প্রচ্ছদ / ইতিহাস ও ঐতিহ্য / মসজিদে গম্বুজ নির্মাণ কি অগ্নিপূজকদের থেকে গৃহিত?

মসজিদে গম্বুজ নির্মাণ কি অগ্নিপূজকদের থেকে গৃহিত?

প্রশ্ন

আমাদের ভার্সিটির এক ম্যাম ক্লাস নেওয়ার সময় একদিন বললেন, গম্বুজ আসলে ইসলামিক কোন নিদর্শন না। এটা প্রথম তৈরি করেছিল পারসিয়ানরা, যারা পূর্বে ছিল অগ্নি পূজক। তাই তারা ঐ অভ্যাস হিসেবে গম্বুজ গুলো অগ্নি শিখার মতো করে তৈরি করেছে (একটি ছবি সঃযোজন করে দেওয়া হলো, যার সাথে গম্বুজের আকিরের মিল পাওয়া যায়)। ইসলামিক প্রধান নিদর্শন হচ্ছে কাবা, যেটি চার কোনা। এটাও একটা প্রমাণ যে, গম্বুজ ইসলামিক কোন নিদর্শন নয়।

  1. এখন আমার প্রশ্ন হল, ওনার বক্তব্য কতটুকু সত্য?
  2. হুজুর (সা:) এর সময় বা ওনার পূর্বে ইসলামিক নিদর্শন হিসেবে গম্বুজের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় কি না?
  3. ইসলামিক নিদর্শন হিসেবে গম্বুজ নির্মাণের ইতিহাস জানতে চাই।

দয়া করে তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়ে বিভ্রান্তি নিরশন করুন।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

 

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে যে ইসলাম পূর্ণতা পেয়েছে তা সর্বশেষ দ্বীন। এর আগে অনেক ধর্ম, মতবাদ ও সভ্যতা ছিল।

আগের ধর্মগুলোর অনেক বিষয় এবং আগের জাতির বেশ কিছু আচরণ ও রীতি ইসলাম পরিপূর্ণ রহিত করেনি। বরং কিছু কিছু বিষয় সংস্কার করে ইসলাম এর অনুমোদন দিয়েছে।

বিয়েশাদী আগে থেকেই ছিল। ইসলাম এর মাঝে কতিপয় বিধিবিধান আরোপ করেছে। রোযা আগে থেকেই ছিল ইসলাম এসে এর কিছু বাইন্ডিং ও সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। দান সদকা আগে থেকেই ছিল, ইসলাম সদকাতুল ফিতির, যাকাত ইত্যাদি নামে এর একটি পরিপূর্ণ নিয়মনীতির আওতাধীন করেছে।

আগের ধর্মগুলোতে সপ্তাহান্তে একদিন বিশেষ ইবাদতের জন্য নির্ধারিত ছিল। ইসলাম এসেও সপ্তাহান্তে একদিন বিশেষ ইবাদতের দিন হিসেবে সাব্যস্ত রেখেছে। তবে দিন ভিন্ন রেখেছে।

ঈদ আগের ধর্মেও ছিল। ইসলাম এসে ঈদের আনুষ্ঠানিকতাকে দুই ঈদ নামে দুই সময়ের শুকরিয়ার দিন সাব্যস্ত করেছে।

এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে যা আগের ধর্মে ছিল। ইসলাম এসে তা নবরূপে, সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে, নতুন সাজে তা সজ্জিত করেছে।

গম্বুজও এমন একটি বিষয়। ইসলাম পূর্ব যুগেই এর প্রচলন ছিল।

গম্বুজ প্রথা প্রথমে ছিল এশিয়ার সংস্কৃতি। তারপর সেটি পারস্য, গ্রীস ও রোমে স্থানান্তরিত হয়।

এই সভ্যতাগুলো যেহেতু আগের সুতরাং ইসলাম এর আগে থেকেই তা ধারণ করার সুযোগ ছিল না।

এরপর ইসলামের মাঝে এর প্রচলন শুরু হয়।

মসজিদে গম্বুজ নির্মাণের সরাসরি কোন নির্দেশনা কুরআন ও হাদীসে বিদ্যমান নেই। আবার নিষেধও নেই। তাই অতিরঞ্জন এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় না হলে ও বিধর্মীদের সাথে সাদৃশ্যায়ন না হলে মসজিদকে স্বতন্ত্র এবং দৃষ্টিনন্দন দেখাতে গম্বুজ নির্মাণ মূলত জায়েজ।

একটি হাদীসে কিছুটা গম্বুজ নির্মাণের বৈধতা বিষয়ে সাদৃশ্যতা পাওয়া যায়। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ قَالَ ‏مَنْ بَنَى مَسْجِدًا لِلَّهِ كَمَفْحَصِ قَطَاةٍ أَوْ أَصْغَرَ بَنَى اللَّهُ لَهُ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ

জাবির বিন আবদুল্লাহ রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যাক্তি আল্লাহ্‌র জন্য টিড্ডির ঢিবির ন্যায় বা তার চাইতেও ক্ষুদ্র একটি মাসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করেন। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৭৩৮]

টিড্ডির ঢিবির মতোই দেখতে হয়ে থাকে গম্বুজ। তাই এখান থেকে গম্বুজ নির্মাণের কিছুটা হলেও বৈধতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

এছাড়া কুরআনে কারীমের আয়াত:

فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَن تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ ﴿النور: ٣٦

আল্লাহ যে ঘরগুলিকে উচ্চমর্যাদা দিতে এবং তাতে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে আদেশ করেছেন, তাতে সকাল ও সন্ধ্যায় তাসবীহ পাঠ করে [সূরা নূর-৩৬]

আয়াতে “উচ্চ করা” এর দ্বারা কোন কোন তাফসীরকারগণ “মসজিদ নির্মাণ এবং উঁচু করার অর্থ নিয়েছেন”। [তাফসীরে কুরতুবী-১২/২৬৬]

আরেক আয়াত:

وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ﴿البقرة: ١٢٧

এবং (সেই সময়ের কথা চিন্তা কর) যখন ইবরাহীম বাইতুল্লাহর ভিত উঁচু করছিল এবং ইসমাঈলও (তার সাথে শরীক ছিল এবং তারা বলছিল) হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পক্ষ হতে (এ সেবা) কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি এবং কেবল আপনিই সব কিছু শোনেন ও সবকিছু জানেন। [সূরা আল বাকারা – ১২৭]

উপরোক্ত দু’টি আয়াতে মসজিদকে উঁচু করতে বলা হয়েছে। আর গম্বুজের মাধ্যমে মসজিদকে উঁচু করা হয়ে থাকে।

সুতরাং উপরোক্ত হাদীস ও আয়াত থেকেও মসজিদ উঁচু দেখাতে গম্বুজ নির্মাণের বৈধতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

ইসলামে প্রথম গম্বুজ নির্মাণ করেন উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান। যিনি ফিলিস্তিনের বাইতুল মাকদিসের ‘কুব্বাতুস সখরা” নির্মাণ করেন। যা ৬৯ থেকে ৭২ হিজরীতে নির্মিত হয়।

এরপর ১৩২/১৩৩ হিজরীতে খলীফা ওলীদ বিন আব্দুল মালিক দামেশকের ‘মসজিদে বনী উমাইয়া’ তে গম্বুজ নির্মাণ করেন। যা ‘কুব্বাতুন নছর’ নামে পরিচিত।

এরপর থেকে বিভিন্ন খলীফাগণ তাদের আমলে মসজিদে গম্বুজ নির্মাণ শুরু করেন। যা মুসলিম বিশ্বে প্রসার লাভ করে।

অতএব গম্বুজ নির্মাণ অগ্নিপূজকদের সিম্বল অনুসরণ করে বানানো বলাটা যথার্থ নয়।

في بيوت أذن الله أن ترفع ويذكر فيها اسمه يسبح له فيها بالغدو والآصال.

الثانية- قوله تعالى أذن الله أن ترفع ” أذن” معناه أمر وقضى. وحقيقة الإذن العلم والتمكين دون حظر، فإن اقترن بذلك أمر وإنقاذ كان أقوى. و” ترفع” قيل: معناه تبنى وتعلى، قاله مجاهد وعكرمة. ومنه قوله تعالى:”وإذ يرفع إبراهيم القواعد من البيت (البقرة: 127) وقال صلى الله عليه وسلم: (من بنى مسجدا من ماله بنى الله له بيتا في الجنة). وفي هذا المعنى أحاديث كثيرة تحض على بنيان المساجد. وقال الحسن البصري وغيره: معنى” ترفع” تعظم، ويرفع شأنها، وتطهر من الأنجاس والأقذار، …… إذا قلنا: إن المراد بنيانها فهل تزين وتنقش؟ اختلف في ذلك، فكرهه قوم وأباحه آخرون. فروى حماد بن سلمة عن أيوب عن أبي قلابة عن أنس، وقتادة عن أنس أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: (لا تقوم الساعة حتى يتباهى الناس في المساجد). أخرجه أبو داود. وفي البخاري- …….احتج من أباح ذلك بأن فيه تعظيم المساجد والله تعالى أمر بتعظيمها في قوله:” في بيوت أذن الله أن ترفع” يعني تعظم. وروي عن عثمان أنه بنى مسجد النبي صلى الله عليه وسلم بالساج وحسنه. قال أبو حنيفة: لا بأس بنقش المساجد بماء الذهب. وروي عن عمر بن عبد العزيز أنه نقش مسجد النبي صلى الله عليه وسلم وبالغ في عمارته وتزيينه، وذلك في زمن ولايته قبل خلافته، ولم ينكر عليه أحد ذلك. وذكر أن الوليد بن عبد الملك أنفق في عمارة مسجد دمشق وفي تزيينه مثل خراج الشأم ثلاث مرات. وروي أن سليمان بن داود عليهما الصلاة و السلام بنى مسجد بيت المقدس وبالغ في تزيينه (الجامع الأحكام القرآن للقرطبى، الشهير تفسير القرطبى، سورة النور، رقم الآية-36، دار الفكر-12/266)

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ইসলামিয়া দারুল হক লালবাগ ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা: জামিয়াতুস সুন্নাহ কামরাঙ্গিরচর, ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা: কাসিমুল উলুম আলইসলামিয়া, সালেহপুর আমীনবাজার ঢাকা।

পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।

শাইখুল হাদীস: জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, সনমানিয়া, কাপাসিয়া, গাজীপুর।

ইমেইল[email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *