প্রচ্ছদ / প্রশ্নোত্তর / নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের দিন ফেরেশতাদের ছুটি ছিল এবং দুই মিনিটের জন্য নবীকে গায়েব করা হয়েছিল?

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের দিন ফেরেশতাদের ছুটি ছিল এবং দুই মিনিটের জন্য নবীকে গায়েব করা হয়েছিল?

প্রশ্ন

 আমাদের দেশের একজন মশহুর বক্তা তার বয়ানে বলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের দিন আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের দুই দিনের ছুটি দিয়েছেন।

জন্মের পর ঘরের ছাদ ফেটে যায়। তারপর দুইমিনিটের মধ্যে সারা পৃথিবী নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভ্রমণ করানো হয়।

এমন কোন বর্ণনা বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত কি না? দয়া করে জানাবেন।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

ফেরেশতাদের দুইদিনের ছুটি  ও ছাদ ফেটে যাওয়ার কথা সম্পূর্ণ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।

আলখাসায়েসুল কুবরা কিতাবে আসছে যে,

وَأخرج ابو نعيم عَن عبد الرَّحْمَن بن عَوْف عَن امهِ الشِّفَاء بنت عَمْرو بنت عَوْف قَالَت لما ولدت آمِنَة رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَقع على يَدي فَاسْتهلَّ فَسمِعت قَائِلا يَقُول رَحِمك الله ورحمك رَبك قَالَت الشِّفَاء فاضاء لي مَا بَين الْمشرق وَالْمغْرب حَتَّى نظرت الى بعض قُصُور الرّوم قَالَت ثمَّ ألبسته وأضجعته فَلم انشب ان غشيتني ظلمَة ورعب وقشعريرة عَن يَمِيني فَسمِعت قَائِلا يَقُول أَيْن ذهبت بِهِ قَالَ الى الْمغرب واسفر ذَلِك عني ثمَّ عاودني الرعب والظلمة والقشعريرة عَن يساري فَسمِعت قَائِلا يَقُول أَيْن ذهبت بِهِ قَالَ الى الْمشرق……….

وَأخرج ابو نعيم عَن عَمْرو بن قُتَيْبَة قَالَ سَمِعت أبي وَكَانَ من أوعية الْعلم قَالَ لما حضرت ولادَة آمِنَة قَالَ الله لملائكته افتحوا ابواب السَّمَاء كلهَا وأبواب الْجنان كلهَا وامر الله الْمَلَائِكَة بالحضور فَنزلت تبشر بَعْضهَا بَعْضًا وتطاولت جبال الدُّنْيَا وَارْتَفَعت الْبحار وتباشر أَهلهَا فَلم يبْق ملك إِلَّا حضر……… فَلَمَّا ولد النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم امْتَلَأت الدُّنْيَا كلهَا نورا وتباشرت الْمَلَائِكَة وَضرب فِي كل سَمَاء عَمُود من زبرجد وعمود من ياقوت قد استنار بِهِ فَهِيَ مَعْرُوفَة فِي السَّمَاء………

وَمَرَّتْ وَحش الْمشرق إِلَى وَحش الْمغرب بالبشارات وَكَذَلِكَ أهل الْبحار يبشر بَعضهم بَعْضًا لَهُ فِي كل شهر من شهوره نِدَاء فِي الارض ونداء فِي السَّمَاء ان ابشروا فقد آن لأبي الْقَاسِم ان يخرج إِلَى الأَرْض ميمونا مُبَارَكًا……….. فَكَانَت آمِنَة تحدث عَن نَفسهَا……….. فَولدت مُحَمَّدًا صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فَلَمَّا خرج من بَطْني نظرت إِلَيْهِ فَإِذا أَنا بِهِ سَاجِدا قد رفع إصبعيه كالمتضرع المبتهل ثمَّ رَأَيْت سَحَابَة بَيْضَاء قد اقبلت من السَّمَاء حَتَّى غَشيته فغيب عَن وَجْهي وَسمعت مناديا يُنَادي طوفوا بِمُحَمد شَرق الأَرْض وغربها وأدخلوه الْبحار ليعرفوه باسمه ونعته وَصورته ويعلمون انه سمى فِيهَا الماحي لَا يبْقى شَيْء من الشّرك إِلَّا مُحي فِي زَمَنه ثمَّ تجلت عَنهُ فِي السرع وَقت فَإِذا انا بِهِ مدرج فِي ثوب صوف أَبيض وَتَحْته حريرة خضراء وَقد قبض على ثَلَاثَة مَفَاتِيح من اللُّؤْلُؤ الرطب وَإِذا قَائِل يَقُول قبض مُحَمَّد على مَفَاتِيح النُّصْرَة ومفاتيح الرّيح ومفاتيح النُّبُوَّة ثمَّ أَقبلت سَحَابَة اخرى يسمع مِنْهَا صَهِيل الْخَيل وخفقان الاجنحة حَتَّى غَشيته فغيب عَن عَيْني فَسمِعت مناديا يُنَادي طوفوا بِمُحَمد الشرق والغرب وعَلى مواليد النَّبِيين وأعرضوه على كل روحاني من الْجِنّ والأنس وَالطير وَالسِّبَاع وَأَعْطوهُ صفاء آدم ورقة نوح وخلة ابراهيم ولسان اسماعيل وبشرى يَعْقُوب وجمال يُوسُف وَصَوت دَاوُد وصبر أَيُّوب وزهد يحيى وكرم عِيسَى وأعمروه فِي اخلاق الْأَنْبِيَاء

আবূ নুয়াইম আব্দুর রহমান বিন আওফ থেকে, তিনি তার মা আশশিফা বিন আমর বিন আওফ থেকে এ মর্মে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম আমার হাতে হয়েছে। তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল ছিল। আমি কাউকে বলতে শুনলাম, তোমার প্রতি আল্লাহর রহমত, তোমার প্রতি তোমার রবের রহমাত। এরপর আমার সামনে পূর্ব ও পশ্চিম আলোকিত হয়ে গেল এবং আমি রোমের কিছু রাজপ্রাসাদ দেখতে পেলাম। এরপর আমি নবজাত শিশুকে কাপড় পরিয়ে শুইয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার উপর তমসা ও ভীতির একটা পর্দা যেন পড়ে গেল এবং শরীরে কম্পন এসে গেল। আমি কাউকে বলতে শুনলাম, তুমি একে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? জওয়াব দেয়া হলো, পশ্চিম দিকে। এরপর আমার এই অবস্থা কেটে গেল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর পুনরায় সেই অবস্থা আমাকে আচ্ছন্ন করে নিল। ভীতি, অন্ধকার ও কম্পন। আবার কাউকে বলতে শুনলাম ‘একে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো’? জওয়াব এল ‘পূর্ব দিকে’। ………

আবূ নুয়াইম আমর বিন কোতাইবা থেকে, তিনি আপন পিতার কাছ থেকে শুনেছেন যে, হযরত আমেনার সন্তান প্রসবের সময় উপস্থিত হলে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাগণকে আদেশ করলেন, ‘সমস্ত আকাশ ও জান্নাতের দরজা খুলে দাও। সকল ফেরেশতা আমার সামনে উপস্থিত হোক। সে মতে ফেরেশতাগণ একে অপরকে সুসংবাদ দিতে দিতে হাজির হতে লাগল। পৃথিবীর পাহাড়সমূহ উঁচু হয়ে গেল, এবং সমুদ্র স্ফীত হয়ে গেল। এসবের অধিবাসীরা একে অপরকে সুসংবাদ দিল। সকল ফেরেশতা হাজির হয়ে গেল। …… অতঃপর যখন প্রতীক্ষিত জন্ম হল, তখন সমস্ত পৃথিবী নূরে ভরে গেল। ফেরেশতারা একে অপরকে মোবারকবাদ দিল। প্রত্যেক আকাশে পদ্মরাগ মণি ও চুনির স্তম্ভ নির্মিত হলো। ফলে আকাশ আলোকোজ্জ্বল হয়ে গেল।………

পূর্বের জন্তু জানোয়াররা পশ্চিমের জান্তু জানোয়ারদের কাছে সুসংবাদ নিয়ে যায়। এভাবে সমুদ্রের প্রাণীরা একে অপরকে সুসংবাদ দেয়। গর্ভের প্রত্যেক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর আাকশে ঘোষণা করা হতো ‘সুসংবাদ হোক। এখন আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কল্যাণ ও বরকত নিয়ে দুনিয়াতে এসে গেছেন। ………..হযরত আমেনা নিজের সম্পর্কে বলেন:……….. আমার প্রসব বেদনা শুরু হল এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্ম গ্রহণ করলেন। তিনি যখন বাইরে এলেন, তখন আমি তাকে সেজদারত দেখলাম। তিনি অনুনয় সহকারে আঙ্গুলি উত্তোলিত রেখেছিলেন। এরপর আকাশে একটি সাদা মেঘ এসে আকাশকে আচ্ছন্ন করে নিল। অতঃপর অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি একজনকে বলতে শুনলাম: ‘মুহাম্মদকে পূর্ব ও পশ্চিমে নিয়ে যাও এবং সমুদ্রে নিয়ে যাও। যাতে মানুষ তার নাম, আকৃতি ও গুণাবলী সম্পর্কে ওয়াকিফ হয়ে যায় এবং তারা জানতে পারে যে, তার নাম “মাহী”। তার আমলে শিরক মিটে যাবে।’ এর পরক্ষণেই আমি তাকে একটি সাদা পশমী কাপড়ে জড়িত দেখলাম। নীচে ছিল সবুজ রেশম। তিনি যেন বহু মূল্যবান ধাতু নির্মিত তিনটি  চাবি হাতে মুঠিতে ধারণ করে রেখেছেন। আওয়াজ এল: ‘মোহাম্মত নবুয়াতের চাবি গ্রহণ করেছেন’। এরপর একটি মেঘখণ্ড এল, যার মধ্য থেকে অশ্বের হ্রেষারব এবং পাখা নাড়ানোর শব্দ ভেসে আসছিল। অবশেষে সেটি আচ্ছন্ন হয়ে গেল। অতঃপর অদৃশ্য হয়ে গেল। এরপর কেউ ডেকে বলল, ‘মুহাম্মদকে পূর্ব ও পশ্চিমে নিয়ে যাও, পয়গম্বরগণের জন্মভূমিতে নিয়ে যাও। জিন, মানব, পশুপক্ষী এবং হিংস্র প্রাণীদের কাছে নিয়ে যাও। তাকে আদম আঃ এর পরিচ্ছন্নতা, নূহ আঃ এর নম্রতা, ইব্রাহীম আঃ এর  বন্ধুত্ব, ইসমাইল আঃ এর ভাষা, ইয়াকুব আঃ এর মুখমণ্ডল, ইউসুফ আঃ এর রূপ, দাউদ আঃ এর কণ্ঠস্বর, আইউব আঃ এর ছবর, ইয়াহইয়া আঃ এর বৈরাগ্য এবং ঈসা আঃ এর কৃপা দান কর। তাকে সকল পয়গাম্বরের চরিত্রের নমুনা করে দাও।  [খাসায়েসুল কুবরা আরবী-১/৮০-৮৩, বাংলা-১/৮৯-৯৩, দালায়েলুন নবুয়্যাহ, বর্ণনা নং-৫৫৫]

উপরোক্ত দু’টি  বর্ণনা বিষয়ে জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহঃ এর মন্তব্য হলো:

قلت هَذَا الاثر والاثر ان قبله فِيهَا نَكَارَة شَدِيدَة وَلم أورد فِي كتابي هَذَا اشد نَكَارَة مِنْهَا وَلم تكن نَفسِي لتطيب بايرادها لكني تبِعت الْحَافِظ أَبَا نعيم فِي ذَلِك

এ বর্ণনাটি এবং পূর্বেকার দু’টি রেওয়ায়েত মারাত্মক পর্যায়ের মুনকার তথা অগ্রহণযোগ্য। আমার গ্রন্থে এ ধরণের অগ্রাহ্য রেওয়ায়েত আর একটিও নেই। এটি লিখার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না। কেবল আবূ নুয়াইম এর অনুসরণ করে লিপিবদ্ধ করেছি। [খাসায়েসুল কুবরা-১/৮৩]

ইবনে কাসীর রহঃ উক্ত বর্ণনা বিষয়ে মন্তব্য করেন: غريب جدا তথা চূড়ান্ত বিরল বর্ণনা। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৬/২৯৯]

শিহাবুদ্দীন কাস্তাল্লানী রহঃ বলেন, وهو مما تُكلم فيه অর্থাৎ এটি সমালোচিত বর্ণনা। [আলমাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ-১/৭৭]

কিতাবে লিপিবদ্ধকারী সুয়ূতী রহঃ নিজেই যেখানে পরিস্কার বলে দিচ্ছেন যে, এ বর্ণনাগুলো মারাত্মক পর্যায়ের অগ্রহণীয়। এমন অগ্রহণযোগ্য বর্ণনা তিনি আনার কোন ইচ্ছেই করেননি। তারপরও আবূ নুয়াইমের মোহাব্বতে তিনি এনেছেন। এমন একটা বর্ণনা কী করে বয়ান করা জায়েজ হয়?

সবচে’ বড় বিষয় হলো, উপরোক্ত বর্ণনার কোথাও ফেরেশতাদের দুইদিনের ছুটির কথা নেই। সুতরাং এটি একটি বানোয়াট কথা।

সেই সাথে ছাদ ফেটে যাওয়ার কথাও বর্ণিত হয়নি।

সুতরাং ছুটি এবং ছাদ ফাটার বিষয়টি বক্তার পক্ষ থেকে একটি বানোয়াট কথা।

এই হচ্ছে ছাদ ফেটে সারা দুনিয়া ঘুরানো এবং ফেরেশতাদের দুইদিনের ছুটি এবং গাছপালা, মাছসহ সকল প্রাণীর পরস্পর সুসংবাদ দেয়া সংক্রান্ত বর্ণনার হাকীকত।

সুতরাং এ বর্ণনা বয়ান করা থেকে বিরত থাকা জরুরী।

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।

ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com

আরও জানুন

তরজমাসহ কুরআন কি কুরআনের মতো সম্মানিত?

প্রশ্ন আসসালামু অলাইকুম। আমি জানতে চাই এক খন্ডের যেসব তাফসীর পাওয়া যায় সেগুলোতে পূর্ন আরবী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস