প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / কথিত আহলে হাদীসদের বিচিত্র সব নাম এবং ইংরেজদের থেকে দলের নাম রেজিষ্টারকরণ!

কথিত আহলে হাদীসদের বিচিত্র সব নাম এবং ইংরেজদের থেকে দলের নাম রেজিষ্টারকরণ!

মুফতী রফীকুল ইসলাম মাদানী

লা-মাযহাবীদের বিচিত্র নাম ও এর রহস্য

নবজাত শিশুর যেমন প্রথমেই কোন নাম থাকে না, কিছুদিন পর তার একটি নাম রাখা হয় , পছন্দ না হলে প্রয়োজনে তাও আবার পরিবর্তন করা হয়, অনুরূপভাবে ভারতবর্ষে নবজন্মা লা-মাযহাবী নামক নতুন দলটিরও প্রাথমিক পর্যায়ে কোন নাম ছিল না। তাদের অপতৎপরতা লক্ষ্য করে জনগণ যখন তাদেরকে “ওহহাবী” “লা-মাযহাবী” বলতে থাকে তখন তারা নিজেদেরকে “মুহাম্মাদী” বলে ঘোষণা করে এবং পর্যায়ক্রমে সুবিধামত “মুয়াহহিদ” “গাইরে মুক্বাল্লিদ” “আহলে হাদীস” ইত্যাদি নাম বরাদ্দ করতে থাকে। সাউদী আরবে তেল, পেট্টোলের পয়সা জমজমাট হওয়ার মুরাদে আরবীদেরকে ধোঁকা দিয়ে পেট পালার ব্যবস্থা হিসেবে বর্তমানে তারাই “সালাফী” নামে আত্মপ্রকাশ করেছে।

এ বিষয়ে আহলে হাদীস মতবাদেরই অন্যতম ব্যক্তি মৌলভী মুহাম্মাদ শাহজাহানপুরীর উক্তি ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া তাদের অনেকেরই বই পুস্তকে এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। তন্মধ্য হতে লা-মাযহাবী আলিম মৌলভী আসলাম জিরাজপুরী তার বিশিষ্ট রচনা “নাওয়াদিরাতে” লিখেন-

پہلے اس جماعت نے اپنا کوئی خاص نام نہیں رکھا تھا، مولانا شہیدؒ کے بعد جب مخالفوں نے انکو بدنام کرنے کے لئے وہابی کہنا شروع کیا تو وہ اپنے آپکو محمدی کہنے لگے ، پھر اس کو چھوڑ کر اہل حدیث کا لقب اختیار کیا جو آج تک چلا آرہا ہے”۔

”প্রথমে এ জামাত নিজেদের বিশেষ কোন নাম রাখেনি। মাওলানা ইসমাইল শহীদ (রহ.)-এর শাহাদাতের পর প্রতিপক্ষের লোকেরা যখন দুর্নাম করার জন্য তাদেরকে ওহহাবী বলতে শুরু করে, তখন তারা নিজেদেরকে “মুহাম্মাদী” বলতে থাকে। অতঃপর এ নামটি পরিহার করে “্আহলে হাদীস” উপাধি চয়ন করে, যা আজ পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে।

একই দলের বিচিত্র নামের রহস্য কী?

একটু লক্ষ্য করলেই বুঝা যাবে যে, লা-মাযহাবীদের নিজেদেরই অনুভূতি নেই যে তারা কী? কখনো তারা নিজেদেরকে “মুহাম্মাদী” বলে, কখনো “মুয়াহহিদ” কখনো “ গাইরে মুকাল্লিদ” কখনো “লা-মাযহাবী” কখনো ”আহলে হাদীস” আবার কখনো “আসারী” আবার কখনো “সালাফী” ইত্যাদি। যে দলটি নিজের নাম নিয়েই আজ পর্যন্ত সংশয়ে নিপতিত, তারাই জানে তাদের ধর্ম ও দ্বীন নিয়ে কেমন সংশয় ও সন্দেহে আপতিত। আর যে ধর্ম ও মতবাদে এত সংশয় ও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে তা গ্রহণ করা সন্দেহমুক্ত তথা হক্ব হওয়ার নিশ্চয়তা কোথায়?

প্রকৃত পক্ষে  তারা না “মুহাম্মাদী” না “আহলে হাদীস” না “সালাফী”; বরং তারা একমাত্র ধোঁকাবাজ এবং মুসলমানদের মধ্যে সংশয় সৃষ্টিকারী। সাধারণ মুসলমানদেরকে ধোঁকা ও প্রতারণার মানসেই তারা এ সমস্ত নাম ব্যবহার করে থাকে।

সম্মানিত পাঠকবর্গ নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, নির্বাচনের সময় কোনো কোনো চরিত্রহীনা মহিলা তার প্রকৃত নাম, স্বামীর নাম ও বোরকা পরিবর্তন করে বিভিন্ন পরিচয়ে পালাক্রমে ভোট প্রদান করে থাকে। কিন্তু সময়-সুযোগে গণধোলাই আর কিছু উত্তম মাধ্যম দিলে তার মূল পরিচয় বেরিয়ে আসে। অনুরূপভাবে লা-মাযহাবীরাও সুবিধামত বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন নামে , বিভিন্ন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে থাকে। তাই আহলে হকের পক্ষ থেকে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেই তাদের আসল রূপ ও মূল উদ্দেশ্য বেরিয়ে আসবে।

মুহাম্মাদী কে?

ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, ১২৪৬হিজরীর পর এই উপমহাদেশে সৃষ্ট বিদয়া‘ত ও নতুন ফিরক্বাটিকে মুসলমানগণ যখন ওহহাবী বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন তখন তারা নিজেদেরকে মুহাম্মাদী বলে দাবি করে। সে হিসেবে মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী ও মৌ. নজীর হুসাইন ভারতবর্ষের প্রথম মুহাম্মাদী নামের দাবিদার। অনুরূপভাবে তাদের তদানীন্তন অনুসারীরাও মুহাম্মাদী নামেই আত্মপ্রকাশ করতো। এ ধারায় নবাব ছিদ্দিক্ব হাসান খান ১২৭৫ হিজরীতে মৌ. আব্দুল হক্ব বেনারসী থেকে লিখিতভাবে মুহাম্মাদী উপাধি লাভ করেন।

মুহাম্মাদী নামের রহস্য

মুহাম্মাদী বলে তারা বুঝাতে চায় যে, তারা সরাসরি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসারী, তারা কোন মাযহাবের তাক্বলীদ বা অনুসরণ করে না। তাই তারা হানাফী নয়, নয় শাফেয়ী, মালেকী বা হাম্বলী, বরং তারা মুহাম্মাদী। কিন্তু প্রশ্ন জাগে মুহাম্মাদ (সা.)-এর সত্যিকার অনুসারীদেরকেই যদি মুহাম্মাদী বলতে হয়, তাহলে হযরত সাহাবায়ে কিরাম(রা.) ও তাবেয়ীগণই তো এর সর্ব প্রথম ও সর্বাধিক উপয্ক্তু ধারক ও বাহক, তাঁরা কেন তা গ্রহণ করেন নি? তাঁদের উপাধি মুহাম্মাদী নয় কেন? এ শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগের সূচনা ১২০০হিজরীর পর কেন?

নবাব ছিদ্দিক্ব হাসান খান অবশ্য এ প্রশ্নের উত্তর দিতে যেয়ে চতুর্থ শতাব্দীর শেষার্ধের মুহাদ্দিস আবু হাফস উমার বিন আহমদ ইবনে শাহীন এর কথা উল্লেখ করেছেন যে, ইবনে শাহীনের নিকট কোন মাযহাবের আলোচনা আসলে তিনি বলতেন,”আমি মুহাম্মাদী মাযহাবের”।

কিন্তু মুহাদ্দিস ইবনে শাহীনের এ উক্তি নকল করার দ্বারা তাদের কী লাভ? তিনিও তো ৪র্থ শতাব্দীর শেষার্ধের লোক। তাঁর মৃত্যু ৩৮৫ হিজরীতে। আর চার ইমামের অনুসরণের ধারা তো এর অনেক পূর্বেকার। সুতরাং তাদের বক্তব্য অনুযায়ী তারাই ৪র্থ শতাব্দীর শেষার্ধে বিদয়া’তের সূচনাকারী দল। অতএব আমরা হানাফী বা শাফেয়ী মাযহাব মানি, আর তারা মানে ৪র্থ শতাব্দীর ইমাম ইবনে শাহীনের মাযহাব। এ ছাড়া ইবনে শাহীন তো কেবল মাত্র একজন বিশেষজ্ঞ আলিম ছিলেন। শরীয়তের সর্বক্ষেত্রে অনুসরণ যোগ্য হিসেবে মুসলিম উম্মাহ তাকে গ্রহণ করেন নি। হাফেয যাহাবী (রহ.) তাঁর অসংখ্য ভুল ত্রুটির এক বিরাট দাস্তান উল্লেখ করেছেন।

তিনি তো কোন সাহাবী ছিলেন না, তাবেয়ীও ছিলেন না। লা-মাযহাবীরা কি কোন সাহাবী বা তাবেয়ী অথবা হুজুর (সা.) এর পবিত্র হাদীসে উল্লেখিত উত্তম যুগ তথা স্বর্ণযুগের কারও এ উপাধি মুহাম্মাদী প্রমাণ করতে পারবেন? সকল মুহাম্মাদী নামের ধব্জাধারীরা একত্রিত হয়েও যদি সক্ষম হবেন বলে মনে করেন তবে প্রমাণ করে দিন । এটাও তাদের প্রতি আমাদের চ্যালেঞ্জ। আর এ চ্যালেঞ্জ বংশানুক্রমে তথাকথিত সকল মুহাম্মাদীদের প্রতি বহাল থাকবে।

আহলে হাদীস নাম ইংরেজের বরাদ্দকৃত

বর্তমানে অবশ্য লা-মাযহাবীরা ওহহাবী বা সালাফী নামে আত্মপ্রকাশ করে সাউদি রিয়াল, দিনার, দিরহাম উপার্জনের মোহে ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু ১২৪৬ হিজরীতে , তাদের উদ্ভবের সূচনালগ্নে যখন তেল পেট্রোলের পয়সার জমজমাট ছিল না, ওহহাবীদেরই যখন দুর্দিন-দুর্ভিক্ষ চলছিল, বিশেষ করে ভারতবর্ষে ইংরেজ বিরোধী ও ইংরেজ বিতাড়নের জিহাদে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদেরকে ইংরেজ সরকার ওহহাবী বলে আখ্যায়িত করেছিল, তখন লা-মাযহাবীরা ওহহাবী নামের আখ্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তাই তারা তখন নিজেদের জন্য “ মুহাম্মাদী” এবং পরবর্তীতে “ আহলে হাদীস” নাম বরাদ্দ করার সম্ভাব্য সকল তৎপরতা চালিয়ে গিয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে লা-মাযহাবীদের তৎকালীন অন্যতম মুখপাত্র মৌলভী মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী লাহোরী বৃটিশ সরকারের প্রধান কার্যালয় এবং পাঞ্জাব, সি-পি, ইউ-পি, বোম্বাই, মাদ্রাজ, ও বাঙ্গাল সহ বিভিন্ন প্রাদেশিক কার্যালয়ে ইংরেজ প্রশাসনের আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করতঃ তাদের জন্য “ আহলে হাদীস” নাম বরাদ্দ দেয়ার দরখাস্ত পেশ করেন। এ দরখাস্তগুলোর প্রতিউত্তর সহ তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত তৎকালীন “এশায়াতুস সুন্নাহ” পত্রিকায়ও প্রকাশ করা হয়। যা পরে সাময়িক নিবন্ধ আকারেও বাজারজাত করা হয়।

তাদের মানসিকতা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কিছুটা আঁচ করার জন্য পাঠক সমীপে তন্মধ্য হতে একটি দরখাস্তের অনুবাদ নিম্নে পেশ করছি।

“বখেদমতে জনাব গভর্নমেন্ট সেক্রেটারী,

আমি  আপনার খেদমতে লাইন কয়েক লেখার অনুমতি এবং এর জন্য ক্ষমাও প্রার্থনা করছি। আমার সম্পাদিত মাসিক “এশায়াতুস সুন্নাহ” পত্রিকায় ১৮৮৬ ইংরেজীতে প্রকাশ করেছিলাম যে, ওহহাবী শব্দটি ইংরেজ সরকারের নিমক হারাম ও রাষ্ট্রদ্রোহীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং এ শব্দটি হিন্দুস্তানের মুসলমানদের ঐ অংশের জন্য ব্যবহার সমীচীন হবে না, যাদেরকে “ আহলে হাদীস” বলা হয় এবং যারা সর্বদা ইংরেজ সরকারের নিমক হালালী, আনুগত্য ও কল্যাণই প্রত্যাশা করে, যা বার বার প্রমাণও হয়েছে এবং সরকারী চিঠি পত্রে এর স্বীকৃতিও রয়েছে।

অতএব, এ দলের প্রতি ওহহাবী শব্দ ব্যবহারের জোর প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে এবং সাথে সাথে গভর্র্নমেন্টের বরাবর অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সাথে আবেদন করা যাচ্ছে যে, সরকারীভাবে এ ওহহাবী শব্দ রহিত করে আমাদের উপর এর ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক এবং এ শব্দের পরিবর্তে “আহলে হাদীস” সম্বোধন করা হোক।

আপনার একান্ত অনুগত খাদেম

আবু সাঈদ মুহাম্মাদ হুসাইন

সম্পাদক, এশায়াতুস সুন্নাহ

দরখাস্ত মুতাবেক ইংরেজ সরকার তাদের জন্যে “ ওহহাবী ” শব্দের পরিবর্তে “ আহলে হাদীস ” নাম বরাদ্দ করেছে। এবং সরকারী কাগজ-চিঠিপত্র ও সকল পর্যায়ে তাদেরকে “ আহলে হাদীস ” সম্বোধনের নোটিশ জারি করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দরখাস্তকারীকেও লিখিতভাবে মঞ্জুরী নোটিশে অবহিত করা হয়।

সর্বপ্রথম পাঞ্জাব গভর্নমেন্ট সেক্রেটারী মি. ডাব্লিউ, এম, এন (W.M.N) বাহাদুর চিঠি নং-১৭৫৮ এর মাধ্যমে ৩রা ডিসেম্বর ১৮৮৬ ইংরেজিতে অনুমোদনপত্র প্রেরণ করেন। অতঃপর ১৪ই জুলাই ১৮৮৮ ইং সি,পি গভর্নমেন্ট চিঠি নং-৪০৭ এর মাধ্যমে, ২০শে জুলাই ১৮৮৮ ইং ইউ,পি গভর্নমেন্ট চিঠি নং-৩৮৬ এর মাধ্যমে, ১৪ই আগস্ট ১৮৮৮ইং বোম্বাই গভর্নমেন্ট চিঠি নং-৭৩২ এর মাধ্যমে, ১৫ই আগস্ট ১৮৮৮  মাদ্রাজ গভর্নমেন্ট চিঠি নং-১২৭ এর মাধ্যমে, ৪ঠা মার্চ ১৮৯০ইং বাঙ্গাল গভর্নমেন্ট চিঠি নং-১৫৬নং এর মাধ্যমে দরখাস্তকারী মৌ. আবু সাইদ মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভীকে অবহিত করা হয়।

কোন মুসলিম জামাতের নাম অমুসলিম, নাস্তিক, মুসলমানদের চিরশত্রু খৃস্টান নাছারাদের মাধ্যমে বরাদ্দ করার ঘটনা ইসলামী ইতিহাসের পৃষ্ঠায় বিরল। যা কেবল হিন্দুস্তানী লা-মযাহাবীদেরই গৌরব ও সৌভাগ্যের বিষয়(!) তাই তারা এ ইতিহাসটা অত্যন্ত গৌরবের সহিত নিজেদেরই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করে তৃপ্তি লাভ করেছেন।

আল্লাহ তাআলা এ ভ্রান্ত ফিরক্বা থেকে উম্মতে মুসলিমাকে হিফাযত করুন। আমীন।

0Shares

আরও জানুন

বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে একথাগুলো কি আমরা জানি?

সংগৃহিত  আমরা জানি না লালন আসলে কে? লালন ছিলেন বাউল সম্প্রদায়ের গুরু।আমরা কি জানি কারা …

One comment

  1. Mahiruddin Chowdhury

    অনেক ধন্যবাদ আহলে হক মিডিয়া কে, প্রত্যেকটি লেখক কে।
    আল্লাহ আমাদের হকের পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *