প্রশ্ন
তথাকথিত এক আহলে হাদিস একটা প্রশ্ন করেছে যা হুবহু তুলে দিলাম। আপনাদের মুরব্বি নিজেকে আল্লাহ (নাউযুবিল্লাহ) দাবি করেছেন।
তাবলীগের মুরুব্বী, বিশিষ্ট দেওবন্দি আলেম ও চরমোনাইর পীরের পীর মাওঃ যাকারিয়া স্বীয় পীর রশীদ আহমাদ গাংগুহীর একটি পত্র ফাজায়েলে সাদাকাত নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন। সে পত্রে মাওলানা গাংগুহী স্বীয় পীর এমদাদ উল্লাহ মক্কীকে সম্বোধন করেছেন ‘হে আমার দুই জাহানের আশ্রয়স্থল।
হে আল্লাহ! সব তোমারেই ছায়া, তোমারই অস্তিত্ব , আমি কি , কিছুই নই এবং আমি যাহা রহিয়াছি উহাও তুমি। আমি এবং তুমি স্বয়ং শিরকের ভিতের শিরক। (ফাজায়েলে সাদাকাতের ২য় খণ্ড, ৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদ , পৃষ্টা নং ২২১-২২২}
আপনি কি আপনার মুরব্বির ইবাদাত করেন নাকি এক আল্লাহর ? আশা করি যথাশিঘ্র উত্তর দিবেন। জাযাকাল্লাহ।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
অবাক কান্ড! এখানে নিজেকে কে আল্লাহ দাবি করেছেন? এখানেতো আল্লাহর একত্ববাদ তথা তাওহীদের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা হয়েছে। নিজের সমস্ত ফযীলত, ক্ষমতা, যোগ্যতাকে কেবল আল্লাহরই পক্ষ থেকে বলে নিজেকে স্রষ্টার সামনে ক্ষুদ্রাতিক্ষুুদ্র করে উপস্থাপিত করা হয়েছে। স্রষ্ঠার সামনে নিজেকে অস্তিত্বহীন, ছোট, নীচ অনুল্লেযোগ্য বলে স্রষ্টার মহত্ব আর বড়ত্বকে স্বীকার করার নাম নিজেকে খোদা দাবি করা? এরকম বোকামী আর আহমকী সূলভ কথাতো কেবল শিশু আর পাগলদের মুখেই মানায়। কুরআন হাদীসের অনুসারী দাবিদার কোন সুস্থ্য বিবেকবান মানুষতো এমন বোকামীসূলভ বক্তব্য দিতে পারে না।
প্রথমে ফাযায়েলে সাদাকাদের ২য় খন্ডের প্রশ্নে উল্লেখিত চিঠিটির আগে পড়ের কিছু অংশ সহ উদ্ধৃত করছি। কুতুবল আলম রশীদ আহমদ গঙ্গুহী রহঃ এর মুর্শীদ হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহঃ রশীদ আহমদ গঙ্গুহী রহঃ এর ইলমী ও আমলী অবস্থা জানিয়ে পত্র লিখতে বললে রশীদ আহমদ গঙ্গুহী রহঃ বিনয় আর নম্রতা ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের একত্ববাদের বিশ্বাসের এক চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন তার লিখিত পত্রে। কী চমৎকার সব শব্দ গাঁথুনিতে নিজেকে আল্লহ রাব্বুল আলামীনের বিশালতা ও ক্ষমতার সামনে ছোট অনুল্লেখযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। দেখুন তিনি কিভাবে বিনয় আর নম্রতা প্রকাশ করেছেন-
অধম বান্দা সম্পর্কে হুজুর জানতে চেয়েছেন। [এর জবাবে আরজ এই যে,] হে আমার উভয় জাহানের আশ্রয়স্থল! [দুনিয়ায় আখেরাতের পথপ্রদর্শক হিসেবে আর আখেরাতে নবীজী সাঃ এর সুপারিশে কুবরার পর সুপারিশে সুগরা হিসেবে]। আমি অধমের এমনকি অবস্থা বা এমন কিই বা গুণ রয়েছে যে, গুণাবলীর জগতে দীপ্যমান সূর্যসদৃশ্য হযরতের সামনে তা উপস্থাপন করবো? আল্লাহর কসম! আমি অত্যন্ত লজ্জিত, কিছুই নই; কিন্তু হযরতের হুকুম বলে বাধ্য হয়ে কিছু লিখতে হচ্ছে।
হে আমার মুর্শিদ! যাহেরী ইলমেরতো অবস্থা এই যে, খুব সম্ভব সাত বছর থেকে কিছু বেশি হবে, আপনার খেদমত থেকে দূরে চলে এলাম। এ বছর পর্যন্ত আমার কাছ থেকে দুইশতের অধিক ছাত্র হাদীসের সনদ হাসীল করে গেছে। তাদের মাঝে অধিকাংশই ইলমে দ্বীনের পাঠদানে রত আছে। সুন্নত জিন্দা করার কাজে তৎপর হয়েছে। তাদের দ্বারা দ্বীনের প্রচার হচ্ছে।
যদি কবুল হয়ে যায় তাহলে এ সম্মান ও মর্যাদা হতে বড় আর কোন সম্মান নেই। হযরতের পদতলে থেকে যে ফায়দা ও ফল হয়েছে এর সারমর্ম এই যে, অন্তরের অন্তঃস্থলে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো থেকে উপকার বা ক্ষতির দিকে দৃষ্টি নেই।
আল্লাহর কসম! কোন কোন সময় নিজেকে মাশায়েখদের দিক হতে পৃথক হয়ে যাওয়া হয়। [স্বীয় উস্তাদদের কারো কথা মনে থাকে না] কারো প্রশংসা ও নিন্দাবাদের পরোয়া নেই। নিন্দাকারী ও প্রশংসাকারীকে দূরে মনে করি। গুণাহের প্রতি স্বভাবগতভাবে ঘৃণা আল্লাহর আনুগত্বের প্রতি স্বভাবগত আকর্শন সৃষ্টি হয়ে গেছে। এটি হযরতের সেই নিসবতেরই প্রতিক্রিয়া। যা হযরতের আলোকময় প্রদীপ থেকে পৌঁছেছে। অতিরিক্ত আরজ করা বেয়াদবী ও ধৃষ্টতা।
হে আল্লাহ! আমাকে মাফ করুন। হযরতের হুকুমে লিখতে হয়েছে। [নতুবা নিজের কামালাত, ইবাদত ও ইলমী যোগ্যতার কথা কখনোই প্রকাশ করতাম না কারো সামনে]। মিথ্যুক আমি! কিছুই নই! [তোমার ক্ষমতা দান ছাড়া আমার কোন অস্তিত্বই নেই] সব তোমারই ছায়া [তোমার দয়া ও ক্ষমতায়ই সব হয়েছে]।] তোমারই অস্তিত্ব [তোমার অস্তিত্বই মূল অস্তিত্ব আর বাকি সব কিছু তোমার অস্তিত্বের সামনে অস্তিত্বহীন]। আমি কি? কিছুই নই। আমার যা কিছু আছে সব তোমারই। [ফাযায়েলে আমল বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে “আমি যাহা রহিয়াছি উহাও তুমি] আমি এবং তুমি স্বয়ং শিরকের ভিতরে শিরক। আস্তাগফিরুল্লাহ। আস্তাগফিরুল্লাহ। আস্তাগফিরুল্লাহ। লা হাওলা ওয়ালা কুওওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ। {ফাজায়েলে আমল উর্দু-২/৪৩১}
রশীদ আহমদ গঙ্গুহী রহঃ এর চিঠি থেকে আমরা কী জানতে পারলাম?
১
মুরব্বীর আদেশে গঙ্গুহী রহঃ নিজের আমলী ও ইলমী হালত বর্ণনা করছেন।
২
– তাঁর কাছ থেকে দুই শতের অধিক ছাত্র হাদীস শিখে মুহাদ্দিস হয়ে চলে গেছে। বিভিন্ন স্থানে সুন্নত জিন্দা করা ও ইলমী খিদমাতে রত আছে।
৩
– তার মনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বড়ত্ব ও ক্ষমতা এত দৃঢ়তার সাথে বসে গেছে যে, অন্য কেউ তার ক্ষতি করতে পারে এটা তিনি কখনোই ভাবেন না। কারণ আল্লাহ ছাড়া উপকার অপকার করার সামান্যতম ক্ষমতা কারো নেই। এটা তার মনের দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা।
৪–
মন এতটাই পরিশুদ্ধ হয়ে গেছে যে, শরীয়তের বিধান পালন করা এটা স্বাভাবিক স্বভাবজাত আচরণ হয়ে গেছে। স্বভাববিরুদ্ধ কোন কঠিন কিছু মনে হয় না। তাই সর্বদা ইবাদত করতে কোন কষ্ট মনে হয় না। আর গোনাহের প্রতি স্বভাবজাত ঘৃণা জন্মে গেছে। তাই গোনাহের প্রতি কোন আগ্রহই মনে জাগে না।
৫-
তার এসব যোগ্যতা মুর্শীদ হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহঃ এর সোহবতে থেকে শরীয়তের পরিপূর্ণ প্রশিক্ষণের দ্বারা মনের মাঝে দৃঢ় হয়েছে।
৬–
এতসব বৈশিষ্ট ও যোগ্যতা তিনি যে অর্জন করেছেন, তার কোনটিই তিনি তার নিজের যোগ্যতা বলে অর্জন করেননি। বরং সব কিছুই আল্লাহ তাআলার ফজল ও করমে হয়েছে। নিজে নিজে কোন কিছু করার ক্ষমতা তার [গঙ্গুহী রহঃ] নেই। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তৌফিক দিয়েছেন বলেই তিনি এত সব আমল করতে পারছেন। মনের এ সুন্দর ও প্রশংসনীয় হালাত তৈরী হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তৌফিক না দিলে সামান্যতম প্রশংসনীয় কাজ করার ক্ষমতা তার ছিল না। তাই তিনি কিছুই নয়। সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকেই। সবই আল্লাহর দয়া। আল্লাহর রহমত। তার নিজের কোন ক্ষমতা, নিজের কোন যোগ্যতা, নিজের কোন কামালাত নেই। যা কিছু আছে সবই আল্লাহর দয়া। আল্লাহর করূনা। আল্লাহ তাআলার তৌফিকের কারণে সম্ভব হয়েছে। তাই তিনি যেন আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের সামনে অস্তিত্বহীন। যেমন কেরোসীনের প্রদীপ দেদীপ্যমান সূর্যের সামনে অস্তিত্বহীন। গাড়ীর কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। যদি না ড্রাইভার সে গাড়ি সুন্দর করে পরিচালিত করে। তেমনি তার কোন গুণ নেই। যোগ্যতা নেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের তৌফিক ছাড়া। তাই সব কিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দয়া ও করুনা। তিনি কিছুই নয়।
যদি তিনি নিজেকে আলাদা যোগ্যতাবান মনে করে বলেন যে, “আমি এবং তুমি” তথা আমি গঙ্গুহী স্বয়ংসম্পন্ন ক্ষমতাবান। আর আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা আলাদা। তথা আমার ক্ষমতা আল্লাহ প্রদত্ব নয়। আলাদা ক্ষমতা আমার আছে। এমন জঘন্য ধারণা যদি তার মনে আসে, তাহলে বুঝতে হবে সেটা হবে “শিরকের ভিতরে শিরক”। কারণ তখন আল্লাহর ক্ষমতাকে অস্বিকার করে নিজেকে ক্ষমতাবান ও যোগ্যতাবান মনে করা হবে। তাহলে এটি মারাত্মক শিরক হবে।
আস্তাগফিরুল্লাহ। হে আল্লাহ ক্ষমা চাই এমন জঘন্য মানসিকতা থেকে। কখনো যেন মনে এমন ধারণা না হয় যে, তোমার দয়া ও করুনা ছাড়া আমি আলাদা ক্ষমতাবান।
এরকম শিরকী ধারণা থেকে আস্তাগফিরুল্লাহ। আস্তাগফিরুল্লাহ। আস্তাগফিরুল্লাহ। লা হাওলা ওয়ালা কুওওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ।
প্রিয় পাঠক! নিরপেক্ষ থেকে বলুনতো। উপরে যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে সেটাই কি হযরত গঙ্গুহী রহঃ এর বক্তব্য নয়?
যে ব্যক্তি বলে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রণীত বিধান শরীয়ত পালন করা আমার স্বভাবজাত অভ্যাস হয়ে গেছে। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ক্রোধের কারণ গোনাহ এর প্রতি স্বভাবজাত ঘৃণা তৈরী হয়ে গেছে উক্ত ব্যক্তি নিজেকে খোদা দাবি করছেন? এমন উদ্ভট কথা কোন বদ্ধ উন্মাদ ছাড়া কেউ বলতে পারে?
যিনি স্পষ্ট ভাষায় বলছেন যে, আমার কোন যোগ্যতা নেই। কোন ক্ষমতা নেই। আমি কিছুই নই। সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে। তিনিই সব করেন। আমি যদি যদি নিজেকে আমি বলে আলাদা ক্ষমতাবান মনে করি। নিজেকে আল্লাহর রহমত ছাড়া ও তৌফিক ছাড়া ক্ষমতাবান মনে করি তাহলে এটি শিরকের ভিতরে শিরক হবে। এমন জঘন্য শিরক থেকে আস্তাগফিরুল্লাহ। আস্তাগফিরুল্লাহ। আস্তাগফিরুল্লাহ। লা হাওলা ওয়ালা কুওওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ।
আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি মন উজার করা এমন আবেগ আর ব্যকুলতা ও দৃঢ় বিশ্বাসের নাম যদি শিরক হয়, নিজেকে খোদা দাবি করা হয়, তাহলে তাওহীদ ও একত্ববাদ মানা কাকে বলে?
আল্লাহ তাআলা মিথ্যুকদের প্রোপাগান্ডা থেকে মুসলিম জাতিকে হিফাযত করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
mashaalllah, kub sundar kore bijano hoyse, Allah sobaike buj dan korun. Amin.