প্রচ্ছদ / আকিদা-বিশ্বাস / হযরত আলী রাঃ কি হযরত হারূন আলাইহিস সালামের মত?

হযরত আলী রাঃ কি হযরত হারূন আলাইহিস সালামের মত?

প্রশ্ন

ভারতের মুর্শিদাবাদের সুন্নী কাদেরী নামধারী এক বক্তা প্রায়ই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মাহফিলের সফরে আসে। তিনি হযরত আলী রাঃ সম্পর্কে এবং সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে বেশ কিছু আপত্তিকর বক্তৃতা প্রদান করে থাকে। এমনি একটি বিষয় সম্পর্কে জানতে চাই।

তিনি এক বয়ানে বলেন যে, হযরত আলী রাঃ একমাত্র নবীজীর পর খলীফা হবার যোগ্য। কারণ, তাবুক যুদ্ধে যাবার সময় মদীনায় হযরত আলী রাঃ কে নবীজীর প্রতিনিধি হিসেবে রেখে যান।

সেই সাথে নবীজী হযরত আলীকে লক্ষ্য করে বলেন যে, তুমি আমার কাছে হারুন আলাইহিস সালামের মত। আর তাবুক থেকে ফেরার পর হযরত আলীকে সেই দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে এমন কোন কথা নবীজী বলেননি।

সুতরাং বুঝা গেল যে, যেমন হযরত মুসা আলাইহিস সালামের অবর্তমানে হারুন আলা্ইহিস সালাম তার প্রতিনিধি ও খলীফা ছিলেন, তেমনি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর হযরত আলী রাঃ ই একমাত্র নবীজীর প্রতিনিধি ও খলীফা এটাই নবীজী বলে গেছেন।

এমন কোন নির্দেশ আর কোন সাহাবীর ক্ষেত্রে দেয়া হয়নি। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী ছিলেন, আর হযরত আলী নবী ছিলেন না।

হযরতের কাছে আবেদন হল, এ বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানালে কৃতজ্ঞ হবো।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

কয়েকটি বিষয় বুঝলে এ দাবীটি যে, একটি অসাড় ও অহেতুক দাবী তা পরিস্কার হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

তবুক যুদ্ধের সময় হযরত আলী রাঃ কে নবীজীর খিলাফতের প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়েছে। এ কথাটিই সঠিক নয়।

বরং নবীজীর প্রতিনিধি ও মদীনার প্রশাসক বা গভর্ণর হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে হযরত মুহাম্মদ বিন মুসলিম রাঃ কে।

নামাযের ইমামতীর দায়িত্ব ছিল হযরত আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতূম রাঃ এর দায়িত্বে।

আর হযরত আলী রাঃ যেহেতু নবী পরিবারের সদস্য। তাই তাকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারের দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।যা

 

গভর্ণর বা নবীর অবর্তমানে সাময়িক খলীফার দায়িত্ব দেয়াই হয়নি। [সীরাতে মুস্তাফা-৩/৮৯]

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে যাবার সময় হযরত আলী রাঃ কে স্বীয় পরিবারবর্গের হিফাযতের দায়িত্বে রেখে যাওয়ার দ্বারা হযরত আলীর আমানতদারী, সততা ও বৈশিষ্ট্যের কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে।

কেননা, স্বীয় পরিবারবর্গের রক্ষণাবেক্ষণ ও হিফাযতের দায়িত্ব তার উপর ন্যাস্ত করা হয় যার আমানতদাদারী, সততা ও ন্যায়-নিষ্ঠা, স্নেহ, শ্রদ্ধা এবং চরিত্রের উপর আস্থা ও বিশ্বাস থাকে। সাধারণত, বংশধর ও সন্তান সন্ততিকে এ কাজে নিয়োগ করা হয়।

কিন্তু ইন্তেকালের পর তুমিই আমার খলীফা নিযুক্ত হবে এ বিষয়ের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।

এছাড়া হযরত আলীকে স্থলাভিষিক্ত করা শুধু পরিবারবর্গের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। কেননা, গাযওয়ায় যাবার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাম্মদ বিন মাসলামাকে মদীনার শাসনকর্তা, সাবা বিন আরফা রাঃ কে মদীনার কোতওয়াল এবং আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতূম রাঃ কে মসজিদে নববীর ইমাম নিযুক্ত করেন।

এতে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত আলী রাঃ কে রেখে যাবার দ্বারা নবীজীর খলীফা বানানো উদ্দেশ্য নয়, বরং পরিবারের দায়িত্ব পালন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল।

হযরত আলী রাঃ কে নায়েব বানানোকে হযরত হারুন আলাইহিস সালামকে নায়েব বানানোর সাথে পুরোপুরি মিলানো একটি অযৌক্তিক কথা।

কারণ, হযরত হারুন আলাইহিস সালাম নায়েব হবার সময় নিজেই নবী ছিলেন। আর হযরত আলী রাঃ নবী নন।

দ্বিতীয়ত হযরত হারুন আলাহিস সালাম হযরত মুসা আলাইহিস সালামের আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন।

তিনি মুসা আলাইহিস সালামের খলীফা হতে পারেননি।

বরং মুসা আলাইহিস সালামের পর তার খলীফা হয়েছেন হযরত ইউশা বিন নূন আলাইহিস সালাম।

সুতরাং হারুন আলাইহিস সালামের সাথে আলী রাঃ এর পুরোপুরি মিল বলাটা অযৌক্তিক কথা। কারণ, আলী রাঃ এর ক্ষেত্রে হারুন আলাইহিস সালামের মত ঘটনা ঘটেনি।

এছাড়া মদীনা তাইয়্যিবায় হযরত আলী রাঃ কে সাময়িক নায়েব বানানো হয়েছিল। স্থায়ী নয়।

হযরত আলীকে নায়েবের দায়িত্ব শুধুমাত্র নবীজীর তাবুক যুদ্ধ থেকে ফেরার আগ পর্যন্তের জন্য দেয়া হয়েছিল। স্থায়ীভাবে দেয়ার কোন প্রমাণ নেই।

সুতরাং নবীজীর তাবুক থেকে মদীনায় ফেরার সাথে সাথেই হযরত আলী রাঃ নায়েবের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পেয়ে যান।

যেমন হযরত হারুন আলাইহিস সালামকে যখন তূর পাহাড়ে যাবার সময় মুসা আলাইহিস সালাম নায়েব বানালেন সাময়িক সময়ের জন্য। তখন মুসা আলাহিস সালাম ফেরার সাথে সাথে হারুন আলাইহিস সালাম নায়েবের দায়িত্ব থেকে অটোমেটিক অব্যহতি হয়ে যান।

এর জন্য নতুন করে কোন ফরমান জারি করার প্রয়োজনই নেই।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন সফর বা যুদ্ধের জন্য মদীনা থেকে বের হতেন, তখন মদীনায় তার স্থলাভিষিক্ত ও সাময়িক খলীফা নিযুক্ত করে যেতেন।

এমন বিশটির উপর সফর ও যুদ্ধে যাবার সময় বিভিন্নজনকে মদীনায় নবীজী তার প্রতিনিধি বা সাময়িক খেলাফতের দায়িত্ব দিয়েছেন মর্মে সীরাত গ্রন্থাবলীতে প্রমাণ পাওয়া যায়।

নবীজী সফর ও যুদ্ধ থেকে ফেরার সাথে সাথে কোন নতুন ফরমান ছাড়াই নায়েবগণ অটোমেটিক তাদের দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত হয়ে যান। নতুন করে বরখাস্ত করার ফরমান জারী করা হয়নি।

৩টি উপমা বুঝার জন্য পেশ করা হল,

ক)

গাযওয়ায়ে কায়নুকা যখন সংঘটিত হয়। তখন হযরত আবূ লুবাবা বিন আব্দুল মুনজির রাঃ কে মদীনায় নবীজীর নায়েব বা সাময়িক খলীফা বানানো হয়। [সীরাতে মুস্তাফা সাঃ-২/১৪৭]

খ)

গাযওয়ায়ে বনীল মুস্তালিক বা মুরাইসী সংঘটিত হবার সময় হযরত জায়েদ বিন হারেছা রাঃ কে মদীনায় নবীজীর নায়েব ও সাময়িক খলীফা নির্ধারণ করা হয়। [সীরাতে মুস্তাফা-২/২৩৯]

গ)

এমনিভাবে গাযওয়ায়ে বনী গাতফানের সময় হযরত উসমান রাঃ কে মদীনায় সাময়িক খলীফা নিযুক্ত করেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

এমনিভাবে গাযওয়ায়ে জাতুর রিক্বা এর সময়ও হযরত উসমান রাঃ কে মদীনার সাময়িক খলীফা নিযুক্ত করা হয়। [মিনহাজুস সুন্নাহ লিইবনে তাইমিয়া রহঃ-৩/১৬, ৪/৮৭]

এ সমস্ত সময়গুলোতে যখনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফর থেকে ফিরতেন তখন উক্ত নায়েবগণ এবং সাময়িক খলীফাগণ কোন ফরমান ছাড়াই তাদের দায়িত্ব থেকে অটোমেটিক বরখাস্ত হয়ে যেতেন।

তেমনি তাবুক যুদ্ধের সময় হযরত আলী রাঃ কে বানানো নায়েবের পদ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফিরে আসার দ্বারাই বাতিল হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে গেছে। ফরমান জারী করে বাতিল করার প্রয়োজনই ছিল না।

গাযওয়ায়ে তাবুকের পর যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা গেলেন। সে সময় হযরত আলী রাঃ ইয়ামানে যান। ইয়ামান থেকে ফিরে তিনি মক্কায় নবীজীর সাথে হজ্বের সময় সাক্ষাৎ করেন।

এ সময়ে মদীনায় সাময়িক খেলাফতের দায়িত্ব পালনে আদিষ্ট ছিলেন, আবু দুজানা আসসা’দী রাঃ বা সাবা’ বিন উরফাতাহ গিফারী রাঃ।

এ দায়িত্বভার সুনিশ্চিতভাবেই তাবুক যুদ্ধের পর দেয়া হয়।

যদি হযরত আলী রাঃ ই একমাত্র নবীজীর নায়েব হিসেবে নিযুক্ত হয়ে থাকতেন, তাহলে আবার আরেকজনকে দায়িত্ব কেন দেয়া হল?

সুতরাং বুঝা গেল যে, হযরত আলী রাঃ কে নায়েব বানানোর বিষয়টি কোন স্থায়ী সিদ্ধান্ত নয়। বরং একটি সাময়িক সিদ্ধান্ত। সুতরাং এটাকে পূঁজি করে হযরত আলী রাঃ কে নবীজীর পরের খলীফা বলা অযৌক্তিক ও হাস্যকরও বটে।

হাদীসাংশের ব্যাখ্যা

এখন প্রশ্ন রয়ে গেল যে, হযরত আলী রাঃ যখন বললেন   যে, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে শিশু ও মহিলাদের নিকট রেখে যাচ্ছেন? তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি কি এর উপর সন্তুষ্ট নও যে, আমার সাথে তোমার ঐ সম্পর্ক হোক যা হযরত মুসা আঃ এর সাথে হযরত হারুন আঃ এর ছিল?”।

নবীজীর এ উপমাটির ব্যাখ্যা কি?

উত্তর

এ উপমা বা সাদৃশ্য দ্বারা নিশ্চয়ই এক প্রকার ফযীলত প্রমাণিত হয়। কিন্তু সাদৃশ্য দ্বারা সমস্ত বিষয়ে সমতা জরুরী নয়।

এ হাদীসে যদিও হযরত আলী রাঃ কে হযরত হারুন আঃ এর সাথে তুলনা করা হয়েছে, পক্ষান্তরে বদরযুদ্ধে গ্রেফতারকৃত কয়েদীদের সম্পর্কে যখন পরামর্শ করেন, তখন তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাঃ কে হযরত ইবরাহীম আঃ এবং হযরত ঈসা আঃ এর সাদৃশ্য প্রদান করেন।

হযরত উমর রাঃ কে হযরত নূহ আঃ এর সাথে সাদৃশ্য প্রদান করেন। [সীরাতে মুস্তাফা-৩/৯০]

কাউকে নূহ হযরত ইবরাহীম আঃ, হযরত ঈসা আঃ এবং নূহ আঃ এর সাথে তুলনা করা “আমার সাথে তোমার ঐ সম্পর্ক হোক যা হযরত মুসা আঃ এর সাথে হযরত হারুন আঃ এর ছিল” বলার চেয়ে উত্তম নয়?

সুতরাং বুঝা গেল যে, উপরোক্ত কথাটি শুধুমাত্র হযরত আলী রাঃ কে সান্ত্বনা দেবার জন্য নবীজী বলেছেন। এর সাথে পরবর্তী খলীফা নির্ধারণের সামান্যতম কোন সম্পর্কই নেই।

যারা এসব বলেন, ওরা মূর্খ বা জ্ঞানপাপী ছাড়া কিছু নয়।

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com

আরও জানুন

আট ভরি স্বর্নের উপর কতটুকু যাকাত আবশ্যক?

প্রশ্ন আচ্ছালামুয়ালাইকুম। মুহতারাম আমার একটা প্রশ্ন স্বর্ণের কত ভরি হলে যাকাত দিতে হবে। আর আমার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস