল, যারা কতল হয়ে গেছে আল্লাহ তাআলা তাদের কিভাবে জিন্দা বলছেন?

এ প্রশ্নের যে জবাব আপনি দিবেন, সেই জবাব বুযুর্গদের এসব ঘটনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, শায়েখ জাকারিয়া রহঃ উপরোক্ত ঘটনাটি নিজের থেকে বানিয়ে লিখেননি, বরং ইমাম ইয়াফী ইয়ামেনী রহঃ [মৃত্যু ৭৬৮ হিজরী] এর কিতাব “রউজুর রাইয়্যাহীন” থেকে নকল করেছেন মাত্র। আর ইমাম ইয়াফী রহঃ উক্ত ঘটনা দ্বারা ইস্তিদলালও পেশ করেছেন।  দেখুন-রউজুর রাইয়্যাহীন-১৬৯]

উক্ত ঘটনাটি দলীল হিসেবে কারা কারা পেশ করেছেন?

ইমাম ইয়াফী ইয়ামেনী রহঃ [মৃত্যু ৭৬৮ হিজরী] {রউজুর রাইয়্যাহীন-১৬৯}

জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহঃ {শরহুস সুদূর-২০৮]

আল্লামা তাজুদ্দীন সুবকী রহঃ {তাবাক্কাতুশ শাফিইয়্যাহ-৩/৫০]

ইমাম ইবনুল মুলাক্কিন রহঃ [মৃত্যু ৮০৪ হিজরী] {তাবাক্বাতুল আউলিয়া-১/৫১-৫২]

ইমাম আবূ মুহাম্মদ আব্দুল হক উন্দুলুসী রহঃ [মৃত্যু-৫৮১ হিজরী] {আলআক্বিবাহ ফী জিকরিল মাওত ওয়ালআখিরাহ-১/১৬১]

আল্লামা আবুল ফিদা ইসমাঈল বিন মুস্তাফা রহঃ [মৃত্যু-১১২৭ হিজরী] {রূহুল  বয়ান-৭/৫০]

ইমাম কুশাইরী রহঃ [মৃত্যু ৪৬৫ হিজরী] {আররিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ-২/৫০৭]

এবার প্রশ্ন হল,

ইমাম সুয়ূতী রহঃ [মৃত্যু ৯১১ হিজরী]

যাকে উলামায়ে কেরাম ইমাম, হাফিজ, তাজুল মুফাসসিরীন, ইমামুল মুহাদ্দিসীন উপাধী দিয়েছেন। [আল’আলাম লিজযুরকানী-৩/৩০১]

ইমাম ইবনে মুলাক্কিন রহঃ মৃত্যু ৮০৪ হিজরী।

যাকে আইম্মাগণ ইমাম, হাফিজ, মুহাদ্দিস ঘোষণা করেছেন।

ইমাম তাজুদ্দীন সুবকী রহঃ [মৃত্যু-৭৭১ হিজরী]

যাকে উলামায়ে কেরাম ইমাম, শাইখুল ইসলাম বলে উপাধী দিয়েছেন।

ইমাম ইয়াফী ইয়ামেনী রহঃ, মৃত্যু ৭৬৮ হিজরী।

যাকে আইম্মাগণ শাইখুল হাফিজ ওয়া শাইখুল হারাম, ইমাম, আরীফ ইত্যাদি পদবী দিয়েছেন।

ইমাম আব্দুল হক উন্দুলুসী রহঃ [মৃত্যু ৫৮১ হিজরী]

যাকে আইম্মাগণ ফক্বীহ, হাফিজুল হাদীস, ইলাল ও রিজালের আলেম সাব্যস্ত করেছেন। [তারীখুল ইসলাম-১২/৭২৯]

ইমাম কুশাইরী রহঃ [মৃত্যু ৪৬৫ হিজরী]

যাকে ইমাম খতীব বাগদাদী রহঃ সিক্বা, ইমাম সুবকী রহঃ [মৃত্যু ৭৭১ হিজরী] ইমামুল আইম্মা, শাইখুল মাশায়েখ ওয়া আইম্মায়ে মুসলিমীন সাব্যস্ত করেছেন। [তারীখে বাগদাদ-১১/৮৩, তাবাকাতুস সুবকী-৫/১৫৩]

এসব ফুক্বাহা, মুহাদ্দিসীনগণের উপর কি ফাতওয়া আরোপ করা হবে?

যদি শাইখুল হাদীস জাকারিয়া রহঃ উক্ত ঘটনাটি ফাযায়েলে আমালে নকল করার কারণে শিরকী কাজ করে থাকেন, যদি হারাম কাজ করে থাকেন,তাহলে যাদের কাছ থেকে নিলেন, উপরোক্ত ফক্বীহ, মুহাদ্দিসগণের উপরই কি এসব ফাতওয়া আরোপিত হচ্ছে না?

যে ফাতওয়া জাকারিয়া কান্ধলবী রহঃ এর উপর আরোপ করা হচ্ছে, একই ফাতওয়া কি এসব মুহাদ্দিস, ফক্বীহদের উপর করতে পারবেন?

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা-ইমাম আবূ হানীফা ইসলামী রিসার্চ সেন্টার পিরোজপুর।

ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com

আরও জানুন

ইস্তিস্কার সালাত তথা বৃষ্টির নামাযের বিস্তারিত বিবরণ

প্রশ্ন বৃষ্টি না হলে যে নামায পড়া হয়, যাকে আমরা ইস্তিস্কার নামায বলে থাকি। উক্ত …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস