প্রশ্ন
আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?
আমাকে এক আহলে হাদীস ভাই কিছু মাসআলা দিয়েছে। এই মাসআলাগুলো আমাদের ফিক্বহের কিতাবে কেমন করে লিখা হল? আমি পর্যায়ক্রমে লিখবোঃ দয়া করে দলীলভিত্তিক জবাব দিয়ে তাদের মুখোশ খুলে দিন।
যদি কোন লোক মৃত স্ত্রীলোকের বা চতুষ্পদ জন্তুর স্ত্রী অঙ্গে বা অন্য কোন দ্বারে রোযা অবস্থায় বলৎকার করলে রোযা নষ্ট হবে না। [শরহে বেকায়া-১]
প্রশ্নকর্তা- তানজীল, ঢাকা।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
ইসলামী ফিক্বহ হল, কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত মানুষের দৈনিন্দীন জীবনের মাসায়েলের সুসমন্বিত রূপের নাম। যাতে সহজ ভাষায় কুরআন ও হাদীসের বিধানাবলীকে লিপিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। যেমন অজুর ফরজ কয়টি? অজু ভঙ্গের কারণ কতটি? কী কী কারণে অজু মাকরূহ হয়? কী কী কারণে অযু ভঙ্গ হয় না ইত্যাদি বিষয় কুরআন ও হাদীসে আছে। কিন্তু স্পষ্ট শব্দে অনেক সময়ই পাওয়া যায় না। যেমন নাম্বার দিয়ে, সংখ্যা উল্লেখ করে অযুর ফরজ, মাকরূহ, ভঙ্গের কারণ ইত্যাদি কুরআন ও হাদীসে পাওয়া যাবে না।
তাহলে একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে পূর্ণ বিধানগুলো পালন করে অযু করবে? কী কী কারণে অযু ভেঙ্গে যায়? তা জানা না থাকলে একটি মানুষ কিভাবে তার অযু আছে কি না? তা জানবে?
তাহলে এসব মাসআলা জানাতো খুবই জরুরী বিষয়।
তাই ফিক্বহের কিতাবে সম্ভাব্য মাসায়েলের সূরত উল্লেখ করে বিধান উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে সাধারণ মুসলমানদের সহজতার জন্য।
যে ফুক্বাহায়ে কিরাম এত কষ্ট করে এসব মাসায়েল লিখে আমাদের শরয়ী জিন্দেগী যাপন করা সহজ করে দিয়েছেন তাদের জন্য সবারই মন থেকে দুআ করা উচিত।
এসব মাসআলা কেন লিখা হল?
এ প্রশ্নটিই একটি বোকামীসূলভ প্রশ্ন। আমাদের কথা হল, কেন লেখা হবে না? না লিখলে সাধারণ মানুষ এসব সমস্যার সমাধান জানবে কোত্থেকে? যদি কোন নালায়েক এমন জঘন্য কাজ করে বসে, অপরদিকে নামাযের সময় চলে যাচ্ছে, এখন তার অযু আছে কি না? গোসল করা লাগবে কি না? এসব জানা না থাকলে উক্ত ব্যক্তি কিভাবে নামায আদায় করবে?
এটাতো স্বাভাবিক কমন সেন্সের বিষয়। এসবতো প্রয়োজনীয় মাসায়েল। এখানে মাসআলা উল্লেখ করে দেয়া, মানেতো এসব কাজকে বৈধতা দেয়া নয়। বরং যদি কেউ করে ফেলে, তাহলে তার হুকুম কী হবে? এ বিষয়টি জানানো মাকসাদ।
তাই কেন এমন মাসআলা লিখা হল? প্রশ্ন করাই বাচ্চাসূলভ প্রশ্ন।
এবার প্রশ্নটির জবাবের দিকে মনযোগী হইঃ
কোন কম বখত উপরোক্ত জঘন্য কাজ করে ফেলে এখন তার হুকুম কী হবে?
এক্ষেত্রে মাসআলা দাঁড়াচ্ছে ৪টি। যথা-
১
উক্ত কাজ করার হুকুম কী?
২
উক্ত কাজ করে ফেললে ব্যক্তির উপর অজু বা গোসল আবশ্যক হবে কি?
৩
রোযা অবস্থায় উক্ত কাজ করলে রোযা ভাঙ্গবে কি?
৪
এরকম জঘন্য কর্মসম্পাদনকারীর শাস্তি কী? সেই সাথে উপরোক্ত জন্তুটি কী করবে?
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ফুক্বাহায়ে কিরামের কবরকে জান্নাতের নূর দ্বারা ভরে দিন। ফুক্বাহায়ে উপরোক্ত প্রতিটি মাসআলা আলাদা শিরোনামে হুকুম লিখে দিয়ে উম্মতের উপর বিশাল বড় ইহসান করেছেন।
পবিত্রতা অধ্যায়ে এমতাবস্থায় গোসল বা অজু আবশ্যক হবে কি না? রোযার অধ্যায়ে উক্ত ব্যক্তির রোযা ভাঙ্গবে কি না? এমনিভাবে হুদুদ বা শাস্তি অধ্যায়ে উপরোক্ত ব্যক্তির শাস্তি কী হবে? তা আলাদা আলাদা অধ্যায়ে উল্লেখ করে দিয়েছেন।
এর দ্বারা উম্মতের উপর বড় ইহসান ও করূনা করেছেন ফুক্বাহায়ে কিরাম। আল্লাহ তাআলা তাদের উত্তম প্রতিদান দান করুন।
পবিত্রতা অধ্যায়ে ফুক্বাহায়ে কিরাম লিখেছেনঃ
و) ولا عند (وطء بهيمة او ميتة او صغيرة غير مشتهاة) بأن تصير مفضاة بالوطء وان غابت الحشفة ولا ينتقض الوضوء، فلا يلزم الا غسل الذكر…… (بلا انزال) (رد المحتار على الدر المختار شرح تنوير الابصار-1/305-306)
চতুষ্পদ জন্তু, মৃত বা শিশুর সাথে সহবাস করলে বীর্যপাত না হলে গোসল আবশ্যক হবে না। অযুও ভাঙ্গবে না, যদিও বিশেষ অঙ্গ খানিক ভিতরে প্রবেশ করে। তবে পুরুষাঙ্গ ধৌত করা আবশ্যক। [রদ্দুল মুহতার আলাদদুররিল মুখতার-১/৩০৫-৩০৬]
আর রোযা অধ্যায়ে জানিয়ে দিয়েছেনঃ বীর্যপাত না হলে রোযা ভঙ্গ হবে না।
وان اولج بهيمة او ميتة ولم ينزل لا يفسد صومه ولا (فتاوى قاضى خان
যদি কোন ব্যক্তি পশুর সাথে যিনা করে, তাহলে বীর্যপাত না হলে তার রোযা ভাঙ্গবে না। [ফাতাওয়া কাযীখান]
আর এ মাসআলাই শরহে বেকায়া কিতাবে বর্ণিত। যেহেতু ফুক্বাহায়ে কেরাম মূলত কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত মাসায়েলই উদ্ভাবন করে লিখে থাকেন। সেই হিসেবে তারা উক্ত মাসআলাটি হাদীস থেকেই গ্রহণ করেছেন। হাদীসে এসেছে-
عَنْ حَكِيمِ بْنِ عِقَالٍ , أَنَّهُ قَالَ: سَأَلْتُ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا مَا يَحْرُمُ عَلَيَّ مِنَ امْرَأَتِي وَأَنَا صَائِمٌ؟ قَالَتْ فَرْجُهَا
হাকীম বিন ইকাল থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আম্মাজান আয়শা রাঃ কে প্রশ্ন করলামঃ রোযা অবস্থায় স্ত্রীর সাথে কোন কাজ করা হারাম? তিনি বললেনঃ মহিলাদের বিশেষ অঙ্গ। [তাহাবী শরীফ, হাদীস নং-৩৪০০]
তাছাড়া ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ ও বীর্যপাত না হলে রোযা ভঙ্গ না হওয়ার কথাই উদ্ধৃত করেছেনঃ
قَالَ النَّوَوِيُّ وَلَا خِلَافَ أَنَّهَا لَا تُبْطِلُ الصَّوْمَ إِلَّا إِنْ أَنْزَلَ بِهَا
ইমাম নববী রহঃ বলেনঃ[মহিলাদের গাঢ় সংস্পর্শ দ্বারা] বীর্যপাত না হলে রোযা ভঙ্গ হয় না। [ফাতহুল বারী-৪/১৫৩]
আবার হুদুদ তথা শাস্তি অধ্যায়ে কঠোর ভাষায় উপরোক্ত জঘন্য কর্মের শাস্তির কথাও উল্লেখ করে দিয়েছেনঃ
بَلْ يُعَزَّرُ وَتُذْبَحُ ثُمَّ تُحْرَقُ، وَيُكْرَهُ الِانْتِفَاعُ بِهَا حَيَّةً وَمَيِّتَةً مُجْتَبَى
(পশুর সাথে যিনাকারীকে) শাস্তি দিতে হবে। আর উক্ত পশুকে জবাই করে পুড়ে ফেলবে। উক্ত পশু দ্বারা জীবিত বা মৃত অবস্থায় কোন উপকার নেয়া মাকরূহ। [আদদুররুল মুখতার মাআ রদ্দুল মুহতার-৪/২৬]
কত কঠোরতার সাথে উক্ত পশু দ্বারা উপকার নেয়াকেও মাকরূহ বলে উল্লেখ করে উক্ত জঘন্য কাজের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করা হয়েছে। সেই সাথে উপরোক্ত ঘৃণ্য কর্মকারীর শাস্তির কথা পরিস্কার শব্দে উল্লেখ করে দিয়ে একাজ হারাম হওয়াও জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
কী শাস্তি হতে পারে? তা কাযী নির্দিষ্ট করবে। এর তাযীর হত্যা করে ফেলার মাধ্যমেও হতে পারে।
অন্যত্র তাও উল্লেখ করা হয়েছেঃ
আদ্দুররুল মুখতারে এক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে
(وَ) التَّعْزِيرُ (لَيْسَ فِيهِ تَقْدِيرٌ بَلْ هُوَ مُفَوَّضٌ إلَى رَأْيِ الْقَاضِي) وَعَلَيْهِ مَشَايِخُنَا زَيْلَعِيٌّ لِأَنَّ الْمَقْصُودَ مِنْهُ الزَّجْرُ، وَأَحْوَالُ النَّاسِ فِيهِ مُخْتَلِفَةٌ بَحْرٌ (وَيَكُونُ) التَّعْزِيرُ (بِالْقَتْلِ
তাযীর তথা শাস্তি সুনির্দিষ্ট নয়। বরং বিষয়টি সমকালিন কাযীর উপর ন্যস্ত করা হবে। এর উপরই ফুক্বাহাদের মত। কেননা, এ বিষয়ে সতর্ক করা উদ্দেশ্য। আর মানুষের অবস্থা বিভিন্ন হয়ে থাকে। এ তাযীর তথা শাস্তি হত্যার মাধ্যমেও হতে পারে। [আদদুররুল মুখতার]
রুদ্দুল মুহতারে ইবনে আবেদীন শামী লিখেছেন
وَالْجِمَاعِ فِي غَيْرِ الْقُبُلِ إذَا تَكَرَّرَ فَلِلْإِمَامِ أَنْ يَقْتُلَ فَاعِلَهُ،
যদি বিবাহিত স্ত্রীর নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া অন্যত্র সহবাস করায় কোন ব্যক্তি অভ্যাস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে ইমামের উচিত উক্ত ব্যক্তিকে হত্যা করা। [রদ্দুল মুহতার]
তো যেখানে ফুক্বাহায়ে কেরাম উপরোক্ত মাসআলাটি হাদীসের আলোকে সব কৱটি অংশসহ বর্ণনা করে উম্মতের উপর ইহসান করেছেন। সেখানে উক্ত মাসআলা কেন উল্লেখ করা হল মর্মে বাচ্চাসূলভ অভিযোগ কেন?
এরকম অহেতুক অভিযোগের হেতু কী? তা আমাদের কিছুই বুঝে আসছে না।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ফিক্বহ ও ফুক্বাহায়ে কেরামের দুশমনদের প্রতারণা থেকে উম্মতে মুসলিমাকে হিফাযত করুন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
ইমেইল- [email protected]