প্রচ্ছদ / ইলমে হাদীস / বুখারী মুসলিম ও তিরমিজী গ্রন্থের আসল নাম কি?

বুখারী মুসলিম ও তিরমিজী গ্রন্থের আসল নাম কি?

প্রশ্ন

সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও জামে তিরমিজী কিতাবের মূল নাম কি? দয়া করে দলীলসহ জানালে কৃতজ্ঞ থাকবো।

প্রশ্নকর্তা- আহমদ আলী

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

কখন কখনো কোন কিছুর পদবীমূলক নাম ও সামাজিক নাম এমন প্রসিদ্ধি লাভ করে যে,মানুষ তার আসল নামই ভুলে যায়। যেমন আবু হুরায়রা রাঃ। তার আসল নাম যে, কি? এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসীনে কেরাম থেকে প্রায় ৫০টির মত নাম পাওয়া যায়। কিন্তু রাসূল সাঃ যে নামে ডেকেছেন এর উপরে আর কী নাম হতে পারে?

যাইহোক, একজন সাংবাদিক যেমন তার সংবাদের শিরোনাম এমনভাবে লিখে থাকেন, যেন শিরোনাম দেখেই সেই সংবাদের সারাংশ বুঝে এসে যায়, বুঝা যায় এ সংবাদে কি আলোচ্য? তেমনি একজন লেখক তার গ্রন্থের নাম এমনি রেখে থাকেন। যেন নাম দেখেই কিতাবটির আলোচ্য বিষয় এবং মাকসাদ পরিস্ফুটিত হয়ে যায়।

এ কারণে একটি গ্রন্থের নাম জানা খুবই জরুরী একটি বিষয়।

বুখারী, মুসলিম এবং তিরমিজী। পৃথিবী বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ। এসবের সিফাতি নাম এতটাই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে, আমরা অনেকেই এর আসর নাম সম্পর্কে বেখবর।

বুখারী শরীফ

আমরা এ গ্রন্থটিকে বুখারী শরীফ, সহীহ বুখারী বা শুধু বুখারী বলেই বলে থাকি।

 

মুহাদ্দিসীনে কেরামের মাঝে অনেকে বুখারী শরীফের নাম নিজের পক্ষ থেকেও দিয়েছেন। যেমন অনেকেই নাম লিখেছেন “আলজামেউস সাহীহ”। এ নামকে বুখারী শরীফের সিফাত বলা যায়। কিন্তু এটি ইমাম বুখারী রহঃ এর রাখা নাম নয়।

আবার অনেকে কিতাবটির পরিচয় তুলে ধরার জন্য বা সংক্ষিপ্ত করেও নাম লিখেছেন। যেমন প্রসিদ্ধ মালেকী ফক্বীহ কাযী ইয়াজ রহঃ “মাশারিকুল আনোয়ার আলা সিহাহিল আসার” নামক গ্রন্থে বুখারী শরীফের নাম লিখেছেন “আল জামেউল মুসনাদ আসসহীহ আলমুখতাসার মিন আসারি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম”।

কাজী ইয়াজ রহঃ এ নামে কিছুটা সংক্ষেপ এবং কিছুটা নিজের পক্ষ থেকে নাম জুড়েছেন।

বুখারী শরীফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাকার হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ ফাতহুল বারীর মুকাদ্দিমা “হাদয়ুস সারী” তে বুখারীর নাম লিখেছেন- “আলজামেউস সাহীহ আলমুসনাদ মিন হাদীসি রাসূলিল্লাহি আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়া সুনানিহী ওয়াআয়্যামিহী। {হাদয়ুস সারী-১/৬}

ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ মুতাআখখীরীন মুহাদ্দিসীনদের মাঝে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় সমাসীন। কিন্তু বড়রাও মাঝে মাঝে হোচট খান। এক্ষেত্রেই ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ এর খানিক ভুল হয়েছে। তিনি যেভাবে নামটি বলেছেন ইমাম বুখারী রহঃ হুবহু এ শব্দে বুখারীর নাম রাখেননি।

হাফেজ আবু নসর আলকালাবাজী রহঃ [মৃত্যু-৩৯৮ হিজরী] স্বীয় কিতাব “রিজালু সহীহিল বুখারী” এর ২৪ নং পৃষ্ঠায় বুখারী শরীফের নাম লিখেছেন- “আল জামেউস মুসনাদ আসসহীহ আলমুখতাসার মিন উমুরি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াসুনানিহী ওয়াআয়্যামিহী”।

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ফক্বহীহ কাজী আবু মুহাম্মদ আব্দুল হক বিন গালিব বিন আতিয়্যা উন্দুলুসী রহঃ [মৃত্যু ৫৪১ হিজরী] স্বীয় কিতাব “ফেহরেস্তে ইবনে আতিয়্যা” তে বুখারী শরীফের নাম লিখেছেন “আলজামেউল মুসনাদ আসসাহীহ আলমুখতাসার মিন উমুরি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াসুনানিহী ওয়াআয়্যামিহী”।

{ফেহরেস্তে ইবনে আতিয়্যা-৪৫}

ইমাম নববী রহঃ ও একই নাম বলেছেন তথা “আলজামেউল মুসনাদ আসসাহীহ আলমুখতাসার মিন উমুরি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াসুনানিহী ওয়াআয়্যামিহী”। {তাহযীবুল আসমায়ি ওয়াললুগাত-১/৭৩}

একই নাম হাফেজ ইবনুস সালাহ রহঃ ও বলেছেন। {মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ-২৪/২৫}

একই নাম হাফেজ ইবনে রশীদ আলবাস্তী রহঃ ও লিখেছেন। {ইফাদাতুত তাসহীহ ফীততারীফি বিসানাদিল জামেয়িস সহীহ-১৬}

আল্লামা হাফেজ বদরুদ্দীন আইনী রহঃ ও একই নাম উল্লেখ করেছেন। {উমদাতুর কারী-১/৫}

তাহলে কি বুঝা গেল? বুখারী শরীফের মূল নাম হল “আলজামেউল মুসনাদ আসসাহীহ আলমুখতাসার মিন উমুরি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াসুনানিহী ওয়াআয়্যামিহী”।

মুসলিম শরীফ

বুখারীর পর সবচে’ সহীহ গ্রন্থ বলা হয়ে থাকে। অনেক মুহাদ্দিস বুখারীর উপরও মুসলিমকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কারণ ইমাম মুসলিম রহঃ তার স্বীয় গ্রন্থ হাদীস ছাড়া অন্য কোন কথা না আসার এতটাই সতর্কতা অবলম্বন করেছেন যে, নিজের পক্ষ থেকে উক্ত গ্রন্থে কোন শিরোনামও তিনি কায়েম করেননি। এ কারণে এ গ্রন্থটি শিরোনামহীনভাবে হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে।

তাছাড়া মুসলিমের মাঝে এক হাদীসের একাধিক সনদ একত্র করা হয়েছে। যা পড়ার দ্বারা সনদের বক্তব্য ও সনদের যাবতীয় বিষয় সামনে চলে আসে। যা বুখারীতে পাওয়া যায় না।

বুখারীর নামের চেয়েও মুসলিমের নাম নিয়ে বেশি জট। অধিকাংশই সংক্ষেপে মুসলিম শরীফ বলেই ডেকে থাকি। বেশি যদি কেউ গুরুত্ব দিয়ে নাম লিখে থাকেন, তাহলে লিখেন যে, “আলমুসনাদুস সহীহ”। ব্যস এতটুকুই।

অন্যদের কথা কি বলবো? খোদ ইমাম মুসলিম রহঃ ই সংক্ষেপের জন্য স্বীয় কিতাবের একস্থানে শুধু “আলমুসনাদ” আবার কোথাও “আলমুসনাদুস সহীহ” নাম উল্লেখ করেছেন।

মুহাম্মদ বিন মাসারজী রহঃ বলেন, আমি মুসলিম বিন হুজ্জাজ রহঃ কে বলতে শুনেছি যে, আমি এ মুসনাদুস সহীহ গ্রন্থটি তিন লাখ হাদীস থেকে নির্বাচিত করে লিখেছি। {ফেহরেস্তে ইবনে আতিয়্যা]

আল্লামা খতীব বাগদাদী সহীহ মুসলিমের নাম লিখেন-“আলমুসনাদুস সহীহ”। {তারীখে বাগদাদ-১৩/১০০}
একই নাম বলেন, হাফেজ ইবনে মানজুয়াহ ইস্ফাহানী রহঃ। {রিজালু সহীহ মুসলিম-১/২৯}

ইমাম মুসলিম রহঃ কোথাও কোথাও স্বীয় কিতাবের নাম শুধু মুসনাদ লিখেছেন।

যেহেতু বুখারী মুসলিম উভয় গ্রন্থেই সহীহ হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। তাই পরবর্তী মুহাদ্দিসীনে কেরামগণ উভয় কিতাবের মাঝে পার্থক্য করার জন্য বুখারীকে “আলজামেউস সহীহ” আর মুসলিমকে “আলমুসনাদু সহীহ” নামে উল্লেখ করেন। {ইমাম হাকেমকৃত “তাসমিয়াতু মান আখরাজাহুমুল বুখারী ওয়ামুসলিম-৩৫}

ইমাম ইবনে আতিয়্যা ফেহরেস্তে ইবনে আতিয়্যাতে লিখেন- “আলমুসনাদুস সহীহ বিনাকলি আদল আনিল আদলি আন রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

কাজী আয়াজ রহঃ লিখেন- আলমুসনাদুস সহীহ আলমুখতাসার বিনাকলিল আদল আনিল আদলি আন রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম”। {মাশারিকুল আনওয়ার আলা সিহাহিল আসার-১/১০}

এ সংজ্ঞায় “সুনান” শব্দটি নেই।

হাফিজ ইবনে খায়র আশশাবীলী মুসলিম শরীফের নাম লিখেন, “আলমুসনাদুস সহীহ আলমুখতাসার মিনাস সুনান বিনাকলিল আদল আন রাসূলিল্লাহি আলাইহি ওয়াসাল্লাম”। {ফেহরেসে মারাওয়াহু আন শুয়ুখুহু-৯}

এটাই মুসলিম শরীফের মূল নাম।

তিরমিজী শরীফ

তিরমিজীর অবস্থাও সহীহাইনের চেয়ে কম নয়।এর আসল নাম মানুষের মন থেকে মুছে গেছে বলা যায়। যারা পড়েন এবং পড়ান সবার ব্রেইনের একই বাক্য শুনা যায়, এ গ্রন্থের নাম তিরমিজী।

এ কিতাব নিয়ে প্রথমত যে বিতর্ক। সেটি হল এটি সুনান নাকি জামে?

শায়েখ নাসুরুদ্দীন আলবানী রহঃ সর্বপ্রথম তিরমিজীকে দুইভাগে ভাগ করেন। একভাগের নাম দেন সহীহ তিরমিজী, আরেক ভাগের নাম দেন জঈফ তিরমিজী।  এর আগে এ বেআদবী কর্ম কোন মুহাদ্দিস করেননি। কোন মুহাদ্দিসীসের সংকলিত কিতাবকে ভাগ করে ফেলার ধৃষ্টতা কেউ প্রদর্শন করেননি।

যাইহোক, নাসীরুদ্দীন আলবানীও তিরমিজী শরীফের নাম নিয়ে দীর্ঘ বাহাস করেছেন। কিন্তু ফলাফল বের করতে সমর্থ হননি।

অনেক মুহাদ্দিস তিরমিজী শরীফকে “সহীহ” গ্রন্থ হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছেন। যেমন ইমাম হাকিম এবং খতীব বাগদাদী।

হাফেজ ইবনুস সালাহ রহঃ মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ গ্রন্থে এ বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। তারপর সেটকে রদ করে বলেন, ইমাম তিরমিজী রহঃ এর বক্তব্য অনুপাতেই তিরমিজীতে বেশ ক’টি জঈফ এবং মুনকার বর্ণনাও রয়েছে। তা এটিকে সহীহ বলা ঠিক নয়।

অপরদিকে অনেক মুহাদ্দিস তিরমিজী শরীফকে “আলমুসনাদুল জামে” বলে নাম দিয়েছেন।

যেমন-হাফেজ আবুল কাশেম তার “ফাযায়িলুল কিতাব আলজামে লিআবী ঈসা আততিরমিজী” গ্রন্থের ৩ নং পৃষ্ঠায় তিরমিজীর নাম লিখেছেন “আলমুসনাদুল জামে”।

হাফেজ ইবনে খায়ের আশশাবিলী রহঃ লিখেন “আলজামে আলমুখতাসার মিনাস সুনান আন রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়ামারিফাতুস সাহীহ ওয়ালমা’লুল ওয়ামা আলাইহিল আমল”।

তিরমিজী শরীফের দুই পুরাতন হাতে লেখা পান্ডুলিপিতেও এ নাম লিখা পাওয়া গেছে। একটি পান্ডুলিপি ৪৭৯ হিজরীর আরেকটি ৫৮২ হিজরীর।

প্রথম নুসখাটি শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহঃ এর বক্তব্য অনুপাতে ড.মোস্তাফা আজমীর মালিকানায় রয়েছে। এটি তিনি হিন্দুস্তান থেকে অনেক টাকা দিয়ে ক্রয় করেছিলেন। এটি অনেক পুরাতন নুসখা। এক খন্ডের শেষে ৩ পৃষ্ঠা কম। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা হল ৬৪৮।

দ্বিতীয় নুসখাটি মাকতাবায়ে ফাইজুল্লাহ আফিন্দীতে সংরক্ষিত।সেখানে পরিস্কার ভাষায় লিখিত আছে “আলজামেউল মুখতাসার মিনাস সুনান আন রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়ামারিফাতুস সাহীহ ওয়ালমালুল ওয়ামা আলাইহিল আমল”।

উভয় নুসখাতেই সনদ রয়েছে। যা ইমাম তিরমিজী পর্যন্ত পৌঁছে।

বিস্তারিত জানতে পড়ুন শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ কৃত “তাহকীকু ইসমিস সাহীহ ওয়া ইসমিস জামেউত তিরমিজী”।

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল- [email protected]

[email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …

No comments

  1. ইব্রাহীম আবির ইবু

    জামে কিতাব হিসেবে তিরমিজি ও বুখারী শরিফের তুলনামুলক আলোচনা করুন ।

Leave a Reply to ইব্রাহীম আবির ইবু Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *