প্রশ্ন
জাযাকাল্লাহ খাইরান। আরও একটি প্রশ্ন ছিল, ইনশাআল্লাহ্ উত্তর দিবেন।
আজকাল অনেক মানুষ জ্বীনে ধরা বিশ্বাস করতে চাই না। তাই আমার প্রশ্নটি হল, মানুষকে জ্বীনে ধরা বা জ্বীনে আছর করা এটি কি কুরআন হাদীস দ্বারা সরাসরি প্রমাণিত ? আর জ্বীনে ধরলে বিভিন্ন হক্কানী হুজুররা এর যে চিকিৎসা করে থাকেন, তারও কি প্রমাণ আছে ? ফেকাহ শাস্ত্র কি বলে এই সম্পর্কে ? জানালে খুব উপকৃত হব।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
জীন আল্লাহ তাআলার এক প্রকার সৃষ্টি। যারা আগুনের তৈরী। মানুষ যেমন অপর মানুষের ক্ষতি করতে পারে। তেমনি জীনরাও মানুষের ক্ষতি করতে পারে। জীনের অস্তিত্বের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জীনের বিষয়ে স্বতন্ত্র একটি সূরা “জীন”নামে অবতীর্ণ করেছেন।
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ [٥١:٥٦
আমার এবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি। {সূরা আজ যারিয়াত-৫৬}
قُلْأُوحِيَإِلَيَّأَنَّهُاسْتَمَعَنَفَرٌمِنَالْجِنِّفَقَالُواإِنَّاسَمِعْنَاقُرْآنًاعَجَبًا [٧٢:١
বলুনঃ আমার প্রতি ওহী নাযিল করা হয়েছে যে, জিনদের একটি দল কোরআন শ্রবণ করেছে, অতঃপর তারা বলেছেঃ আমরা বিস্ময়কর কোরআন শ্রবণ করেছি;
يَهْدِيإِلَىالرُّشْدِفَآمَنَّابِهِ ۖوَلَنْنُشْرِكَبِرَبِّنَاأَحَدًا [٧٢:٢
যা সৎপথ প্রদর্শন করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনও আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক করব না।
وَأَنَّهُتَعَالَىٰجَدُّرَبِّنَامَااتَّخَذَصَاحِبَةًوَلَاوَلَدًا [٧٢:٣
এবং আরও বিশ্বাস করি যে, আমাদের পালনকর্তার মহান মর্যাদা সবার উর্ধ্বে। তিনি কোন পত্নী গ্রহণ করেননি এবং তাঁর কোন সন্তান নেই।
وَأَنَّهُكَانَيَقُولُسَفِيهُنَاعَلَىاللَّهِشَطَطًا [٧٢:٤
আমাদের মধ্যে নির্বোধেরা আল্লাহ তা’আলা সম্পর্কে বাড়াবাড়ির কথাবার্তা বলত।
وَأَنَّاظَنَنَّاأَنْلَنْتَقُولَالْإِنْسُوَالْجِنُّعَلَىاللَّهِكَذِبًا [٧٢:٥
অথচ আমরা মনে করতাম, মানুষ ও জিন কখনও আল্লাহ তা’আলা সম্পর্কে মিথ্যা বলতে পারে না।
وَأَنَّهُكَانَرِجَالٌمِنَالْإِنْسِيَعُوذُونَبِرِجَالٍمِنَالْجِنِّفَزَادُوهُمْرَهَقًا [٧٢:٦
অনেক মানুষ অনেক জিনের আশ্রয় নিত, ফলে তারা জিনদের আত্নম্ভরিতা বাড়িয়ে দিত।
যেহেতু জীন আছে। তাই সে মানুষের ক্ষতিও সাধন করতে পারে। এটা স্বাভাবিক যুক্তি। এর জন্য কুরআন হাদীসের দলীলের কোন প্রয়োজন নেই। তবে কুরআনে জীনের অস্তিত্বের কথা স্পষ্টাক্ষরে ঘোষণা করেছে।
জীনে ধরা রোগীর চিকিৎসা বিষয়ে কথা হল। আমাদের জ্বর আসলে আমরা প্যারাসিটামল খাই। ঠান্ডা লাগলে ওরাডিন বড়ি বা ফেনাড্রিল ইত্যাদি সিরাপ খেয়ে থাকি। আমরা কি এর জন্য কখনো কুরআন হাদীসের দলীল খুজি যে, জ্বর ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে এসব ওষুধ খাওয়া জায়েজ কি না? নাকি এগুলো হারাম?
নিশ্চয় আমরা দলীল খুজতে যাই না। বরং বলে থাকি যে, এটা ডাক্তারদের অভিজ্ঞতার বিষয়। অসুখ হলে এ ওষুধ খেলে সেরে যায় আল্লাহর রহমাতে। ব্যস তাই আমরা খেয়ে থাকি। এখানে আক্বিদার কোন বিষয় আমরা সাধারণত খুজতে যাই না। আমরা জানি যে, ওষুধ মূলত কিছু করতে পারে না। বরং আল্লাহ তাআলাই সব কিছু করে থাকেন। তবে আল্লাহ তাআলা কিছু কিছু বিষয়ে কতিপয় গুণ দিয়ে রেখেছেন। যে গুণের বরকতে উক্ত বস্তু ক্রিয়াশীল হয়।
ঠিক তেমনি বুজুর্গদের অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের ঝাড়ফুকের কিছু নিয়ম রীতি আবিস্কার করেছেন। যা ডাক্তারের প্যারাসিটামল ইত্যাদি ওষুদের মতই। যা দিয়ে তারা ঝাড়ফুক করলে রোগী আরোগ্য লাভ করে স্বাভাবিকভাবে।
তাই এসব বিষয়ে দলীল খুজতে যাওয়াটা বোকামী বৈ কিছু নয়। যেমন প্যারাসিটামল খাওয়া জায়েজ কি না? এর দলীল খুঁজতে যাওয়া বোকামী।
পবিত্র কুরআনের অনেকগুলি আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘কুরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য শেফা ও হেদায়াতের উৎস।’আলোচ্য আয়াতগুলোতে উল্লেখিত ‘শেফা’শব্দের তফসীরে শাহ্ আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলভী (রহ.) লিখেছেন, ‘কুরআন শরীফের চাইতে ব্যাপক উপকারী এবং মানবজাতির রোগ-ব্যাধি নিরাময়কারী আর কিছু নাযিল হয়নি।’যেমন বলা হয়েছে, ‘আর আমি কুরআনে এমন কিছু আয়াত নাযিল করেছি যা মু’মিনদের জন্য শেফা এবং রহমত স্বরূপ।’ (বনী ইস্রাঈল: ৮২)এতদসঙ্গে পবিত্র কুরআনের আয়াতে শেফা নামে পরিচিত আয়াতগুলোর কথা উল্লেখ করা যায়। আয়াতগুলো হচ্ছে :
এতদসঙ্গে পবিত্র কুরআনের আয়াতে শেফা নামে পরিচিত আয়াতগুলোর কথা উল্লেখ করা যায়। আয়াতগুলো হচ্ছে :
১. সুরা তাওবার ১৪ নং আয়াত, ২. সুরা ইউনূসের ৫৭ নং আয়াত, ৩. ছুরা নাহ্লের ৬৯ নং আয়াত, ৪. সুরা বনী ইস্রাঈলের ৮২ নং আয়াত, ৫. সুরা আশ্-শোয়ারার ৮৫ নং আয়াত এবং ৬. সুরা হা-মীম ছাজদার ৪৪ নং আয়াত। উপরোক্ত প্রতিটি আয়াতেই কুরআনে মুমিনদের জন্য ‘শেফা’, ‘রহমত’প্রভৃতির কথা উল্লেখিত হয়েছে। তফসীরবিদ ইমাম বায়হাকী (রহ.) ‘শেফা’অর্থ আত্মা এবং দেহ উভয়ের শেফা বা নিরাময় বলেছেন। অর্থাৎ পবিত্র কুরআনে যেমন আত্মার যাবতীয় রোগ এবং মন্দ প্রবণতার চিকিৎসা রয়েছে, তেমনি দেহের যাবতীয় রোগ-ব্যাধীরও চিকিৎসা রয়েছে।
কুরআনের আয়াত দ্বারা রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা হতে পারে এ কথা অনুধাবন করার জন্য শেষ দু’টি সুরার তফসীর ও শানে-নুযুল পাঠ করাই যথেষ্ট। উল্লেখ্য যে, এই দুইটি সুরা হযরত নবি করীম (সা.)-কে যাদু করার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছিল। আল্লাহ্পাক যাদুর প্রতিকার করার উদ্দেশ্যে সুরা দু’টি দান করেছিলেন।
ইমাম কুশাইরী (রহ.) তাঁর মারাত্মক অসুস্থ শিশুপুত্রের চিকিৎসার লক্ষ্যে যে আয়াতে ‘শেফা’পাত্রে লেখে তা পানিতে ধুয়ে পান করিয়েছিলেন। ফলে মৃতকল্প শিশুটি আশ্চর্যজনকভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছিল। ইমাম সাহেব এই তদবীরটি একটি মোবারক স্বপ্নের মাধ্যমে প্রাপ্ত নির্দেশের ভিত্তিতে করেছিলেন। তারপর থেকে আয়াতে ‘শেফা’গুরুতর অসুস্থতা নিরাময়ের লক্ষ্যে যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
শাফেয়ী মাযহাবের ইমাম তাজউদ্দীন সুবকী (রহ.) রোগ-ব্যাধী নিরাময়ের উদ্দেশ্যে আয়াতে শেফা এবং পবিত্র কুরআনের অন্য কয়েকটি আয়াতের ব্যবহার সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা শেষে মন্তব্য করেছেন যে, ‘আমাদের মাশায়েখগণ রোগ-ব্যাধী নিরাময়ের উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরআনের আয়াত ব্যবহার করতেন।’
হাদিস শরীফের সহীহ্ বর্ণনায় বিচ্ছুর দংশনজনিত বিষ নিরাময়ের দোয়ার উল্লেখ আছে। সুতরাং ঝাড়-ফুঁক কুরআন-হাদিস পরিপন্থী, এমন কথা বলা মোটেও বাস্তবতা-সংগত নয়।
বিস্তারিত জানতে পড়–ন “মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া”
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক–তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।