প্রচ্ছদ / প্রবন্ধ নিবন্ধ / “ফতোয়া” অপপ্রচারের শিকার এক মজলুম ইসলামী শব্দ

“ফতোয়া” অপপ্রচারের শিকার এক মজলুম ইসলামী শব্দ

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

ফতোয়া কী?‎

ফতোয়া হল একটি আরবী শব্দ। যা কুরআন সুন্নাহ তথা ইসলামী শরীয়তের একটি মর্যাদাপূর্ণ পরিভাষা। ‎দ্বীন-ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসার পর একজন দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে প্রাজ্ঞ মুফতী কুরআন-হাদীস ও ইসলামী আইন ‎শাস্ত্র অনুযায়ী যেই সমাধান দেন তাই “ফতোয়া”। ইসলামী বিধান বর্ণনাকারীকে বলে “মুফতী” আর যে ‎সকল প্রতিষ্ঠান এই দায়িত্ব পালন করেন তাকে বলে “দারুল ইফতা”।

ফতোয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

ফতোয়ার উল্লেখিত সংজ্ঞা দ্বারা সহজেই অনুমেয় মুসলমানদের জন্য ফতোয়া কী পরিমাণ আবশ্যকীয় বিষয়। ‎আমরা যেহেতো বিশ্বাস করি আমরা দুনিয়াতে থাকার জন্য কেউ আসিনি। আখেরাতে আমাদের ফিরে যেতে ‎হবে। মহান আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। দুনিয়ার আমাল তথা কাজকর্মের হিসেব দিতে হবে। তাই ‎দুনিয়াতে যথা সম্ভব মহান আল্লাহর বিধানের উপর আমল করতে হবে। আর আমরা জানি! কোন বিষয় করার ‎জন্য সে ব্যাপারে সম্যক অবগতি থাকা আবশ্যক। সুতরাং একজন মুসলমান যদি ইসলামী রীতি মানতে চায়, ‎তবে তারও সে ব্যাপারে না জেনে আমল করা সম্ভব নয়, তাই বাধ্য হয়ে তিনি তা জানতে চাইবেন এ ব্যাপারে ‎একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির কাছে, এটাইতো স্বাভাবিক। তারপর এ বিষয়ে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি যেই সমাধান জানাবেন ‎ইসলামী পরিভাষায় তাই হল “ফতোয়া”।
আমরা কি বলব? কেউ এভাবে ইসলামী সমাধান জানতে চাইলে তাকে সমাধান জানানো যাবেনা?! যদি ‎তা’ই হয় তবে সাধারণ মুসলমানরা ধর্মের উপর আমল করবে কীভাবে? সকল মানুষেরা কী নিজে নিজে ‎ধর্মীয় প্রাজ্ঞ হয়ে নিজের সমাধান নিজেই দেয়া সম্ভব? সাধারণ মুসলমানদের ফতোয়া ছাড়া মুসলমান হিসেবে ‎টিকে থাকা কি সম্ভব?

ফতোয়া দেয়া আমাদের সাংবিধানিক অধিকার

আমরা মুসলমান। মুসলমান হিসেবে ইসলামী বিধান যথা সম্ভব পালন করব এটা আমাদের সাংবিধানিক ‎অধিকার, যা সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় স্বীকৃত। এখানে আমরা একটি ধারা উল্লেখ করছি-‎
৪১(১) আইন, জনশৃংখলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্মাবলম্বন, পালন বা ‎প্রচারের অধিকার রহিয়াছে।
‎(খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার ‎রহিয়াছে,(গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান)‎
আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন হল-কোন ধর্ম প্রচার কী সম্ভব তার বিধান বর্ণনা করা ছাড়া? বিধান সম্পর্কে না ‎জেনে তা কী পালন করা যায়?‎
সুতরাং সংবিধান অনুযায়ী সাধারণ মুসলমান একজন প্রাজ্ঞ মুফতীর কাছে ধর্মীয় বিষয়ে সমাধান জানার ‎অধিকার রাখে, আর প্রাজ্ঞ মুফতী তার ধর্মীয় সমাধান জানানের অধিকার রাখে। নতুবা ধর্ম প্রচার সম্ভব নয়।
যেদিন থেকে ইসলাম সেদিন থেকেই ফতোয়া
মহান রাব্বুল আলামীন রাসূল সা: কে যেসব দায়িত্ব দিয়েছেন তার মধ্যে একটি হল ফতোয়া তথা ইসলামী ‎সমাধান জানানো। সুতরাং মুসলমান কী করে ফতোয়া শব্দের অপপ্রয়োগ করে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে?‎

ফতোয়ার পরিধি

মুসলমানদের জীবনে ফতোয়ার পরিধি খুবই ব্যাপক। একজন মুসলমানের পারিবারিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ‎সর্বক্ষেত্রে ফতোয়ার প্রয়োজন। নামায,রোযা, হজ্ব, যাকাত, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিবাহ-তালাক, মিরাছ সর্বত্র ‎ফতোয়াই হচ্ছে মুসলমানদের জন্য সঠিক সমাধান জানার পথ। সুতরাং ইসলামিক জীবনে ফতোয়া হল ‎আবশ্যিক একটি অনুসঙ্গ। এছাড়া একজন মুসলমান খাঁটি মুসলমান হিসেবে টিকে থাকা অসম্ভব।

ফতোয়া কারা দিবে?‎

ফতোয়া দেবার অধিকার কেবল ইসলামী আইন শাস্ত্র নিয়ে যারা পড়াশোনা করে কোন স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে ‎কৃতীত্ব সহকারে সনদ সংগ্রহ করেছেন। তিনি যখন কুরআন-হাদিস ও ইজমা-কিয়াসের ভিত্তিতে ইসলামী ‎আইন শাস্ত্রের রীতি মেনে ফতোয়া দিবেন তখন তার ফতোয়া গ্রহণযোগ্য হবে।

বিচার ব্যবস্থা ও ফতোয়া

ইসলামী শরীয়তে বিচার ব্যবস্থা ও ফতোয়া দু’টি এক জিনিস নয়। আমাদের অজ্ঞতাবশত: দু’টিকে একসাথে ‎গুলিয়ে ফেলার কারণেই আমাদের সমাজে এই ভুল বুঝাবুঝির মুল কারণ। সমাধান জানানো মুফতির কাজ, ‎কিন্তু তা প্রয়োগ করার কোন অধিকার তার নেই। আর ইসলামী সরকার কর্তৃক নিযুক্ত বিচারক তা প্রয়োগ ‎করবেন। সুতরাং আমাদের দেশে সংঘটিত দোর্রা মারা ও পাথর নিক্ষেপ করে কাউকে হত্যা করা কী ‎ফতোয়ার দোষ? আর সত্যিকারর্থে কী সব ঘটনা সত্যিকার মুফতীর ফতোয়ার কারণে হচ্ছে? না গ্রাম্য ‎মোড়লদের সালিসি সিদ্ধান্তের কারণে? একবার শান্ত মাথায় ভাবি।

গ্রাম্য সালিসি সিদ্ধান্ত ও ফতোয়া শব্দের অপপ্রয়োগ

উপরোক্ত আলোচনা মনযোগ সহকারে পড়লে আমরা নিশ্চয় বুঝে যাব আমাদের দেশে কী পরিমাণ বিভ্রান্তি ‎ছড়ানো হচ্ছে ফতোয়ার মত পবিত্র শব্দ নিয়ে। কী কৌশলে ইসলামের এই পবিত্র শব্দকে কলুষিত করা হচ্ছে ‎গ্রাম্য মোড়লদের সালিসি দরবারী সিদ্ধান্তকে ফতোয়া বলে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার দিকে আমরা দৃষ্টি ‎বুলালে বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে-‎

কেস ষ্টাডি-১

নওগাঁ জেলার বিনহালী গ্রামে গৃহবধু লাভলীর মাথা ন্যাড়া করার ঘৃণ্য ঘটনায় জড়িত ‎অপরাধীরা সবাই গ্রাম্য মাতাব্বর। যাদের নাম যথাক্রমে-১. সাদেক হোসেন বাবু। ২. মাতাব্বর উজ্জল। ৩. ‎মোজাফ্ফর ৪. শফিকুল।

কেস ষ্টাডি-২

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের বড়কাপন গ্রামে ফতোয়ার ঘটনা নিয়ে ‎স্থানীয় চার ব্যক্তিকে তলব করেছেন হাইকোর্ট। ২৪ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় বড়কাপন জামে মসজিদের সেক্রেটারি ‎মৌলবি ফয়জুল, আজাদ মিয়া, নানু মিয়া ও আছকর মিয়াকে আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে। ‎মৌলভীবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) ওই দিন তাঁদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে নির্দেশ ‎দেওয়া হয়েছে।

কেস ষ্টাডি-৩

 রাজশাহী জেলার তনোরের কচুয়া গ্রামে সুফিয়া নামে গৃহবধুকে গ্রাম্য সালিসের ভিত্তিতে ‎দোর্রা মারলে সে অসুস্থ্য হয়ে মারা যায়। উক্ত ঘটনায় জড়িত হিসেবে প্রাথমিকভাবে প্রধান আসামী হিসেবে ‎গ্রেফতার করা হয়-১. কচুয়া মসজিদের মুয়াজ্জিন সাজ্জাদ আলী ও দোর্রা মারার সাথে জড়িত মেহেরজানকে।

কেস ষ্টাডি-৪

মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার পাহাড় টিলা বেষ্টিত ছোট একটি ‎গ্রাম ছাতকছড়া। সেই গ্রামের আশ্রব উল্লার যুবতী কন্যা নুরজাহান ছিলো ভাই বোনদের মধ্যে চতুর্থ। ‎নুরজাহান বেগমকে প্রথমে বিয়ে হয় শেরপুর এলাকার আব্দুল মতিনের সঙ্গে। বিয়ের পর দীর্ঘ দিন স্বামীর ‎কোন খোঁজ খবর না থাকায় পিতা আশ্রব উল্লা মেয়ে নুরজাহানকে নিয়ে আসেন ছাতকছড়া গ্রামের নিজ ‎বাড়ীতে। পিতার বাড়ীতে নুরজাহান আসার পর স্থানীয় মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল মান্নান গৃহবধু ‎সুন্দরী নুরজাহানের প্রতি কু-নজর পড়ে এবং তাকে বিয়ে করার জন্য নুরজাহানের পিতার কাছে বিয়ের ‎প্রস্তাব পাঠায়। নুরজাহানের পিতা আশ্রব উল্যা মাওলানার প্রস্তাবে রাজী না হয়ে একই গ্রামের মোতালিব ‎হোসেন মতলিব মিয়ার সঙ্গে নুরজাহানের দ্বিতীয় বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ে করতে না পেরে মাওলানা আং ‎মান্নান প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে এবং নানা ছলচাতুরী শুরু করে। বিয়ের ৪৫দিন পর মাওলানা ‎আ: মান্নান নুরজাহান ও আব্দুল মতলিবের ২য় বিয়েকে অবৈধ বলে ফতোয়া জারী করে এবং গ্রাম্য সালিশের ‎ডাক দেয়। মাওলানা মান্নানের কথামত ১৯৯৩ সালের ১০ জানুয়ারী সকালে একই গ্রামের নিয়ামত উল্লার ‎বাড়ীতে গ্রাম্য সালিসি বিচার বসে। সালিশী বিচারে গ্রামের মনি সর্দার, দ্বীন মোহাম্মদ, নিয়ামত উল্লা ও ‎মাওলানা মান্নান প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ নুরজাহান ও মতলিবের পরিবারকে দোষী সাব্যস্ত করে। সেই বিচারে গৃহবধু ‎নুরজাহানকে মাটিতে পুঁতে ১০১ টা পাথর নিক্ষেপ করার রায় ঘোষণা দেয়া হয়। সালিশী রায় কার্যকর করার ‎পর উপস্থিত গ্রাম্য সর্দার মনির মিয়া নুরজাহানের উদেশ্যে বলতে থাকে এত কিছুর পর তোর বেঁচে থাকা ‎উচিত নয়। তোর বিষ পানে মরে যাওয়া উচিত। গ্রাম্য এ সর্দারের কটু উক্তি সহ্য করতে না পেরে দুঃখে ‎গৃহবধু নুরজাহান সেই দিনই বিষ পানে আত্মহনন করে। ‎

বিজ্ঞ পাঠকের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ আপনারা ভাল করে তাকিয়ে দেখুনতো উল্লেখিত কোন ‎ঘটনার সাথে ইসলামী শরীয়তের ফতোয়ার বিষয়টি জড়িত? এই সকল ঘটনায় জড়িত কোন ব্যক্তিটি প্রাজ্ঞ ‎মুফতী? এগুলোর কোনটিই কোন প্রাজ্ঞ মুফতীর দ্বারা সংঘটিত নয়। সুতরাং প্রথমত এগুলো ফতোয়া হবার ‎প্রশ্নই আসেনা। আর ফতোয়া হলেও প্রয়োগের অধিকার ইসলামী শরীয়ততো তাকে দেয়নি, যেমন বিচার ‎ব্যাবস্থা ও ফতোয়ার মাঝে পার্থক্য শিরোণামে ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সব ক’টি গ্রাম্য “সালিস” ‎দরবারী লোকদের খেয়ালীপনা। এগুলোর ক্ষেত্রে ইসলামের একটি পবিত্রতম শব্দ “ফতোয়া” এই শব্দের ‎অপপ্রয়োগ করছেন কেন? সাংবাদিকদের ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা দেখে মুসলমান হিসেবে লজ্জায় মাথা হেট ‎হয়ে আসে। হায়রে! কোথায় সালিসি জুলুম! আর কোথায় পবিত্র ফতোয়া!! ‎

উপসংহার

‎“ফতোয়া মানে কী?” এটা না জেনেই ইসলামের শত্রুদের শিখিয়ে দেয়া বুলি অজ্ঞের মত সালিসি সিদ্ধান্তকে ‎ফাতোয়া বলে অপপ্রয়োগ না করতে সকল মুসলমানদের প্রতি আমার আকুল আবেদন থাকবে। এই পবিত্র ‎শব্দের অপপ্রয়োগ করে গোনাহগার হওয়া থেকে আল্লাহ আমাদের হিফাযত করুন।

0Shares

আরও জানুন

রব্বে কারীম যাদের নিয়ে গর্ব করেন!

মাওলানা মুহাম্মদ ইমরান হুসাইন বড় কেউ যদি কাউকে স্মরণ করে, সে গর্বিত হয় এবং নিজেকে ধন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *