প্রশ্ন
আসসালামুআলাইকুম হুজুর।
আগে কয়েকবার প্রশ্ন পাঠিয়েছি। উত্তর পাইনি। বারবার বিরক্ত করার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
হুজুর, আমি আমার বাবা মায়ের পছন্দ মতো ২০১৪ সালে বিয়ে করি। বিয়ের পরে আমি ঢাকায় চাকুরি করি। ২০১৪ সালে আল্লাহ পাক আমাদের একটি পুত্র সন্তান দান করেন। বাচ্চার বয়স যখন একমাস তখন মোবাইলে আমার স্ত্রী আমার মায়ের সাথে যেকোন একটি বিষয় নিয়ে খুব নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করে। সে তখন তার বাবার বাড়িতে ছিলো।
আমার মা আমাকে বিষয়টি জানালে আমি আমার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে মাকে গালি দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সে আমার সাথে খুব বাজে আচরণ করে,এবং তুমুল ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি খুব রাগান্বিত হয়ে সেন্সলেস হয়ে আমি তাকে বলি “তোকে আমি এক তালাক দিলাম”।
এর কিছু ক্ষন পরে আমার শাশুড়ী আমাকে ফোন দিলে সে আমাকে খুব গালাগালি করলে আমি বলি আপনার মেয়েকে আমি একতালাক দিয়ে দিয়েছি সাবধান ভবিষ্যতে সে যেন আমার বাবা মায়ের সাথে খারাপ আচরণ না করে।
একথা শুনার পরে আমার শাশুড়ী আমাকে এবং আমার মাকে নিয়ে খুব খারাপ ভাষা করলে আমি শুধু বলি “দুই তালাক দিলাম”।
এরপর সে ফোন কেটে দেয়। আমি তখন ঢাকায় কর্মস্থলে। এর এক সপ্তাহ পরে আমার মা আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
এক মাস পরে আমি ছুটি নিয়ে বাড়ি আসি এবং স্বামী স্ত্রী হিসাবে বসবাস করতে থাকি।
এরপরে আমাদের স্বাভাবিক সাংসারিক জীবন যাপন চলতে থাকে।
২০২০ সালে আমার আব্বা হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যায়। আমার কোন ভাই নেই। তাই আমি বাড়ি চলে আসি। আমার বাবা আমাদের সবকিছু দেখাশুনা করতো। আব্বা হঠাৎ চলে যাওয়ার কারনে আমি খুবই ভেঙে পড়ি। জমিজমা নিয়ে অনেকের সাথে বিরোধ লেগে যায়। আত্মীয় স্বজনরা সব দুরে সরে যায়।
আমি খুব হতাশ হয়ে যাই। আমি খুব আর্থিক সমস্যায় পড়ে যাই,এরপরে আমি ঢাকায় চাকুরীতে চলে আসি। আমি খুবই মানুসিক অস্থিরতায় পড়ে যাই।
বাড়িতে কোন পুরুষ লোক না থাকায় সবসময় ওদের নিয়ে টেনশনে থাকি।
আমি নিউরোলজিস্ট কাজী দ্বীন মোহাম্মদ কে দেখাই যার চিকিৎসা এখনো চলমান। আমার মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। ঠিক মত ঘুম হয়না। আচার আচার-আচরণ পরিবর্তন হয়ে যায়। যার তার সাথে কথা কাটাকাটি হয় অল্পতেই রেগে যাই।
গত তিন মাস ধরে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ি। মানুষের সাথে খুব বাজে আচরণ করি পরে যখন মাথা ঠান্ডা হয় তখন নিজের ভুল বুঝতে পারি এবং ক্ষমা চাই তারা আমার সমস্যা জেনে আমাকে মাফ করে দেয়।
শারীরিক ও মানসিকভাবে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ি। কাজের চাপ ও ছুটি না থাকার কারনে আমি আরো সমস্যায় পড়ে যাই।
একদিকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে খুবই অসুস্থ আবার ১৪/১৬ ঘন্টা কাজ করতে হয়। এক দিকে কাজের চাপ আবার শারীরিক অসুস্থ আবার মানুসিক অস্থিরতা। আবার সারাদিন রোযায় অনেকটা ক্লান্ত হয়ে যাই।
আমার এ সমস্যাগুলো মা এবং স্ত্রীকে জানাই। ঘটনার দিন ২৩/৪/২২ আমি খুব মানসিক অস্থিরতায় ছিলাম। আমার স্ত্রীকে বারবার ফোন দিতে নিষেধ করি।
এরপরেও কাজের সময় সে আমাকে ফোন দিয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক করতে থাকে। এক পর্যায়ে তার সাথে কথা কাটাকাটি হয় এবং একসময় আমি প্রচন্ড রাগান্বিত হয়ে যাই তাকে বলি আমি তোকে “একতালাক দিলাম”।
আমার তখন আমার শাশুড়ীর সাথে বলা তালাকের কথা স্মরণ ছিলোনা।
এরপর যখন মাথা ঠান্ডা হয় তখন স্ত্রীকে ফোন দিলে সে খুব কান্না কাটি করতে থাকে। আমি তাকে বুঝাই যে, এক তালাক দিলে সমস্যা নাই সংসার ঠিক আছে।
তখন সে আমাকে বলে তুমি আমাকে আগেও একবার বলেছিলে বাচ্চার বয়স যখন একমাস।
আগের তালাকের কথা স্মরণ করে দিলে আমি তখন বলি, আগের তালাক বাদ হয়ে গেছে কারন এর কিছু দিন পর থেকেই আমরাতো স্বাভাবিক সংসার করে আসছি।
তখন সে আমার শাশুড়ীর সাথে বলা তালাকের কথা বলে।
আমি তালাকের সঠিক মাসায়ালা জানতাম না। আমি জেনারেল লাইনে লেখাপড়া করা মানুষ।
মানুষ রোগে আক্রান্ত হলে ডাক্তার কাছে যায় চিকিৎসার জন্য।
আর মুসলিমরা কোন ইসলামের শরিয়ত জীবন যাপনে কোন সমস্যা হলে অথবা ধর্মীয় কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে যায় মুফতি সাহেবের কাছে।
হুজুর আমি খুব হতাশার মধ্যে আছি। এরপর থেকে আমরা দুজন আলাদা থাকি। আমার নাওয়া খাওয়া সব বন্ধ হয়ে গেছে। দিন -রাত শুধু দুশ্চিন্তা করতে করতে আমি অনেক অসুস্থ হয়ে গেছি।
আমি আমার বয়স্ক মা,ছেলের এবং সংসার নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। টেনশনে আমার ঘুম হয় না।
আল্লাহর কাছে তওবা করে কান্নাকাটি করতেছি। চাই আল্লাহ কোন রাস্তা খুলে দেয়।
হুজুর আমার সমস্যার সঠিক সমাধান চাই। আমি পাপী বান্দা আল্লাহ যেন আমাকে মাফ করে দেয়। তাকে ছেড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য আমি তালাকের কথা বলি নাই। শুধু তাকে থামানো ভয় দেখানোর জন্য বলেছিলাম।
জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। সঠিক সমাধান দিয়ে আল্লাহর বিধান মতো চলার ব্যবস্থা করে দিলে উপকৃত হতাম।
উল্লেখ্যঃ আমি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এবং হানাফি মাজাহাব বিশ্বাসী ও অনুসারী।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
প্রথমবার তালাক দেবার পর আপনার শ্বাশুরীর ফোনে কথা বলার সময় “দুই তালাক দিলাম” বলার দ্বারা যদি স্বতন্ত্র দুই তালাক নিয়ত করে থাকেন, তাহলে তখনি আপনার স্ত্রী তিন তালাক হয়ে আপনার উপর হারাম হয়ে গেছে।
তারপর তার সাথে সংসার করা আপনার জন্য বৈধ হয়নি।
আর যদি আলাদা দুই তালাক বলার দ্বারা স্বতন্ত্র দুই তালাক নয়, বরং দ্বিতীয় তালাক উদ্দেশ্য নিয়ে থাকেন। যেমনটি আপনার কথার দ্বারাও বুঝা যাচ্ছে, তাহলে আপনার স্ত্রীর উপর ইতোপূর্বে দুই তালাক হয়েছিল।
তারপর এক মাস পর ঘর সংসার অব্যাহত রাখার দ্বারা সে আপনার স্ত্রী হিসেবে বাকি রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আপনি আর এক তালাকের মালিক ছিলেন।
কিন্তু অবশেষে আপনার বাবার ইন্তেকালের পর আরো এক তালাক দেবার দ্বারা আপনার স্ত্রী তিন তালাকপ্রাপ্তা হয়ে আপনার উপর হারাম হয়ে গেছে।
এক্ষেত্রে তার সাথে একত্রে ঘর সংসার করা আপনার জন্য জায়েজ নয়।
এখন যদি আপনার উক্ত স্ত্রীর অন্যত্র বিয়ে হয়, তার সাথে শারিরীক সম্পর্কসহ ঘর সংসার করতে থাকে, কোন কারণে দ্বিতীয় স্বামী মারা যায়, বা তালাক দেয়, তাহলে ইদ্দত শেষে আপনি আবার স্ত্রীকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারবেন।
এছাড়া আর কোন গত্যান্তর নেই।
فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِن بَعْدُ حَتَّىٰ تَنكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ ۗ فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَن يَتَرَاجَعَا إِن ظَنَّا أَن يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ ۗ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ [٢:٢٣٠]
তারপর যদি সে স্ত্রীকে (তৃতীয়বার) তালাক দেয়,তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর কোন স্বামীর সাথে বিয়ে করে না নেবে,তার জন্য হালাল নয়। অতঃপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিয়ে দেয়,তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরস্পরকে পুনরায় বিয়ে করাতে কোন পাপ নেই। যদি আল্লাহর হুকুম বজায় রাখার ইচ্ছা থাকে। আর এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা; যারা উপলব্ধি করে তাদের জন্য এসব বর্ণনা করা হয়। {সূরা বাকারা-২৩০}
وقال الليث عن نافع كان ابن عمر إذا سئل عمن طلق ثلاثا قال لو طلقت مرة أو مرتين فأن النبي صلى الله عليه و سلم أمرني بهذا فإن طلقتها ثلاثا حرمت حتى تنكح زوجا غيرك
হযরত নাফে রহ. বলেন,যখন হযরত ইবনে উমর রাঃ এর কাছে ‘এক সাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাক পতিত হওয়া না হওয়া’ (রুজু‘করা যাবে কিনা) বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলো,তখন তিনি বলেন-“যদি তুমি এক বা দুই তালাক দিয়ে থাকো তাহলে ‘রুজু’ [তথা স্ত্রীকে বিবাহ করা ছাড়াই ফিরিয়ে আনা] করতে পার। কারণ,রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এরকম অবস্থায় ‘রুজু’ করার আদেশ দিয়েছিলেন। যদি তিন তালাক দিয়ে দাও তাহলে স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে, সে তোমাকে ছাড়া অন্য স্বামী গ্রহণ করা পর্যন্ত। {সহীহ বুখারী-২/৭৯২, ২/৮০৩}
عن مجاهد قال كنت عند ابن عباس فجاء رجل فقال إنه طلق امرأته ثلاثا. قال فسكت حتى ظننت أنه رادها إليه ثم قال ينطلق أحدكم فيركب الحموقة ثم يقول يا ابن عباس يا ابن عباس وإن الله قال (وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا) وإنك لم تتق الله فلم أجد لك مخرجا عصيت ربك وبانت منك امرأتك
অর্থ: হযরত মুজাহিদ রহঃ. বলেন,আমি ইবনে আব্বাস রাঃ-এর পাশে ছিলাম। সে সময় এক ব্যক্তি এসে বলেন-‘সে তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ চুপ করে রইলেন। আমি মনে মনে ভাবছিলাম-হয়ত তিনি তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার কথা বলবেন (রুজু করার হুকুম দিবেন)। কিছুক্ষণ পর ইবনে আব্বাস রা. বলেন,তোমাদের অনেকে নির্বোধের মত কাজ কর;[তিন তালাক দিয়ে দাও!] তারপর ‘ইবনে আব্বাস! ইবনে আব্বাস! বলে চিৎকার করতে থাক। শুনে রাখ আল্লাহ তা‘য়ালা বাণী-“যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘য়ালাকে ভয় করে আল্লাহ তা‘য়ালা তার জন্য পথকে খুলে দেন। তুমিতো স্বীয় রবের নাফরমানী করেছো [তিন তালাক দিয়ে]। এ কারণে তোমার স্ত্রী তোমার থেকে পৃথক হয়ে গেছে। {সুনানে আবু দাউদ-১/২৯৯, হাদীস নং-২১৯৯,সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী,হাদীস নং-১৪৭২০,সুনানে দারা কুতনী,হাদীস নং-১৪৩}
কয়েকটি কথা:
দেখুন বিবাহ শুধুই সামাজিক বন্ধন নয়, বরং ধর্মীয় বিধান। ধর্মীয় হুকুম। দুনিয়াবী কোন কাজ করতে গেলে তার বিধানাবলী জেনেই তা শুরু করতে হয়। না জেনে শুরু করা উচিত নয়।
রাস্তায় নামলে রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যাল জেনেই নামতে হবে। নেমে ভুল করে ‘জানি না’ বলে পাড় পাবার কোন সুযোগ নেই।
বৈবাহিক জীবনে বিচ্ছেদের পন্থা ‘তালাক’। এটা সবাই জানে। জানে বলেই ঝগড়া হলেই স্ত্রীকে তালাক দিয়ে থাকে। অন্য কারো সাথে ঝগড়া লাগলে তালাক দেয় না।
সুতরাং স্ত্রীকে রাগের মাথায়, বা ঝগড়া করে তালাক দিয়ে বলা যে, ‘আমি বিধান জানতাম না’ এটা সত্য কথা নয়।
কারণ, তালাকের দ্বারা কী হয়? না জানলে তালাকই কেন বললেন? আর কিছু বলার ছিল না?
সুতরাং এসব ঠুনকো ওজর গ্রহণযোগ্য নয়।
আল্লাহ তাআলা আপনাকে শারিরীক ও মানসিকভাবে সুস্থ্য করে দিন। দ্বীনের উপর অটল থেকে আখেরাতের অনন্ত জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের চেয়ে আখেরাতের অনন্ত জীবনকে প্রাধান্য দেবার ঈমানী হিম্মত দান করুন। আমীন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী, নরসিংদী।
ইমেইল– [email protected]