প্রশ্ন
আসসালামু আলাইকুম।
হুযুর আমি ঢাকা শ্যামলি থাকি। আমি ওষুধ কোম্পানিতে মার্কেটিং চাকরি করি।
রমজান মাসে আমার চাকরি চলে যায়,এবং কোম্পানি বেতন নিয়ে ঘুরাতে থাকে। সেই বেতন এখনো পাইনি। ঈদের মাস টাকা নাই হাতে। ঈদে কারো জন্য কিছু কিনতে পারিনি।এমনকি বাসা ভাড়া দিতে পারতেছিলাম না। বাড়ি ওয়ালার কাছ থেকে পালিয়ে বেরাতে হত। খাওয়ার মত টাকা ছিল না। সেই অবস্থায় আমার স্ত্রী আর একমাত্র ছেলেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেই। হাতে কোন টাকাই ছিল না। আমি চাকরি খুঁজতাছি এর ভিতরে অই মাস চাকরি পেলাম না।আমি নিজে খাওয়ার মত টাকা ছিল না। এর কাছ ওর কাছ থেকে ৫০ টাকা ১০০ টাকা ধার নিয়ে কোনো রকম চলছিলাম আর চাকরি খুঁজতে ছিলাম। আর হতাশায় ভুগতে ছিলাম।
এক মাস পরে একটা চাকরি পেলাম। হুযুর ওষুধ কোম্পানিতে মার্কেটিং চাকরি তে একজন গ্রান্টার দিতে হয়, আমি সব কাগজপত্র যোগার করে আমার শ্বশুরকে ফোন দেই তাকে গ্রান্টার হওয়ার জন্য।
আগের কোম্পানিতেও তিনি গ্রান্টার ছিল। কিন্তু তিনি এইবার গ্রান্টার হতে রাজি হলনা।
অনেক চেস্টা করলাম তাকে রাযি করানোর জন্য। বললাম আপনি এর আগেও গ্রান্টার হইছেন কোনা সমস্যা হয়নি। এখন আপনি এই সময় গ্রান্টার না হলে আমার চাকরি টা আর হবে না। তাছাড়া আমার সেই রকমের কাছের কোনা আত্মীয়ও ঢাকা থাকে না। কাল আমার জয়েন্ট, না কইরেন না। আর কাছের আত্মীয় ছাড়া যে কাউকে গ্রান্টার দেওয়া যায় না। এটা কোম্পানি গ্রহণ করে না।
অনেক বুঝানোর পরেও সে রাজি হল না।
আমি হতাশ হয়ে গেলাম। আমি এখন কি করবো? হাতে সময় নাই। এই চাকরি না হলে কোথায় টাকা পাবো? কিভাবে ঘর ভাড়া দিবো? কি খাবো? মাথায় কিছু কাজ করতে ছিল না।
সেই মুহুর্তে আমার স্ত্রী আমার কাছে ফোন দেয়। ওর বাবার উপরে রাগ। টাকার সমস্যা। তাছাড়া মা আর আমার ছোট ভাইয়ের বউ বলছিল আমার ফুফাতো ভাই এর সাথে ওর সম্পর্ক হইছে। এই সব মিলিয়ে মাথায় কিছু কাজ করছিল না। ওর বাবার উপরে রাগ। রাগের মাথায় ওরে আমি তালাক এর কথা বইলা ফালাইছি। কয়বার বলছি আমি নিজেও জানিনা। কারণ আমার মাথা ঠিক ছিলনা।
এখানে ওর কোনা প্রকার দোষ ছিল না। আমারো মাথা ঠিক ছিল না। তাছাড়া পরে খবর নিয়া জানছি আমার ফুফাতো ভাই এর সাথে ওর কোন রকম সম্পর্ক হয়নি। ছোট ভাই এর বউ শত্রুতা করে এই কাহিনী বানাইছে। এখন আমি কি করবো হুযুর?
আমার ২ বছর বয়সের একটা ছেলে আছে। আমাদের ওই একটাই বাচ্চা। এখন আমি কি করতে পারি? আমার মনে নাই তালাক কথাটা আমি কয়বার বলছি। আমাকে সমাধান দেন হুযুর।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
আপনি মোটা দাগে দু’টি ভুল করেছেন।
বাবার উপরের রাগ তার মেয়ের উপর ঝেড়েছেন। যা খুবই অন্যায়। একজনের ভুলের শাস্তি আরেকজনকে দেয়া শুধু ভুলই মারাত্মক জুলুমও বটে।
দ্বিতীয়ত অভিযোগ শুনে যাচাই ছাড়াই তালাকের মত আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যা আরেকটি মারাত্মক ভুল। অভিযোগ শুনেই যাচাই ছাড়া এ্যাকশনে চলে অবিবেচকের নিদর্শন। ভবিষ্যতে এমন বোকামী করা থেকে বিরত থাকুন।
রইল আপনার তালাকের বিষয়টি। তালাক কয়টি দিয়েছেন? এ বিষয়ে সুষ্পষ্ট আপনার মনে না হলে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করুন তাকে কয়টি তালাক দিয়েছেন, তাহলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবার কথা।
যদি তার মাধ্যমেও বিষয়টি পরিস্কার জানা না যায়। তাহলে প্রবল ধারণা যা হবে সেটি পতিত হয়েছে বলে ধর্তব্য হবে। যদি কোনটিই প্রবল ধারণা না হয়, তাহলে সর্বনিম্ন তালাক পতিত হয়েছে বলে ধর্তব্য হবে।
যেমন দুই দিয়েছেন না তিনন? সন্দেহ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে দুই তালাক বলে গণ্য হবে।
আর যদি এক বা দুইয়ের মাঝে সন্দেহ হয়,তাহলে এক তালাক বলে গণ্য হবে। আর যদি কোনটিই মনে না হয়, সেই সাথে প্রবল ধারণাও মনে না আসে, তাহলে এক তালাক বলে গণ্য হবে।
উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে আপনার স্ত্রীর উপর কয়টি তালাক পতিত হয়েছে তা ঠিক করে নিন।
এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যদি তিন তালাক পতিত হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে উক্ত স্ত্রীর সাথে আপনার আর ঘর সংসার করার কোন সুযোগ নেই।
আর যদি এক বা দুই তালাক পতিত হয়ে থাকে, তাহলে স্ত্রীর সাথে থাকতে পারবেন। বাকি এক হলে আর দু’টি আর দুই হলে আর একটি তালাকের মালিক আপনি বাকি থাকবেন। তাই সাবধান থাকতে হবে।
ولو شك أطلق واحدة أو أكثر بنى على الأقل، وفى الشامية: بنى على الأقل أى كما ذكره الاسبجابى، الا أن يستيقن بالأكثر أو يكون أكبر ظنه، (الدر المختار مع رد المحتار، كتاب الطلاق، باب الصريح-3/283، سعيد)
شك الوزج لا يخلو اما أن وقع فى أصل التطليق أطلقها أم لا؟……وان وقع فى القدر يحكم بالأقل لأنه متيقن به وفى الزيادة شك، (بدائع الصنائع، كتاب الطلاق، فصل فى الرسالة فى الطلاق-3/126، سعيد)
لَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِن بَعْدُ حَتَّىٰ تَنكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ ۗ فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَن يَتَرَاجَعَا إِن ظَنَّا أَن يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ ۗ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ [٢:٢٣٠]
তারপর যদি সে স্ত্রীকে (তৃতীয়বার) তালাক দেয়া হয়, তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর কোন স্বামীর সাথে বিয়ে করে না নেবে, তার জন্য হালাল নয়। অতঃপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরস্পরকে পুনরায় বিয়ে করাতে কোন পাপ নেই। যদি আল্লাহর হুকুম বজায় রাখার ইচ্ছা থাকে। আর এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা; যারা উপলব্ধি করে তাদের জন্য এসব বর্ণনা করা হয়। {সূরা বাকারা-২৩০}
وقال الليث عن نافع كان ابن عمر إذا سئل عمن طلق ثلاثا قال لو طلقت مرة أو مرتين فأن النبي صلى الله عليه و سلم أمرني بهذا فإن طلقتها ثلاثا حرمت حتى تنكح زوجا غيرك
হযরত নাফে রহ. বলেন,যখন হযরত ইবনে উমর রাঃ এর কাছে ‘এক সাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাক পতিত হওয়া না হওয়া’ (রুজু‘করা যাবে কিনা) বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলো,তখন তিনি বলেন-“যদি তুমি এক বা দুই তালাক দিয়ে থাকো তাহলে ‘রুজু’ [তথা স্ত্রীকে বিবাহ করা ছাড়াই ফিরিয়ে আনা] করতে পার। কারণ,রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এরকম অবস্থায় ‘রুজু’ করার আদেশ দিয়েছিলেন। যদি তিন তালাক দিয়ে দাও তাহলে স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে, সে তোমাকে ছাড়া অন্য স্বামী গ্রহণ করা পর্যন্ত। {সহীহ বুখারী-২/৭৯২, ২/৮০৩}
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা-জামিয়া ফারুকিয়া দক্ষিণ বনশ্রী ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]