প্রচ্ছদ / আকিদা-বিশ্বাস / আমাদের নবী কি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী নন?

আমাদের নবী কি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী নন?

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। কোন মুসলমানের এ বিষয়ে কোন মতভেদ কখনোই ছিল না। নবীযুগ থেকে নিয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত পুরো দুনিয়া এ বিষয়ে একমত।

সেই সাথে পুরো মুসলিম উম্মাহ এ বিশ্বাস করে যে, আগের সমস্ত নবীগণও সত্য নবী ছিলেন। আমরা তাদেরকে নবী হিসেবে সম্মান ও ইজ্জত করি। কোন নবীকে অসম্মান বা অবিশ্বাস করাকে কুফরী মনে করি। তাদের মাঝে কতক নবী মর্যাদার দিক থেকে কতক নবী থেকে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু নবী হিসেবে সবাই সমান।

এর মাঝে মর্যাদার দিক থেকে কতিপয় নবীকে কতিপয় নবীর উপর আল্লাহ তাআলা শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।

ইরশাদ হচ্ছে:

وَلَقَدْ فَضَّلْنَا بَعْضَ النبيين على بَعْضٍ وَآتَيْنَا دَاوُودَ زَبُوراً 

আমি কতক নবীকে কতক নবীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। আর আমি দাউদকে যাবূর দিয়েছিলাম। [সূরা বনী ইসরাঈল-৫৫]

 تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِنْهُمْ مَنْ كَلَّمَ اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ

এই যে রাসূলগণ, তাদের কতককে কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তাদের মধ্যে কেউ এমন আছে, যার সঙ্গে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে তিনি বহু উঁচু মর্যাদা দান করেছেন। [সূরা বাকারা-১৮৯]

মর্যাদাপ্রাপ্ত নবীদের মাঝে আমাদের নবী সবচে’ শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম।

সৌদী আরব, ইরাক, ইরান, লিবিয়া, তুরস্ক, লেবানন, কাতার, কুয়েত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ সারা পৃথিবীর মুসলমাগণ আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শ্রেষ্ঠ নবী বিশ্বাস করে থাকে। নবী যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত পুরো দুনিয়ার মুসলিম উম্মাহ এ বিশ্বাসই লালন করে থাকে।

এমন কি আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিও এ বিশ্বাসই পোষণ করেন। প্রতি বছরে ১২ই রবিউল আউয়ালে প্রকাশিত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বাণীতে পরিস্কার শব্দে লেখা থাকে “সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল”।

এর প্রমাণ কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসের মাঝে স্পষ্ট।

কুরআন থেকে

وَإِذۡ أَخَذَ ٱللَّهُ مِيثَٰقَ ٱلنَّبِيِّـۧنَ لَمَآ ءَاتَيۡتُكُم مِّن كِتَٰبٖ وَحِكۡمَةٖ ثُمَّ جَآءَكُمۡ رَسُولٞ مُّصَدِّقٞ لِّمَا مَعَكُمۡ لَتُؤۡمِنُنَّ بِهِۦ وَلَتَنصُرُنَّهُۥۚ قَالَ ءَأَقۡرَرۡتُمۡ وَأَخَذۡتُمۡ عَلَىٰ ذَٰلِكُمۡ إِصۡرِيۖ قَالُوٓاْ أَقۡرَرۡنَاۚ قَالَ فَٱشۡهَدُواْ وَأَنَا۠ مَعَكُم مِّنَ ٱلشَّٰهِدِينَ 

এবং (তাদেরকে সেই সময়ের কথা স্মরণ করাও) যখন আল্লাহ নবীগণ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন, আমি যদি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত দান করি, তারপর তোমাদের নিকট কোন রাসূল আগমন করে, যে তোমাদের কাছে যে কিতাব আছে তার সমর্থন করে, তবে তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং অবশ্যই তার সাহায্য করবে। আল্লাহ (সেই নবীদেরকে) বলেছিলেন, তোমরা কি একথা স্বীকার করছ এবং আমার পক্ষ হতে প্রদত্ত এ দায়িত্ব গ্রহণ করছ? তারা বলেছিল, আমরা স্বীকার করছি। আল্লাহ বললেন, তবে তোমরা (একে অন্যের স্বীকারোক্তি সম্পর্কে) সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী থাকলাম। [আলে ইমরান – ৮১]

উক্ত আয়াতে সমস্ত নবীগণ থেকে রূহের জগতে আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে স্বীকারোক্তি নেয়া হয়েছে। যেন তাদের জীবদ্দশায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলে তার উপর ঈমান আনবে এবং তার সহযোগী হবে। এরপর সমস্ত নবীরা এর উপর স্বীকারোক্তি দিলেন।

এ আয়াতে ‘রাসূল’ বলে আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে সমস্ত মুফাসসিরগণ একমত।

এ হিকমতেই আগের কোন নবীর কালিমায় রাসূলুল্লাহ নেই। কারো কালিমায় খলীলুল্লাহ, কারো কালিমায় রুহুল্লাহ, কারো কালিমায় নাবিয়্যুল্লাহ, সিদ্দিকুল্লাহ। আর আমাদের নবীর কালিমায় রয়েছে একমাত্র ‘রাসূলুল্লাহ’।

এ আয়াত পরিস্কার প্রমাণ করে যে, আমাদের নবী সব নবীর সর্দার বা নেতা।

وَمَآ ‌أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا رَحۡمَةٗ لِّلۡعَٰلَمِينَ 

(হে নবী) আমি তোমাকে বিশ্ব জগতের জন্য কেবল রহমাত করেই পাঠিয়েছি। [সূরা আম্বিয়া-১০৭]

আগের কোন নবীকে পুরো দুনিয়ার জন্য পাঠানো হয়নি। গোত্র, সম্প্রদায়, বা নির্দিষ্ট এলাকার জন্য পাঠানো হয়েছে। আমাদের নবীকেই কেবল পুরো দুনিয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে। যাও সর্বশেষ্ঠ নবী হবার প্রমাণ।

‌وَمَآ ‌أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا كَآفَّةٗ لِّلنَّاسِ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗا وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَعۡلَمُونَ 

(হে নবী) আমি তোমাকে সমস্ত মানুষের জন্য একজন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই পাঠিয়েছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বুঝছে না। [সূরা সাবা-২৮]

সকল মানুষের জন্য আর কোন নবীকে পাঠানো হয়নি। এটাও সর্বশ্রেষ্ঠ হবার পরিস্কার প্রমাণ।

وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ ‌وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّـۧنَۗ 

কিন্তু তিনি আল্লাহর রাসূল এবং নবীদের মধ্যে  সর্বশেষ। [সূরা আহযাব-৪০]

সর্বশেষ হওয়াও শ্রেষ্ঠত্বের একটি আলামত। কারণ, সর্বশেষে তাকেই পাঠানো হয়, যিনি আগের আগতদের চেয়ে স্পেশাল হয়ে থাকেন।

عَسَىٰٓ ‌أَن ‌يَبۡعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامٗا مَّحۡمُودٗا 

আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে ‘মাকামে মাহমুদ’ তথা প্রশংসনীয় স্থানে পৌছাবেন। [সূরা বনী ইসরাঈল-৭৯]

মাকামে মাহমূদ হাশরের ময়দানের একটি পদমর্যাদা। যা কেবল আমাদের নবীকে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এর দ্বারাও পরিস্কার যে, আমাদের নবী অন্য নবীদের চেয়ে মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ।

হাদীস থেকে

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِي دَعْوَةٍ، فَرُفِعَ إِلَيْهِ الذِّرَاعُ، وَكَانَتْ تُعْجِبُهُ، فَنَهَسَ مِنْهَا نَهْسَةً وَقَالَ ‏‏ أَنَا سَيِّدُ الْقَوْمِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ،

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে এক যিয়াফতে উপস্থিত ছিলাম। তাঁর সামনে (রান্না করা) ছাগলের বাহু পেশ করা হল, এটা তাঁর কাছে পছন্দনীয় ছিল। তিনি সেখান থেকে এক টুকরা খেলেন এবং বললেন, আমি কিয়ামতের দিন সমগ্র মানব জাতির সরদার হব। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩৩৪০, ইফাবা-৩১০৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৩৬৮]

أَبُو هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَأَوَّلُ مَنْ يَنْشَقُّ عَنْهُ الْقَبْرُ وَأَوَّلُ شَافِعٍ وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি কিয়ামতের দিনে আদম সন্তানদের নেতা হব এবং আমিই প্রথম ব্যক্তি যার কবর উন্মুক্ত করে দেয়া হবে এবং আমিই প্রথম সুপারিশকারী ও প্রথম সুপারিশ গৃহীত ব্যক্তি। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৫৭৪১, সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং-৪৬৭০]

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ فَخْرَ وَبِيَدِي لِوَاءُ الْحَمْدِ وَلاَ فَخْرَ وَمَا مِنْ نَبِيٍّ يَوْمَئِذٍ آدَمُ فَمَنْ سِوَاهُ إِلاَّ تَحْتَ لِوَائِي

আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন আমিই হব বনী আদমের সরদার। এতে কোন অহংকার নেই; আমার হাতেই থাকবে হামদের পতাকা, এতে কোন অহংকার নেই; আদম এবং অন্যান্য সকল নবীই ঐ দিন আমার পতাকার নিচে থাকবেন। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৩১৪৮]

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ فُضِّلْتُ عَلَى الأَنْبِيَاءِ بِسِتٍّ أُعْطِيتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ وَنُصِرْتُ بِالرُّعْبِ وَأُحِلَّتْ لِيَ الْغَنَائِمُ وَجُعِلَتْ لِيَ الأَرْضُ طَهُورًا وَمَسْجِدًا وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً وَخُتِمَ بِيَ النَّبِيُّونَ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাকে ছয়টি জিনিস দ্বারা অন্য নবীদের (নবীদের) উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে ১. আমাকে ব্যাপক তথ্যপূর্ণ ও অর্থবহ বাণী দান করা হয়েছে; ২. আমাকে প্রবল প্রভাব দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে; ৩. আমার জন্য গনিমতের মাল হালাল করা হয়েছে; ৪. আমার জন্য মাটিকে পবিত্রকারী ও মসজিদ বানানো হয়েছে; ৫. আমাকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে; ৬. আমার দ্বারা নবীদের সীল মোহর (নবুওয়াতের সমাপ্তি) করা হয়েছে। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১০৫০, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-১৫৫৩, ইফাবা-১৫৫৯]

قال القاضي عياض – رحمه الله -:  لا خلاف أنه أكرم البشر، وسيد ولد آدم، وأفضل الناس منزلة عند الله، وأعلاهم درجة، وأقربهم زلفى، واعلم أن الأحاديث الواردة في ذلك كثيرة جداً” انتهى ( كتاب الشفا-1/165)

কাযী আয়াজ রহঃ বলেছেন, এতে কোন মতভেদ নেই যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের মাঝে সবচে’ বেশি সম্মানিত। বনী আদমের সর্দার। আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম মানুষ। স্তরের দিক থেকে সর্বোচ্চ। সবচে’ বেশি নৈকট্যশীল। জেনে রাখো, এ সংক্রান্ত বর্ণনা অনেক আছে। [আশশিফা-১/১৬৫]

এরকম পরিচ্ছন্ন আয়াত ও বিশুদ্ধ হাদীস এবং উম্মতের ইজমায়ী একটি মাসআলা অস্বিকার করে মুরতাদ আবূ সাঈদ খান তার ‘প্রচলিত ও প্রকৃত ইসলাম: একটি পর্যালোচনা’ বইয়ের একাধিক স্থানে চরম ধৃষ্টতার সাথে কী কী শব্দ প্রয়োগ করেছে তা একটু দেখে নিন।

“সর্বশেষ্ঠ তত্ত্বের মিথ্যাটি প্রবল দাপটে বিরাজমান থাকায় সকল নবী রাসূলের মহান ও উত্তম আদর্শের বয়ান সম্বলিত কুরআনী সত্য আমাদের দৃষ্টি থেকে দূরিভূত। তাই মিথ্যার মহাপ্রাচীরকে গুড়িয়ে দিতে পারলে একজন মুমিন মুসলিম হিসেবে কুরআন নির্দেশিত দায় দায়িত্ব সহজে চিহ্নিতকরণ, পরিপালন ও বাস্তবায়ন আমাদের জন্য সহজ হবে। [প্রাগুক্ত-২০]

‘ইমামুল আম্বিয়া’ তত্ত্বের বিষবৃক্ষই ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণার সূতিকাগার!

দীন ইসলামের শত বিভ্রান্তি, ভেজাল নিয়ে আমরা নিরন্তর কথা বলছি। কিন্তু বিভ্রান্তির গোড়া (আরবিতে বলে আছল) চিহ্নিত করতে পারতে হবে। শেষ নবীর নামে সর্বশ্রেষ্ঠত্ব তত্ত্ব ইসলামের নামে উদ্ভাবিত সবচেয়ে ভয়াবহতম কিন্তু অতি জনপ্রিয় মিথ্যাবচন। এই মিথ্যাকে পুঁজি করেই প্রায় যাবতীয় ধর্ম-ভিত্তিক ব্যবসাগুলো পরিচালিত হয়।

শেষ নবীকে নিয়ে ‘আশরাফুল আম্বিয়া’ বা ‘ইমামুল আম্বিয়া’ বা ‘সাইয়্যিদুল মুরসালীন’ সংক্রান্ত ধারণা সবচেয়ে বড় মাপের ডাহা মিথ্যাচার। ইসলামের নামে এ যাবৎকালে যত যত মিথ্যা উদ্ভাবন করা হয়েছে তার মধ্যে বলা যায়, এটি হচ্ছে সকল ‘মিথ্যার মা’এটি খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদের চাইতেও ভয়ংকর এক বিষবৃক্ষ যার ফল ভক্ষণ মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের মুনাফিক এবং মুশরিকে পরিণত করছে। প্রতিনিয়ত মিথ্যা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহ ‘নকল মুসলমানে’ পরিণত হয়েছে। [প্রাগুক্ত-৩২]

নবীকে শ্রেষ্ঠ নবী বলা খৃষ্টানদের ত্রিত্ববাদের শিরকী আকীদাতুল্য?

খ্রিস্টানদের ‘ত্রিত্ববাদ (Doctrine of the Trinity)’-এর মোকাবেলায় মুসলমানদের একটি সম্প্রদায় ‘সর্বশ্রেষ্ঠত্ববাদ (Doctrine of the Superiority)’ উদ্ভাবন করেছে এবং নিষ্ঠার সাথে তাকে লালন করে চলেছে। এখানে খ্রিস্ট সম্প্রদায় তাদের পূর্বসূরি ইহুদি সম্প্রদায়ের পথই অনুসরণ করেছে; যেভাবে মুসলমান তাদের পূর্বসূরি খ্রিস্টানদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। [প্রাগুক্ত-৩৩]

ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন। মুরতাদ আবু সাঈদ খানের উপরোক্ত বক্তব্যে তার কয়েকটি দাবী পরিস্কার।

আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল নবীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হবার বিষয়টি সর্বৈব মিথ্যা। [নাউজুবিল্লাহ]

এতো বড় মিথ্যা যে, এর কারণেই কুরআনের উপর আমল করা সম্ভব হচ্ছে না।

শ্রেষ্ঠ নবী নির্ধারণ করাটাই দ্বীনে ইসলামের সবচে’ বড় বিভ্রান্তি ও ভেজালের কারণ?

আমাদের নবীকে শ্রেষ্ট নবী বিশ্বাস করার আকীদা খৃষ্টানদের ত্রিত্ববাদের আকীদার চেয়েও জঘন্য?

শ্রেষ্ঠ নবী মানার কারণেই মুসলিম উম্মাহ মুনাফিক ও মুশরিক এবং নকল মুসলমান হয়েছে।

তাহলে আবু সাঈদ খানের ভাষ্য অনুপাতে নববী যুগ থেকে আজ পর্যন্তের হাজার কোটি মুসলমান এবং বর্তমানে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ সারা দেশের মুসলমানগণ এবং সারা বিশ্বের মুসলমাগণ খৃষ্টানদের চেয়ে নিকৃষ্ট এবং মুনাফিক ও মুশরিক?

এত বড় স্পর্ধা? এত বড় দুঃসাহস আবু সাঈদ মিয়ার হলো কিভাবে? ইসলামী রাষ্ট্র হলে আবু সাঈদের প্রকাশ্য ফাসি কার্যকর করা হতো মুরতাদ হওয়ার শাস্তি হিসেবে।

সাড়ে চৌদ্দশত বছর পরে এসে একমাত্র মুসলমান হয়েছেন আবু সাঈদ খান। আর সবাই নবীকে শ্রেষ্ঠ নবী মানার কারণে মুশরিক কাফের।

আসলে যে সারা দুনিয়াকে মুশরিক কাফের বলে আসলে সে নিজেই কাফের হয়ে থাকে।

হাদীস বলে:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: ” إِذَا قَالَ الرَّجُلُ: هَلَكَ النَّاسُ فَهُوَ أَهْلَكُهُمْ “

আবু হুরায়রা (রাঃ) সুত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন তুমি কোন ব্যাক্তিকে বলতে শুনবে, সকল লোক ধংস হয়েছে, তখন সে-ই তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ধংসের কবলে পড়বে। অথবা সে যেন তাদের ধংস করলো| [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৯৮৩, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৬২৩, মিশকাত মাআ মিরকাত-৯/৫৮, হাদীস নং-৪৮২১]

عَنْ أَبِي ذَرٍّ ـ رضى الله عنه ـ أَنَّهُ سَمِعَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ “‏ لاَ يَرْمِي رَجُلٌ رَجُلاً بِالْفُسُوقِ، وَلاَ يَرْمِيهِ بِالْكُفْرِ، إِلاَّ ارْتَدَّتْ عَلَيْهِ، إِنْ لَمْ يَكُنْ صَاحِبُهُ كَذَلِكَ

আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ একজন অপর জনকে ফাসিক বলে যেন গালি না দেয় এবং একজন অন্যজনকে কাফির বলে অপবাদ না দেয়। কেননা, অপরজন যদি তা না হয়, তবে সে অপবাদ তার নিজের উপরই আপতিত হবে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৬০৪৫]

সুতরাং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস অনুপাতে বলতে চাই: সারা দুনিয়া নয় আবু সাঈদ খান নিজেই মুনাফিক এবং মুশরিক ও কাফের তথা মুরতাদ হয়েছেন পুরো উম্মতকে মুশরিক বলার কারণে।

এবার আসুন জেনে নেই আমাদের নবী শ্রেষ্ঠ নবী হওয়া কি কুরআনের খেলাফ?

ক)

‘কুরআন’ কুরআন হয়েছে আমাদের নবীর জবানে তা কুরআন বলে স্বীকৃতি দেবার কারণে। সুতরাং নবীজীর কুরআন বলে কথা যেমন দলীলযোগ্য প্রমাণ্য। তেমনি নবীর জবানে বলা দ্বীনের ও ঈমানের প্রতি কথাই দলীলযোগ্য ও প্রমাণ্য।

এ কারণেই কুরআনে পরিস্কার ভাষায় আল্লাহর আনুগত্যের সাথে নবীর আনুগত্য এবং নবীকে নিজের জীবনের উত্তম আদর্শ মানতে বারবার বলা হয়েছে।

কুরআনে কোথাও ‘আমাদের নবী সকল নবীর উপর শ্রেষ্ঠ নয়’ এমন কথা বলা হয়নি। বরং কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আমাদের নবী শ্রেষ্ঠ হবার প্রতি পরিস্কার ইংগিত রয়েছে।

খ)

আমাদের নবী সকল নবীর উপর শ্রেষ্ঠ হওয়া আর খৃষ্টানদের ত্রিত্ববাদ এক হওয়ার সাযুজ্যতা করার দ্বারা আবু সাঈদ খান তার মূর্খতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন।

কারণ, খৃষ্টানরা ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর  সন্তান বলে এবং তার সমকক্ষ বলে। তাকেও একজন গড বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু পরক্ষণে দুনিয়ার কোন মুসলমান মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর সন্তান বা তার সমকক্ষ, কিংবা তিনি ইবাদতের উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব বলেও না, বিশ্বাসও করে না।

মুসলমানরা বলে যে, মানুষের মাঝে আমাদের নবী সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহর বান্দাদের মাঝে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ।

যেমন ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার একটি জনমত জরিপে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী’ শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বাচিত করা হয়।

এখন বাঙ্গালী  হিসেবে শেখ মজিবুর রহমান শ্রেষ্ঠ হওয়া কি তাকে রবের আসনে বসানো? এটা ত্রিত্ববাদের সমমানের?

আপনি কি পাগল নাকি অশিক্ষিত?

কোথায় খ্রিষ্টানদের ত্রিত্ববাদের আকীদা আর কোথায় মানুষ হিসেবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শ্রেষ্ঠ হবার আকীদা।

কোথায় আগারতলা আর কোথায় উগারতলা। এগুলোকে গবেষণা না বলে উন্মাদনা ও মাতলামী বলাই অধিক উপযুক্ত। সভ্য সমাজে আপনার স্থান নয়, হওয়া দরকার পাগলা গারদ।

)

আমাদের নবীকে শ্রেষ্ঠ নবী বলার দ্বারা অন্যান্য নবীদের যেমন কোন ছোট করা হয় না। কারণ, নবী হিসেবে সব নবী যেমন এক মানের। কিন্তু মর্যাদা হিসেবে পার্থক্য আছে একথা আল্লাহ তাআলা কুরআনে একাধিক স্থানে বলেছেন।

আর আমাদের নবী ‘সকল নবীর উপর মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ’ হওয়ার দ্বারা অন্য নবী ‘ভিন্ন কোন কারণে অন্যান্য নবীদের উপর শ্রেষ্ঠ’ হওয়ার বিরোধী নয়।

যেমন শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী শেখ মজিবুর রহমান হওয়া মানে, কবি হিসেবে বাংলার শ্রেষ্ঠ নজরুল হতে বাঁধা নেই। জয়নুল আবেদীন এর ‘বাংলার শ্রেষ্ঠ চিত্র শিল্পী’ হতেও কোন সমস্যা নেই।

এসব  বুঝার জন্য যে ন্যুনতম জ্ঞান দরকার অবুঝ ও জ্ঞানে মিসকিন আবু সাঈদ খান সাহেবের এটাও নেই। আল্লাহ তাআলা আপনাকে মগজ দিয়ে ঈমান নবায়নের তৌফিক দিন। নতুবা নবীর প্রতি দুশমনির কারণে ধ্বংস করে দিন।

আরও জানুন

ইসলামের দশ শতাংশে (নাজাত) দশ শতাংশ কোন কোন আমল?

প্রশ্ন: আসসালামু আলাইকুম! মুহতারাম আমার একটা বিষয় বহুদিন থেকে জানার ইচ্ছে, একজন বক্তা বয়ানে বলেছিলেন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *