প্রচ্ছদ / প্রবন্ধ নিবন্ধ / শারদীয় দুর্গাপূজার ইতিবৃত্তঃ কোন দেশপ্রেমিক এ পূজায় অংশ নিতে পারে না!

শারদীয় দুর্গাপূজার ইতিবৃত্তঃ কোন দেশপ্রেমিক এ পূজায় অংশ নিতে পারে না!

009

লেখকঅনিমেষ রায়

ভুমিকা

বেদ, রামায়ন সহ দাদাদের মূল ধর্মীয় বইয়ে দূর্গাপূজার অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায়না। কিছু ধনাঢ্য হিন্দু ব্যক্তির প্রতিপত্তি প্রদর্শনের ফলস্বরুপ দূর্গাপূজা ভুমিষ্ট হয়।

দুর্গাপূজা বেদসম্মত নয়। বৈদিক পূজার ছাপ দেয়ার জন্য বেদের দেবী সূক্তটির ব্যবহার করা হয় কিন্তু বেদের দেবীসূক্তে যে হৈমবতী উমার উল্লেখ আছে তার সঙ্গে দুর্গার কোনো সম্পর্ক নেই।

অনুপ্রবেশ

বাল্মীকির রামায়ন যে সময়কার রচনা মার্কণ্ডেয় পুরাণ সে সময় জন্মায়নি, কথিত দেবী দুর্গার আখ্যায়িকাও তখনও আসেনি।
মূল বাল্মীকির রামায়ণে দূর্গা পূজার কোন অস্থিত্ব নাই। মোগল যুগের কবি তুলসীদাসের ”রামচিতমানস”।সেখানেও রাম কর্ত্তৃক দুর্গা পূজার কোন উল্লেখ নেই। মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি কৃত্তিবাস ওঝা সংস্কৃত রামায়ণ বাংলা করার সময় মূল রামায়ণের বাইরের তৎলালীন সমাজে প্রচলিত অনেক গল্প বাংলা রামায়ণে ইচ্ছাকৃত ভাবে ঢুকিয়েছেন। তাঁর এই অনুবাদকৃত রামায়ণ পরিচিত পায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে। সেখানে তিনি কালিকা পুরাণের ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের দূর্গা পূজা করার কথা উল্লেখ করেছেন।
( তথ্যসূত্রঃ রামায়ণ কৃত্তিবাস বিরচিত, ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখিত ভূমিকা সম্বলিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৫৭ সংস্করণ)”

……………………..……………….

মার্কণ্ডেয় পুরাণ যুগের ভিত্তিতে ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ লিখিত হয়েছে। পৌরাণিক শাক্তাচারের শক্তির আদিমতম অবস্থাকে সংস্কৃতিতে বলা হয় আদ্যাশক্তি। এই আদ্যাশক্তির চণ্ডরূপই চণ্ড শক্তি বা চণ্ডী। তেরশ বছর আগের মার্কণ্ডেয় পুরাণ যার সংক্ষিপ্ত নাম চণ্ডী যাতে দুর্গার কথা রয়েছে, সুরথ রাজার গল্প রয়েছে, তাতেও রামের কথা লেখা নেই, আর রাম যে দুর্গার পূজা করেছিলো সে গল্পও নেই।

……………………..……………….

মোঘল যুগের কবি তুলসী দাসের ‘রামচিতমানস্থ। সেখানেও রাম কর্তৃক দুর্গাপূজার কোন উল্লেখ নেই। তাহলে দুর্গাপূজার প্রচলন হলো কিভাবে?
সুপ্রাচীনকালে বাংলায়, আজ আমরা মন্ডপে- মন্ডপে যেভাবে দুর্গা পূজা দেখছি ঠিক সেভাবে দুর্গা পূজার প্রচলন ছিল না-এই হল পন্ডিতদের অভিমত।
[ ড. আর. এম দেবনাথ; সিন্ধু থেকে হিন্দু ; পৃষ্ঠা, ৮২]

……………………..……………….

তাহলে কিভাবে শুরু হল?

পাঠান যুগের গোড়ার দিকে বরেন্দ্রভূমিতে- মানে, উত্তর বাংলার রাজশাহী জেলার তাহেরপুরে কংস নারায়ণ রায় নামে একজন রাজা ছিলো। গৌড় রাজ্যের শাসকদের জায়গীরদার তাহের খাঁর নামানুসারে ‘তাহেরপুর’ নামকরণ হয়েছিলো।
এর পূর্ব নাম ছিলো সাপরুল। তাহের খাঁকে পরাজিত করে কংস নারায়ণ তাহেরপুর দখল করে এবং লুটপাট চালিয়ে অকল্পনীয় ধন-সম্পদ হস্তগত করে। অতঃপর নিজের শক্তি ও মহিমা সর্বজনে প্রকাশ করতে অশ্বমেধ যজ্ঞ করার সংকল্প করে।
সে তার সময়ের পণ্ডিতদের ডেকে বললো, ‘আমি রাজসূয় কিংবা অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চাই। মানুষে জানুক আমার ধন ঐশ্বর্য কি রকম আছে, আর দু’হাতে ফেলে ছড়িয়ে দান করবো।’
শুনে পণ্ডিতেরা বলেছিলো, ‘এই কলিযুগে রাজসূয় বা অশ্বমেধ যজ্ঞ হয় না, তাই মার্কণ্ডেয় পুরাণে যে দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসবের কথা আছে, তাতেও খুব খরচ করা যায়, জাঁকজমক দেখানো যায়, নিজের ঐশ্বর্য দেখানো যায়। আপনি মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে এই দুর্গোৎসব করুন।’ তখন রাজা কংস নারায়ণ রায় তৎকালীন সাতলক্ষ স্বর্ণমুদ্রা (বর্তমান বাজার মূল্যে ছয়শ’ কোটি টাকা প্রায়) ব্যয় করে প্রথম দুর্গাপূজা করে।
তার দেখাদেখি একটাকিয়ার (একটাকিয়া সম্ভবত রংপুর জেলায়) রাজা জগৎবল্লভ সাড়ে আটলক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে আরো জাঁকজমক করে দুর্গাপূজা করলো। তাদের দেখাদখি অন্যান্য জমিদাররা ভাবলো, ‘আমরাইবা কম কিসে, আমরাও টাকার খেলা দেখাতে পারি।’
তারাও জাঁকজমক করে দুর্গাপূজা শুরু করলো। প্রতি হিন্দু জমিদার বাড়িতে শুরু হয়ে গেলো দুর্গাপূজা।

……………………..……………….

সেই সময়ের হুগলী জেলার বলাগড় থানার গুপ্তিপাড়ার (জায়গাটার আসল নাম গুপ্তবৃন্দাবন) বারোজন বন্ধু ভাবলো যে আমরা এককভাবে পারবো না, কিন্তু বারোজন মিলে তো পূজার আয়োজন করতে পারি। উর্দুভাষায় বন্ধুকে ইয়ার বলে, তাই বারোজন ইয়ারে মিলে যে দুর্গাপূজা করলো সেটা হলো বারো ইয়ারী পূজা বা বারোয়ারী পূজা।
আর এই বারোয়ারী পূজায় যেহেতু অন্ত্যজ লোকদের অঞ্জলি দেবার অধিকার থাকে না, তাই সবার অধিকার যাতে থাকে সেজন্য আধুনিককালে বারোয়ারী পূজা বিবর্তিত হয়ে তাদের ভাষায় হলো সার্বজনীন পূজা।

……………………..……………….

ঘটা করে দূর্গা পূজার ইতিহাস খুব বেশি দিন আগের কথা নয়।

পলাশী যুদ্ধের পর বিশ্বাসঘাতক নবকৃষ্ণ চেয়েছিলো ক্লাইভকে সংবর্ধনা দিতে। কিন্তু সে সময় কলকাতায় বড় কোন গির্জা ছিলো না। তাই নবকৃষ্ণ এক ফন্দি আটলো। সে বাড়িতে ৪দিন দিন ব্যাপী এক পার্টি দিতে চাইলো, যা সেকলের কাছে পরিচিত ছিল কোম্পানীর পূজো হিসেবে।
যা আজও শোভাবাজার রাজবাড়ির পূজো বলে টিকে আছে। কালক্রমে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠান পরিণত হয় শারদীয় দূর্গা পূজা রূপে।
তাই দেশপ্রেমিকরা এই পুজোকে ‘বেইমানের পুজো’ বলে আখ্যা দিতো৷ বঙ্কিমচন্দ্রও জানত যে লর্ড ক্লাইভের আমলেই দুর্গার সৃষ্টি। সে এও জানত যে ওটা ইংরেজদেরই কারসাজি। “বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্রুপ করিয়া লিখিয়াছিল যে, পরে দুর্গাপূজার মন্ত্রও ইংরাজিতে পঠিত হইবে।”
[তথ্যসূত্র : এ এক অন্য ইতিহাস- গোলাম আহমদ মোর্তজা, বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৩২-৩৪]

তাই এখনো কলকাতা শহরের পুরনো ধনী পরিবারগুলির দুর্গাপূজা “বনেদি বাড়ির পূজা” নামে পরিচিত।
অন্যদিকে আঞ্চলিক স্তরে এক একটি অঞ্চলের বাসিন্দারা যৌথভাবে যে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন তা বারোয়ারি পূজা বা সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত। (উপরে উল্লেখিত)

তবে আধুনিক সময়ে এর এত প্রচারের কারণ হোলও ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সময় সর্বজনীন পূজা শুরু হয়।
উগ্রহিন্দু নেতা সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতারা বিভিন্ন সর্বজনীন পূজার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন।
এর অন্যতম কারণ ছিল যাতে হিন্দুরা জাতীয়তা রক্ষার অজুহাতে পাকিস্তানের সাথে এক না হয়।

……………………..……………….

ঊনিশ শতক থেকে আস্তে আস্তে কলকাতার পূজার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিলো বাংলাদেশে এবং কলকাতায় অবস্থানরত অনুপস্থিত ভূস্বামী ও ধনাঢ্যরা কলকাতায় আমোদ ফুর্তি তামাসার একটি অংশ আবার শুরু করতে চাইলো বাংলাদেশের নিজ নিজ অঞ্চলে।
এ ছাড়া মধ্যবিত্ত, ধনাঢ্য পেশাজীবীরা যারা প্রধানত থাকতো কলকাতা বা ঢাকায় তারাও আসতো পূজার ছুটিতে গ্রামে। মূল উদ্দেশ্য সবার ছিলো একই, ঐশ্বর্য (আধিপত্য) ও প্রজাদের প্রতি ক্ষমতা প্রদর্শন।

বর্ণহিন্দু ছাড়া তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে যারা ছিলো বিত্তশালী তারাও দুর্গাপূজা উপলক্ষে নিজেদের ‘সম্মান’ বাড়ানোর চেষ্টা করতো। তারা অবিকল অনুকরণের চেষ্টা করতো বর্ণ হিন্দুদের, যা বর্ণহিন্দু বিশেষ করে ব্রাহ্মণেরা মোটেই পছন্দ করতো না। এমনকি নিম্নবর্ণের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত প্রতিমা প্রণামও ছিলো নিষিদ্ধ।

এরপর ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে যে নব্যধনীদের উদ্ভব ঘটে, তারা দুর্গাপূজার নামে অশ্লীলতাকে আরো বিস্তার করে। অশ্লীল কদর্য নৃত্যগীত, মদ্যপান ও বেশ্যাগমনকে তাদের দুর্গাপূজার অপরিহার্য অনুষঙ্গ তারা করে নেয়।

দুর্গাপূজা প্রবল উৎসবে পরিণত হয়েছিলো প্রথমে কলকাতায়। শুধু নিছক উৎসবের জন্য নয়, প্রভু ইংরেজদের মনোরঞ্জন ও যোগাযোগের জন্যও উচ্চবর্গ ও মধ্যবিত্ত ব্যবহার করতো দুর্গাপূজা। এর প্রচুর বিবরণ ছড়িয়ে আছে সমসাময়িক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, নকশা, উপন্যাসে। এখানে একটি পুস্তিকার সামান্য উদ্ধৃতি দেয়া হলো,
‘…মহামায়ার শুভ আগমনে যে কেবল হিন্দুরা আহ্লাদে ফুটিফাটা হলো তা নয়, ইংরেজ ফিরিঙ্গিরাও এ সময়ে আমোদ করতে ছাড়েন না। সম্বতসরের মধ্যে বঙ্গদেশে এই একটি বিশেষ সময়।…

অতীতে ইংরেজদের আকৃষ্ট করতে হিন্দু জমিদাররা যেমন দুর্গাপূজায় অবাধ অশ্লীলতার ব্যবস্থা করতো বর্তমানে মুসলমানদেরকে দুর্গাপূজায় আকৃষ্ট করতে অতীতের চেয়ে বহুগুণ বেশি অশ্লীলতার অবাধ সুযোগ করে দিচ্ছে।

আর মনুষ্যসৃষ্ট কোন উৎসব কখনও ধর্ম হতে পারে না। যেখানে বারবনিতার গন্ধ থাকে, যেখানে গনিকাবাড়ীর মাটি দিয়ে দুর্গামুর্তি তৈরি হয় সেখানে ধর্ম কোথায় থাকে !!!

……………………..……………….

এই হল সংক্ষেপে দুর্গা পুজার ইতিহাস।

সূত্র- http://www.animeshraiarko.com/2016/04/blog-post_55.html

লিখার সুত্রসমুহঃ
১। রামায়ণ কৃত্তিবাস বিরচিত, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ও ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখিত ভূমিকা সম্বলিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৫৭ সংস্করণ
২। ড. আর. এম দেবনাথ; সিন্ধু থেকে হিন্দু
৩। এ এক অন্য ইতিহাস- গোলাম আহমদ মোর্তজা, বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন, কলকাতা
৪। উইকিপিডিয়া
৫। কিছু পুরনো পত্রিকা
৬। আর ১৫ বছরের নিজস্ব গবেষণা

0Shares

আরও জানুন

মুসলমানদের জন্য হিন্দুদের মন্দির পাহারা দেয়া কি জায়েজ?

প্রশ্ন মুসলমানদের জন্য হিন্দুদের মন্দির পাহারা দেয়া, পূজামণ্ডপ পাহারা দেয়া, তাদের মূর্তি বানাতে সহযোগিতা করা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *