প্রশ্নঃ
সালাম জনাব।
আমার বিয়ে হয়েছে ১০মাস হচ্ছে। বিয়ের কোন ওয়ালিমা করা হয়নি। আমার মায়ের খরচে বাসায় শুধু আকদ করা হয়েছিল। বিয়েতে আমার দেনমোহর ৫লক্ষ ধারন করা হয়,এক লক্ষ তাৎক্ষণিক উসুল দেখানো হয়।
বাকি চার লাখ দেবার সামর্থ্য তার ছিল না তখন। কিন্তু বিয়ের পর তার অ্যাকাউন্ট থেকে দুলাখ টাকা তুলে সে তার বাবা মাকে ওমরাহ হজ্জ্বের জন্য দিয়ে দেয়।
এর মধ্যে পরে দিবে এ আশ্বাসে আমি তাকে আমাকে স্পর্শ করতে দেই। এখনও সে স্বাভাবিক ভাবেই থাকছে মাঝে মাঝে।
তার কাছে এখন দেনমোহরের কথা তুললে সে পালটা বলে আমি তার বাসায় গিয়ে তার বাবা মায়ের সাথে থাকলে সে দেনমোহর দিতে বাধ্য এছাড়া আমি তার সম্পুর্ন স্ত্রী হইনি বলে দাবি করে।
আমি একটি বেসরকারি হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত। আমার বাবার বাসা থেকে যাতায়াত সুবিধা আছে তাই এখানেই থাকছি। সাথে তাদের বাসা অনেক দূরে এবং সেখানে পর্দা রক্ষার কোন উপায় নেই। আমি রুম থেকে এক পা বের হতে হলেও আমাকে খিমার/বড় হিজাব পড়ে বাইরে আসতে হয়। নাহলে সম্পুর্ন উন্মুক্ত,শ্বশুর দেবর থাকছে। রান্না ঘরে,খাবার ঘরে সারাক্ষন আমাকে বড় নামাজের হিজাবগুলো পড়ে থাকতে হয়। পর্দায় সমস্যা হচ্ছে সাথে যাওয়া আসার বিশাল রাস্তায় আমাকে অনেকক্ষন একা থাকতে হবে তাই মার কাছে আছি।
মাঝে তার চাকরি ছিল না,আমি তখনও আমার ডিউটি করেছি হাসপাতালে।
১.এই অবস্থায় দেনমোহর চাওয়া কী আমার জন্য নাজায়েজ?
২.আমি শ্বশুর -শাশুড়ি,দেবর ননদ এবং আরও অনেক আত্মীয়দের সাথে থাকতে চাই না- এটা কী হারাম ধরনের দাবি?
৩.আমার মায়ের বাড়ির অর্থনৈতিক সাহায্য ছাড়া সম্পুর্ন স্বামী ভরনপোষন বহন করবে অথবা তাকে সাহায্য করতে আমি আমার হাসপাতালের ডিউটি ডক্টরের চাকরি করতে ইচ্ছুক – এরকম দাবি কী অনৈতিক?
৪.পরনারী ও হারাম কাজে লিপ্ত এরকম কিছু সন্দেহে অনেক আগে থেকেই ওর সাথে আমার প্রায়ই ঝগড়া হয় এবং আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। বিয়ের পর একাধিক মেয়ের সাথে সে ঘুরেছে বাইক নিয়ে এই প্রমান পাবার পর থেকে আমি অসুস্থ হয়ে থাকি সব সময়। তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা দূরের কথা তার পরিবারের প্রতিটা মানুষকে আমার ঘৃণা হয়। প্রায়ই সিদ্ধান্ত নিই তার সাথে থাকবো না। এমতাবস্থায় স্বাভাবিক ভাবে তাকে আমার কাছে আসতে দেয়া কী উচিত?
শরীয়াহ মোতাবেক উত্তর দিয়ে আমাকে সাহায্য করবেন আশা করি।
From: sadiasiddiqua
[email protected]
উত্তরঃ
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
حامدا ومصليا ومسلما
প্রথমত আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি উত্তর দিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
প্রথম কথা হচ্ছে, বৈবাহিক জীবন আল্লাহ তাআলার প্রদত্ত এক অনন্য অনুগ্রহ, যা মানুষের জীবনে প্রশান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতি সৃষ্টি করার জন্যই নির্ধারিত। এটি কোনো দরকষাকষি, দরদাম বা হিসাব-নিকাশের সম্পর্ক নয়; বরং পারস্পরিক সম্মান, আন্তরিকতা, আত্মত্যাগ, প্রীতি, ভালোবাসা ও উত্তম আচরণ এই সকল মহৎ গুণাবলীর ওপর দাঁড়ানো একটি পবিত্র বন্ধন। দাম্পত্যের সৌন্দর্য তখনই ফুটে ওঠে, যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়েই একে অপরকে আল্লাহর আমানত মনে করে দায়িত্ব পালন করে, একে অপরকে সম্মান দেয়, একে অপরের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে এবং জীবনের প্রতিটি বাঁকে পরস্পরের জন্য সহায়ক হয়।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে এই সম্পর্ক কোমল হৃদয়ের যত্ন দাবি করে। অহংকার, অতিরিক্ত প্রত্যাশা, রাগ, অভিযোগ, অভিযোগের পাল্টা অভিযোগ, পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধা এসবই ধীরে ধীরে দাম্পত্যের সেই শান্তিময় পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যত বেশি টানাপোড়েন, কঠোরতা এবং একে অপরকে বোঝার অনীহা বাড়ে, ততই সম্পর্কের সৌন্দর্য হারিয়ে যায়; শান্তির পরিবর্তে অশান্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অথচ বিবাহ তো ছিল শান্তির প্রতীক, রহমতের ছায়া, হৃদয়ের প্রশান্তি যা আল্লাহ তাআলা নিজেই মানুষের কল্যাণের জন্য স্থির করে দিয়েছেন।
আজ আমাদের সমাজে দেখা যায়, অনেক সময় সামান্য বিষয়েও দাম্পত্য সম্পর্কে তিক্ততা তৈরি হয়, মতবিরোধকে বড় করে দেখা হয়, ছোট খাটো ভুলকে ক্ষমা করা হয় না, একে অপরের ভালো গুণগুলোকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র খুঁতগুলোর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়। ফলে আল্লাহর দান করা এই অমূল্য নিয়ামতকে আমরা নিজেরাই কঠিন করে তুলি, এমনকি কখনো কখনো সেটিকে নরকসম পরিবেশে পরিণত করে ফেলি। অথচ সামান্য ধৈর্য, সামান্য সহমর্মিতা, কিছুটা ক্ষমা ও উদারতা এই সম্পর্ককে পারে জান্নাতের বাগানে রূপান্তর করতে।
দ্বীতিয়ত আপনার প্রশ্নের উত্তরঃ
১নং উত্তরঃ
মহর হচ্ছে নারীর একটি নির্ধারিত অধিকার, এবং শরিয়ত তা দ্রুত পরিশোধের প্রতি বিশেষ জোর দিয়েছে। সুতরাং যদি সম্পূর্ণ মহর মুআজ্জাল (তাৎক্ষণিক পাওনা) হয়, তাহলে স্ত্রী মহর আদায় না হওয়া পর্যন্ত স্বামীকে দাম্পত্য অধিকারের দাবি থেকে বিরত রাখতে পারে। এ পরিস্থিতিতে স্বামীর কোনো ধরনের জবরদস্তির অধিকার নেই। তবে যদি স্ত্রী মহর মুআজ্জাল হওয়া সত্ত্বেও তা সঙ্গে সঙ্গে দাবি না করে, বরং স্বেচ্ছায় স্বামীকে দাম্পত্য অধিকার ভোগ করতে দেয়—তাহলে এতে কোনো দোষ নেই। আর এমন পরিস্থিতিতে স্বামী জোর করেও যদি শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়, তবুও তাকে ‘ব্যভিচারী’ বলা হবে না। কিন্তু বিপরীত দিক থেকে যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারীর সঙ্গে বিবাহ করে, মহর নির্ধারিত হয়, অথচ তার মনে মহর আদায় করার কোনো ইচ্ছাই না থাকে এবং সে মহর না দিয়েই স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে, তাহলে শরিয়তের দৃষ্টিতে সে ব্যক্তি ব্যভিচারী হিসেবে গণ্য হবে।
যদি মহর ততক্ষণাৎ আদায়ের জন্য নির্ধারিত না হয়, তাহলে তাতক্ষণিৎ মহর আদায়ের জন্য স্ত্রীর পক্ষ থেকে চাপাচাপি করা যাবে না।
مصنف ابن ابی شیبہ :
“قال النبي صلى الله عليه وسلم: من نكح امرأةً وهو يريد أن يذهب بمهرها فهو عند الله زان يوم القيامة”. (4/360)
الاختیار لتعلیل المختار :
“قال : ( وللمرأة أن تمنع نفسها وأن يسافر بها حتى يعطيها مهرها )؛ لأن حقه قد تعين في المبدل فوجب أن يتعين حقها في البدل تسويةً بينهما، وإن كان المهر كله مؤجلاً ليس لهاذلك؛ لأنها رضيت بتأخير حقها”. (3/122)
المبسوط للسرخسی:
” والدليل عليه أنها تحبس نفسها؛ لاستيفاء المهر، ولاتحبس المبدل إلا ببدل واجب وإن بعد الدخول بها يجب. ولا وجه لإنكاره؛ لأنه منصوص عليه في القرآن”. (6/190)
২নং উত্তরঃ
৩নং উত্তরঃ
৪নং উত্তরঃ
স্বামী পরকীয়ায় জড়ানোর পেছনে সাধারণত কয়েকটি কারণ একত্রে কাজ করে, যেমন ঈমান ও তাকওয়ার দুর্বলতা, দাম্পত্য সম্পর্কে মানসিক বা শারীরিক অসন্তোষ, পারস্পরিক যোগাযোগের অভাব, সম্মানহানি, চরিত্রের দুর্বলতা, সামাজিক ও অনলাইন প্রলোভন, অশ্লীলতার সহজলভ্যতা, খারাপ বন্ধুদের প্রভাব এবং দায়িত্বহীন মানসিকতা। এসব কারণে স্বামী ভুল পথের দিকে ঝুঁকে পড়ে, যদিও পরকীয়া কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়; এটি একটি গুরুতর কবিরা গুনাহ এবং পরিবার ধ্বংসের কারণ।
দাম্পত্য শান্তির জন্য পরামর্শ:
১. পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর স্বামীর জন্য আন্তরিকভাবে দু‘আ করুন।
২. তাকে মানসিকভাবে সহযোগিতা দিন। এটি আপনার সম্পর্কের জন্য কল্যাণকর।
৩. শরীয়তের বিরোধী নয় এমন কোনো আচরণ যদি তার অপছন্দ হয়, তা পরিহার করার চেষ্টা করুন।
৪. পরস্পরের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক ও বিতণ্ডা থেকে দূরে থাকুন।
৫. একে অপরকে বুঝার চেষ্টা করুন, প্রয়োজন হলে কথা বলে ভুল ধারণা দূর করুন।
৬. যতটা সম্ভব কাছাকাছি থাকুন, দূরত্ব কমান—মানসিক ও শারীরিক দু’দিকেই।
৭. দ্বীন ও ইসলাম সম্পর্কে পড়ুন, শিখুন, এবং কোমলভাবে স্বামীকেও দাওয়াত দিন।
৮. একে অপরের হালাল চাহিদাগুলো পূরণ করুন, এটি দাম্পত্য শান্তির মূল চাবিকাঠি।
৯. ভালো গুণগুলো প্রশংসা করুন; ছোট ছোট কথা বা কাজ দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করুন।
১০. রাগ এলে নীরব থাকুন; রাগের সময়ে সিদ্ধান্ত না নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
১১. ঘরোয়া পরিবেশকে শান্ত, পরিচ্ছন্ন ও ইতিবাচক রাখার চেষ্টা করুন।
১২. পরস্পরের প্রতি হেসে কথা বলা, সুন্দর আচরণ ও কোমল ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিন।
১৩. একে অপরের ভুল ক্ষমা করতে শিখুন; অহংকার বা জেদের কারণে দূরত্ব সৃষ্টি হতে দেবেন না।
১৪. দাম্পত্যে তৃতীয় পক্ষের অনুপ্রবেশ, যেমন অভিযোগ নিয়ে পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের কাছে দৌড়ানো, এড়িয়ে চলুন।
১৫. নিয়মিত স্বামী-স্ত্রী মিলে কিছু সময় একান্তে কাটান; এতে হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়।
ইনশাআল্লাহ, এসব আমল ও আচরণ দাম্পত্য জীবনে শান্তি, ভালোবাসা ও বোঝাপড়া ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে।
والله أعلم بالصواب
উত্তর লিখনে,
মুহা. শাহাদাত হুসাইন , ছাগলনাইয়া, ফেনী।
সাবেক শিক্ষার্থী: ইফতা বিভাগ
তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
সত্যায়নে
মুফতী লুৎফুর রহমান ফরায়েজী দা.বা.
পরিচালক– তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ইসলামিয়া দারুল হক লালবাগ ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা: জামিয়াতুস সুন্নাহ কামরাঙ্গিরচর, ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা: কাসিমুল উলুম আলইসলামিয়া, সালেহপুর আমীনবাজার ঢাকা।
পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।
শাইখুল হাদীস: জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, সনমানিয়া, কাপাসিয়া, গাজীপুর।
আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস Ahle Haq Media
