প্রশ্ন
লেখক কবি দার্শনিক জনাব ফরহাদ মজহার তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, “ইসলামে গান বাজনা হারাম কোথায়? কোথায় আছে? হযরত দাউদ নবী হলো কিভাবে? গান করেইতো তিনি নবী হয়েছেন?”
এ বিষয়ে সত্যতা জানতে চাই। আসলেই কি দাউদ আলাইহিস সালাম গান বাজনা করতেন। তিনি গান বাজনা করে নবী হয়েছেন?
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
লালন ধর্মের অনুসারী জনাব ফরহাদ মজহার হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে সুষ্পষ্ট অপবাদ আরোপ করেছেন। বাদ্যযন্ত্র সমৃদ্ধ হারাম গানকে বৈধতা দিতে একজন জলীলুল কদর নবীর উপর মিথ্যা আরোপ করা খুবই জঘন্য কাজ। গান করেই তিনি নবী হয়েছেন বলা আরো বেশি ধৃষ্টতা ও অমার্জনীয় বেআদবী।
হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম বাদ্য যন্ত্র দিয়ে কখনো গান করেছেন এমন কোন কথা কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীস এবং গ্রহণযোগ্য কোন ঐতিহাসিক গ্রন্থ দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং এটি একটি মিথ্যা অপবাদ ও গলদ মশহুর। যা লালন ধর্মের অনুসারী এবং বাউলরা বানিয়েছে। যার কোন ভিত্তি নেই।
দাউদ আলাইহিস সালামের কণ্ঠস্বর সুন্দর ছিল। তিনি চমৎকার সুরে তার উপর নাজিলকৃত জবুর কিতাব পাঠ করতেন।
এ সংক্রান্ত হাদীস দেখে নেই:
عَنْ أَبِيْ مُوْسَى عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لَهُ يَا أَبَا مُوْسَى لَقَدْ أُوْتِيْتَ مِزْمَارًا مِنْ مَزَامِيْرِ آلِ دَاوُدَ
আবূ মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আবূ মূসা! তোমাকে দাঊদ (আঃ)-এর সুমধুর কন্ঠ দান করা হয়েছে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫০৪৮, জামে তিরমিজী, হাদীস নং-৩৮৫৫, সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং-১০২২, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৩৪১]
عَنْ أَبِي مُوسَى، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لأَبِي مُوسَى “ لَوْ رَأَيْتَنِي وَأَنَا أَسْتَمِعُ لِقِرَاءَتِكَ الْبَارِحَةَ لَقَدْ أُوتِيتَ مِزْمَارًا مِنْ مَزَامِيرِ آلِ دَاوُدَ
আবূ মূসা (আল আশ’আরী) (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ মূসা (রাযিঃ) কে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ গতরাতে আমি যখন তোমার কুরআন পাঠ শুনছিলাম তখন যদি তুমি আমাকে দেখতে তাহলে খুব খুশী হতে। তোমাকে তো দাউদ এর মতো সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর দেয়া হয়েছে। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৭৩৭, ইফাবা-১৭২৫]
এ হাদীসের কোথাও গান বাদ্য এর কথা নেই। এখানে আসছে যে, সুন্দর কণ্ঠে কোন কিছু পাঠ করা। সুন্দর কণ্ঠের সাথে বাদ্যযন্ত্র এর কী সম্পর্ক? কণ্ঠ সুন্দর হবার জন্যতো বাদ্য যন্ত্র প্রয়োজন নেই। আর বাদ্যযন্ত্র থাকলেইতো কণ্ঠ সুন্দর হয়ে যায় না।
মূলত বাদ্যযন্ত্র দিয়ে যেমন কণ্ঠের গান শ্রুতিমধুর ও আকর্ষণীয় করার চেষ্টা কর হয়ে থাকে। এ কারণে উক্ত শব্দ দিয়ে সুমধুর কণ্ঠকে হাদীসে তাশবীহ তথা সাদৃশ্যায়ন করা হয়েছে। সাদৃশ্য দিলেও উক্ত বস্তু হুবহু প্রমাণিত বলা অজ্ঞতা ছাড়া আর কী? হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ কে সাইফুল্লাহ তথা আল্লাহর তরবারী বলা হয়। তাই বলে কি তিনি নিজেই তরবারী হয়ে গেছেন? এমন কথা বলা বোকামী ছাড়া আর কী?
ইমাম নববী রহঃ বলেন:
قوله ص فِي أَبِي مُوسَى الْأَشْعَرِيِّ أُعْطِيَ مِزْمَارًا مِنْ مَزَامِيرِ آلِ دَاوُدَ قَالَ الْعُلَمَاءُ الْمُرَادُ بِالْمِزْمَارِ هُنَا الصَّوْتُ الْحَسَنُ وَأَصْلُ الزَّمْرِ الْغِنَاءُ وَآلُ دَاوُدَ هُوَ دَاوُدُ نَفْسُهُ وَآلُ فُلَانٍ قَدْ يُطْلَقُ عَلَى نَفْسِهِ وَكَانَ دَاوُدُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَسَنَ الصَّوْتِ جِدًّا قَوْلُهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِأَبِي مُوسَى لَوْ رَأَيْتَنِي وَأَنَا أَسْمَعُ قِرَاءَتَكَ الْبَارِحَةَ لَقَدْ أُوتِيتَ مِزْمَارًا مِنْ مَزَامِيرِ آلِ دَاوُدَ (شرح صحيح مسلم للنووى، كتاب الصلاة، باب استحباب تحسين الصوب بالقرآن-6/80)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা হযরত আবূ মূসা আশআরী রাঃ ব্যাপারে যে, “তাঁকে দাউদ আলাইহিস সালামের মতো সমধুর কণ্ঠস্বর দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামগণ বলেন যে, এখানে ‘মিযমার’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ‘সুন্দর কণ্ঠ’। যদিও ‘যমর’ এর আসল অর্থ গান। আর ‘আলো দাউদ’ বলে উদ্দেশ্য খোদ দাউদ আলাইহিস সালাম। ‘আলো ফুলান’ শব্দ দ্বারা কখনো নিজেকেই বুঝায়। আর হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ছিলেন সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কথা আবূ মূসা আশআরী রাঃ কে যে, গতরাতে আমি যখন তোমার কুরআন পাঠ শুনছিলাম তখন যদি তুমি আমাকে দেখতে! তোমাকে দাউদ আলাইহিস সালামের সুমধুর কণ্ঠস্বর দেয়া হয়েছে। [শরহে মুসলিম-৬/৮০]
তাহলে আবূ মূসা আশআরী রাঃ এর সুমধুন কণ্ঠের কুরআন তিলাওয়াতকে দাউদ আলাইহিস সালামের কণ্ঠের সাথে তুলনা করা হয়েছে। সুতরাং এটাতে পরিস্কার যে, এখানে গান বাদ্য উদ্দেশ্য নয়। বরং কণ্ঠ সুন্দর উদ্দেশ্য। তাহলে ‘দাউদ আলাইহিস সালাম গান বাদ্য করতেন’ এমন উদ্ভট কথা কোত্থেকে আবিস্কার হলো?
আল্লামা ইরাকী রহঃ আরেকটু পরিস্কার করে ব্যাখ্যা করেছেন:
وَالْمُرَادُ بِالْمِزْمَارِ هُنَا الصَّوْتُ الْحَسَنُ وَأَصْلُهُ الْآلَةُ الَّتِي يُزَمَّرُ بِهَا شَبَّهَ حُسْنَ صَوْتِهِ وَحَلَاوَةَ نَغْمَتِهِ بِصَوْتِ الْمِزْمَارِ……
آلُ دَاوُد هُنَا هُوَ دَاوُد نَفْسُهُ وَآلُ فُلَانٍ قَدْ يُطْلَقُ عَلَى نَفْسِهِ (طرح التثريب في شرح التقريب الأسانيد وترتيب المسانيد، أبو الفضل زين الدين عبد الرحيم بن الحسين بن عبد الرحمن بن أبي بكر بن إبراهيم العراقي (ت ٨٠٦هـ)، كتاب الصلاة، باب تعاهد القرآن وحسن القراءة، فائدة تحسين الصوت بالقراءة وحكم القراءة بالألحان-3/105)
‘মিযমার’ দ্বারা এখানে উদ্দেশ্য হলো: সুন্দর কণ্ঠ। যদিও তার আসল অর্থ হলো বাঁশি যা দিয়ে বাজানো হয়। সুমধুর কণ্ঠ এবং সুরের মাধুর্যতাকে তাশবীহ তথা সাদৃশ্যায়ন করা হয়েছে বাঁশির আওয়াজের সাথে। ‘আলো দাউদ’ দ্বারা এখানে উদ্দেশ্য হলো হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম নিজে। আর ‘আলো ফুলান’ দ্বারা নিজেকেই বুঝায়। [তরহুত তাছরীব-৩/১০৫]
وَالْمُرَادُ بِالْمِزْمَارِ الصَّوْتُ الْحَسَنُ وَأَصْلُهُ الْآلَةُ أُطْلِقَ اسْمُهُ عَلَى الصَّوْتِ لِلْمُشَابَهَةِ (فتح البارى لابن حجر، كتاب التفسير، باب الترجيع-9/93، تحت رقم الحديث-5048)
সুতরাং বুঝা গেল, ‘হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম গান বাজনা করতেন, তিনি গান বাজনা করে নবী হয়েছেন’ বলা চরম পর্যায়ের মূর্খতা। সেই সাথে নবীর উপর মিথ্যা অপবাদ। অবিলম্বে ফরহাদ মজহারের উপরোক্ত কুফরী বক্তব্যের জন্য তওবা করতঃ উম্মতে মুসলিমার ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হানার অপরাধে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ইসলামিয়া দারুল হক লালবাগ ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা: কাসিমুল উলুম আলইসলামিয়া, সালেহপুর আমীনবাজার ঢাকা।
পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।
শাইখুল হাদীস: জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, সনমানিয়া, কাপাসিয়া, গাজীপুর।
ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com