প্রশ্ন:
কোন কারণে ফজরের সুন্নত যদি কেউ পড়তে না পারে তবে সে এই সুন্নতের কাযা কখন আদায় করবে?
সুর্য উদিত হবার আগে না সুর্য উদিত হবার পর?
আমাদের দেশে কতিপয় আহলে হাদিসের লোকেরা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে যে, সুর্য উদিত হবার আগে সুন্নত আদায় করলে তা আদায় হবে।
এই মর্মে নাকি বুখারী শরীফে হাদিস আছে। সুতরাং এই বিভ্রান্তির অপনোদনে হাদিসের দলিলসহ বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানালে উপকৃত হব।
জবাব:
بسم الله الرحمن الرحيم
ফজরের সুন্নত কোন কারণে পড়তে না পারলে তার কাযা আদায় করবে সুর্য উদিত হবার পর।
আগে আদায় করা জায়েজ নয়। যারা আগে আদায় করার কথা বলেন তাদের ব্ক্তব্যটি বিশুদ্ধ নয়।
কারণ নবীজি সা: থেকে متواتر (নিরবচ্ছিন্ন সূত্র পরম্পরায়) বর্নিত হাদিসে এসেছে যে, তিন সময়ে নামায পড়া জায়েজ নয়।
তার মাঝে একটি সময় হল-“ফজরের ফরয পড়ার পর থেকে সুর্য উদয় হবার আগ পর্যন্ত।”
তাছাড়া নবীজি সা: থেকে বিভিন্ন হাদিসে এসেছে যে, নবীজি বলেছেন যে, কারো ফজরের দুই রাকাআত সুন্নত ছুটে গেলে সে যেন তা সুর্য উদিত হবার পর আদায় করে।
সূর্যোদয়ের আগে ফজরের সুন্নত পড়ার ক্ষেত্রে একটি হাদিস পাওয়া যায়, যা স্পষ্ট নয়, নিম্নে হাদিসটির ক্ষেত্রে বিস্তারিত আলোচনা বিধৃত হল।
আর বুখারীতে এই মর্মে কোন হাদিস আমরা পাইনি। সুতরাং এটাই সহীহ কথা যে, ফজরের কাযা হওয়া সুন্নত সূর্যোদয়ের আগে পড়া জায়েজ নয়।
দলিল:
أَبَا سَعِيدٍ الخُدْرِيَّ، يَقُولُ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «لاَ صَلاَةَ بَعْدَ الصُّبْحِ حَتَّى تَرْتَفِعَ الشَّمْسُ، وَلاَ صَلاَةَ بَعْدَ العَصْرِ حَتَّى تَغِيبَ الشَّمْسُ
অনুবাদ-হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা: বলেন-আমি নবীজি সা: কে বলতে শুনেছি যে, ফজরের নামাযের পর সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত কোন নামায নেই, এবং আসরের পর সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত কোন নামায নেই। (সহীহ বুখারী-১/৮২, হাদীস নং-৫৮৬)
صَلِّ صَلَاةَ الصُّبْحِ، ثُمَّ أَقْصِرْ عَنِ الصَّلَاةِ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ حَتَّى تَرْتَفِعَ، فَإِنَّهَا تَطْلُعُ حِينَ تَطْلُعُ بَيْنَ قَرْنَيْ شَيْطَانٍ، وَحِينَئِذٍ يَسْجُدُ لَهَا الْكُفَّارُ
অনুবাদ-আমর বিন আবাসা আস সুলামী রা: বলেন-আমি বললাম-হে আল্লাহর নবী! আপনি আমাকে নামায সম্পর্কে শিক্ষা দিন, রাসুলুল্লাহ সা: বললেন-ফজরের নামায আদায় করবে। তারপর সূর্য পূর্বাকাশে উঁচু হওয়া পর্যন্ত নামায পড়া থেকে বিরত থাকবে। কেননা সূর্য শয়তানের দুই শিংয়ের মধ্যখানে উদিত হয়, এবং সে সময় কাফেররা সূর্যকে সিজদা করে। (সহীহ মুসলিম-১/২৭৬, হাদীস নং-৮৩২)
أَنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ عُمَرَ فَاتَتْهُ رَكْعَتَا الْفَجْرِ، فَقَضَاهُمَا بَعْدَ أَنْ طَلَعَتِ الشَّمْسُ
অনুবাদ-হযরত ইমাম মালেক রহ: বলেন, আমি জেনেছি যে, আবদুল্লাহ বিন ওমর রা: এর ফজরের দুই রাকাআত ছুটে গিয়েছিল। তিনি তা সূর্যোদয়ের পর আদায় করেন। (মুয়াত্তা মালিক-৪৫, হাদীস নং-৪২২)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ لَمْ يُصَلِّ رَكْعَتَيِ الفَجْرِ فَلْيُصَلِّهِمَا بَعْدَ مَا تَطْلُعُ الشَّمْسُ
অনুবাদ-হযরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত যে, নবীজি সা: বলেন-যে ফজরের দুই রাকআত সুন্নত (সময়মতো) পড়ল না সে যেন সূর্যোদয়ের পর তা আদায় করে। ( জামে তিরমিজী-১/৯৬, হাদীস নং-৪২৩)
একটি সন্দেহ ও তার অপনোদন
কতিপয় ওলামায়ে কিরাম বলেন-ফজরের সুন্নতের কাযা সূর্যোদয়ের আগে পড়া জায়েজ। তারা দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন জামে তিরমিজীতে বর্ণিত নিম্নের হাদিসটি-
عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِبْرَاهِيمَ، عَنْ جَدِّهِ قَيْسٍ قَالَ: خَرَجَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأُقِيمَتِ الصَّلاَةُ، فَصَلَّيْتُ مَعَهُ الصُّبْحَ، ثُمَّ انْصَرَفَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَوَجَدَنِي أُصَلِّي، فَقَالَ: مَهْلاً يَا قَيْسُ، أَصَلاَتَانِ مَعًا، قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنِّي لَمْ أَكُنْ رَكَعْتُ رَكْعَتَيِ الفَجْرِ، قَالَ: فَلاَ إِذَنْ.
অনুবাদ-কায়েস রা: বলেন-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম(মসজিদে) তাশরীফ আনলেন। আমি তাঁর সঙ্গে ফজরের নামায পড়লাম। নামায শেষে প্রস্থানের সময় তিনি দেখলেন, আমি নামায পড়ছি। তিনি তখন বললেন-“কায়েস! তুমি দুই নামায একসাথে পড়ছো কেন?” আমি বললাম-“আমার ফজরের দুই রাকআত (সুন্নত) পড়া হয়নি।” তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- ” فلا اذن “তাহলে অসুবিধা নেই/তবুও অনুমতি নেই।
আমরা ভালো করে খেয়াল করলে বুঝব যে, উক্ত হাদিস দিয়ে দলিল দেয়া শুদ্ধ হবেনা দু’টি কারণে। যথা-
১ম কারণ!
উক্ত হাদিসের ” فلا اذن “শব্দটি দ্বারা কী উদ্দেশ্য তা স্পষ্ট নয়।
এর অর্থ দু’টি হতে পারেঃ
তথা-
ক. কোন অসুবিধা নেই।
খ. তারপরও অনুমতি নেই।
সুতরাং যেহেতো স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছেনা নবীজির শব্দ দ্বারা কী উদ্দেশ্য তাই এটিকে দলিল ছাড়া মেনে নেবার কোন যুক্তি নেই।
অন্যদিকে নিষিদ্ধতার হাদিস স্পষ্ট বুঝাচ্ছে যে, এ সময় নামায পড়া জায়েজ নয়, এবং এর কাযা করবে সূর্য উদিত হবার পর, যেমন পূর্বে বর্ণিত বুখারী মুসলিম ও মুয়াত্তা মালিক ও তিরমিজী শরীফের হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়।
২য় কারণ
উক্ত হাদিসটি মুরসাল তথা এর সূত্র নিরবচ্ছিন্ন নয়। যেমন ইমাম তিরমিজী রহ: এই হাদিস বর্ণনা করার পর উক্ত হাদিসের ব্যাপারে মন্তব্য করেনঃ
وَإِنَّمَا يُرْوَى هَذَا الحَدِيثُ مُرْسَلاً……..وَإِسْنَادُ هَذَا الحَدِيثِ لَيْسَ بِمُتَّصِلٍ مُحَمَّدُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ التَّيْمِيُّ لَمْ يَسْمَعْ مِنْ قَيْسٍ.
অনুবাদ-বর্ণাটি মুরসাল, এর সনদ মুত্তাসিল (নিরবচ্ছিন্ন সূত্রে) নয়। কেননা মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম কায়েস থেকে শোনেননি।
প্রামান্য গ্রন্থাবলী:
১. সহীহ বুখারী-১/৮২
২. সহীহ মুসলিম১/২৭৬
৩.তিরমিজী শরীফ-১/৯৬
৪. মুয়াত্তা মালিক-৪৫
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উক্ত হাদিসের ” فلا اذن “শব্দটি দ্বারা কী উদ্দেশ্য তা স্পষ্ট নয়। এর অর্থ দু’টি হতে পারে তথা-ক. কোন অসুবিধা নেই। খ. তারপরও অনুমতি নেই। সুতরাং যেহেতো স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছেনা নবীজির শব্দ দ্বারা কী উদ্দেশ্য তাই এটিকে দলিল ছাড়া মেনে নেবার কোন যুক্তি নেই। অন্যদিকে নিষিদ্ধতার হাদিস স্পষ্ট বুঝাচ্ছে যে, এ সময় নামায পড়া জায়েজ নয়, এবং এর কাযা করবে সূর্য উদিত হবার পর, যেমন পূর্বে বর্ণিত বুখারী মুসলিম ও মুয়াত্তা মালিক ও তিরমিজী শরীফের হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়।
-মাশা’আল্লাহ্। খুব সাবলীলভাবে বিভ্রান্তি নিরসন করেছেন!
আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম জা’যাক দান করুন (আমীন)