প্রচ্ছদ / আদব ও আখলাক / চুল রাখার সুন্নতী ও জায়েজ পদ্ধতি কি?

চুল রাখার সুন্নতী ও জায়েজ পদ্ধতি কি?

প্রশ্ন

মুরুব্বি,
ফেইসবুক কে জনৈক আলেম বললেন যে “মুসলমানদের শিআ`র হলো চুল ও দাঁড়ি ছেড়ে দেয়া। অর্থাৎ সর্বনিম্ন এক মুষ্ঠি পরিমাণ দাঁড়ি রাখা ও কাঁধ বরাবর বাবরী রাখা।”

এই ব্যাপারে উনার কাছে কমেন্টে দলিল চাওয় আহলে উনি উল্লেখ করেন ” (‘রদ্দুল মুহতার ১০৩:১), (মুলাহাজা হো শারহুশ শামায়েল লিলমানাদী ৮১:১ ), (আ’রফুশ শাজী ৪৪৪) আর ‘শামায়েলে তিরমিজি'”

উনি আরও বলেন যে “চুল সামনে পিছে ছোট করে ছেটে রাখা’ এটা চুল ছোট রাখার জায়েজ পদ্ধতি, সুন্নাতে নবী (সাঃ) নয়”

এব্যাপারে আপনার নিকট আমার প্রশ্ন হল
১। ছোটবেলা থেকে এই পর্যন্ত আলেম ইমাম এমন কি খুতবাতেও শুনেছি চুল রাখার তিনটি তরিকা আছে যা মাথা মুন্ডানো বয়া ন্যাড়া করা , চারিদিক থেকে সমান ভাবে ছাঁটা আর বাবরী রাখা ঘাড় পর্যন্ত। এখন বাবরী ছাড়া অন্য তরিকা গুলোর কি আদৌ কি কোন দলিল নেই ?

২।  কোন আলেম এর কাছে এতদিন ধরে জানা কোন বিষয়ে বৈপরীত্য থাকলে আমার মতো আরবিতে মূর্খ ব্যক্তির দলিল চাওয়া কি বেয়াদবি ?

জাজাকাল্লাহুল খাইর।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحمن

১ম প্রশ্নের জবাব

চুল রাখা বিষয় উপরোক্ত মুরুব্বী সাহেব যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সঠিক।

রাসূল সাঃ থেকে শুধুমাত্র বাবরী রাখাই প্রমাণিত।স্বাভাবিক অবস্থায় হলক তথা চুল চেঁছে ফেলা বা ছোট করে রাখা প্রমানিত নয়।

হাদীসের মাধ্যমে কেবল দুইবার রাসূল সাঃ চুল কামিয়েছেন মর্মে পাওয়া যায়। দু’টিই হজ্বের সময়কার।

একবার বিদায় হজ্বের সময়। আরেকবার হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় রাসূল সাঃ এর কামিয়ে দিয়েছেন হযরত খারাশ বিন উমাইয়্যা রাঃ, এবং বিদায় হজ্বের সময় কামিয়েছেন হযরত মামার বিন আব্দুল্লাহ রাঃ। {ফাতহুল বারী-১/২৮৪, ৩/৫৬৪}

এছাড়া আর কখনো তিনি  চুল কামিয়েছেন মর্মে জানা যায় না।

যা প্রমাণ করে রাসূল সাঃ এর চুল বড় থাকতো। সেই বড়র পরিমাণ কত?

এ বিষয়ে তিন ধরণের বর্ণনা এসেছে। যথা-

ওয়াফরা তথা কানের লতি পর্যন্ত চুল।

লিম্মা তথা গর্দান ও কানের লতির মাঝামাঝি বরাবর বড় রাখা।

জুম্মা তথা ঘাড় পর্যন্ত আলম্বিত চুল।

عَنْ أَنَسٍ، قَالَ: «كَانَ شَعْرُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى شَحْمَةِ أُذُنَيْهِ» (سنن ابى داود، رقم الحديث-4185)

হযরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ এর চুল তাঁর দুই কানের লতি পর্যন্ত লম্বা ছিল।  {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪১৮৫}

عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: «كَانَ شَعْرُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَوْقَ الْوَفْرَةِ، وَدُونَ الْجُمَّةِ» (سنن ابى داود، رقم الحديث-

4187)

হযরত আয়শা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ এর চুল ঘাড়ের উপর এবং কানের নীচ পর্যন্ত লম্বা ছিল। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪১৮৭}

عَنِ الْبَرَاءِ، قَالَ: «مَا رَأَيْتُ مِنْ ذِي لِمَّةٍ أَحْسَنَ فِي حُلَّةٍ حَمْرَاءَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ» زَادَ مُحَمَّدُ بْنُ سُلَيْمَانَ: «لَهُ شَعْرٌ يَضْرِبُ مَنْكِبَيْهِ» (سنن ابى داود، رقم الحديث-4183)

হযরত বারা বিন আজেব রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি কোন ব্যক্তিকে কান পর্যন্ত বাবরীধারী, লাল ইয়ামেনী চাদরের আবরণে রাসূল সাঃ থেকে অধিক সুন্দর দেখিনি। রাবী মুহাম্মদ রহঃ অতিরিক্ত বর্ণনা করে বলেন যে, তাঁর চুল ঘাড় পর্যন্ত লম্বা ছিল। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪১৮৩}

হজ্ব শেষে চুল কামানো, আর অন্য সময় উপরোক্ত তিন পদ্ধতির বাবরি রাখাই রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণিত। আর কোন পদ্ধতির চুল রাখার কোন বর্ণনা রাসূল সাঃ থেকে প্রমানিত নয়।

তাই বাবরি রাখাই রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণিত সুন্নত। অন্য কোন পদ্ধতি রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণিত সুন্নত বলা যাবে না।

হ্যাঁ, হযরত আলী রাঃ সহ আরো কিছু সাহাবী থেকে চুল কামিয়ে ফেলা প্রমাণিত। যা চুল কামানোকে জায়েজ প্রমাণিত করে। কিন্তু এটি রাসূল সাঃ এর সুন্নত বলা যাবে না। সাহাবায়ে কেরামের সুন্নত বলা যাবে।

চুল রাখার ক্ষেত্রে একটি নিষিদ্ধ পদ্ধতি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। সেটি হল, মাথার এক পাশের  চুল কামিয়ে ফেলা, আরেকদিকের চুলকে রেখে দেয়া। এ পদ্ধতি নিষিদ্ধ তথা হারাম। তাই এ পদ্ধতিতে  চুল রাখা জায়েজ নয়।

আর কোন পদ্ধতির জায়েজ বা নাজায়েজের কোন কথা পরিস্কার ভাষায় হাদীসে বর্ণিত হয়নি। বা রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণিত নয়। তাই উপরোক্ত নিষিদ্ধ পদ্ধতি বাদ দিয়ে যেকোন পদ্ধতিতে চুল রাখা জায়েজ। যেমন সমস্ত মাথার চুল সমান করে কাটা। বা সামনে খানিক বড় পিছনে ছোট। বা একদিকে বড় আরেক দিকে ছোট ইত্যাদি পদ্ধতি যতক্ষণ না কোন বিধর্মীর অনুসরণে করা না হবে ততক্ষণ তা নাজায়েজ বলার কোন সুযোগ নেই।

তবে এক্ষেত্রে অন্য সকল বিষয়ের মত চুল রাখার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে, তা হল, চুলের কাটিং যেন কোন ফাসিক বা কাফির তথা বিধর্মী কোন ব্যক্তি বা দলের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ না হয়। যদি কোন কাফের বা ফাসিকের সাথে সাদৃশ্য রেখে চুল রাখা হয় তাহলে তা জায়েজ হবে না।

যেমন কোন বিধর্মী খেলোয়ারের হেয়ার স্টাইল নকল করে তার মত চুলে স্টাইল করা ইত্যাদি।

عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: «نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ القَزَعِ»، وَالْقَزَعُ: أَنْ يُحْلَقَ رَأْسُ الصَّبِيِّ فَيُتْرَكَ بَعْضُ شَعْرِهِ (سنن ابى داود، رقم الحديث-4193)

হযরত ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ কুযা করতে নিষেধ করেছেন। “কুযা”  বলা হয়, বাচ্চার মাথার একাংশ কামিয়ে ফেলা, আরেকাংশের  চুল না কামানো। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪১৯৩}


عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ

হযরত ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি যার সাদৃশ্য গ্রহণ করে, সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪০৩১}

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: كَانَتْ لِي ذُؤَابَةٌ، فَقَالَتْ لِي أُمِّي: لَا أَجُزُّهَا، «كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَمُدُّهَا، وَيَأْخُذُ بِهَا» (سنن ابى داود، رقم الحديث-4197)

হযরত আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার মাথায় চুলের খোঁপা ছিল। আমার মা বলেন, আমি তা কাটবো না। কেননা, রাসূল সাঃ তা ধরে লম্বা করতেন এবং কাছে টেনে নিতেন। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪১৯৭}

২য় প্রশ্নের জবাব

দলীল চাওয়া বেআদবী নয়। তবে বেআদবের মত প্রশ্ন করা বেআদবী। আদবের সাথেও যেমন অনেক কঠিন প্রশ্ন করলেও বেআদবী হয় না, আবার খুবই সহজ বিষয় বেআদবের প্রশ্ন করলে সেটি বেদআদবী হয়। আপনার প্রশ্ন করার স্টাইল ও মানসিকতার উপর নির্ভরশীল বেআদবী হচ্ছে না আদবের সাথেই করা হচ্ছে।

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল- ahlehaqmedia2014@gmail.com

lutforfarazi@yahoo.com

0Shares

আরও জানুন

‘সুন্দর সম্পর্ক কেন নষ্ট করে দিলা’ বলার দ্বারা কি স্ত্রী তালাক হয়ে যায়?

প্রশ্ন আস্সালামুআলাইকুম মুফতি সাহেব, এই প্রশ্ন কয়েকটা আগেও করেছিলাম, উত্তর না পেয়ে আবার করছি| ওয়াসওয়াসা …

No comments

  1. অসংখ্য ধন্যবাদ হুজুর – আল্লাহ পাক আপনাকে সবচাইতে উত্তম প্রতিদান দান করুন – আমিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *